শৈশবের স্মৃতিমণ্ডিত কোনো জায়গায় অনেকদিন পরে গেলে যে আনন্দ অনুভব করা উচিত, সেরকম খুব একটা হল না। কারণ গ্রামে ঢুকতেই আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। তোমরা তো জান, দেবী আমাকে কিছু অতিমানবিক ক্ষমতা দান করেছিলেন। গ্রামে ঢুকেই আমার মনে হল—এখানে একটা অমঙ্গলজনক কিছু ঘটছে। সেটা কি, তা তখনই বুঝতে পারলাম না বটে, কিন্তু মনের ভেতর কেমন অস্বস্তি পাক খেতে লাগল।
বিরজা জিজ্ঞাসা করল—কি হয়েছে? অমন মুখ করে রইলি কেন?
বললাম—কিছু না। এমনি।
বিরজার বৌটা ভারি ভালো, বেশ সাধবী মেয়ে। আমাকে আগে কখনো দেখেনি বটে, কিন্তু হাবভাব দেখে বুঝতে পারল আমি তার স্বামীর খুব বড় বন্ধু। চড়ুইটিপ গায়ে এখনো শহরে চালচলনের ঢেউ এসে দোলা দেয়নি। সেকালের মত একটা জলভর্তি গড়র ওপরে পাটকরা গামছা এনে রেখে গেল বিরজার বৌ। হাতমুখ ধুয়ে দুই বন্ধু বাইরের ঘরে তক্তাপপাশে বসে গল্প করতে লাগলাম। সবই আমাদের সেই রঙিন হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার গল্প।
গল্প করছি, কিন্তু পোকায় খাওয়া দাতের ব্যথা যেমন সর্বদা সব কাজের মধ্যে জানান দেয়, তেমনি মনের ভেতরকার অস্বস্তিটাকে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারলাম না। বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমার এ অনুভূতি সচরাচর ভিত্তিহীন হয় না। এ গ্রামে কোথাও একটা খারাপ কিছু ঘটছে। কি সেটা?
আমি অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছি দেখে বিরজা ভাবল আমি বোধ হয় ক্লান্ত। সে গল্পে ক্ষান্ত দিয়ে উঠে খাওয়ার কতদূর দেখতে গেল।
পরের দিন খুব ভোরে উঠে আমি আর বিরজা নদীর ধারে বেড়াতে গেলাম। ছোট গ্রাম্য নদী, কিন্তু কচুরিপানায় তার স্রোত বন্ধ হয়ে যায়নি। বেশ কাকচক্ষু জল ধীরগতিতে বয়ে চলেছে। সকালের স্নিগ্ধ হওয়ায় শরীর জুড়িয়ে যায়। একটু পরিষ্কার জায়গা দেখে দুজনে বসলাম। আমার বাঁ-পাশে একটা বড় বাবলা গাছ। তার ডালপালা অনেকখানি জলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। গুঁড়ি থেকে কিছু ওপরে এক জায়গায় তিনটে মোটা ডাল তিন দিকে বেরিয়েছে। সেখানে একটা কাকের বাসা। কাকের বাচ্চা হয়েছে বোধ হয়। মা-কাক বসে বাচ্চা পাহারা দিচ্ছে, আর বাবা-কাক একটু বাদে-বাদেই কি মুখ করে এনে বাচ্চাদের খাইয়ে যাচ্ছে। ওপারে চাষীরা জমিতে লাঙল দেবার উদ্যোগ করছে। গ্রামে এত সকালেই দিন শুরু হয়ে যায়। শহরে অর্ধেক লোক বোধ হয় এখনো বিছানা ছেড়ে ওঠেনি।
খোলা জায়গা, বেলা বেশি না হলেও রোদুর ওঠার পর আর বসা গেল না। বিরজা বলল—চল উঠি। মমতা খাবার করে বসে আছে এতক্ষণ–
ফেরবার সময় আগে পড়ে অম্বিকাভূষণের বাড়ি। দেখলাম একজন প্রৌঢ় মানুষ, পরনে খাটো ধুতি, বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, গলায় একছড়া মোটা রুদ্রাক্ষের মালা–বসে বসে তামাক খাচ্ছেন। সেদিকে না তাকিয়ে বিরজা চুপিচুপি বলল—ওই আমার দাদা।
অম্বিকাভূষণ আমাদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। আমরা বাড়ির সামনে দিয়ে পার হয়ে যাবার আগেই ভেতরবাড়ি থেকে একজন লাল কাপড় পরা সন্ন্যাসী গোছের চেহারার লোক বেরিয়ে এসে অম্বিকাভূষণের পাশে বসে একবার আমাদের দিকে তাকাল। বিশ্রী দৃষ্টি লোকটার। মাথায় সামান্য জটাও আছে। নিম্নশ্রেণীর তন্ত্রসাধকের মত চেহারা। জায়গাটা পার হয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—ওই লোকটা কে রে? বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল? তোর দাদার গুরু নাকি?
