বিরজা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। তারপর নিজের বিপদ সম্বন্ধে কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—আবিদ শেখ তাহলে সত্যি কথাই বলেছিল।
বললাম—তা বটে।
বিরজা বলল—আমি তাহলে এখন কি করবো?
–বললাম তো, যোগাড়যন্ত্র করে দে—কাল সকালেই স্বস্ত্যয়ন করে দিই।
—তাতে আমার বিপদ কেটে যাবে? ওদের পুজোর ফল ফলবে না?
বিরজার কথার কোনো উত্তর দিতে না পেরে চুপ করে রইলাম।
তার খুলে বিরজার চোখ মুখ কেমন হয়ে গেল। আমি আর জ্ঞানানন্দ একসঙ্গেই জিজ্ঞাসা করলাম—কি হয়েছে? কি খবর?
বিরজা আমার দিকে তারটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল—দাদা করেছেন। পড়ে দেখ
পড়ে দেখলাম। অম্বিকাভূষণেরই করা তার বটে। বিশেষ কিছু লেখা নেই। শুধু বলা হয়েছে—অবিলম্বে ফিরে এস। বাড়িতে বিপদ।
বিরজার দিকে তাকিয়ে বললাম—কি বিপদ বলে মনে করিস?
–-তা কি করে বলব? কিছু তো বলা হয়নি। তাছাড়া দাদা হঠাৎ—যার জন্য এত কাণ্ড। আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে—
জ্ঞানানন্দ বুদ্ধিমান মানুষ, বিরজার কথার ধাচে বুঝলেন কোথাও কোনো গোলমাল আছে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন—আচ্ছা, আমি তাহলে যাই—একটু কাজ আছে। কি ঠিক করেন জানাবেন আমাকে।
তিনি চলে যেতে বললাম—কি করবি?
বিরজা বলল—চল ফিরি। নিশ্চয় কিছু গুরুতর হয়েছে। নইলে দাদা তার করতেন না। ট্রেনে আসতে সমস্ত পথ বিরজা বলল-রক্তের টান, বুঝলি? দাদা ভুল বুঝতে পেরে আমাকে আবার ডেকেছে।
আমি তার কথার উত্তর দিই নি তখন। কারণ হঠাৎ আমার মনের মধ্যে আবার সেই পুরনো অমঙ্গলের ধ্বনি বেজে উঠেছে। যেন অবিলম্বে একটা অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। এর ওপর বিরজাকে আর কিছু বলে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। কিন্তু আমি জানি কিছু একটা ঘটবেই, বা ঘটছে। আমার এ অনুভূতি মিথ্যা হয় না।
হলও তাই।
গরুর গাড়ি নিয়ে স্টেশন থেকে একেবারে অম্বিকাভূষণের বাড়ির সামনে গিয়ে নামা হল। মালপত্র গাড়িতেই রেখে আমরা ঢুকলাম বাড়িতে।
চারদিকে কেমন একটা থমথমে ভাব। বাইরের ঘরে কেউই নেই। বিরজা অন্দরের দিকে পা বাড়াবে, এমন সময় স্বয়ং অম্বিকাভূষণ এসে ঘরে ঢুকলেন। বিরজা নিচু হয়ে তার পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে বলল—কি হয়েছে দাদা? তার করেছ। কেন?
উত্তরে অম্বিকাভূষণ ভাইকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।
-কি হয়েছে দাদা? আমন করছ কেন?
–সন্তুর খুব অসুখ বীরু, আর বুঝি রাখা যায় না—
সন্তু অম্বিকাভূষণের বড় ছেলে। বিরজা অবাক হয়ে বলল—কি হয়েছে সন্তুর?
