বাড়ির লোক খোঁজাখুঁজি করবে এবং সন্ধান পেলেই ধরে নিয়ে যাবে বাড়িতে। এজন্য সারাদিনই প্রায় হাঁটতাম, যতটা দূরে গিয়ে পড়া যায়। রাত্তিরে আশ্রয় নিতাম কোন গৃহস্থের বাড়িতে। তখনকার লোকজন ছিল ভাল। অভাব ছিল না, গোলাভর্তি ধান, পুকুরভর্তি মাছ নিজের গরুর দুধ। অতিথিকে যত্ন করতে সে যুগের লোক ক্রটি করত না। অব্রাহ্মণ গৃহস্বামী হলে গোয়ালঘরের একপাশ পরিষ্কার করে রান্নার আয়োজন করে দিত। সেখানে বসে রাধতাম। তারা আবার অপেক্ষা করত ব্রাহ্মণের প্রসাদ পাবার।
কিশোরী প্রশ্ন করল, জিনিসপত্রের দাম তখন কি রকম ছিল?
তারানাথ বলল, গায়ের দিকে বেশির ভাগ জিনিসই কিনে খেতে হত না। সবই তো গ্রামেই উৎপন্ন হত। তবে হ্যাঁ, মনে আছে একবার আমি আর আমার বন্ধু হরমোহন মাংস খাবার শখ হওয়ায় পাশের গ্রাম থেকে দশ আনা দিয়ে একটা পাঠা কিনে এনে দুজনে রান্না করে খেয়েছিলাম। তাও হরমোহন বার বার বলছিল আমরা ঠকেছি, আর একটু দরাদরি করলে আট আনার ভেতরেই হয়ে যেত।
আমি অবাক হয়ে বললাম, দশ আনায় একটা আস্ত পাঁঠা?
–বটেই। সে-সব সস্তাগণ্ডার বাজার তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।
—দুজনে মিলে গোটা পাঁঠাটা খেয়ে ফেললেন?
-তা পারব না কেন? গাঁয়ের ছেলে, আমাদের খিদেও ছিল আর অম্বলের ব্যামোতেও ভুগতাম না। আমার খাওয়ার কথা আর কি শুনছ? আমার বাবার খাইয়ে হিসেবে দশটা গায়ের মধ্যে নামডাক ছিল। সে গল্প বলব এখন পরে একদিন।
কিশোরী বলল, হ্যাঁ, যে গল্প হচ্ছিল সেটা হোক।
তারানাথ বলতে শুরু করল।
এভাবে কিছুদিন ঘুরে বেড়িয়ে বিরক্তি ধরে গেল। রোজ রোজ অকারণে পথ হাটা, লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া, তাদের দাক্ষিণ্যে ভাল ভাল খাওয়া—শুধু খাওয়ার জন্যই কি বাড়ি থেকে বেরিয়েছি? বাড়িতে কি আমার ভাতের অভাব ছিল? কিন্তু যা চাই তা পাই কই?
যাই হোক, পথ হেঁটে ক্লান্ত অবস্থায় একদিন সন্ধ্যেবেলা এক গ্রামে এসে পৌঁছলাম। গ্রামটায় ঘনবসতি নেই, একটু ছাড়া ছাড়া বাড়িঘর। আম-জাম বাঁশবাগানে ভরা। একটা বড় আমবাগানের পাশে কাদের বেশ সুন্দর বাড়ি দেখে সেখানেই আশ্রয় নেব ভাবলাম। সুন্দর বলতে পাকা বাড়ি নয়, পোড়ো চালের বড় বড় আট-দশখানা ঘর মাঝখানে উঠোনকে ঘিরে। বিরাট উঠোনে ধানের গোলা, একপাশে গোয়ালে ক’খানা গরু সাজালের ধোয়ার মধ্যে বসে বসে জাবর কাটছে। আমি উঠোনে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মধ্যে শাঁকে ফুঁ পড়ল। সব মিলিয়ে সম্পন্ন গৃহস্থের লক্ষণ ফুটে বেরুচ্ছে।
উঠোনে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, একজন কালোমত মধ্যবয়স্ক লোক এগিয়ে এসে বলল, কি চাই?’