পেছন ফিরে একবার দেখে বিরজা বলল—নাঃ, দাদা মন্ত্র নেয়নি। তবে সাধুসন্নিসি করার খুব বোক। মঝে-মাঝেই এমন দু’চারটেকে এনে পোষে। এ ব্যাটাকে দেখছি আজ কয়েকদিন যাবৎ। কিছুদিন শুষে চলে যাবে আর কি!
দুপুরে দুজনে বৈঠকখানায় বসে কথাবার্তা বলছিলাম। বহুদিন পরে শহর থেকে বাইরে বেরিয়ে যেন হাপ ছেড়ে বেঁচেছি। কোলাহল নেই, লোকজনের ঝামেলা নেই, রোজ সকালে বাজার থেকে শুটকো তরকারি আর আধপচা মাছ কিনে আনবার তাড়া নেই। এখানে সকালবিকেল শুধু খাচ্ছি আর বৈঠকখানায় বসেই তামাক খেয়ে আড্ডা দিচ্ছি। পরিবেশও বেশ শাস্ত। বেড়াতে বেরুলে মেঠো পথ, বাশঝাড়ের নুয়ে পড়া ডগার ওপরে বসে পাখির গান—মনে হয় এসব ছেড়ে এতদিন ছিলাম কি করে?
কথায় কথায় হঠাৎ বিরজা বলল—তারানাথ, তুই তো আজকাল শহরে থাকিস, আমার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা করা যায় না?
বুঝতে না পেরে বললাম—কিসের ব্যবস্থা?
–ওসব দিকে আমার একটা চাকরি হয় না?
হেসে বললাম—তুই চাকরি করবি কি রে! তোর বংশে কেউ কোনোদিন পরের কাজ করেনি। আর তাছাড়া সেরকম কারো সঙ্গে আমার পরিচয় নেই–
বিষণ্ণমুখে বিরজা বলল—মনে হচ্ছে দাদার সঙ্গে এই মামলায় আমি পেরে উঠব। যদি জিতি তাহলে সর্বস্বান্ত হয়ে যাব। তখন তো চাকরি ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না ভাই।
এ কথার আর কি উত্তর দেব? চুপ করে বসে রইলাম।
রাত্তিরবেলা গরমে ঘুম আসছিল না। এই দুদিন বিরজার বাড়িতে থাকাকালীন মনের এই অস্বস্তির ভাবটা কিন্তু দূর হয়নি। রাত্তিরে শুয়ে এ ব্যাপারে ভাববার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারলাম না।
সকালে বিরজা আর আমি নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়া একটা অভ্যেস করে ফেলেছিলাম। আসশেওড়ার ডাল ভেঙে দাঁতন করতে করতে আমরা ভোরবেলা রওনা দিলাম নদীর দিকে। একেবারে স্নান করে তবে ফিরবো।
সারারাত গুমোট গরমের পরে সকালে স্নিগ্ধ নদীজলে অবগাহন যে কি তৃপ্তির সে তোমরা শহরের মানুষেরা কি বুঝবে! জলে নেবে ডুব দিয়ে পরে মাথা তুলে দেখলাম যেখানে দাঁড়িয়ে ডুব দিয়েছিলাম, সেখান থেকে বেশ কিছুটা সরে এসেছি। বিরজা হেসে বলল—আমাদের ছোট নদী হলেও বেশ স্রোতের টান আছে, কি বল?