অন্ধকারে লোকটাকে দেখা যায় না, সে যেখানে বসে আছে আন্দাজে সেদিকে। তাকিয়ে প্রশ্নটা করলাম!
প্রথমে খানিকক্ষণ চুপচাপ, তারপর কেমন যেন ভাঙা, খসখসে গলায় উত্তর এল— এই শ্মশানেই থাকি।
মড়া পোড়াতে সাহায্য করা যাদের জীবিকা, এমন একশ্রেণীর লোক প্রায় সব শ্মশানেই থাকে। আমি আন্দাজ করে নিলাম এ তাদেরই একজন। জিজ্ঞাসা করলাম—থাকো মানে কি? কি করো? মড়া পোড়াও?
না।
—তাহলে?
—শুধু থাকি। আর শ্মশানে ঘুরে বেড়াই।
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এ ধরনের লোকেরা কথা কম বলে, আর নিজেদের সম্বন্ধে কিছু বলতে চায় না। কাজেই প্রসঙ্গ বদলে বললাম—বিড়ি খাবে?
না।
ভাল মজা। আমি একটু গল্প জমাতে চাইছি, কারণ চিরদিনই আমার শহুরে পালিশ করা মানুষের চাইতে এইসব হাটে-মাঠে-ঘুরে-বেড়ানো চরিত্রদের বেশি ভাল লাগে তা এ দেখছি বাক্যব্যয়ে একেবারেই অনিচ্ছুক। লোকটার গলাই বা অমন ভাঙা ভাঙা কেন? ঠাণ্ডা লেগেছে নাকি?
একটু চুপ করে থেকে ভাবলাম কি প্রসঙ্গে কথাবার্তা চালানো যায়, তারপর মনে হল ওর জীবনের সঙ্গে মিল আছে এমন কথা জিজ্ঞাসা করাই ভাল। ঘরের কোণে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম—তুমি কতদিন আছ এইখানে?
—অনেকদিন।
—অদ্ভুত কিছু দেখনি? বা এমন কোনো ঘটনা, যা তোমার মনে রয়ে গেছে?
এইবার লোকটার অনিচ্ছুক কষ্ঠে প্রথম প্রাণের স্পর্শ লাগল। সে বলল—কেন। দেখব না? এমন একটা ঘটনা দেখেছি যা কোনদিন ভুলতে পারবো না—
একটু বিস্মিত হয়ে বললাম—কি ঘটনা?
কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। তারপর অন্ধকারের ভেতর থেকে আবার সেই মানুষটির গলা ভেসে এল—অনেক বছর আগে এই শ্মশানে একজন লোক তার স্ত্রীকে দাহ করতে নিয়ে এসেছিল। অল্পবয়েসের বৌ, লালপাড় শাড়ি পরিয়ে, মাথার সিঁদুর দিয়ে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। নদীর পাড়ে ওই যেখানে রাঙামাটি টিবি মত উঁচু হয়ে আছে, দেখতে পাচ্ছ? বাইরে তো চাঁদের আলো? ঠিক ওইখানে লোকটা বসে কাঁদছিল একা। বৌকে খুব ভালবাসতো কিনা।
আমি নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলাম। এ ঘটনা যেন বড্ড চেনা-চেনা লাগছে। তাহলে কি এই লোকটা রাঙাকাকীমার দাহকার্যের সাক্ষী?
-ক’দিনের জন্য এসেছিল তারা, কাজ শেষ করে ফিরে যাবার কথা ছিল। বৌয়ের আর ফেরা হল না। আকাশে মেঘ ঘন হয়ে আসছিল, পাছে বৃষ্টি এসে পড়ে এই ভয়ে ডোমেরা বাঁশ দিয়ে চিতা খুঁচিয়ে দিচ্ছিল তাড়াতাড়ি কাজ সারবার জন্য। এখানেই জন্ম হয়েছিল বৌটার, আবার এখানে এসেই মরল—
আমার আর কোন সন্দেহ ছিল না, রাঙাকাকীমার শেষ কাজের কথাই বলছে বটে লোকটা!
আশ্চর্য যোগাযোগ তো! আমি জীবনে আজ প্রথম এখানে এলাম, তাও না জেনে, আর এসেই লোকটার সঙ্গে আলাপ!
বললাম—খুবই দুঃখের কথা বটে, কিন্তু মানুষ তো মরেই। বিশেষ করে এই ঘটনাটা তোমার মনে আছে কেন?
আবার একটু স্তব্ধতা। লোকটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি না। মানুষ এমন চুপ করে বসে থাকতে পারে?
লোকটা বলল—মনে রাখবার কারণ আছে। বৌটার পেটে বাচ্চা ছিল।
আমি চমকে উঠে বললাম—কি বলছ তুমি? এ কথা কেউ জানতো না?
