আমাদের বাড়িতেই কাকীমা চতুর্থীর শ্রাদ্ধ করলেন। তারপর রাঙাকাকা তাকে নিয়ে চলে গেলেন শ্বশুরবাড়ি। যাবার আগে রাঙাকাকীমা বিরাজকে কোলে নিয়ে আদর করে গেলেন, বললেন—লক্ষ্মী হয়ে থাকবি, কেমন? আমি ক’দিন বাদেই চলে আসব, তোকে কত গল্প বলব—
রাঙাকাকা আর কাকীমাকে বাড়ির সবাই খুব ভালবাসতো, সেকথা তো আগেই বলেছি। তাদের এই সম্পত্তিপ্রাপ্তির ঘটনায় সবাই খুশি হল।
মাসদেড়েক পর একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা ভাইবোনেরা দুধ-মুড়িগুড় দিয়ে জলখাবার খাচ্ছি রোয়াকে বসে, এমন সময় বিরাজ আমার মাকে বলল— জেঠিমা, কাল রাত্তিরে রাঙাকাকীমা কখন এসেছে? দেখছি না তো?
মা অবাক হয়ে বললেন—কই, সে তো আসেনি। কে বলল তোকে?
—কেউ বলেনি, আমি দেখেছি।
মায়ের মুখ শুকিয়ে গেল। বিরাজকে আর কোনো কথা না বলে সোজা বাবাকে গিয়ে জানালেন। বাবা ভেতরবাড়িতে এসে বিরাজের গায়ে হাত বুলিয়ে আদরের স্বরে বললেন-কি হয়েছে মা? রাঙাকাকীমার ব্যাপারে কি বলছিলি?
কাল রাত্তিরে রাঙাকাকীমা এসেছিল তো! আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, দেখলাম কাকীমা ঘরে ঢুকে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল, তারপর আবার বেরিয়ে গেল। আমার সঙ্গে কথা বলল না কেন জেঠু?
-তুই স্বপ্ন দেখেছিস, বৌমা তো আসেনি
বিরাজ আপত্তি করে বলল—না জেঠু, স্বপ্ন না! আমি যে পরিষ্কার দেখলাম। কেমন সুন্দর লালপাড় নতুন শাড়ি পরেছিল, আর কি সিঁদুর দিয়েছে মাথায়, বাব্বাঃ! চুল সব সিঁদুরে মাখামাখি!
বাবা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়ে বললেন—এই চুপ চুপ–কি দেখতে কি দেখেছিস ঘুমের ঘোরে—বাজে বকিস না।
বিরাজের কথাটা কিছুক্ষণের মধ্যে বাড়ির মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে গেল। মা-কাকীমারা উদ্বিগ্নমুখে পরামর্শ করতে বসলেন। একজন পুরুষমানুষ কেউ গিয়ে খোজ করে এলে। ভাল হয়। সবাই ভাল আছে নিশ্চয় ঠাকুরের কৃপায়, তবু দেখে এলে ক্ষতি কি?
