সকাল হবার আগেই নিবারণ রায় মর্গ্যানকে নিয়ে পৌঁছলেন। শেষরাতের ট্রেনে এসেছেন।
স্ট্যানলি মর্গান রোগী দেখে বললেন—বোধ হয় পেরিটোনাইটিস। যদি র্যাপচারড় হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে ছেলে বাঁচবে না। নইলে একটু সুস্থ হলেই কলকাতা নিয়ে গিয়ে অস্ত্র করাতে হবে—
পরের কথা সংক্ষেপে বলি। সন্তু বেঁচে উঠেছিল। আমাদের সবার মিলিত প্রার্থনার জোরেই হোক, বা অম্বিকাভূষণের অনুতাপে ঈশ্বর দয়া করার জন্যই হোক—সন্তু তিনদিনের দিনে একটু ভাল হয়ে উঠল। ডাক্তার মর্গান নিজে তার অপারেশন করেন। সে ভাল হয়ে ওঠে। দুই ভাইয়ের ঝগড়াও চিরকালের জন্য মিটে যায়। কিন্তু তান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অপরের ক্ষতি করতে গিয়ে মানুষ নিজের কি বিপদ ডেকে আনে দেখলে তো? বোধ হয় ভগবানই অম্বিকাভূষণকে একটু শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন। নইলে সামান্য বাতাসের চিহ্ন নেই কোথাও, অথচ অমন হবে কি করে!
কিশোরী বলল—সে তান্ত্রিকের কি হল?
—সে পরের দিনই লোটা-কম্বল নিয়ে কাউকে না বলে ভেগেছিল। প্রাণের ভয় সবারই আছে তো—
কিশোর বলল—সন্তুর অসুখের ব্যাপারটা কাকতালীয়ও তো হতে পারে?
তারানাথ কড়া চোখে তাকিয়ে বলল—পাষণ্ড কোথাকার! আর যদি কখনো তোমাদের গল্প বলেছি!
০৬. আকাশে মেঘ করে এলে
কবি কালিদাস বলে গিয়েছেন আকাশে মেঘ করে এলে মানুষের চিত্ত আকুল হয়ে ওঠে। আমি কবি নই, তবে আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এলে আমার তারানাথের কাছে যেতে ইচ্ছে করে বটে। বর্ষার দিনে মুড়ি আর গরম গরম তেলেভাজার মত তারানাথের গল্পও একটা আবশ্যিক ব্যাপার।
আজ ছুটির দিনটা সকাল থেকেই মনে হচ্ছিল হয়তো বা বৃষ্টি হবে। আকাশ ঘোলা, রোদুরের তেমন তেজ নেই। দুপুরের পরেই কালো মেঘে চারদিক অন্ধকার হয়ে এল। এমন সময়ে বাড়িতে বসে থাকার কোন মানে হয় না। বিশেষ করে কোলকাতায় বৃষ্টি মোটেই একটা উপভোগ্য জিনিস নয়। আলনা থেকে একটা শার্ট টেনে নিয়ে গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম বৃষ্টি এসে পড়ার আগে হয়তো তারানাথের বাড়িতে পৌঁছতে পারবো না। কিন্তু মট লেনের মুখে পৌঁছে দেখলাম তখনো মেঘ আকাশে থমকে আছে। গলির মোড়ের সিগারেটের দোকান থেকে তারানাথের জন্য এক প্যাকেট পাসিং শো নিচ্ছি, পেছন থেকে কে বলে উঠল—এই যে, তুমিও এসে পড়েছ দেখছি!
তাকিয়ে দেখি কিশোরী। সে একগাল হেসে বলল—যাই বলো ভাই, লোকটার গল্প বলার একটা দারুণ কায়দা আছে। একেবারে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে, কি বলো?
বললাম—তুমি তো তারানাথের গল্প বিশ্বাস করো না, তাহলে আসো কেন?
—কে বলল বিশ্বাস করি না?
