আশীর্বাদ সেরে পাত্রপক্ষের লোকেরা বিকেলবেলা চলে গেলেন, তারা সন্ধ্যের ট্রেন ধরবেন। সঙ্গে আমাদের বাড়ি থেকে লোক দেওয়া হল স্টেশন অবধি পৌঁছে দেবার জন্য।
সেইদিনই রাত্তিরে বিরাজের ঘর থেকে কান্নার আওয়াজ পেয়ে মা আর বাবা উঠে দেখতে গেলেন। ছোটকাকীমার পাশেই শুয়েছিল বিরাজ। কাকীমা জেগে বসে অবাক হয়ে বিরাজেরদিকে তাকিয়ে আছেন, আর বিরাজ আঝোর ধারায় কাঁদছে।
মাঝরাত্তিরে ঘুম ভেঙে বিরাজ নাকি দেখতে পায় মশারীর ঠিক বাইরে রাঙাকাকীমা দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে কি বলবার চেষ্টা করছেন, কিন্তু প্রাণপণ। চেষ্টাতেও তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। কি করুণ, বিধ্বস্ত মুখ রাঙাকাকীমার–বিরাজ কেঁদে ফেলে বলে—কেন বার বার আসছ রাঙাকাকী? কি বলবে? কি কষ্ট তোমার?
উত্তরে রাঙাকাকীমা দুহাতে ধরে রাখা কি একটা জিনিস সামনে বাড়িয়ে দেন।
সে-হাতে ডলপুতুল। কি সুন্দর। ঠিক যেন একটা সত্যিকারের বাচ্চা।
এই সময়ে ছোটকাকীমা জেগে উঠতে রাঙাকাকীমার শরীর যেন গুড়ো গুড়ো হয়ে ঝরে পড়ে গেল।
পরদিন সকালে বাবারা সব ভাই মিলে পরামর্শ সভা বসালেন। আলোচনার বিষয় ছিল এই—বিরাজের বিয়ে হতে চলেছে। বিয়ের পরেও যদি সে এরকম রাত-বিরেতে চেঁচামেচি করে, তাহলে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কি ভাববে? পরে এ নিয়ে মহা অশাস্তির সূত্রপাত হতে পারে। আবার কি একজন রোজা ডাকা হবে? আর কি করা যেতে পারে?
সবার মতামতই রোজা ডাকার দিকে যাচ্ছে দেখে আমার বড় খারাপ লাগল। প্রেতবিতাড়নী মন্ত্র অবশ্যই আছে, কিন্তু বেশির ভাগ পাড়াগেয়ে বুজরুকের দল তার কিছুই জানে না। আমি জানি, কিন্তু রাঙাকাকীমাকে আমরা সবাই খুব ভালোবাসতাম—তাকে তাড়াবার জন্য কোন ক্রিয়া-অনুষ্ঠান করতে কেমন যেন বাধাবাধো ঠেকতে লাগল। তাছাড়া ওই মন্ত্র পাঠ করবার সময় যে আত্মাকে তাড়ানোর জন্য অনুষ্ঠান করা হচ্ছে তার খুব কষ্ট হয়। সে যন্ত্রণার মধ্যে রাঙাকাকীমাকে ফেলতে মন চাইল না। অবশ্য একটা কাজ করা যায়, বিরাজকে একটা কবচ করে দিতে পারি। সেটা হাতে ধারণ করলে কোনো আত্মা ইচ্ছে করলেও ওকে দেখা দিতে পারবে না। যা যা লাগবে যোগাড় করতেও বিশেষ অসুবিধে হবে না। বামাবর্ত শঙ্খের চুর্ণ আর তিনটে কাকের বাসা আছে এমন নিমগাছের শেকড়ের অংশ চাই। তার সঙ্গে মেশাতে হবে—না, তোমাদের কাছে এসব বলা বৃথা! ওই যে কিশোরী হাসছে—
কিশোরী তৎক্ষণাৎ গম্ভীর হয়ে বলল—না না, আমি অবিশ্বাস করে হাসছি না মোটেই। আসলে আপনি মাঝে মাঝে এমন সব জিনিসের নাম করেন, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একেবারেই অপরিচিত—শুনলে হাসি পেয়ে যায়। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, বিরাজের এই ব্যাপারটা সম্বন্ধে আপনার কি মত?
