তারানাথ চটে গিয়ে বলত—হয় না? এই শোনো তবে—
একটা নতুন গল্প শুরু হয়ে যেত।
সেদিন সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে। জামাকাপড়, রুমাল—এমন কি মনের ভেতরটা অবধি ভিজে স্যাতসেঁতে হয়ে রয়েছে। অন্যদিন অফিস ছুটির পর বলাইবাবু কিম্বা হরি মিত্তিরের সঙ্গে মোড়ের দোকানে চা খেতে খেতে রাজনীতি, জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য অথবা বাঙালী কি ছিল আর কি হয়েছে—এসব বিষয়ে গভীর আলোচনা করে আনন্দ পেয়ে থাকি। কিন্তু আজ আর সে-সব ইচ্ছে করল না। অফিস থেকে বেরিয়ে তারানাথের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।
পৌঁছে দেখি কিশোরী সেন আমার আগেই এসে বসে আছে। আমাকে দেখে বলল—এই যে! এসো হে—তোমারই জন্য বসে আছি—হেসে বললাম—কি করে জানলে আমি আসব?
–ওর জন্য কি আর মন্ত্র-তন্ত্র জানতে হয়? আজ এমন বাদলা করেছে—যাকে বলে আড্ডার মেজাজ, না এসে যাবে কোথায়?
তারানাথের জন্য এক প্যাকেট পাসিং শো কিনে এনেছিলাম, তাকে দিয়ে বললাম—আজ একটা ভাল গল্প হবে নাকি?
তারানাথ হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিল বটে, কিন্তু তার মুখে বিশেষ প্রফুল্লতা দেখলাম না। বিরসমুখে সে বলল—নাঃ তোমাদের কাছে গল্প বলতে ইচ্ছে করে না, তোমরা আমার গল্প অবিশ্বাস করো—
কিশোরী বলল—কই, সব গল্প তো অবিশ্বাস করি না! নেহাত যেগুলো একেবারেই বিশ্বাস করবার মত নয়, সেগুলো বাদে।
তারানাথ চটে উঠতে যাচ্ছিল, আমি কথার মোড় ঘোরাবার জন্য বললামকিশোরীর কথা ছেড়ে দিন। আসল কথা হচ্ছে, আপনার গল্প যদি সত্যি হয় তাহলে আমরা বিশ্বাস করলেই বা কি আর না করলেই বা কি? সত্য কারো মতামতনির্ভর নয়।
তারানাথ কথঞ্চিৎ শান্ত হয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল—এই যে বিশ্বাসের কথা বললে না? বিশ্বাসে সত্যিই অনেক কিছু ঘটায়, সাধারণ বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা করা যায় না—
কিশোরীর ঘাড়ে আজ দুগ্রহ ভর করেছিল, সে বলল—তার মানে আপনি বলতে চাইছেন কেউ যদি বিশ্বাস করে সে কোনোদিন মরবে না, তাহলে বিশ্বাসের জোরে সে সত্যি সত্যিই অমর হয়ে যাবে?
