একটু পরেই বাইরে উঠোন থেকে বিরাজের গলার চিৎকার ভেসে এল, পর পর দুবার। কাকীমারা দৌড়ে গেলেন, বারবাড়ি থেকে কাক-জ্যাঠারা ছুটে এলেন। তুলসীমঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে বিরাজ। পায়ের কাছে মাটিতে প্রদীপটা পড়ে আছে, তেল ছড়িয়ে পড়েছে উঠোনে।
-–কি রে, কি হয়েছে? আমন চেঁচিয়ে উঠলি কেন?
বিরাজ কাঁপা-কাঁপা আঙুল তুলে রাঙাকাকার ঘরের দিকটা দেখিয়ে বললরাঙাকাকীমাকে দেখলাম। ওইখানটায় দাঁড়িয়েছিল—
সবাই চুপ। বিরাজ মিথ্যে বলবে না, আর তার বিশেষ অপ্রাকৃত ক্ষমতার ব্যাপারটা এখন প্রায় একটা প্রমাণিত সত্য। তবু বাবা একবার বললেন—যাঃ কি যাতা বলছিস? অন্ধকারে ভুল দেখে থাকবি
—না জেঠু, আমি ঠিক দেখেছি। সাদা কাপড় পরা ছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলল, তারপর আবার ঢুকে গেল ঘরে—
-ঘর থেকে বেরিয়ে এল? বাবা এগিয়ে গিয়ে রাঙাকাকার ঘরের দাওয়ায় উঠে। দরজায় লাগানো তালা টেনে দেখলেন তা কি করে হবে? এই তো তালা বন্ধ রয়েছে।
বুঝিয়েসুঝিয়ে বিরাজকে ঠাণ্ডা করে ভেতরে নিয়ে আসা হল। তখনকার মত চাপা পড়ে গেলেও এরপর থেকে বিরাজ ঘন ঘন রাঙাকাকীমাকে দেখতে শুরু করল। কখনো একেবারে পরিষ্কার দিনের বেলায়। কাকীমা যেন বিরাজকে কি বলছেন। মা জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কি বলে কিছু বুঝতে পারিস?
–না জেঠিমা। মুখ নাড়ছে দেখতে পাই, কথা কানে আসে না। তবে একটা জিনিস–
–কি?
–কাকীমার খুব কষ্ট বলে মনে হয়।
–কি করে বুঝলি? কথা তো শুনতে পাস না—
-মুখ দেখতে পাই যে! খুব ব্যথা পেলে যেমন মুখ হয় সেইরকম—
ছোটকাকা গিয়ে কোথা থেকে এক ভূতের রোজা ডেকে আনলেন। লোকটাকে দেখে আমার আদেী শ্ৰদ্ধা হল না। তখন আমি একটু বড় হয়েছি, গ্রামে সাধুসন্ত এলে সেখানে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকি, লোক চেনবার ক্ষমতা সামান্য হয়েছে। ভূতের রোজা ঘণ্টাদুয়েক ধরে উঠোনে নানান বিচিত্র ক্রিয়াকলাপ করল, মাটিতে খড়ি দিয়ে নকশা একে তার ওপর শ্বেতসরষে আর আতপচাল ছিটিয়ে চিৎকার করে মন্ত্র পড়তে লাগল। কিন্তু ওই পর্যন্তই—সে দক্ষিণা নিয়ে বিদায় হবার পর সেদিন বিকেলেই বিরাজ আবার রাঙাকাকীমাকে দেখতে পেল। দালানের একদিকে রান্নাঘর, সেখানে মা উনুনে আঁচ দিচ্ছেন আর বিরাজ মেঝেতে বসে বিকেলের তরকারীর জন্য কুটনো কুটছে, এমন সময় বিরাজ দেখল লম্বা দালান বেয়ে কাকীমা হেঁটে চলে যাচ্ছেন। বিরাজ চেঁচিয়ে উঠল—ওই, ওই যে কাকীমা যাচ্ছে!
মা কাজ ফেলে ছুটে এসে দেখলেন বিরাজ একদৃষ্টে দালানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে— দেখতে পাচ্ছ না জেঠিম? ওই তো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে! হাতে আবার একটা কি জিনিস রয়েছে। ওমা, একটা ডলপুতুল!
মা, বলা বাহুল্য, দালানের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলেন না।
—হাতে কি রয়েছে বললি?
