—না, আপনি আমাকে চেনেন না। আসুন, ওই চায়ের দোকানটায় এক ভাড় চা খেতে খেতে গুছিয়ে বলছি। আমি যা বলতে চাই এক কথায় বলা সম্ভব না।
যে কোন কারণেই হোক, এই সময়ে চায়ের স্টলে বিশেষ ভিড় ছিল না। ভদ্রলোককে একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে দু-কাপ চায়ের অর্ডার দিলাম।
ভদ্রলোক উসখুস্থ করছিলেন, বললেন—কই, কি বলবেন বলছিলেন-কি ব্যাপার বলুন তো?
কোন ভূমিকা না করেই বললাম—আমি একটু-আধটু জ্যোতিষ ইত্যাদি চর্চা করি। আপনি যখন আমার কাছে দেশলাই চাইলেন, আমার হঠাৎ কেন যেন মনে হল। আপনার খুব বিপদ। সত্যি কি তাই? আমাকে খুলে বললে আমি হয়ত আপনার কাজে লাগতে পারি—
আমার বিশেষ ক্ষমতার কথাটা আর বললাম না। প্রথমেই সে কথা বললে আমাকে হয় পাগল নয়তো ঠগ মনে করবে।
ভদ্রলোক একটু সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এবার ভাল করে দেখে বুঝলাম মানুষটা বেশ বুদ্ধিমান, কিন্তু সাম্প্রতিক দুঃসময় এবং উদ্বেগ তার মুখের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যের ওপর ছায়া ফেলেছে। আজকাল সময় খারাপ, নানারকম ধান্দাবাজ লোক চারদিকে ঘুরছে—এমন অবস্থায় আমাকে হঠাৎ বিশ্বাস করতে না পারাই সম্ভব। কিন্তু মনের যে জোর থাকলে লোকে কোন কিছুকে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করতে পারে, বর্তমানে সে মনের জোর তার নেই। অসহায় ভাবে ভদ্রলোক আমার দিকে চেয়ে বসে রইলেন।
হেসে বললাম–ভয় নেই, আমি ঠগ-জোচ্চার নই। আমার একটা, মানে একটা। বিশেষ ধরনের ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে আমি অনেক কিছু আগে থেকে বুঝতে পারি। আমার গুরুর আদেশ ছিল কারো বিপদ বুঝতে পারলে এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করা, তাই আপনাকে দেখে
ভদ্রলোক সামান্য কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন—কি ধরনের বিশেষ ক্ষমতা?
বললাম—এই যেমন ধরুন—আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি আপনার জন্ম চৈত্র মাসে, সাত থেকে দশ তারিখের মধ্যে। আপনার নামের আদ্যক্ষর ক। গত তিনচারদিনের মধ্যে আপনি বেশ বড় রকমের একটা অগ্নিভয় থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আর—
ভদ্রলোকের চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠেছিল, বললেন—আর কি?
—বলব?
দুর্বল স্বরে ভদ্রলোক বললেন—বলুন।
গত বছর আপনার কর্মস্থলে আপনাকে নিয়ে যে গোলমাল হয়েছিল তাতে বিচারে আপনি রেহাই পেয়ে গেলেও দোষটা কিন্তু আপনারই ছিল, তাই না?
ভদ্রলোক মাথা নিচু করে শুনছিলেন। মুখ তুললে দেখলাম তার চোখে জল। আস্তে আস্তে বললেন—আজ্ঞে হ্যাঁ, দোষ আমারই ছিল! কেউ জানে না সেকথা, আমার স্ত্রীও না। কিন্তু বিশ্বাস করুন, নিতান্ত বাধ্য হয়েই
বললাম—তিন হাজার টাকা। ঠিক তো?