বললাম, আমি বিদেশী লোক, রাত্তিরটা একটু থাকবার সুবিধে হবে কি?
—আপনারা?
–ব্রাহ্মণ।
লোকটা আসুন আসুন করে ব্যস্ত হয়ে আমায় নিয়ে দাওয়ায় বসাল, পা ধোয়ার জল দিল। তার নাম মাধব ঘোষ, সে-ই বাড়ির মালিক। চাষ-বাস আছে প্রায় পঞ্চাশ বিঘের। মাধব লোক বেশ ভাল, আমাকে রান্নার ব্যবস্থা করে দিয়ে সে ঠায় বসে রইল সামনে। বসে গল্প করে, আর একটু বাদে বাদে হুকো-টিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, সাজুন, ব্রাহ্মণের প্রসাদ পাব।
কথায় কথায় আমি বললাম, আমাদের বাংলাদেশের আতিথেয়তা বড় সুন্দর, না? এই যে তুমি আমাকে এত যত্ন করছ, এতে তোমার লাভ কি?
জিভ কেটে মাধব বলল, আজ্ঞে ও কথা বলবেন না। ব্রাহ্মণ-দেবতার হাড়িতে দুটি চাল দিতে। পারছি—সে তো আমার সৌভাগ্য। তবে কথা কি জানেন, সব অতিথি তো আবার সমান হয় না—এই তো, দিন সাতেক আগে আমাদের বাড়িতে সে এক কাণ্ড।
ধোয়া সুগন্ধি আতপচাল হাড়িতে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে ফিরে বললাম, কেন, কি হয়েছিল? চুরি-টুরি নাকি?
-–তাহলে তো বরং ছিল ভাল। শুনুন না কাণ্ড। এই ঠিক গেল সোমবার বিকেলের দিকে এক লাল কাপড় পরা সন্নোসী এসে বলে তোমার এখানে থাকব। আমার সাদা মনে কাদা নেই, বললুম—থাকুন। গোয়ালঘরে রান্নার ব্যবস্থা করে দিলুম। দিব্যি চেহারা তার—ফর্সা রঙ, এই মোটা পৈতের গোছা, দেখে কিছু বোঝবার উপায় নেই।
নিঃশেষিত কলকেটি উপুড় করে তামাকের গুল ঝেড়ে কলকেটি একপাশে রেখে মাধব বলল, সে রাত্তিরে কিছু হল না। পরের দিন সকালে সন্ন্যেসী যাওয়ার সময় আমাকে বললে—কাল যে মেয়েটি রান্নার জিনিসপত্র এগিয়ে দিচ্ছিল, সে তোমার কে হয়?
আমি বললাম–আমার মেয়ে। কেন বলুন তো?
তারপর, কি বলব আপনাকে, সন্ন্যেসী যা বলল তা শুনে তো নিমেষে আমার। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছে। বলে কি, তোমার ওই মেয়েটি আমাকে দাও, আমি ভৈরবী করব। ওর শরীরে ভৈরবীর চিহ্ন রয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তারপর?
মাধব ঘোষ বলল, তারপর আর কি, আমার চেচামেচিতে পাড়ার লোক জড় হয়ে গেল। বললুম, যাও ঠাকুর, ব্রাহ্মণ বলে শুধু পার পেয়ে গেলে। নইলে মাধব ঘোষের মেয়ের দিকে নজর দিয়ে এ গ্রাম থেকে আর বেরুতে হত না। সন্ন্যেসী আমার দিকে কম করে তাকিয়ে যাবার সময় বলে গেল, কাজটা ভাল করলি না, তোর মেয়ে উদ্ধার হয়ে যেত। প্রতিফল হাতে হাতে পাবি।
আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম, বললাম, বল কি হে, এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার! লোকটা আর আসেনি তো?
মাধব ঘোষ হেসে বলল, আর তার আসতে সাহস হবে না। সন্ন্যেসী হলেও প্রাণের মায়া তো আছে।
মাধব ঘোষের যত্নের সত্যি তুলনা নেই। খাওয়া যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, একটা বড় জামবাটিভর্তি দুধ এনে সে একটু দূরে নামিয়ে রাখল। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, আবার দুধ কেন?