—না, বলুন আপনি—
একটু ইতস্তত করে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—আপনার ওপরেই যদিও সব কিছু ছেড়ে দিচ্ছি, তবু আমার নিজস্ব বিশ্বাসের জন্য যদি কিছু ক্রিয়াকলাপ করি তাহলে আপত্তি হবে না তো?
হেসে বললাম—না, আমার কি আপত্তি? করুন আপনার যা ইচ্ছে—
চণ্ডিকাপ্রসাদ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন—কালী, কৌটোটা এনেছিস তো?
—হ্যাঁ, বাবা। এনে দেব?
—নিয়ে আয়।
কালীপ্রসাদ উঠে পাশের ঘর থেকে মা কালীর কৌটো এনে বাবার হাতে দিলেন। সেটা নিয়ে চণ্ডিকাপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—এটার কথা শুনেছেন বোধ হয়?
বললাম—হ্যাঁ, কালীবাবু আসতে আসতে আমাকে বলেছেন।
—তাহলে তো আপনি সবই জানেন। এই কৌটোর ওপর আমাদের সবার মনে একটা গভীর বিশ্বাস আছে আর কি। তবে বিশ্বাসটা অযৌক্তিক নয়, পরীক্ষিত সত্য। গ্রামে বসন্তের মড়ক লেগে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল। এই কৌটাতে হাতে মা কালীর নাম করতে করতে বাড়ির চারদিক ঘুরে গণ্ডি কেটে দিয়েছিলাম। আন্দেক গ্রাম সাফ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আমাদের বাড়িতে অসুখ ঢোকেনি। আজও তাই করবো ভাবছি, কৌটো নিয়ে বাড়ির চারধারে গণ্ডি কেটে দেব। আসবেন আমার সঙ্গে? কালী, তুইও আয়—
বৃদ্ধকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করল না। বললাম-চলুন, যাবো।
বাইরে যাবার জন্য সবে উঠে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ বাড়ির ভেতরে হুড়মুড় করে বিকট শব্দ হল—ধাতব কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ।
চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—ওই শুরু হল আবার! চলুন দেখি।
ভেতরের বারান্দা থেকে আওয়াজ এসেছিল, সেখানে গিয়ে দেখলাম বাড়ির মেয়ে আর বাচ্চারা বারান্দার অপর প্রান্তে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দশ-বারোখানা ইট দিয়ে বেদীমত করে তার ওপরে একটা লোহার ড্রাম দাঁড় করানো ছিল—চাল রাখবার জন্য। সেটা উলটে পড়ে চাল ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখনও ড্রামটা গড়াচ্ছে। আমাদের পায়ের কাছে এসে থেমে গেল।
আমার নাকে ভেসে এল সেই বিশ্রী গন্ধটা, বাইরের বাগানে যেটা পেয়েছিলাম।
চণ্ডিকাপ্রসাদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে বললাম—যা করবার করে ফেলুন, আর রাত করবেন না।
সদর দরজা দিয়ে আমরা বাইরে এলাম। সঙ্গে কালীপ্রসাদ আর লণ্ঠন নিয়ে অভিরাম। চাদ ঢাকা পড়েছে গাছের পাতার আড়ালে। মাটিতে স্নান জ্যোৎস্না আর ছায়ার খেলা। ঝোপেঝাড়ে জোনাকি জুলছে। বাতাস নেই কোনো দিকে, কেমন একটা থমথমে আবহাওয়া। কালীপ্রসাদের হাতে একটা মোটা লাঠি, যদিও বুঝতে পারলাম না অতিপ্রাকৃত কোন বিপদ হলে লাঠি দিয়ে কি করে ঠেকানো সম্ভব।
চণ্ডিকাপ্রসাদের হাতে মা-কালীর কৌটো, মুখে বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে পড়তে চলেছেন। ক্রমে আমরা বাড়ির পেছনদিকে এসে হাজির হলাম। এদিকটায় জঙ্গল খুব বেশি, আসশেওড়া আর কুঁচকাটার ঝোপে ভর্তি। সাবধানে কাপড় বঁচিয়ে চলেছি, আর কয়েক পা হাঁটলেই আমরা একটা বাক ফিরে বাড়ির পুব দিকের সীমানায় পৌঁছব, সেখানে ঝোপঝাড় অপেক্ষাকৃত কম। এমন সময় আমার মনের ভেতর সেই পরিচিত বিপদের ঘণ্টাটা বেজে উঠল—বুঝতে পারলাম এক্ষুনি একটা কিছু ঘটবে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ডানদিকের একটা ঘন ঝোপের মধ্যে খড়খড় করে কি নড়ল, আমরা সবাই থমকে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকালাম। কালীপ্রসাদ দুই হাতে লাঠি বাগিয়ে ধরেছেন। অভিরাম লণ্ঠন মাটিতে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে তার হাত থেকে লাঠিটা নিল।
পরমুহূর্তেই ঝোপের মধ্যে থেকে কালো মত বেশ বড়সড় কুকুরের আকারের কি একটা জীব বেরিয়ে এসে ক্রুদ্ধ গর্জন করে চণ্ডিকাপ্রসাদের দিকে ছুটে গেল। কালীপ্রসাদ ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন। আমি বলে উঠলাম—সামলে!
