অন্ধকার বেশ চেপে আসছে দেখে বাড়ি ফেরবার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে নজর পড়ল ওপাশের সেই বাবলা গাছটার দিকে। গাছের নিচে একটু ঝোপমত, তার মধ্যে কি যেন নড়ছে!
প্রথমে বেশ ভয় পেয়েছিলাম। এদিককার গ্রামে সন্ধের দিকে এখনো বুনো শুয়োর বেরোয়। শখ করে হাওয়া খেতে এসে শেষে বুনো শুয়োরের হাতে পড়লাম নাকি? শুয়োর বড় পাজী জানোয়ার, অকারণেই তেড়ে এসে দাঁত দিয়ে পেট চিরে দেয়।
না, শুয়োর নয়।
আমার পায়ের আওয়াজ পেতেই বোধ হয় ঝোপের মধ্যে থেকে একজন উঠে দাঁড়াল।
অম্বিকাভূষণের বাড়িতে দেখা সেই তান্ত্রিক সন্ন্যাসী। তার হাতে কতগুলো শেকড়বাকড়।
লোকটা তীব্র জ্বলন্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় পৃথিবীতে সব আলো-হাসি-গান ফুরিয়ে গিয়েছে। যেন কাল সকালে আর সূর্য উঠবে না এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমি মারা যাব। তোমরা হলে সেই চাউনিতেই তোমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসত। কিন্তু আমি তারানাথ, আমারও জীবন কেটেছে ভয়ানক সব সাধকদের সঙ্গে মেলামেশা করে। তারা সত্যিকারের সাধক। আর এ লোকটাকে দেখেই বুঝতে পারলাম এর কিছু ক্ষমতা আছে বটে, কিন্তু সে নিম্নশ্রেণীর ক্ষতি করার ক্ষমতা। সেটা বুঝেই মনে জোর পেলাম।
লোকটা আমার দিকে তাকিয়েই আছে। আমি তার চোখে চোখ রেখে বললামকি, শ্বেতসরষে যোগাড় হল?
মুহূর্তের মধ্যে তার মুখে বিস্ময়, ক্রোধ ইত্যাদি কয়েকটা অভিব্যক্তি খেলে গেল। আমার দিকে এক পা এগিয়ে এসে অদ্ভুত কর্কশ গলায় বলল—তুমি কি করে জানলে?
আবার বললাম—কাকের বাসা তো আগেই সংগ্রহ হয়েছে, নিমপাতা কি কালকে। পাড়া হবে, না পরশু পরশুই তো অমাবস্যা, তাই না?
সে কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে, প্রত্যেকটি কথা গরম লোহার মত বিধিয়ে দিয়ে বলল—ওঃ, তুমি জেনেছ তাহলে? তাই তোমাকে দেখে সেদিন আমার—আমিই বোকা, আমার আগে বোঝা উচিত ছিল।
তারপরেই তার চোখ আবার দপ করে জ্বলে উঠল। মাথাটা সামনে ঝুঁকিয়ে সে বলল—কিন্তু বিশেষ কিছু লাভ হবে না। এক সাধকের অভিচার ক্রিয়ায় বাধা দেওয়া নিয়মবিরুদ্ধ, জানো তো? দিয়েও সুবিধে করতে পারবে না। আমার যা করবার তা করবই। বাধা দিলেও লাভ হবে না। আমার ক্রিয়ার ফল হবেই।
বললাম—দেখা যাক।
সে কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে, ‘বেশ, দেখ তাহলে বলে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল।
খুব মন খারাপ নিয়ে বিরজার কাছে ফিরলাম। আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি এসব সাধকদের ভালো করার ক্ষমতা না থাকুক, ক্ষতি করবার শক্তি খুবই থাকে।
কিশোরী হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল—কিন্তু আমরা যে অন্ধকারে রয়ে গেলাম। আপনি কি ভাবে দুইয়ে দুইয়ে চার করলেন, বললেন না?
