-কতদিন বাবা রিটায়ার করেছেন?
—তা বছর কুড়ি তো বটেই। বাবার বয়েস এখন প্রায় আশি, কিন্তু বেশ ভাল স্বাস্থ্য—অসুখবিসুখ কিছুই নেই। কেবল চোখে একটু কম দেখেন।
বললাম—যা হোক, যা বলছিলেন বলে যান—
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে কালীপ্রসাদ বলতে শুরু করলেনজ্ঞাতিদের কিছুই আনতে পারেননি। নগদ টাকা সামান্য যা ছিল তাই দিয়েই কোলকাতায় ব্যবসা শুরু করেন। কেবল প্রাণের চেয়েও প্রিয় একটি জিনিস বয়ে নিয়ে আসেন–
বললাম—কি জিনিস?
—একটি অষ্টধাতুর তৈরী কালীমূর্তি। আমাদের গৃহদেবী। চার-পাঁচ পুরুষ ধরে এই মূর্তি আমাদের পরিবারে পুজো পেয়ে আসছে। ঠাকুরদার বাবা—আমার প্রপিতামহতিনি ছিলেন তন্ত্রসাধক। আজীবন সাধনা করে তন্ত্রের বিভিন্ন শাখায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন বলে শোনা যায়। তার জীবনের শেষদিকে একবার গ্রহনক্ষত্রের কি এক বিচিত্র সংস্থান এবং অমাবস্যা একসঙ্গে পড়ে। তেমন যোগ নাকি একশো বছরেও একটা আসে না। সেই বিশেষ অমাবস্যার রাত্তিরে আমার প্রপিতামহ সারারাত জেগে তন্ত্রের এক গৃঢ় প্রক্রিয়া সাধন করেন। শেষরাত্রে হোমকুণ্ডে পূর্ণাহুতি দিয়ে একটা গোল লোহার কোটায়ে পুজোর উপচার থেকে কি একটা জিনিস পুরে কৌটোটা প্রপিতামহীর হাতে দিয়ে বলেন—এই নাও, রাখো। এ যা করে দিয়ে গেলাম। আমাদের বংশে আর হঠাৎ কারো কোন বিপদ হবে না। সত্যিই তার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই কৌটোটা আমাদের সব আপদে-বিপদে রক্ষা করে এসেছে। কারো অসুখবিসুখ হলে এই মা-কালীর কৌটো তার মাথায় বুকে ঠেকিয়ে দিলে সে ভাল হয়ে ওঠে। ডাক্তার জবাব দিয়ে গিয়েছে এমন মরণাপন্ন রোগীকেও মা-কালীর কৌটোর প্রভাবে সেরে যেতে দেখেছি। সেও না হয় কাকতালীয়, কিন্তু কে একবার কৌটোর মহিমা নিয়ে উপহাস করায় বাবা সাপুড়েদের সদ্য ধরা বিষাক্ত গোখরো সাপের সামনে কোটোটা ধরেন। ছোটবেলার ঘটনা হলেও আমার পরিষ্কার মনে আছে— সাপটা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে গুটিয়ে এতটুকু হয়ে পড়ে রইল। জোকের মুখে নুন পড়লে যেমন হয়।
বললাম—এটা কিন্তু দ্রব্যগুণ হতে পারে।
কালীপ্রসাদ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-ঠিক। দ্রব্যগুণে সাপ বশীভূত হয়, কিন্তু লোহার কৌটো ফুটো করে দ্রব্যগুণ বের হবে কি করে বলতে পারেন?