জন্তুটা চণ্ডিকাপ্রসাদের পায়ে দাঁত বসিয়ে দিতে গেল, অস্ফুট আর্তনাদ করে সরে গেলেন তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অভিরাম সবলে লাঠি দিয়ে আঘাত করল প্রাণীটার মাথায়। শূন্য মাটির হাড়ি ফেটে যাবার মত ফটাস করে শব্দ হল। নিঃশব্দে জন্তুটা কত হয়ে পড়ে গেল একপাশে।
বলতে এত সময় লাগলেও ঘটতে লেগেছিল কয়েক মুহূর্ত মাত্র।
কালীপ্রসাদ লণ্ঠন নিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন—এঃ! এ তো শেয়াল। মরে গেছে।
মরা জ্যোৎস্না আর লণ্ঠনের আলো মিলিয়ে কেমন একটা আলো-আঁধারি মত হয়েছে। তবু ভাল করে তাকিয়ে মনে হল শেয়ালই বটে।
অভিরাম বলল—অদ্ভুত ব্যাপার বাবু! শেয়ালে কখনো তাড়া করে কামড়াতে আসে শুনিনি!
কালীপ্রসাদ বললেন—ঠিক কথা। শেয়াল ভীতু জন্তু, মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। এটা তাড়া করে এল কেন?
চণ্ডিকাপ্রসাদ বোধ হয় নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন—পাগলা শেয়াল হবে। নইলে কি আর—যা হোক চল—অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়।
এদিনের গৃহ প্রদক্ষিণের একটা ফল কিন্তু হাতে হাতে দেখতে পেলাম। সে রাত্তির থেকে বাড়ির ভেতরের উপদ্রব বন্ধ হয়ে গেল। সারারাত সজাগ হয়ে শুয়ে রইলাম, কাশির শব্দ শুনে টের পাচ্ছিলাম চণ্ডিকাপ্রসাদও জেগে। কিন্তু সে রাতে আর কোনো উপদ্রব হল না।
পরের দিন সমস্ত ব্যাপারটা অদ্ভুতভাবে মিটে গেল। যে কথা বলবার জন্য এ গল্পের অবতারণা। আমাকে আর যজ্ঞ করতে হয়নি। এ ঘটনায় আমার ভূমিকা ছিল শুধুই দ্রষ্টার।
মরা শেয়ালটার পা ধরে টেনে অভিরাম দূরে আমবাগানের ওপাশে একটা পতিত জমিতে ফেলে দিয়ে এসেছিল। রাত্তিরেও কোন উপদ্রব হয়নি। সকালে উঠে দেখলাম বেশ প্রসন্ন সূর্যের আলোয় চারদিক ভরে আছে। চণ্ডিকাপ্রসাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করে দিনটা কেটে গেল। ভদ্রলোক সেকেলে মানুষ হলেও হিন্দু শাস্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে বেশ পড়াশুনো করেছেন।