—যাবেই তো। তবে তোমার মত ফিচেল লোক পারবে না। হিমালয়ে যে-সব। প্রাচীন যোগীরা শত শত বছর বেঁচে আছেন, তারা কি করে এত দীর্ঘকাল জীবিত আছেন বলে মনে কর? কেবলমাত্র ইচ্ছাশক্তির জোরে। মানুষের বিশ্বাস ইচ্ছাশক্তিরই একটা প্রকাশ
এমন সময় বাইরে আবার ঝমঝম্ করে বৃষ্টি নামল। আলো কমে গিয়ে অন্ধকারমত হয়ে এল ঘরের ভেতরে। বৃষ্টির বহর দেখে মনে হল সহসা থামবার নয়। অবশ্য তাড়াতাড়ি মেসে ফিরেই বা কি লাভ? কিন্তু এখানে বসে থাকতে হলে গল্প চাই। বললাম-বিশ্বাসের শক্তি সম্বন্ধে একটা ভাল গল্প হোক তবে
তারানাথ বলল—আমার কাছে কোনো গল্প নেই, সব সত্যি ঘটনা।
কিশোরী আবার কি বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম—এখন অন্তত ঘণ্টাদুই আমরা আপনার অতিথি, বেরোবার উপায় নেই। আমাদের প্রার্থনা—একটি গল্প—মানে সত্যি ঘটনা। সৎ গৃহস্বামী মাত্রেই অতিথির প্রার্থনা পূরণ করে থাকে। আপনারও করা উচিত।
তারানাথ একটু হাসল। চোখ বুজে কিছুক্ষণ ভেবে বোধ হয় মনে মনে গল্পটা গুছিয়ে নিল, তারপর বলতে শুরু করল—বছর কুড়ি আগেকার কথা। এক শিষ্যবাড়ি থেকে স্বস্ত্যয়ন করে ফিরছি, ট্রেন বদলাবার জন্য বসে আছি রানাঘাট স্টেশনে। টেনের তখনো প্রায় ঘণ্টাখানেক দেরি। কি করা যায়, একটা বেঞ্চিতে বসে আপন মনে সিগারেট খেয়ে সময় কাটাতে লাগলাম। দক্ষিণ এবং পুজো বাবদ পাওয়া জিনিসপত্র পোটলা করে পায়ের কাছে রাখা। এমন সময় একজন মধ্যবয়সী লোক এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বলল—একটু আগুনটা দেবেন তো ভাই
বিশেষ খেয়াল না করেই পকেট থেকে দেশলাই বের করে তার হাতে দিলাম। প্রথম কাঠিটা নষ্ট করে দ্বিতীয় কাঠি দিয়ে লোকটা বিড়ি ধরিয়ে আমাকে দেশলাই ফেরত দিল। তখনও আমি তার দিকে তাকাইনি। দেশলাই পকেটে পুরে কি জানি কেন হঠাৎ লোকটার দিকে একবার চাইলাম। সে তখন পেছন ফিরে প্ল্যাটফর্মের অন্যদিকে চলে যাচ্ছে।
তাকিয়েই চমকে উঠলাম।
তোমরা তো জানো আমার কতগুলো বিশেষ ক্ষমতা আছে—যা দিয়ে আমি মানুষের আশু বিপদ বা ভাগ্য পরিবর্তনের কথা টের পাই। পেছন থেকে তাকিয়ে আমি লোকটার শরীর ঘিরে একটা কালো ছায়া দেখতে পেলাম। যেন একটা কালো মসলিনের ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে লোকটা চলাফেরা করছে। বুঝলাম মানুষটা ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। পায়ের কাছ থেকে পোটলাটা হাতে নিয়ে আমি দ্রুতপায়ে তার পেছনে এগিয়ে গেলাম।
প্লাটফর্মের একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন জায়গায় দাঁড়িয়ে লোকটি অন্যমনস্কভাবে লাইনের ওপারে তাকিয়ে ছিল। আস্তে করে ডাকলাম—শুনছেন ভাই?
ভদ্রলোক ভয়ানক চমকে উঠে আমার দিকে তাকালেন। দেখলাম বছর চল্লিশ বয়সের একজন মানুষ, উদ্বেগে ও চিন্তায় মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। গালে পাঁচ-ছ’দিনের
কামানো খোঁচা খোচা দাড়ি। শার্টের একটা বোতাম ভুল ঘরে লাগানো। ভদ্রলোক বিস্মিত গলায় বললেন— আমাকে কিছু বলছেন কি?
একটু বিপদে পড়লাম। কেন ডেকেছি তা ভদ্রলোককে কি ভাবে বলা যায়? একজনকে তো আর হঠাৎ বলা যায় না—ও মশাই, আপনার খুব বিপদ, কারণ আপনার চারদিকে একটা কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে!
সময় নেবার জন্য বললাম—আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল, একটু এদিকে আসবেন?
–কিন্তু আপনাকে তো ঠিক, মানে–