মেয়ে-জামাই বিদায় হবার সময় বাড়ির মেয়েরা তো কান্নাকাটি করলেনই, এমন। কি বাবা আর মেজকাকা অবধি দেখলাম বারান্দায় এক কোণে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছেন। ছোটকাকাকে তো খুঁজেই পাওয়া গেল না, আশীর্বাদ করেই তিনি কোথায় গিয়ে লুকিয়ে বসে আছেন।
আশীর্বাদের পর্ব মিটে গেলে মেয়ে-জামাইকে নিয়ে যাওয়া হল ছোটকাকীমার ঘরে, সেখানে লক্ষ্মীর আসনের সামনে ওদের প্রণাম করিয়ে নিয়ে তারপর গাড়িতে তুলে দেওয়া হবে।
ঘরে ঢোকবার মুখে চৌকাঠের কাছে থমকে দাঁড়ালেন মা, এ কি! এগুলো এমন করল কে?
ঘরের সামনে চৌকাঠের বাইরে কে যেন বিরাজের লাল ট্রাঙ্কটা টেনে বার করে ভেতরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাকার করেছে। মুখে মাখবার নতুন পাউডারের কোটোটা ঢাকনা খোলা অবস্থায় পড়ে, তার থেকে মুঠো মুঠো পাউডার চারদিকে ছড়িয়ে কেউ খেলা করেছে যেন।
মা তাড়াতাড়ি ট্রাঙ্কের ভেতরে হাতড়ে দেখলেন। না, জামাইয়ের শালের নিচে গয়নার বাক্স ঠিক আছে। তাহলে এর মানে কি? চোর হলে গয়নার বাক্সই তার লক্ষ্য হবে। কোনো শিশুর দুষ্টুমি বলে মনে করা যেত, কিন্তু তত ছোট শিশু বাড়িতে কেউ নেই।
মা আর ছোটকাকীমা জিনিসগুলো গুছিয়ে আবার বাক্সে ভরে দিয়ে ট্রাঙ্কের ডালা বন্ধ করতেই যারা কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল তারা অস্ফুট বিস্ময়সূচক শব্দ করে উঠল।
ট্রাঙ্কের লাল রঙের ডালার ওপরে পাউডারমাখা ছোট ছোট হাতের ছাপ! একটি শিশু যেন হাতে পাউডার মেখে মনের আনন্দে ছাপ দিয়েছে।
কিন্তু অত ছোট বাচ্চা তো কেউ নেই আমাদের বাড়িতে। ছাপগুলো খুবই ছোট ছোট হাতের, প্রায় সদ্যোজাত শিশুর মত। এত ছোট বাচ্চা কি নিজে বসে খেলা করতে পারে?
ব্যাপারটা রহস্যই রয়ে গেল। বিরাজ আর তার স্বামী রওনা হয়ে যাবার পর এ নিয়ে অনেক আলোচনা হল বটে, কিন্তু কেউ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না।
এর কিছুদিন পর আমিও আবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। কত ঘুরলাম সমস্ত বাংলাদেশের শ্মশানে-মশানে, সিদ্ধপীঠে। প্রকৃত সাধকের দেখা পাবার পিপাসা মনের মধ্যে উদগ্র হয়ে উঠেছে তখন। সারাদিন পথ হাটি, সন্ধ্যেবেলা কোনো মন্দিরে কি বাঁধানো গাছের তলায় রাতের আশ্রয় নিই। রান্না করে খেতাম না কখনো। হাতে পয়সা থাকলে দোকান থেকে চিড়েমুড়ি কিনে নিতাম, কখনো বা পুণ্যলোভী গ্রামবাসীরা খাবারদাবার উপহার দিয়ে যেত। জীবনের এই সময়টা খুব ভাল কেটেছে, জানো? এখন এই বদ্ধতার ভেতর বসে মনে করলে রোমাঞ্চ হয়। কেমন মুক্ত আনন্দে পথে পথে বেড়ানো, মাথার ওপরে খোলা আকাশ, পথেরও কোনো সীমা নেই। কত বিচিত্র মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কত আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। এখন মাঝে মাঝে মনে হয় সাধনার জন্য নয়, বোধ হয় এই পথের নেশাতেই ঘরছাড়া হয়ে পড়তাম।
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে বাংলা আর বিহারের সীমান্তে একটা ছোট শহরমত জায়গায় গিয়ে পড়েছি, সেখানকার মুদির দোকানে চিড়ে আর গুড় কেনবার সময় মুদিকে জায়গাটার নাম জিজ্ঞাসা করলাম।
মুদি বলল—ছোট রামপুর বাবুজী।
আমি চমকে উঠলাম—কি বললে? ছোট রামপুর?
