–আজ্ঞে, খান ওটুকু। ব্রাহ্মণ-সেবা করলে আমার কল্যাণ হবে।
পরের দিন সকালে উঠে আমি মাধবের কাছে বিদায় নিলাম। সে ছাড়তে চায় না কিছুতেই। আমি প্রায় জোর করে চলে এলাম বলা যায়। কারণ আগেই বলেছি, আমি দুটো ভাতের জন্য পথে বের হইনি। সরল মানুষের ঘাড়ে চেপে অকারণে অনুধ্বংস করতে আমার খারাপ লাগল। এই পথে আবার কখনও এলে তার বাড়িতে আশ্রম নেব কথা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
দুপুরে একটা গঞ্জ মত জায়গায় চিড়ে-দই কিনে খাই, তারপর আবার হাটি। সারাদিনে প্রায় মাইল পনেরো-ষোল হেঁটে সন্ধ্যে নাগাদ একটা এমন জায়গায় এসে পৌঁছলাম যার ত্রিসীমানায় কোন গ্রাম বা জনবসতি নেই। রুক্ষ, পাদপহীন প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে একটা ছোট্ট কি নদী তিরতির করে বয়ে চলেছে। কি করব ঠিক করতে না পেরে নদীর ধার ধরে হেঁটে এগুতে লাগলাম। মিনিট পনেরো হেঁটে দেখি সামনে এক শ্মশান। বেশ বড় শ্মশান। অন্তত যতদূর চোখ যায় তাকিয়ে দেখলাম কেবল পোড়া পোড়া কাঠের গুড়ি, ছেড়া মাদুর—কাথা, ভাঙা কলসী—এইসব পড়ে আছে।
কিশোরী বললে, ওই নিজন শ্মশানে সন্ধ্যেবেলা আপনার ভয় করল না?
—নাঃ। ভয় করবে কেন? শ্মশান অতি পবিত্র স্থান, সেখানে মানুষের সমস্ত পাপ শেষবারের মত মুছে যায়, তার উধ্বলোকে প্রস্থানের পথ সুগম হয়। শ্মশানে ভয় কিসের?
যাই হোক, দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখছি, হঠাৎ গম্ভীর ভারী গলায় পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল—এখানে কি চাই?
কি ভয়ানক গলার স্বর! লোহার ড্রামে পাথরকুচি ঢাললে এমন শব্দ হতে পারে। চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখি একজন সাধু দাঁড়িয়ে। মাথায় পাকা তেঁতুলের মত অজস্র জটা। মুখময় অযত্নবর্ধিত দাড়িগোঁফের জঙ্গল। লম্বায় আমার মাথা ছাড়িয়ে আর এক হাত। পরনে রক্তাম্বর, পায়ে বউল দেওয়া কাঠের পুরু খড়ম।
–কি দরকার এখানে?
সাধুকে প্রণাম করে বিনীতভাবে জানালাম আমার বিশেষ কোন দরকার নেই, পথ হাটতে হাঁটতে এসে পৌছিয়েছি—এই মাত্র।
—কোথায় যাওয়া হবে?
—কোথাও না।
–মানে?
—ঠিক নেই।
—সাধু কি বুঝলে জানি না। কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকল, তারপর তার দাড়ির জঙ্গলে খুব সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে বলল, আয় আমার সঙ্গে।
সেই ঘনায়মান অন্ধকারে আমি সাধুর পেছনে চললাম। বেশ খানিকটা হাটবার পর দেখি একটা গাব বা ওই জাতীয় কোন গাছের নীচে সাধু মড়ার মাদুর, কাঁথা ইত্যাদি টাঙিয়ে বেশ ঝুপড়ি মত বানিয়েছে। বললাম, এইখানে আপনি থাকেন?
-–কেন, অসুবিধেটা কি?