অম্বিকাভূষণ কপালে আঘাত করে বললেন—সব আমার দোষ, আর কারো কোনো পাপ নেই ভাই। আমার নিজের দোষেই আমি পুত্রশোক পেতে চলেছি—
—আহা, শান্ত হও দাদা। সব ঠিক হয়ে যাবে। অস্থির হয়ো না—
বিরজার স্ত্রী তক্ষুনি অন্দরে চলে গিয়ে সন্তুর পায়ের কাছে বসল। আমার বুদ্ধিই বোধ হয় কিছু স্থির ছিল। আমি দুই ভাইকে ধরে বসালাম। বললাম—কি হয়েছে খুলে বলুন তো—
অম্বিকাভূষণ কাদছিলেন, বিরজা পাশে বসে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। বেশ দৃশ্যটা। দুই ভাইয়ের বিবাদ বিপদের স্রোতে ভেসে গিয়েছে।
আমার প্রশ্ন শুনে অম্বিকাভূষণ মুখ তুলে তাকালেন। বললেন—নিজের মুখে স্বীকার করলে পাপের বোঝা হালকা হয়। তাই কোনো কিছু না লুকিয়েই বলছি। বীরু, তোর সর্বনাশ করার জন্য আমি এক তান্ত্রিকের পরামর্শে শ্বেতবগলার পুজো করেছিলাম। সে পুজোয়–
আমি বললাম-এ অংশটা বাদ দিয়ে বলুন। এটা আমি আগেই টের পেয়ে বিরজাকে বলেছি।
অম্বিকাভূষণ একবার আমার দিকে তাকালেন, তারপর বললেন—ও, জানতেন তাহলে! যাই ব্যাটা তান্ত্রিক এ কাজটা আমাকেই করতে বলল। কি আর বলব, তখন শয়তান আমার বুদ্ধি কেড়ে নিয়েছিল। এই সময় বীরুও কাশীতে। বাড়ি ফাকা। কাজেই আমিও ভাবলাম সুবিধেই হল। অমাবস্যার দিন প্রায় সারারাত্তির পুজো হল। হোম শেষ হতে হতে শেষরাত্তির। কলাপাতায় মুড়ে খানিকটা ছাই আমার হাতে তুলে দিয়ে তান্ত্রিক বলল—যাও। সাবধান, অন্য কোথাও যেন না পড়ে। তাহলেই সর্বনাশ!
তখনো ভোর হতে দেরি আছে। বীরুর বাড়ির পাঁচিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতে আমার কলাপাতায় মোড়া হোমের ছাই। পাচিল ডিঙিয়ে সেটা সবসুদ্ধ ছুড়ে ফেলতে যাব ওর বাগানে, কি বলব মশাই, একটু মেঘ নেই বা ঝড়ের চিহ্ন নেই কোথাও—অথচ প্রচণ্ড একটা বাতাসের ঝাপটা এল কোথা থেকে! ততক্ষণ আমিও সেটা ছুড়ে দিয়েছি হাত থেকে। আমার চোখের সামনে বাতাসের মুখে উড়ে গিয়ে তা পড়ল আমারই বাড়ির উঠোনে! তখুনি দৌড়ে গিয়ে উঠোন থেকে সবটুকু ছাই নিকিয়ে তুলে নিলাম। কিন্তু তাতে কি আর পাপ যায়! গত পরশু থেকে সন্তু বাবা আমার কেবলই রক্তবমি করছে—
বিরজা ব্যস্ত হয়ে বলল—কোন ডাক্তার দেখছে?
—কোনো ডাক্তার কি বাকি আছে? বিকেলেই সদর থেকে বড় ডাক্তার এসেছিলেন। নিবারণ কলকাতা গিয়েছে মর্গান সাহেবকে আনতে। কাল সকাল নাগাদ। এসে পৌঁছবে মনে হয়।
বিরজা উঠে পড়ে বলল—চল দাদা ভেতরে, সন্তুকে দেখি গিয়ে।
বললাম-আমি একবার যেতে পারি কি?
অম্বিকাভূষণ বললেন—হ্যাঁ হ্যাঁ, আসুন না।
তারপর বিরজার হাত দুটো ধরে বললেন—ভাই, আমি যা করবার তো করেই ফেলেছি। তুই কোনো রাগ পুষে রাখিস না। তুই আমার সন্তুকে আশীর্বাদ কর—
বিরজা কেঁদে ফেলে বলল—অমন করে বলছ কেন দাদা? সন্তু আমার নিজের ছেলের মতন–