–গল্পের মধ্যে কেবল বাগড়া দাও, আজেবাজে প্রশ্ন করো—
-আরে, ওসব তো তারানাথকে উসকে দেবার জন্য। চটে গেলে ওর ভালো ভালো গল্পগুলো বেরিয়ে আসে। চল, চল—আর দেরি নয়। ওই দেখ, জল এসে পড়ল বলে—
প্রায় দৌড়ে তারানাথের বাড়িতে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। সারাদিনের গুমোট ভাবটা কাটিয়ে এলোমেলো ঠাণ্ডা বাতাস বইতে আরম্ভ করল। বসবার ঘরে ঢুকে দেখি তারানাথ আমাদের দিকে পেছন ফিরে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। কলকাতার গলি, সেদিকে অবশ্য দেখবার কিছুই নেই, হাততিনেক তফাতেই ঠেলে উঠেছে পাশের বাড়ির দেয়াল। তবু তারানাথ দেখলাম বিভোর হয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে।
আমাদের পায়ের শব্দে সে পিছন ফিরে বলল—এই যে তোমরা এস এস, বোসো। ভাবছিলাম তোমরা হয়তো এসে পড়বে। এমন দিনটা–
সবাই মিলে সেই নড়বড়ে তক্তাপপাশে বসলাম। কিশোরী আমার হাত থেকে নিয়ে সিগারেটের প্যাকেট তারানাথের সামনে রাখল। অন্যমনস্কভাবে একটা সিগারেট ধরিয়ে তারানাথ বলল—খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ছিল, জানো? এইরকম মেঘ করে এলে গ্রামের সব ছেলেমেয়ে মিলে দৌড়াতাম আমবাগানে। ঝড়ের প্রথম ঝাপটা আসার সঙ্গে সঙ্গেই ঢ়িবঢ়াব আম পড়তে শুরু করত। আম কুড়তে কুড়োতে আসত বৃষ্টি। এক কোচড় আম নিয়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতাম। এই আজকের মত বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ত, সোদা মাটির গন্ধ উঠত চারদিক থেকে। বৃষ্টি থামলে বাড়ি গিয়ে তেল নুন দিয়ে কাচা আম জরিয়ে খাওয়া। আর কিছু না, শুধু কাচা আম তাই যেন কি মধুর মত লাগত। নাঃ, সে-সব দিন আর ফিরবে না।
কিশোর দেখল তারানাথের কবিত্বের চোটে যে গল্পের জন্য আসা সেটাই বুঝি মারা যায়! সে বলল—আপনার পুরনো অভিজ্ঞতা থেকেই আজ একটা গল্প বলুন না—
-বলবো, বলবো। আগে একটু চা হোক—
তারানাথ উঠে ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এল। তারপর তক্তাগপাশে জমিয়ে বসে বলল—কলকাতায় বর্ষার রূপ তোমরা দেখতে পাও না। আমরা গ্রামের ছেলে, বুঝলে? খালবিল ভাসিয়ে একনাগাড়ে তিন-চারদিন বাদলা হওয়ার পর কখনো গামছা দিয়ে কই মাছ ধরতে বেরিয়েছ? আমরা যেতাম। তারপর বাড়ি ফিরে একবাটি নুন নিয়ে বসে সারা গা থেকে জোঁক ছাড়াতাম। মা এসে বকুনি দিতেন বৃষ্টি মাথায় করে বাইরে বেরুনোর জন্য। আঃ, আবার শিশু হয়ে মায়ের সেই বকুনি খেতে ইচ্ছে করছে। জীবনে অনেক দুঃখকষ্ট আছে, বুঝলে হে? তবু মোটের ওপর জীবনটা বেশ ভালই কেটেছে। যদি সুযোগ পাই তাহলে আবার ফিরে আসব পৃথিবীতে। আবার আম কুড়োতে যাব ঝড়ের দিনে, খেলা করব মায়ের কোলে—সুখ-দুঃখ সহ্য করতে করতে বড়ো হয়ে উঠব—