যথার্থ কথা। বললাম—বলে যান।
—যাই হোক, বিগত তিনপুরুষ ধরে আমাদের পরিবারের ভালমন্দর ব্যাপারে আমরা মাকালীর কৌটোর ওপর নির্ভর করে থাকি। তবু তো আমি আধুনিক লোক, বাস করি আধুনিক কোলকাতায়, আমার বিশ্বাস হয়ত অতটা দৃঢ় নয়। কিন্তু বাবা প্রাচীন মানুষ—ডাক্তার-উকিলের চেয়ে এই কৌটোর ওপর তার নির্ভরতা বেশি।
মাস চারেক আগে কোলকাতার বাসায় আমার বড় ছেলের খুব অসুখ হয়। ছেলে মরণাপন্ন হচ্ছে—ভেতরে বাইরে আমি তখন খুব বিপন্ন। টাকার ব্যাপার বাবা জানতেন না, কিন্তু নাতির অসুখের খবর পেয়ে আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের হাত দিয়ে মাকালীর কৌটো কোলকাতায় আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। কৌটোর মহিমাতেই কিনা জানি না, আমার ছেলেটি সেরে ওঠে— অফিসের গোলমালও মিটে যায়।
একটু থেমে কালীপ্রসাদ বললেন-কিছু মনে করবেন না, আমাকে আর একটা সিগারেট দেবেন?
সিগারেট ধরিয়ে ঘন ঘন টান দিয়ে প্রায় অর্ধেক করে আনবার পর কালীপ্রসাদ আবার বলতে শুরু করলেন—এতদিন মা-কালীর কৌটো কোলকাতায় আমার কাছেই ছিল। হঠাৎ দিন দুয়েক আগে বাবার এক জরুরি চিঠি পেলাম। সে এক অদ্ভুত চিঠি। ছেলে-বৌকে কদিন আগেই বাবার দেখাশুনা করবার জন্য দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম—
এখন চিঠি পেয়ে আমিও চলেছি। কোটোটাও নিয়ে যাচ্ছি সঙ্গে। বললাম—চিঠিটা অদ্ভুত বলছেন কেন? কি আছে চিঠিতে?
উত্তরে কালীপ্রসাদ কাধের ঝোলা থেকে একটা খাম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন-নিজেই পড়ে দেখুন।
বয়স্ক মানুষের ঈষৎ কম্পিত হস্তাক্ষরে লেখা চিঠি—
স্নেহের কালীপ্রসাদ,
আশা করি মঙ্গলময়ের কৃপায় কুশলেই আছ। এক বিচিত্র ঘটনার সম্মুখীন হইয়া তোমাকে এই পত্র দিতেছি। আজ কয়েকদিন হইল আমাদের বাটিতে নানা অলৌকিক এবং ভৌতিক উপদ্রব আরম্ভ হইয়াছে। ইহার কারণ বা কি ভাবে নিরসন হইবে কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। যাহা হউক, পত্র পাওয়া মাত্র তুমি ছুটি লইয়া দেশে আসিবে। গত চার-পাঁচ মাস যাবৎ মা-কালীর কৌটা তোমার কলিকাতায় বাসায় রহিয়াছে, আসিবার সময় উহা সঙ্গে আনিতে ভুলিবে না। সম্ভবত উহা না থাকাতেই এই উপদ্রব। এই পত্রকে তার মনে করিয়া অবিলম্বে রওনা হইবে। আশীর্বাদ লইয়ো। ইতি–
আঃ
চণ্ডিকাপ্রসাদ মিত্র
পড়া শেষ করে চিঠিটা কালীপ্রসাদকে ফেরত দিলাম। ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন-কি বুঝলেন?
–হ্যাঁ, রহস্যময় চিঠি বটে।
—কি অলৌকিক ব্যাপার কিছু আন্দাজ করতে পারেন?
বললাম—তা কি বলা যায়? সে তো কত কিছুই হতে পারে। আগে কখনো আপনাদের বাড়িতে এরকম কিছু হয়েছে?
কালীপ্রসাদ বললেন—কক্ষনো না।
বেলা পড়ে আসছে। আমার ট্রেন আসবার সময় হল। কালীপ্রসাদ দাঁত দিয়ে নিচের ঠোট কামড়ে ধরে কি যেন ভাবছেন। যাক, আমার আর কি করবার আছে? পোটলাটা হাতে নিয়ে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম—আসি তাহলে। সাবধানে থাকবেন—
কালীপ্রসাদ কেমন যেন হতাশ আর ভীত গলায় বললেন-কিন্তু আমার কি হবে? জানেন, আমার বড় ভয় করছে।