—বিপদে ঈশ্বরকে স্মরণ করবেন। একমাত্র তিনিই সমস্ত ভয় থেকে মানুষকে মুক্ত করতে পারেন।
কালীপ্রসাদের মুখ দেখে মনে হল না যে আমার উপদেশে তিনি কিছুমাত্র ভরসা পেয়েছেন। অবশ্য সেজন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ঈশ্বর অদৃশ্য, আড়ম্বর করে তার পুজো দেওয়া যায়। কিন্তু জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তার ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা একটা উচ্চস্তরের সাধনা। সে সাধনায় কালীপ্রসাদ এখনো সিদ্ধিলাভ করেননি। কিন্তু আমি আর কি করবো? বিদায়সূচক সামান্য হেসে পেছন ফিরে হাটতে শুরু করলাম।
কয়েক পা হেঁটে আসতে-না-আসতেই কালীপ্রসাদ দৌড়ে এলেন।
–শুনছেন? একটু দাঁড়ান–
দাঁড়ালাম। কালীপ্রসাদ আমার কাছে পৌঁছে বললেন—আর একটা কাজ করা যেতে পারে।
-–কি?
–আপনি কি তাতে রাজি হবেন?
বললাম—বলেই ফেলুন না। আমারও তো ট্রেন আসবার সময় হল—
গুরুত্বপূর্ণ কথা শুরু করার ভঙ্গিতে কেশে গলা পরিষ্কার করে কালীপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—আপনি আমার সঙ্গে আমাদের দেশের বাড়ি চলুন।
প্রস্তাবটা নিতান্ত আকস্মিক। অবাক হয়ে বললাম—আমি? আপনার বাড়িতে?
—হ্যাঁ। আপনি অলৌকিক শক্তির অধিকারী। আপনি গেলে আমাদের অমঙ্গল কেটে যাবে। আপত্তি করবেন না—দয়া করে আমার সঙ্গে চলুন। বলুন, যাবেন?
লোকটা সত্যিই ভয় পেয়েছে। পাওয়াই স্বাভাবিক। একটু চিন্তা করলাম-বাড়িতে এমন কিছু বলে আসিনি যে তাড়াতাড়ি ফিরবো। আরো পাঁচ-সাত দিন দেরি হলে ক্ষতি নেই। দেখাই যাক না এর সঙ্গে গিয়ে।
বললাম—আচ্ছা চলুন—যাব।
কালীপ্রসাদের চোখের দৃষ্টি কৃতজ্ঞতায় ভারী হয়ে এল। আমার হাত দুটো ধরে তিনি বললেন—বাঁচলাম। সত্যি বিশ্বাস করিনি আপনি যেতে রাজি হবেন—
একটা ছোট্ট গ্রাম্য স্টেশনে নেমে পাক্কা তিন মাইল হেঁটে কালীপ্রসাদের বাড়ি। গ্রামে যখন ঢুকলাম, তখন রাত্রি প্রায় আটটা। পল্লীগ্রামের তুলনায় শেষ রাত। কৃষ্ণপক্ষের সুমুখ অন্ধকার রাত্তির, পঞ্চমীর রাঙা চাদ পুবদিগন্তের নিচে থেকে চালতে গাছের পেছন দিয়ে এক অলৌকিক গোলকের মত উঠে আসছে। গ্রামের প্রায় শেষের দিকে আম-জাম গাছে ঘেরা নির্জন বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদর দরজায় শেকল নাড়তে একটু বাদে দরজার ফাঁক দিয়ে লণ্ঠনের আলো দেখা গেল। কিন্তু কারো সাড়াশব্দ নেই, যেন ভেতরে যে দাঁড়িয়ে, সে সাহস করে দরজা খুলতে পারছে না।
কালীপ্রসাদ হেঁকে বললেন—অভিরাম নাকি? দরজা খোল—
—কে, বাবু?
ব্যস্ত হয়ে যে লোকটি দরজা খুলে দিল তার বয়েস ষাট ছাড়িয়েছে। মাথায় কাচাপাকা চুল, পরনে খাটা েধুতি, খালি গা। তার সরল মুখে বিশ্বস্ততার ছাপ! কালীপ্রসাদ বললেন–ঠাকুরমশাই, এ হচ্ছে অভিরাম। পুরনো লোক, আমাকে কোলে করেছে ছোটবেলায়। দরজা খুলছিলি না কেন রে?