সাধুর কথাবার্তা যেন কেমন কেমন। আমি বললাম—না, অসুবিধে আর কি? তাই বলছি—
সাধু আমাকে ঝুপড়ির বাইরে বসতে বলে নিজে ভেতরে ঢুকল। বেরিয়ে এল দুটো পাকা কলা হাতে নিয়ে। বলল, এই নাও, খাও—
নিলাম।
-–কি উদ্দেশ্যে বেরুনো হয়েছে বাড়ি থেকে? সাধু হবার ইচ্ছে নাকি?
আমি উত্তর না দিয়ে কলা হাতে চুপ করে বসে রইলাম।
–তুই আমার কাছে থেকে যা। আমি তোকে চেলা করে নেব। থাকবি?
তারপর সাধু একটা কথা বলল যা আমাকে আমাদের গ্রামের বটতলার সেই সাধুও বলেছিল। বলল, তোর কপালে তন্ত্রসাধনার চিহ্ন আছে। থেকে যা তুই আমার কাছে।
আমি একটু ফাপরে পড়লাম। এই সাধুকে দেখে আমার তেমন ভক্তির উদয় হয়নি, বরং কেমন একটু অস্বস্তিই হয়েছে। এত সহজে নিজে থেকে চেলা করে নিতে চাইল দেখে সে ভাব বেড়েছে বই কমেনি। ভাল সাধু কখনও কথায় কথায় শিষ্য করে বেড়ায় না। অবশ্য আমার আর চিন্তা কি? থাকি ক’দিন, ভাল না লাগলে কেটে পড়ার বাধা কোথায়? সাধুসঙ্গের জন্যই তো বেরিয়েছি, বাজিয়ে দেখতে দোষ কোথায়?
বললাম, থাকব।
সাধু বলল, বেশ। আমি একটা বিশেষ সাধনা করছি। সেটা ক’দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। তারপর তোকে দীক্ষা দেব।
—কি সাধনা?
—সে আছে। সময় হলেই জানাব। তাছাড়া তোর সাহায্যও আমার দরকার হতে পারে। থেকে গেলাম সাধুর কাছে। দু-চারদিন কেটে গেল।
সাধু আমাকে একলা ফেলে রেখে সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে কি সব সংগ্রহ করে আনে। বোধ হয় নিজের সাধনার জিনিসপত্র। রাত্তিরে বসে অনেকক্ষণ ধরে পুজো সে সময়টা আচ্চা আর জপতপ করে।-আমি একটু দূরে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জেলে মাটির হাড়িতে ভাতেভাত রান্না করি। অনেক রাত্তিরে খাওয়া হয়।
ক্রমে সাধুর কাণ্ডকারখানা দেখে আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস হল সাধু একজন কাপালিক। একদিন একটা মরা চড়ুইপাখি কোথা থেকে ঠাং ধরে ঝুলিয়ে এনে হাজির। কুপড়ি থেকে ছুরি এনে চড়ইটার পেট চিরে নড়িভূড়ি বের করল সাধু। তারপর কি একটা জিনিস আমাকে না দেখিয়ে টুক করে ভরে দিল পাখিটার পেটে। আবার ঝুপড়িতে ঢুকে দুখানা একই মাপের মাটির সরা এনে একটায় মরা পাখিটা–রেখে অন্যটা দিয়ে চাপা দিয়ে দিল, তারপর একটু আটা মেখে সেই আটা দিয়ে দুটো সরাই মুখে মুখে জুড়ে দিল। আমি অবাক হয়ে বললাম, এ দিয়ে কি হবে?
সাধু সংক্ষেপে বলল, কাজ আছে।
তারপর আমার হাতে মুখবন্ধ সরাটা দিয়ে বলল, আগুনে পোড়াও তো এটা। এক ঘণ্টা ধরে পোড়াবে। এইভাবে তিনদিন এক ঘণ্টা করে পোড়াবে। নাও–
রান্না হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আগুন তখনও জুলছে। আমি কথা না বলে সরাটা সাধুর কাছ থেকে নিয়ে আগুনে রেখে দিলাম।
সাধু বললে, দ্রব্যগুণ, বুঝলে? দ্রব্যগুণ এক বিরাট জিনিস। তুমি মানো?