—জী। কেন বাবু?
—না, কিছু না।
মনটা খারাপ হয়ে গেল। এই ছোট রামপুরেই ছিল রাঙাকাকীমার বাপের বাড়ি। এখানেই কাকীমার মৃত্যু হয়।
পুরনো স্মৃতি ভিড় করে এল মনে। শৈশবে দেখা কাকীমার সেই হাসিমাখা মুখ, কোদাল হাতে রাঙাকাকা বাগানের জমি কোপাচ্ছেন, কাকীমার মৃত্যুতে রাঙাকাকার সেই কান্না।
ছোট রামপুরের প্রান্ত দিয়ে বয়ে গিয়েছে ভীমা নদী। বিশেষ চওড়া নয়, স্রোতও কম। কিন্তু নদীর দুপাড়ে অনেক দূর অবধি বসতি না থাকায় ভীমা একটা অপূর্ব নির্জনতা লাভ করেছে। নদীর ধারেই রামপুরের শ্মশান। উঁচু-নিচু লালমাটির প্রান্তরের মধ্যে কেবলমাত্র শ্মশানযাত্রীদের জন্য তৈরি একটা চালাঘর দাঁড়িয়ে আছে। আমি যখন পৌঁছলাম, তখন দিনের আলো নিভে এসেছে বটে, কিন্তু সেদিন সম্ভবত শুক্লপক্ষের নবমী—কাজেই রাত্তিরে জ্যোৎস্নার শোভা উপভোগ করা যাবে। শ্মশানে কাটানো আমার অভ্যেস আছে, ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
ভীমার তীরে বসে চড়ে গুড় দিয়ে রাত্তিরের খাওয়া সেরে নদীতে নেমে জল খেলাম। ততক্ষণে দিনের আলো সম্পূর্ণ মুছে গিয়ে রুক্ষ ভূমিত্রীর ওপর ফুটে উঠেছে। শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্না। নদীর ধারের সাদা বালি চিকচিক করছে চাদের আলোয়। অমন দৃশ্য তোমরা দেখনি হে, শহর-বাজার অঞ্চলে তোমরা পূর্ণিমা বা অমাবস্যা টের পাও না। শহরে জীবন নেই।
শরীর খুব ক্লান্ত ছিল, ভাবলাম আর জেগে না থেকে ঘুমিয়ে পড়া যাক। সামনে চালাঘরটা যখন আছে তখন আর খোলা জায়গায় ঘুমোই কেন? এই ভেবে শ্মশানযাত্রীদের ঘরটার দিকে এগুলাম।
বাইরে জ্যোৎস্না থাকলেও ঘরের মধ্যে তা পৌঁচচ্ছে না। অন্ধকারে তাকিয়ে যতদূর মনে হল ঘরটা একেবারে ফাকা, কেবল একদিকে কতগুলো খড়ের আঁটি পড়ে আছে। ভালই হল, আমি খড়ের আঁটিগুলো বিছিয়ে একটু গদিমত করে চেপে বসলাম।
বিড়ি ধরাতে গিয়ে দেশলাইয়ের আলোয় প্রথম চোখে পড়ল লোকটাকে। এতক্ষণ বুঝতেই পারিনি, ঘরে আর একজন মানুষ আছে। কখন থেকে বসে আছে লোকটা? খালি গা, আধময়লা ধুতি পরনে, লম্বা চুল–মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। হঠাৎ আলো জুলায় মুখের সামনে হাত দিয়ে আড়াল করে আছে।
পোড়া কাঠির টুকরোটা ফেলে দিলাম। বিড়ি ধরে গিয়েছিল, গোটাদুই টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—তুমি কে? এখানে কি করছ?