দরজা খোলাই ছিল, ভেতরে ঢুকে দেখি উঠোনের ওপারে বারান্দায় বাড়ির সবাই জড়ো হয়ে শঙ্কিত চোখে তাকিয়ে আছে। আমি ঢুকতেই কালীপ্রসাদ বললেন—এই যে ঠাকুরমশাই। ওঃ, আমরা যা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম–
কালীপ্রসাদের কাধে হাতের ভর রেখে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, আন্দাজে বুঝলাম। তিনিই চণ্ডিকাপ্রসাদ। ফর্সা মানুষ, দীর্ঘদেহী—দেখে বোঝা যায় এককালে খুবই সুপুরুষ ছিলেন। অগোছালো ধরনের ধুতি পরা!
বারান্দায় উঠে লণ্ঠনটা নামিয়ে রাখলাম। চণ্ডিকাপ্রসাদ এগিয়ে এসে বললেনকালী আমাকে এতক্ষণ আপনার কথা বলছিল। আপনি যে কষ্ট করে এসেছেন—
বললাম—ও কথা বলবেন না, আপনি আমার বাবার বয়েসী—
চণ্ডিকাপ্রসাদ আমার হাত দুটো ধরে বললেন—তাতে কি? আপনি বর্ণশ্রেষ্ঠ, সাধক মানুষ। আপনি এসেছেন, এবার আমার বাড়ির অমঙ্গল কেটে যাবে।
কঠিন রোগীর বাড়ি বিলেতফেরত ডাক্তার গেলে বাড়ির লোকে যেমন বলে।
–আমার যা সাধ্য আমি করব মিত্রমশায়। নইলে আমি আসতাম না।
—আমাদের বাড়িতে কেন এমন হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন ঠাকুরমশাই?
–কিছু কিছু বুঝতে পেরেছি বইকি।
পিতা পুত্র দুজনেই বলে উঠলেন-কি? কি বুঝেছেন?
–এখন না। আগে আপনাদের কথা শুনে নিই। তারপর বলব।
চণ্ডিকাপ্রসাদ ব্যস্ত হয়ে বললেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ—চলুন, হাত-মুখ ধুয়ে বসে সব শুনবেন। ওরে—ও অভিরাম, ঠাকুরমশাইকে জল দে–
দক্ষিণ দিকে বড় বড় জানালাওয়ালা একটা ঘরে আমার থাকবার ব্যবস্থা হয়েছিল। একটু সুস্থ হয়ে সেখানে বসে চণ্ডিকাপ্রসাদের বিবরণ শুনলাম।
চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—আমার জীবনে কখনো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি ঠাকুর মশাই। দিন পনেরো-কুড়ি আগে এক রাত্তিরে শুরু। খেতে বসেছি সবে, রাত দশটা কি সাড়ে দশটা হবে–হঠাৎ বাইরে শো শো আওয়াজ করে একটা ঘূর্ণি হওয়া মত উঠল। আমরা অবাক। ঝড়বৃষ্টির সময় নয়, আকাশে মেঘ নেই—এমন বাতাস উঠল কোত্থেকে? সেই বাতাসের দাপটেই রাজ্যের ধুলোবালি এসে আমার ভাতে পড়ল। মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। আমরা সেকেলে মানুষ, লক্ষণ-অলক্ষণ মানি—আর না খেয়ে উঠে পড়লাম। সারারাত ভাল ঘুম হল না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে রাত শেষ হয়ে গেল। সকালে উঠে গড় হাতে বাগানে যাচ্ছি, দেখি সদর দরজার কাছে দুটো মরা পাখি পড়ে আছে। প্রথমে ভাবলাম গতরাত্রিতে যে বাতাস উঠেছিল, তারই ঝাপটায় বোধ হয় মারা পড়েছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি তা নয়—কে যেন পাখি দুটোর ঘাড় মুচড়ে ঘুরিয়ে দিয়েছে। ঝড়ে তেমন হতে পারে না। বাড়ির সবাই দেখলে ভয় পাবে বলে হাতে করে মরা পাখি দুটোকে ঝুলিয়ে নিয়ে গিয়ে দূরে ফেলে দিলাম।
একটু দম নিয়ে চণ্ডিকাপ্রসাদ বললেন—এই শুরু হল। মাঝেমাঝেই উলটো-পালটা বাতাস দেয়, বাড়ির জিনিসপত্র হুড়মুড় করে পড়ে যায়, অদ্ভুত গোঙানির শব্দ শোনা যায় বাড়ির চারপাশে। এসব কিন্তু আমার বাড়ি এবং চারদিকের কিছুটা জায়গায় ঘটে। পরে গ্রামের মধ্যে জিজ্ঞেস করে দেখেছি, তারা ঝড়-বাতাস কিছুই টের পায়নি। কেন এমন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি কি বলেন ঠাকুরমশাই?