পরদিন বিকেলে মেজকাকা যাবেন বলে প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। কিন্তু তাকে আর রওনা দিতে হল না, পরের দিন সকালবেলা রাঙাকাকা স্বয়ং এসে উপস্থিত হলেন। শেষরাত্তিরের ট্রেনে নেমে হেঁটে এসেছেন। চুল উসকোখুসকো, পা খালি, গালে খোচা খোচা দাড়ি—চোখ বসে গিয়েছে গর্তে। বাড়ির দাওয়ায় বসে দু’একবার ফ্যালফ্যাল করে এদিক-ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন—দাদা, আপনার বৌমাকে রেখে এলাম।
মাত্র তিনদিনের জ্বরে মারা গিয়েছেন রাঙাকাকীমা—আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে। কয়েকদিন আচ্ছন্নের মত ছিলেন রাঙাকাকা, একটু ধাতস্থ হয়ে গতকাল রওনা দিয়েছেন।
আরও শোনা গেল। পুজোয় পরবেন বলে কাকীমাকে একখানা ভাল লালপাড় শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন রাঙাকাকা। শেষযাত্রার সময় সেইটে পরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পাড়ার মেয়েরা এসে সিঁদুরের কৌটো উপুড় করে দিয়েছিল মাথায়। বাংলার সীমান্তে একটি অখ্যাত শহরের ক্ষুদ্র নদীর তীরে রাঙাকাকীমার নশ্বর দেহ ছাই হয়ে গিয়েছে।
কাকীমার মৃত্যুতে আমাদের বাড়ির সকলে প্রকৃতই শোক পেলেন। কিছুদিন সবারই মুখ বিষণ্ণ, বাড়িতে কেউ উঁচু গলায় কথা বলে না, হাসে না। কিন্তু সব শোকের তীব্রতাই সময় চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে। পৃথিবীর নিয়মই এই যাকে না হলে জীবন কাটানো অসম্ভব বলে মনে হয়, সে সরে গেলে হঠাৎ আবিষ্কার করা যায় তাকে বাদ দিয়েও দিব্যি চলে যাচ্ছে! একদিন আবার সংসারের চাকা ঠিকঠাক চলতে শুরু করল, মাঝে মাঝে হাসির শব্দও শোনা যেতে লাগল।
একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন কেবল রাঙাকাকা। যে মানুষ হাতে কাজ না থাকলে ছটফট করত, সে সারাদিন বসে আছে ঘরের রোয়াকে। চোখ দুটো উদাস, দীপ্তিহীন। মুখে একটাও কথা নেই। খাওয়ার সময় জোর করে ডেকে নিয়ে যেতে হয়। সংসারের কোনো ব্যাপারে কোনো উৎসাহ নেই। বাবাই তোড়জোড় করে রাঙাকাকীমার বাপের বাড়িটা বিক্রি করে টাকা নিয়ে এসে কাকাকে জিজ্ঞাসা করলেন—এ টাকা দিয়ে কি করতে চাও?
রাঙাকাকা চুপ করে রইলেন।
–চুপ করে থাকলে তো চলে না বিশু। কপালে যা ছিল তো হয়েছে। এ ন্যায্যত তোমার টাকা, তোমাকেই ব্যবস্থা করতে হবে।
রাঙাকাকা মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে বললেন—টাকা দিয়ে আমি আর কি করব? আপনি যা ভালো বোঝেন করুন। আপনি যা করবেন তাতে আমার কোনো অমত থাকবে না—
-তাহলে আমি বলি কি, এ টাকা তুমি বৌমার নামে কোনো হাসপাতালে বা আশ্রমে দান করো—বৌমার আত্মা তৃপ্তি পাবে।
শাস্তভাবে রাঙাকাকা বললেন–বেশ তো, তাই করুন।
সব বিলিব্যবস্থা হয়ে যাবার পর একদিন সকালে উঠে দেখা গেল রাঙাকাকার ঘরের দরজা খোলা, তিনি নেই!
এমন একটা কিছু ঘটবে সবাই আন্দাজ করতে পেরেছিল। কিছুদিন ধরে। খোঁজাখুঁজি চলল, বাবা বোধ হয় কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়ে থাকবেন, কিন্তু রাঙাকাকা আর কোনোদিন ফিরে এলেন না।
বছর ঘুরে এল। রাঙাকাকা আর কাকীমার স্মৃতি পরিবারের সবার মনে একটা বেদনার চিহ্ন হিসেবে রয়ে গিয়েছে। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর মেয়েদের মজলিশে প্রায়ই এ প্রসঙ্গ ওঠে। বাড়ির মাঝখানের উঠোনের পশ্চিমদিকে রাঙাকাকার ঘরখানা কেউ ব্যবহার করে না। বন্ধই পড়ে আছে।
এই উঠোনের মাঝখানে ছিল ইট দিয়ে বাঁধানো তুলসীমঞ্চ। কোনোদিন মা, কোনোদিন কাকীমাদের মধ্যে কেউ সন্ধ্যেবেলা তুলসীমঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে আসতেন। একদিন কিভাবে গল্পে গল্পে কারো আর প্রদীপ দেবার কথা মনে পড়েনি। অন্ধকার বেশ গাঢ় হতে হঠাৎ মেজকাকীমা বললেন—ওই যাঃ, তুলসীতলায় আলো দেখানো হয়নি তো! আমার আবার হাত জোড়া। যা তো মা বিরাজ, একটা প্রদীপ জ্বেলে তুলসীতলায় দিয়ে আয়