—ডলপুতুল। সেই ছোটবেলায় যেমন তুমি আমাকে কিনে দিয়েছিলে।
—ডলপুতুল হাতে কোনো এক মৃতার প্রেতাত্মা বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একথা কল্পনা করা কষ্টকর, কিন্তু বিরাজ কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে ঠিকই—নইলে হাতে পুতুল থাকার মত সুক্ষ্ম মিথ্যা বিরাজের পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব নয়।
এরপর ছোটকাকা আর একজন ভাল রোজা আনবার প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু এবার বিরাজ নিজে বারণ করল—না বাবা, গুণিন এনে না—
—কেন রে?
-রাঙাকাকীমা আমাকে কত ভালবাসত, মরে গিয়ে কি আমার ক্ষতি করতে চাইবে? হয়ত আমাকে ভুলতে পারেনি বলে আমার কাছে আসে
দিন কাটতে লাগল! মাস দুই-তিন হয়ত কিছু হল না, আবার একদিন বিরাজ কাকীমাকে দেখতে পায়। মানুষের মন বড় বিচিত্র জিনিস, কালে সবই খাপ খেয়ে যায়। বিরাজের রাঙাকাকীমাকে দেখতে পাওয়াটাও একটু একটু করে সকলের গাসওয়া হয়ে এল।
প্রথম যৌবনে পা দিয়েই আমি বাড়ি থেকে পালালাম গুরুর খোজে, সে গল্প কিছুটা তোমরা জানেনা। তান্ত্রিকসাধনার দিকে খুব মন গিয়েছিল। প্রকৃত গুরুর সন্ধানে কোথায় কোথায় না ঘুরেছি। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আসি, আবার কিছুদিন পরে উধাও হই। এই সময়েই মাতু পাগলীর সঙ্গে আমার পরিচয়। সে বড় সাংঘাতিক মেয়েমানুষ, আমাকে দীক্ষা দেয়নি বটে, কিন্তু কতগুলো ক্ষমতা দান করেছিল। তারপর বরাকর নদীর ধারের শালবনে সেই মধুসুন্দরী দেবীর আবির্ভাব। তিনিও আমাকে বীজমন্ত্র এবং কতগুলি শক্তি দান করেন। তারই প্রসাদে জীবনে কখনো বড় কোনো বিপদে পড়তে হয়নি, ডালভাত খেয়ে যাহোক করে চালিয়ে দিয়েছি। আমি বড়দরের সাধক হতে পারিনি হে, কয়েকটা সাধারণ সিদ্ধাই পেয়েছিলাম মাত্র!
একবার বাড়ি ফিরে দেখলাম, বিরাজের বিয়ের তোড়জোড় হচ্ছে। ভাল একটা সম্বন্ধ এসেছে গোয়াড়ী-কৃষ্ণনগর থেকে। ছেলের বাপ-মায়ের বিশেষ দাবি-দাওয়া কিছু নেই, মেয়ে দেখে তাদের খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছে। এখন কেবল দিনক্ষণ ঠিক করবার যা দেরি। বিরাজ দেখতেও সত্যি খুব সুন্দর হয়েছে। মাথায় বেশ লম্বা, ফর্সা ধপধপ করছে গায়ের রঙ, একঢাল কালো কোকড়ানো চুল, টানা টানা চোখ-এ মেয়ের বিয়েতে খরচ না হবারই কথা।
আমি থাকতে-থাকতেই একদিন পাত্রপক্ষ এসে বিরাজকে আশীর্বাদ করে পাকা কথা দিয়ে গেল। পাত্রের বাবা মানুষটি ভারি অমায়িক, গোলগাল চেহারা, মুখে সব সময় হাসি লেগে রয়েছে। গ্রামদেশে পাত্রের বাবার সাধারণত একটা দাম্ভিক চালচলন থাকে, এ ভদ্রলোকের সে-সব নেই। বেশ হেসে হেসে গল্প করলেন, বিরাজকে পাশে বসিয়ে মা আমার যেন লক্ষ্মী বলে গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। আশীর্বাদ করলেন দশভরির সেকেলে পাকা সোনার সুষনিপাতা হার দিয়ে। কথা রইল এক বছর পর সামনে বৈশাখে বিয়ে হবে। ওঁদের কি পারিবারিক আচার অনুযায়ী পাত্রের বয়েস জোড়সংখ্যক বছরে না হলে বিয়ে হয় না। সামনের বছর ছেলের বয়েস হবে চব্বিশ।