অভিরামের সরল মুখে ভয়ের স্পষ্ট চিহ্ন ফুটে উঠল। সে বলল—বাবু বাড়িতে যা কাণ্ড। দরজা হঠাৎ খুলতে সাহস হয় না—
–কেন, কি হচ্ছে বাড়িতে?
এর উত্তর অভিরামের দিতে হল না। আমাদের পেছনে আমবাগানে অন্ধকারের মধ্যে গাছের পাতার সরসর শব্দ উঠল, যেন গাছের একটা ডাল ধরে কেউ খুব জোরে বাকাচ্ছে। আমরা দুজন অবাক হয়ে সেদিকে ফিরে তাকাতেই অভিরাম বলল—ওই আবার শুরু হল, দেখছেন তো? নানান উপদ্রব–
সত্যিই, কিসে নাড়াচ্ছে অত মোটা ডালটাকে? মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। তাহলে?
সাঁই করে কি একটা জিনিস গাছের ওপর থেকে আমাদের দিকে ছুটে এল। সহজাত সংস্কারের বশে কালীপ্রসাদ কোমর থেকে শরীর সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে ফেলেছিলেন, জিনিসটা ঠক্ করে পাঁচিলে লেগে মাটিতে পড়ে গেল। নইলে এই আঘাতেই কালীপ্রসাদের পঞ্চভূপ্রাপ্তি ঘটত।
লষ্ঠনের স্নান ঘোলাটে আলোয় দেখলাম মাটিতে পড়ে আছে একটা সেরদশেক ওজনের পাথরের টুকরো।
বললাম—আপনারা দুজনে ভেতরে চলে যান। বাড়িতে টর্চ আছে?
–আজ্ঞে না। কেন?
—আমি একবার ওই গাছটার কাছে যাব। দাও হে অভিরাম, তোমার লণ্ঠনটাই দাও— কালীপ্রসাদ বিচলিত হয়ে বললেন—না না, একা যাবেন না। দেখলেন তো–
-–আমার কিছু হবে না। আপনি ভিতরে যান।
আমি জানতাম মধুসুন্দরী দেবীর কৃপায় কোনো নিম্নশ্রেণীর প্রেত আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। পাথরটা কালীপ্রসাদকে লক্ষ্য করেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, আমাকে নয়।
লণ্ঠন হাতে বাগানের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম।
চারদিক নিঃঝুম, কোথাও গাছের একটি পাতা অবধি নড়ছে না। মনে হল সামনের মোটা গুড়িওয়ালা আমগাছটার ওপর থেকেই পাথরটা ছুটে গিয়েছিল। লণ্ঠনটা তুলে ধরে ওপরদিকে দেখবার চেষ্টা করলাম—কিছু দেখা গেল না।
কিন্তু আমার মনের মধ্যে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল।
মনের একেবারে গভীরে হঠাৎ যেন কে একটা কল বিগড়ে দিল। আমার হাত-পা অবশ হয়ে আসছে, সজ্ঞান চৈতন্য নিভে আসতে চাইছে তেলহীন প্রদীপের মত। আর আমি যেন এক পা-ও হাটতে পারব না। সমস্ত দেহে-মনে কি অস্বস্তি। সে ভাষায় বোঝানো যাবে না।
নিজের ক্ষমতার ওপর অগাধ বিশ্বাস নিয়ে একা এখানে এসেছিলাম। এবার আমার অকস্মাৎ ভয় করতে লাগল। মৃত্যুভয় নয়, যে কোন কারণেই হোক সে ভয় আমার কোনোদিনই নেই। কোন অজানা শক্তির মুখোমুখি হতে গেলে যে ভয় হয়— সেই রকম।
বিশ্রী একটা গন্ধে ভরে গিয়েছে চারদিক। প্রতি নিঃশ্বাসে গন্ধটা একেবারে ফুসফুসের ভেতর অবধি চলে গিয়ে যেন শরীরকে অপবিত্র করে দিচ্ছে। মনকে স্থির করে আমি মধুসুন্দরী দেবীর ধ্যানমন্ত্র আবৃত্তি করতে লাগলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পরিবেশ থেকে দুর্গন্ধ দূর হয়ে গেল, মনের বল ফিরে পেলাম।