চণ্ডিকাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললাম—আপনার বাড়িতে কোনো প্রেতের উপদ্রব হচ্ছে না। অন্তত যে অর্থে আমরা ‘প্রেত’ কথাটা ব্যবহার করি—সে অর্থে নয়।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন—তাহলে?
—ব্যাপারটা আপনাকে বোঝানো একটু কঠিন হবে। আমাদের এই মানুষের জগতের মতই আরো বহু জীবলোক আমাদের চারদিকে সর্বদাই বর্তমান। তারা ঠিক ভূত বা প্রেত নয়—তারাও এক ধরনের জীব। হয়ত মানুষের চেয়ে অন্য রকম। তাদের মন, চিন্তা, আচার-ব্যবহার সবই মানুষের থেকে আলাদা। আমাদের বিচারে হয়ত অমানুষিক। সে জগতের সমস্ত পদার্থই আমাদের কাছে অদৃশ্য ও অস্পর্শযোগ্য। বস্তুত একই স্থান অধিকার করেও এই দুই জগৎ একে অপরের কাছে অস্তিত্বহীন। কিন্তু মাঝে মাঝে প্রকৃতির কোনো আশ্চর্য খেয়ালে এই ছায়াজগৎ আমাদের জগৎকে স্পর্শ করে। এখানে ঠিক তাই হয়েছে। আমরা কোনোভাবে তাদের দুনিয়াতে ঢুকে পড়েছি। সেটা তাদের পছন্দ না হলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না। যা ঘটতে দেখছেন, তা হচ্ছে আমাদের জাগতিক বস্তুর ওপর তাদের মানসিক শক্তির ক্রিয়া। হয়ত তারা ভাবছে এই ভাবে ভয় দেখিয়ে তাদের জগৎ থেকে তারা আমাদের দূর করতে পারবে। বাড়িতে বেড়ালকুকুর ঢুকলে আমরা যেমন ঠেঙিয়ে তাড়াই আর কি! পার্থক্য এই যে, এক্ষেত্রে এসবে কোনো কাজ হবে না। পরিবেশে আর একটা বড় রকমের ঝাঁকুনি লাগলে দুটো জগৎ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। তার আগে নয়।
আমি থামতে চণ্ডিকাপ্রসাদ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপর বললেনএসব আপনি জানলেন কি করে?
খুলে বললে বিস্তর কথা বলতে হয়। ইচ্ছে করছিল না। সংক্ষেপে বললাম—আমি জানতে পারি।
–ওই ঝাঁকুনি না কি বললেন, সেটা কি করে দেওয়া যায়?
—সেটা আপনাআপনিই হয়ে যেতে পারে, যেমন করে শুরু হয়েছিল। স্বস্ত্যয়ন বা স্থানশুদ্ধি গোছের একটা হোমও করতে পারি। কিন্তু আপনাকে সত্য কথাই বলে রাখা ভাল, এই ধরনের উপদ্রবের কথা আমি গুরুদেবের কাছে শুনেছি মাত্র—নিজে দেখছি এই প্রথম। এ বিষয়ে আমার বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমার হোমে কতদূর কাজ হবে জানি না।
চণ্ডিকাপ্রসাদ কি ভাবলেন, তারপর বললেন—তা হোক, আপনি হোমের আয়োজন করুন। আর একটা কথা, যদি কিছু মনে না করেন—