কিশোরী স্পষ্টত উসখুস করতে লাগল। বাইরে ঝঙ্কম বৃষ্টি নেমেছে, ঘরের ভেতরে ঘন হয়ে উঠেছে ছায়া। মনে হচ্ছে যেন আমরা তিনটে প্রাণী ছাড়া জগতে আর কেউ কোথাও নেই। এখন কি আর দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা ভালো লাগে?
এই সময়েই ভেতরবাড়ি থেকে চা নিয়ে এল তারানাথের মেয়ে চারি। চায়ে চুমুক দিয়ে তারানাথ বলল—তোমাদের গল্প চাই, না? আচ্ছা, আজ একটা অদ্ভুত ঘটনা তোমাদের শোনাচ্ছি। আমারই পরিবারের একটি মেয়ের জীবনে ঘটেছিল। একদিনের ব্যাপার নয়, অনেকদিন ধরে একটু একটু করে ঘটেছে। পান খাবে? না? যাক, গল্পটা শোন তবে।
পাসিং শো ধরিয়ে তারানাথ গল্প শুরু করল।
তোমরা তো জানো আমি একান্নবর্তী পরিবারে মানুষ হয়েছি। দুবেলা আমাদের বাড়িতে প্রায় পঞ্চাশখানা পাত পড়ত। আপন কাক-জ্যাঠারা তো ছিলেনই, বাবার এক দূর সম্পর্কের ভাইও আমাদের সংসারে থাকতেন। আমরা ভাইবোনেরা তাকে রাঙাকাকা বলে ডাকতাম। রাঙাকাকা লেখাপড়া বিশেষ জানতেন না, বোধ হয় ক্লাস থ্রি কি ফোর অবধি পড়েছিলেন। কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে পারতেন। সকাল থেকে দেখতাম তিনি কোদাল হাতে বাড়ির পেছনের জমি কুপিয়ে লাউ-কুমড়োর চারা বসাচ্ছেন, নয়তো কুড়ল নিয়ে সংসারের জ্বালানী কাঠ চিরে দিচ্ছেন। তীর অবসর সময় বলে কিছু ছিল না, সব সময়েই কিছু না কিছু করছেন। সবাই রাঙাকাকাকে ভালবাসত তার মধুর ব্যবহারের জন্য।
আমার ছোটবেলাতেই রাঙাকাকার বিয়ে হয়। তখনকার দিনে পাত্রের বড় চাকুরে বা ব্যবসায়ী হবার দরকার হত না, যাহোক খাবার সংস্থান থাকলেই চলত। তাছাড়া বাবা-কাকারা বোধ হয় কয়েক বিঘে জমি রাঙাকাকার নামে লিখে দিয়েছিলেন। তার ফসলে দুটি প্রাণীর না চলার কথা নয়।
রাঙাকাকীমা বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বাড়ির সকলের মন জয় করে নিলেন। কোন অহঙ্কার ছিল না চরিত্রে, সবার কাজ আগবাড়িয়ে করে দিচ্ছেন, সর্বদা হাসিমুখ। উঁচু গলায় কথা বলতে জানেন না। এমন মানুষকে কে না ভাল বাসবে? বাংলাবিহারের একেবারে প্রান্তে একটি ছোট্ট শহরে তার বাপের বাড়ি। বোধ হয় দূরে ভিন্ন পরিবেশে মানুষ হয়েছিলেন বলেই পাড়াগার সংকীর্ণতা রাঙাকাকীমার মধ্যে ছিল না। সবচাইতে তিনি ভালবাসতেন আমার ছোট ভাইঝি বিরাজবালাকে। বিরাজ তখন খুবই ছোট, বছর পাঁচ-ছয় বয়েস হবে। সেও কাকীমার বিষম ভক্ত হয়ে পড়ল। কাকীমার কাছে খায়, তার সঙ্গেই দুপুরবেলা শুয়ে গল্প শোনে। সারাদিন কাকীমার আঁচল ধরে পেছন পেছন ঘোরে। কাকীমা বলতেন—বিরাজ আরজন্মে আমার মেয়ে ছিল—