তারানাথ বলল—বিরাজ খুব ভাল মিডিয়াম ছিল। তখন ততটা বুঝতে পারি নি, এখন আন্দাজ করতে পারি। তুলা রাশি, চন্দ্র প্রবল—এমন জাতিকার এটা হতে পারে। হবেই যে এমন কোন কথা নেই—এর ভেতর আরো অনেক প্রভাব কাজ করে, তবে হওয়া সম্ভব। এদের কাছে মৃত আত্মারা সহজেই দৃশ্যমান হয়। ডামরতন্ত্রের নিয়মানুযায়ী কবচ করে দিলে জাতক বা জাতিকার এই গুণ সাময়িকভাবে লোপ পায়। আর বিরাজ যে মিথ্যে বলছে না বা এটা ওর মনের কিংবা চোখের ভুল নয়, তা আমি সহজেই বুঝতে পেরেছিলাম। কারণ তোমরা তো জানো, আমি প্রেতাত্মার অস্তিত্ব টের পাই। বিরাজের সঙ্গে মৃত আত্মার যোগাযোগ আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
বললাম—কি করে বোঝেন? দেখতে পান?
—দেখতে তো পাই-ই, তবে সব সময় দেখবার প্রয়োজন হয় না। আমি গন্ধ দিয়ে বুঝতে পারি—
–কি রকম?
—যেখানে ঘন ঘন আত্মার আবির্ভাব হয় সেখানকার আবহাওয়ায় একটা অদ্ভুত গন্ধ থাকে। অনেক দিনের বন্ধ ঘরের ভেতর যেমন একটা ছাতাধরা ভ্যাপসা গন্ধ পাওয়া যায় সেই রকম। সেই সঙ্গে সমস্ত শরীরে-মনে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়— এটা অবশ্য আমি তোমাদের ভাষা দিয়ে ঠিক করে বোঝাতে পারবো না।
কিশোর বলল—যাই হোক, গল্পটা বলুন। তারানাথ আবার শুরু করল।
–কবচের কথা তুলতেই বাবা বললেন—তুই? তুই আবার কি কবচ দিবি? না না, সে কাজ নেই–
আসলে বাড়ির লোকেরা আমাকে একেবারেই হিসেবের বাইরে রেখেছিল। অপদার্থ, বাড়িপালানো ছেলে, আমাকে দিয়ে কোনো কাজের কাজ হওয়া সম্ভব নয়— এই ধারণা প্রত্যেকেরই।
বললাম—একবার দেখই না, ফল না হলে খুলে ফেলে দিয়ো।
তাও বাবা বোধ হয় রাজি হতেন না, কিন্তু ছোট কাকীমা বললেন—আচ্ছা, ও দিক কবচ, বিশ্বাসেও তো ফল হয়। অনেকে অনেক কিছু করল, একবার ওরটা করে দেখি—
তিন-চার দিনের মধ্যে কবচ তৈরি করে বিরাজের হাতে পরিয়ে দিলাম।
এরপর মাস দুই সেবার বাড়িতে ছিলাম, তার মধ্যে বিরাজ আর কখনো রাঙাকাকীমাকে দেখেনি। বাবা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হলেন—নাঃ, ছেলেটা কিছু বিদ্যে শিখেছে বটে—
গ্রামাঞ্চলে এসব খবর খুব দ্রুত রটে। আমার দেওয়া কবচের গল্প কিছুদিনের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। একদিন বাবা এসে বললেন—দুজন লোক তোকে ডাকছে, বাইরে বসিয়ে রেখেছি। যা—
বাবা দেখি কেমন প্রশংসামিশ্রিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
বাইরের ঘরে এসে দেখি দুজন গেয়ে চেহারার লোক চৌকিতে সঙ্কুচিত হয়ে বসে আছে। ময়লা ধুতি, ফর্সা জামা—তাতে আবার কাচবার সময় বেশি নীল পড়ে গিয়েছে।