—না। বৌটা ভেবেছিল আর কিছুদিন বাদে স্বামীকে বলবে। তার সময় পায়নি। কিন্তু বাঁশ দিয়ে খোচাবার সময় ডোমেরা বুঝতে পেরেছিল। তারা বলেছিল মানুষটাকে। পেটে সন্তান থাকলে তাকে আলাদা করে দাহ করতে হয়, জানো তো? নইলে দুজনের কারোই মুক্তি হয় না। আহা, বৌটার বড় শখ ছিল একটা সস্তানের সে শখও মিটল না, মুক্তিও হল না। মুক্তি না হওয়ার কি যন্ত্রণা তা কেবল বদ্ধ আত্মাই জানে। তাই বুঝি নিজের যন্ত্রণার কথা জানাবার জন্য সে বার বার বিরাজের কাছে গিয়ে
এতক্ষণ মেরুদণ্ড টান করে শুনছিলাম, এবারে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম—সে কি! তুমি বিরাজের নাম কি করে জানলে? কে তুমি?
কোনো উত্তর নেই। ঘরে স্তব্ধতা।
দেশলাই জালালাম, কেউ নেই কোথাও।
দরজার বাইরে নদীর চরে অপার্থিব জ্যোৎস্না ফুটেছে। ঘরে যে ছিল সে দরজা দিয়ে বেরুলে আমি নিশ্চয় দেখতে পেতাম। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে চারদিকে তাকালাম। শূন্য লালমাটির প্রান্তর চাদের আলোয় স্বপ্নের দেশ বলে মনে হচ্ছে। জনপ্রাণী নেই কোথাও। কোথায় গেল সে?
ঠিক এই সময়েই একঝলক বাতাসে ভেসে এল একটা সোদা, গুমো, ভ্যাপসা গন্ধ-অচেনা বক্তার পরিচয় প্রকট করে দিয়ে গেল।
ভেবে দেখলাম সব ঘটনাই একসূত্রে গাঁথা বটে। রাঙাকাকীমার যন্ত্রণাকাতর আত্মার বার বার ফিরে আসা, লাল ট্রাঙ্কের ওপরে ছোট ছোট হাতের ছাপ, কাকীমার হাতে ডলপুতুলের মত সদ্যোজাত শিশু দেখতে পাওয়া। বিরাজ ভাল মিডিয়াম ছিল, দেখতে পেত। কিন্তু কোন কারণে কথা শুনতে পেত না। শুনতে পেলে অনেক আগেই। গোলযোগ মিটে যেত।
রাত্রি ক্রমে গভীর হতে লাগল। একা বসে রইলাম ভীমা নদীর পাড়ে।
পরের দিন সেখান থেকে রওনা হয়ে সোজা গয়ায় এসে রাঙাকাকীমা এবং তার অজাত সন্তানটির মুক্তিকামনায় পিণ্ডদান করি। পুরোহিত মশায় যখন কাজের জিনিসপত্র সব গোছাচ্ছেন, হঠাৎ আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম—আচ্ছা, এই সঙ্গেই কি আরো একজনের নামে পিণ্ড দেওয়া যাবে? একসঙ্গে করে দিতে পারবেন?
পুরোহিত বললেন—কেন হবে না? কিছু মূল্য ধরে দেবেন এখনকার নামে হবে? কি গোত্র? পুরোহিতকে রাঙাকাকার নামটা বললাম।
০৭. তারানাথ খুব মিশুক লোক ছিল না
তারানাথ ভাল গল্প বলতে পারলেও খুব মিশুক লোক ছিল না। এক ধরনের ফুর্তিবাজ জমাট মানুষ থাকে যারা চায়ের আড্ডায়, ময়দানের বেঞ্চিতে কিম্বা বিয়ের বাসরে একেবারে দারুণ জমিয়ে তোলে। তারানাথ ঠিক তার উল্টো—লোক দেখলে সে গুটিয়ে যায়। বিশেষ করে নিজের কথা সে কিছুতেই বলতে চায় না। কিন্তু আমাদের সহানুভূতির ছোয়ায় তারানাথের বন্ধ মনের দরজা অনেকখানি খুলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা কেবল আমাদের কাছেই। ইদানীং হাত দেখানো বা কোষ্ঠীবিচারের খদ্দের প্রায় নেই বললেই চলে, বন্ধুও কেউ নেই। সারাদিন একাকীত্ব ভোগ করার পর মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে আমরা হাজির হলে তারানাথের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। মানুষটা গল্পের খনি, আমরা নানাভাবে খুঁচিয়ে তার কাছে গল্প আদায় করতাম। তার মতের বিরোধিতা করলে তারানাথ রেগে যেত। আমি আর কিশোরী গল্পের লোভে হঠাৎ তার কথার মাঝখানে হো হো করে হেসে উঠে বলতাম—বাঃ, তা কখনো হয়?