এর বছর দুই তিন পর থেকে বিরাজকে কেন্দ্র করে আমাদের পরিবারে কতগুলো অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। বিরাজের মধ্যে যে কোনো বিশেষ অলৌকিক ক্ষমতা আছে এমন ধারণা কারো মনে আসেনি কোনো দিন–আসবার কথাও নয়। পাড়াগায়ের নিতান্ত স্বাভাবিক আরপাঁচটা মেয়ের মতই তার চালচলন। কিন্তু বিরাজের আট-ন বছর বয়েসের একটা ঘটনায় আমাদের হঠাৎ খটকা লাগে। প্রথমটা অবশ্য ঠিক বোঝা যায়নি, কারণ সব অলৌকিক ব্যাপারেরই নানারকম ব্যাখ্যা হতে পারে। কিন্তু পর পর তেমন ঘটতে থাকলে তাকে আর যুক্তি দিয়ে বা কাকতালীয় ব্যাপার
বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিরাজ আমার ছোটকাকার মেয়ে। একদিন ছোটকাকীমা ঠাকুরের আসনের সামনে বসে পুজো করছেন, বিরাজ বসে রয়েছে পাশে। কাকীমা পুজো আরম্ভ করবার আগে বিরাজ একবার বলল—মা, আমার না খুব তালের বড়া খেতে ইচ্ছে করছে, বিকেলে করে দেবে মা?
কাকীমা রাগ করে বললেন—বকিস নে তো! যা ওঠ এখান থেকে—বসে পুজো করছি, আর মেয়ের এটা খাবো সেটা খাব—পুজোর সময় বুঝি অমন বলে?
ধমক খেয়ে বিরাজ চুপ করে মায়ের পাশে বসে রইল। পুজো হয়ে যাবার পর ছোটকাকীমা যখন গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে উঠেছেন, তখন বিরাজ আবার বলল—হাঁ মা, দেবে তো বিকেলে তালের বড়া করে?
—সে দেখা যাবে, এখন যা–মেয়েদের খাইখাই করতে নেই।
ঠাকুরঘর ছেড়ে আসবার সময় হঠাৎ কাকীমার খেয়াল হল গৃহদেবতা শ্যামসুন্দরের মূর্তির সামনে শ্বেতপাথরের বড় গেলাসের জল আজ বদলে দিতে ভুলে গিয়েছেন। মনে মনে জিভ কেটে কাকীমা জল বদলাবার জন্য গেলাসটা নামিয়ে পাথরের ঢাকনাটা খুললেন।
এ কি! জল কই? গেলাসটা ভর্তি তালের বড়া! সদ্য ভাজা, তখনো গরম রয়েছে।
এ নিয়ে সেদিন খুব হৈ-হৈ হয়েছিল। হবারই কথা। বন্ধ ঠাকুরঘর, কাকীমাই সকালে প্রথম খুলে পুজো করতে ঢুকেছেন, সেই বন্ধঘরে গেলাসের মধ্যে তালের বড়া আসবে কোথা থেকে? কেউ কেউ বলল—বিরাজই হয়তো আগে থেকে গেলাসে বড়া লুকিয়ে রেখেছিল মজা করবে বলে। সে যুক্তিও পুরোপুরি খাটে না। প্রথমত অত সকালে তাকে তালের বড়া ভেজে দেবে কে? দ্বিতীয়ত ঠাকুরের আসনে হাত দেবার সাহস তার হবে না। সেযুগে এসব মানামানি খুব ছিল, জানো তো? সবারই মনে কেমন একটা খটকা লেগে রইল।
এর মাসখানেক বাদে হল আর এক কাণ্ড।
সেদিন সকালে বিরাজ হঠাৎ বায়না ধরল—ও মা, আজ দুপুরে আমি আলু ভাতে দিয়ে ভাত খাব।
আজকাল শুনতে হয়তো একটু অদ্ভুত ঠেকবে, আলুভাতে এমন কি একটা জিনিস, যার জন্য বায়না করতে হবে? কিন্তু তখনকার দিনে পাড়াগায়ে আলু রীতিমত দুপ্তপ্রাপ্য তরকারী হিসেবে গণ্য ছিল। লোকের বাড়িতে সব সময় মজুত থাকত না, অনেকে খেতও না। হাটের দিনে কেউ কেউ শখ করে কিনে আনত।