ভদ্রলোক একবার কেঁপে উঠলেন আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনি সবই জানতে পেরেছেন দেখছি। আপনার ক্ষমতায় আর আমি অবিশ্বাস করছি না। স্ত্রীর অসুখে বাধ্য হয়ে তাকে বাঁচাবার জন্য টাকাটা নিতে হয়েছিল। ভেবেছিলাম কেউ টের পাবার আগেই দেশের জমিজমা বিক্রি করে আবার পুরিয়ে দেব। কিন্তু তার আগেই অডিট্র বসল, ঘাটতি ধরা পড়ে গেল। আমি বহু পুরনো বিশ্বস্ত কর্মচারী, আমাকে কেউ সন্দেহ করল না। অন্য কারো ঘাড়ে দোষ পড়লে হয়ত আমি এগিয়ে গিয়ে অপরাধ স্বীকার করতাম। কিন্তু তাও হল না—যথেষ্ট প্রমাণের অভাবে টাকাটা বাজে খরচের খাতে লিখে রাখা হল।
তারপর ভদ্রলোক আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন-ওঃ, আপনার। কাছে সব স্বীকার করে যেন বাঁচলাম! এতদিন মনে পাপবোধ পুষে রাখা—উঃ, সে যে কি কষ্ট–
ধুতির খুঁটে মুখ মুছে আবার বললেন—হ্যাঁ, গত পরশুদিন আগুনের হাত থেকে বেঁচেছি বটে। আমার স্ত্রী পুত্র বর্তমানে দেশের বাড়িতে রয়েছে—যেখানে আমি এখন যাচ্ছি। নিজে রান্না করে খাওয়ার অভোস নেই কোনকালে। হোটেলে খেলে আমার শরীর খারাপ হয়, তাই যা হোক ভাতে-ভাত দুটো-কটা ফুটিয়ে নেব বলে স্টোভ জেলে চাল বের করতে পেছন ফিরেছি, আর মশাই ধুতিতে লেগে গিয়েছে আগুন! কি ভাগ্য, সেই সময় আমার এক বন্ধু এসে হাজির আড্ডা দিতে। সে বিছানার মোটা চাদর চেপে ধরে আগুন নেভায়। তাও দেখুন না, কতখানি পুড়ে গিয়েছে—
ডান পায়ের থেকে কাপড় সরিয়ে নিতেই দেখলাম পায়ের গুলি থেকে উরুর পেছন অবধি ভেজা নেকড়ার ফেটি বাধা। বললেন—নারকেল তেলের পট্টি বেঁধে রেখেছি।
চায়ের দোকানের ছেলেটা এসে শূন্য কাপ দুটো নিয়ে গেল। তাকে বললাম আর দু-কাপ চা দিতে। সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে ধরালাম, ভদ্রলোককেও দিলাম। সিগারেটে গোটা কয়েক লম্বা টান দিয়ে তিনি বললেন—আমার নাম কালীপ্রসাদ মিত্র। খুলনার বিখ্যাত মিত্রদের কথা হয়ত শুনে থাকবেন, আমরা তাদেরই বংশধর। অবশ্য পঞ্চাশ-ষাট বছর হল খুলনার সঙ্গে আমাদের আর কোনো যোগাযোগ নেই। ঠাকুরদা কর্ম উপলক্ষ্যে এদিকে চলে আসেন—সেই থেকেই আর কখনো দেশে ফিরে যাওয়া হয়নি।
আবার চা এল। গরম চায়ে চুমুক দিয়ে কালীপ্রসাদ বললেন—নদীয়া জেলার উত্তর প্রান্তে কিছু ভূসম্পত্তি কিনে ঠাকুরদা বসবাস শুরু করেন। ব্যবসা করতেন কোলকাতায়, মাঝে মাঝে গ্রামে এসে থাকতেন। তিনি ছাড়া বাড়ির লোকজন গ্রামেই থাকত। বন্দরে যে-সব জাহাজ এসে ভেড়ে, তাতে কাঁচা আনাজ যোগান দেবার ব্যবসা করতেন ঠাকুরদা। বিলক্ষণ দু’পয়সা করেছিলেন। কিন্তু বহু প্রতিদ্বন্দ্বী জোটায় তার জীবদ্দশাতেই সে ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায়। চেনাগুনো কাকে যেন ধরে বাবাকে এক সাহেবী ফার্মে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। বাবা অবসর গ্রহণ করার পর সেই চাকরি আমি পেয়েছি।