কাকীমা বললেন—এখন তো ঘরে আলু নেই মা, ভাতও চড়ে গিয়েছে। ও-বেলা হাট থেকে রামু এনে দেবে এখন, রাত্তিরে খেয়ো—
মায়ের বকুনির ভয়ে বিরাজ চুপ করে গেল। কিন্তু একটু পরেই রান্নাঘর থেকে রাঙাকাকীমা এসে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছোটকাকীমাকে বললেন—বাবাং, এতক্ষণে একটু সময় পাওয়া গেল। ভাত নামিয়ে ফেন গালতে দিয়ে এলাম। আচ্ছা ছোড়দি, ভাতে আজ অত আলুসেদ্ধ কে দিয়েছে বলতে পারো? কে খাবে?
ছোটকাকীমা অবাক হয়ে বললেন—আলুসেদ্ধ? ভাতে? আমি তো দিইনি!
—সে কি! তাহলে কে দিল? হাতা দিয়ে ভাত নাড়ছি, দেখি ভাতের মধ্যে গিজগিজ করছে আলু। তা, দশ-বারোটা তো হবেই।
আবার হৈ-চৈ হল। এবারেও কর্তারা অনেক যুক্তিসহ ব্যাখ্যা দিলেন। কিন্তু মনের ধাঁধা কারোরই ঘুচল না। বাড়িতে আলু ছিল না, হাট অন্তত দুমাইল দূরে। মেয়েটা আলু পাবে কোথায় যে ভাতের হাড়িতে ফেলবে?
এর পরের ঘটনার কিন্তু আর কোন ব্যাখ্যা দেওয়া চললো না। সবারই মনে হল। বিরাজের একটা কিছু অপ্রাকৃত ক্ষমতা আছে বটে।
ছোটকাকা বৈষয়িক কি কাজে সদরে গিয়েছিলেন। দুতিনদিন উকিলের বাড়ি থেকে কাজ সেরে ফিরবেন। কাক সদরে যাবার দুদিন বাদে এক বিকেলে খুব ঝড়বৃষ্টি হল। ঝড় থেমে গিয়েও বৃষ্টি চলল রাত প্রায় নটা পর্যন্ত। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস দিতে লাগল, বাড়ির সবাই তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়লেন। বিরাজ সে রাত্তিরে শুয়েছিল রাঙাকাকীমার কাছে। অনেক রাত্তিরে, তখন বোধ হয় একটা কি দেড়টা হবে, রাঙাকাকীমা হঠাৎ জেগে গিয়ে দেখলেন, বিরাজ বিছানা থেকে নেমে যাচ্ছে। কাকীমা অবাক হয়ে বললেন—এই বিরাজ, যাচ্ছিস কোথায়?
বিরাজ প্রথমটা উত্তর দিল না, মশার তুলে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজার কাছে চলে গেল। রাঙাকাকীমা দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে ধরলেন।
-এই কি হয়েছে তোর? কথা বলছিস না কেন?
বিরাজের চোখ ঈষৎ বিস্ফারিত, যেন কিছু দেখতে বা শুনতে পাচ্ছে না। কাকীমা জোরে বাকুনি দিয়ে বললেন—কি হয়েছে বল?
সেইভাবেই শক্ত হয়ে তাকিয়ে থেকে বিরাজ বলল—দরজা খুলে দাও, বাবা এসেছে–
বিরাজের রকম-সকম দেখে ভয় পেয়ে রাঙাকাকীমা চিৎকার করে ছোটকাকীমাকে ডাকলেন। সেই ডাকে বাড়ির প্রায় সবাই উঠে এল। সবাইয়ের একই প্রশ্ন—কি হয়েছে? আমন করছিস কেন?
বিরাজ কেবল বলে—দরজা খুলে দাও, বাবা দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?
শেষে বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন—চল দেখি কেমন তোর বাবা এসেছে—বাবা এলে ডাকত না?