তারানাথ হেসে বলল—তাও তো বটে। গল্প বলতে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম যে তোমরা এসব ব্যাপার কিছুই জানো না। আচ্ছা, বলি শোন। প্রথমে নদীর ধারের বাবলা গাছ থেকে কাকের বাসাটা অদৃশ্য হয়ে যাওয়াতে আমার মনের ভেতরে টনক নড়ে ওঠে। তোমাদের এ জিনিসটা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না। বহু অভিজ্ঞতায়, শ্মশানে-মশানে ঘুরে একটু একটু করে এটা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কখনো মুণ্ডমালাতন্ত্র অথবা হংসপারমেশ্বর নামে কোনো বইয়ের নাম শুনেছ?
আমি আর কিশোরী বললাম—না।
তারানাথ বলল—সেই বইয়ে শ্বেতবগলা নামে এক দেবীর উল্লেখ রয়েছে। তার পুজো করে তারপর উচাটন ক্রিয়া করতে হয়। কারুর ক্ষতি করবার জন্য যে তান্ত্রিক ক্রিয়া, তার নাম উচাটন। অমাবস্যার দিন ছাড়া শ্বেতবগলার পুজো হয় না। ঘোড়া আর মোষের রক্ত মিশিয়ে কালি তৈরি করতে হয়। তারপর কাকের পালকের কলম দিয়ে যার সর্বনাশ করতে চাও তার নাম একটা নিম পাতার ওপর ওই রক্ত দিয়ে লিখতে হবে। লেখার সময় একটা মন্ত্র উচ্চারণ করতে হয়, সেটা তোমাদের বলব না। এরপর ষোড়শোপচারে শ্বেতবগলার পুজো করে হোম করতে হবে। যজ্ঞের সমিধ হচ্ছে সাধারণত বেলকাঠ বা জগডুমুরের কাঠ। কিন্তু এই যজ্ঞ করতে হয় কাকের বাসার সরু সরু কাঠি দিয়ে। প্রত্যেকটি কাঠি যজ্ঞের আগুনে দেবার আগে শ্বেতসরষের তেলে ভিজিয়ে নিতে হয়। পূর্ণাহুতি দেবার সময় ওই শত্রুর নাম লেখা নিমপাতাটি যজ্ঞের আগুনে দিলেই কাজ শেষ। এবার আগুন নিভে গেলে যজ্ঞকুণ্ড থেকে কিছুটা ভস্ম তুলে শত্রুর বাড়িতে নিক্ষেপ করলে কয়েকদিনের মধ্যেই তার ভয়ঙ্কর সর্বনাশ উপস্থিত হবে।
বললাম—কি ভয়ানক!
–ভয়ানকই বটে। সেই জন্যেই বিরজার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম!
রাত্তিরে বাইরের ঘরে বসে গল্প করতে করতে বিরজা বলল—তোকে এরকম দেখাচ্ছে কেন রে? শরীর খারাপ নাকি?
-নাঃ! শোন ভূষণ, কাল একটা পুজো করব ভাবছি। ফর্দ করে দেব, কতকগুলো জিনিস আনিয়ে দিস তো। রাত্তিরে পুজো হবে।
—পুজো! কিসের পুজো?
–এমনিই। তোর সময়টা ভালো যাচ্ছে না, ভাবছি একটা স্বস্ত্যয়ন গোছের করে দেব।
বিরজা বোকা নয়। সে উঠে এসে আমার হাত দুটো ধরে বলল—কি ব্যাপার বল। দেখি? আমায় ভোলাবার চেষ্টা করিস না। যদি কিছু বুঝে থাকিস আমাকে বল— আমার কি কোন বিপদ আসছে?
ভেবে দেখলাম বিরজার কাছে আসল ঘটনা লুকিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং তৈরি থাকলে ও যাই আসুক না কেন, তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারবে।
আমি বিরজাকে সব খুলে বললাম।