বাইরের দরজা খুলে দেখা গেল কেউ কোথাও নেই। রাত্তির ঝিমঝিম করছে। ততক্ষণে বিরাজেরও সেই ভাবলেশহীন শূন্যদৃষ্টি কেটে গিয়ে সে একটু স্বাভাবিক হয়েছে। সবাই মিলে তাকে বকবকি করে দরজা বন্ধ করতে যাবে, হঠাৎ দেখা গেল বাড়ি থেকে কিছু দূরে আমবাগানের মধ্যে কিসের আলো। কাদের যেন গলার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে। বাবা হেঁকে বললেন—কে? কে আসে রে?
ছোটাকাকার গলায় উত্তর এল—দাদা, আমি–
ছোটকাকাই বটে। সদর থেকে রওনা দিয়ে মাঝপথে ঝড়বৃষ্টিতে পলাশপুরের মোড়লের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা না খাইয়ে ছাড়েনি। সঙ্গে লোকও দিয়েছে।
বাড়ির সবাই জড়ো হয়েছে দরজার কাছে, তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছোটকাকা বিস্মিত কণ্ঠে বললেন—কি হয়েছে দাদা? এত রাত্তিরে সবাই জেগে যে?
বাবা বললেন-কিছু না, তুই ভেতরে আয়—
এবারে কিন্তু বেশি আলোচনা হল না। বিরাজের ক্ষমতার ব্যাপারটা বাড়ির লোকেরা একরকম মেনেই নিল। হয়ত পর পর কয়েক মাস কিছুই না, হঠাৎ একদিন বাবা বাড়ি থেকে বেরুচ্ছেন—যাবেন আমার জ্যাঠতুতো বোনের বিয়ের বাজার করতে, তাকে বিরাজ বলল— জেঠু, আজ তুমি কোথাও যাবে না
-কেন রে, কেন যাব না?
–না, তুমি যাবে না!
বাবা অবশ্য তা সত্ত্বেও বেরুচ্ছিলেন, মা আটকে দিয়ে বললেন–থাক, আজকের দিনটা থেকেই যাও। বিরাজের ব্যাপারটা তো জানোই।
অগত্যা বাবা থেকে গেলেন। দুদিন পর খবর পাওয়া গেল যে ট্রেনে বাবার যাওয়ার কথা ছিল সে ট্রেন বর্ধমান ছাড়িয়ে কি একটা ছোট স্টেশনে ঢোকার মুখে উলটে গিয়েছে। বহু লোক হতাহত হয়েছে।
বাবা একবার বিরাজকে আলাদা ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন—হ্যাঁরে, এই যে তুই। অনেক কথা আগে থেকে বলে দিতে পারিস, কি করে জানতে পাস বল তো?
বিরাজ চুপ করে ছিল। শেষে বাবা এক ধমক লাগাতে সে কেঁদে ফেলে বললআমি সত্যি কিছু জানি না জেঠু। আমি কিছু বলি না, আমার মুখ দিয়ে কে যেন অমনি বলে—
বিরাজ কেঁদে ফেলায় বাবা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন-আচ্ছা আচ্ছা, যা এখন কাঁদছিস কেন? কাঁদার মত কি বলেছি?
এর কিছুদিন পরে খবর এল রাঙাকাকীমার বাবা মারা গিয়েছেন। কাকীমার মা ছিলেন না, ছোটবেলা থেকে বাবার কাছেই মানুষ। যে ভদ্রলোক খবর দিতে এসেছিলেন তিনি বললেন মারা যাবার আগে উইল করে কাকীমার বাবা তার সম্পত্তি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। কাকীমার ভাগে পড়েছে বসতবাড়িটি। ছেলেরা দূরে দূরে নানা জায়গায় কাজকর্ম করে। তারা কোন দিনই আর দেশে ফিরবে বলে মনে হয় না। এ অবস্থায় মেয়ে-জামাইয়ের এখুনি গিয়ে বাড়ির দখল দেওয়া উচিত, নইলে বেদখল হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে।
রাঙাকাকা সবার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। ঠিক হল ওই বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় রাঙাকাকা এখানে কিছু জমিজমা কাকীমার নামে কিনবেন। তবে উইলের প্রােবেট নেওয়া, খদের যোগাড় করা এবং বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করা ইত্যাদির জন্য কাকা-কাকীমাকে হয়ত দুতিন মাস সেখানে গিয়ে থাকতে হবে।