যাক এসব কথা। একদিন বসে আছি এই বৈঠকখানা ঘরে। সময়টা সকাল। আগের দিন এক ব্যাটা মাড়োয়ারীকে কোন শেয়ার ধরে রাখলে লাভ হবে বলে দিয়ে বেশ কিছু নগদ লাভ করেছিলাম। পড়তির মুখেও আমার কথায় ভরসা করে সে শেয়ার ধরে রেখে দেয়। পরের দিন মাঝরাতে বম্বে থেকে ট্রাঙ্ককল পায়—ওই শেয়ারের দর হঠাৎ বাড়তির দিকে। সাত দিনে কয়েক লাখ টাকা মুনাফা করে গতদিন সে এসে বেশ মোটা প্রণামী দিয়ে গিয়েছে। মনটা বেশ ফুর্তিফুর্তি লাগছে। এমন সময় দরজার কাছে একজন লোক এসে দাঁড়াল। পরনে ধুতি আর টুইলের শার্ট, পায়ে পাম্পশু। বয়েস আমারই মত হবে। আমাকে দেখে লোকটা বলল—আচ্ছা, এটা কি বললাম—আজ হাত দেখা হবে না।
-–তারানাথ কার নাম?
লোকটা তারানাথবাবু’ বা ঠাকুরমশাই’ বলল না দেখে তার অভদ্রতায় নিতান্ত চটে গিয়ে বললাম—আমারই নাম। কেন, কি চাই?
লোকটা কাছে এসে একটু সামনে ঝুঁকে ভাল করে আমাকে দেখে বলল—হ্যাঁ, তাই বটে। তুই তো তারানাথ। আমাকে চিনতে পারছিস না?
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে সে বলল—অবশ্য তোরই বা দোষ কি? সে কি আজকের কথা? চিনতে পারলি না? আমি বিরজাভূষণ—বিরজাভূষণ তালুকদার।
আরো কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকবার পর আমার মনে পড়ে গেল। আমাদের ইস্কুল-জীবনের সেই ভূষণ! পেছনের বেঞ্চিতে বসত, আর অনর্গল পকেট থেকে ডাশা পেয়ারা বের করে চিবোতো। তার পুরো নাম বিরজাভূষণই তো ছিল। বটে।
আমি তক্তাপোশ থেকে উঠে তার হাত ধরে বললাম—মাপ কর ভাই, সত্যিই প্রথমটা চিনতে পারিনি। কবেকার কথা সব! চেহারাও একেবারে বদলে গিয়েছে। তারপর কি খবর বল? বোস—
বিরজা চৌকিতে বসে বলল—খবর ভালই। রাজাগজা কিছু হইনি, কিন্তু বেশ কেটে যাচ্ছে, বুঝলি? তুই কেমন আছিস বল—
সংক্ষেপে বললাম—ভালই। আমারও কেটে যাচ্ছে।
-–শুনলাম তুই নাকি নামকরা জ্যোতিষী হয়েছিস; লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে নাকি ভাগ্য বলে দিস? কলকাতায় এসে ভাবলাম তোর সঙ্গে দেখা না করে যাব না।
—বেশ করেছিস। থাক না আমার কাছে ক’দিন।
বিরজা মাথা নেড়ে বলল—থাকা হবে না। আজকের রাতটা হয়তো থাকব, কিন্তু কাল সকালেই রওনা দিতে হবে।
রাত্তিরে খাওয়াদাওয়া সেরে দুই বন্ধু বাইরের ঘরের চৌকিতে এসে বসলাম। ঘুম আর হল না, গল্প করতেই রাত ফুরিয়ে গেল।
বিরজাভূষণ কলকাতায় এসেছিল একটা মামলার তদারক করতে। ওদের সমস্ত সম্পত্তি বাবা মারা যাবার পর দু ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। এক ভাগ পেয়েছে বিরজা, অন্য ভাগ পেয়েছে তার আপন দাদা অম্বিকাভূষণ। দাদাকে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নিজে একটু দূরে আলাদা বাড়ি তৈরি করে নিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি ভাগাভাগির ব্যাপারে কি একটা ক্রটি বের করে অম্বিকাভূষণ ভাইয়ের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেছেন। যে সম্পত্তি নিয়ে মামলা, তার মূল্য বিশ হাজার টাকার চেয়ে বেশি। কাজেই মামলা এসেছে হাইকোর্টে। এ নিয়ে অনেক দুঃখ করল বিরজা। দেখলাম ওর সেই পুরনো দিনের ভালমানুষী এখনো যায়নি। যে দাদা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, তার জন্যই সে দুঃখ করছে।
পরের দিন যাবার সময় বিরজা বলল—একবার আমাদের গায়ে চল না, বেড়িয়ে আসতে পারবি। দেশের দিকে যাসও না অনেকদিন। যাবি?
কথাটা ঠিক। গ্রামে আমাদের বাড়িও প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে পড়েছে। থাকার বা দেখাশুনো করবার কেউ নেই। কাজেই কিসের টানে আর সেখানে যাব? অবশ্য। বিরজার বাড়ি আমাদের গ্রামে নয়, মধ্যে আর একটা গ্রাম পেরিয়ে প্রায় মাইল তিনেক দূরের চড়ইটিপ নামের এক গ্রাম থেকে সে পড়তে আসতো। স্কুলে পড়ারসময় মাত্র একবারই তার গ্রামে গিয়েছিলাম। এখন আর ভালো মনে পড়ে না।
বললাম—আচ্ছা, যাব এখন। দেখি, একটু সময় করে উঠতে পারলেই–
বিরজা বলল—দেখ ওসব ছেঁদো কথায় আমাকে ভোলাতে পারবি না। সময় করে উঠতে পারলে মানে কি? তুই কি কারো চাকরি করিস? ওসব বললে চলবে না। সামনের মাসের প্রথম দিকে আমায় আবার কলকাতায় আসতে হবে। মামলার তারিখ পড়েছে। সেদিন তোর এখানেই এসে উঠব। তুই আগের থেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখিস, ফেরবার সময় তোকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
বললাম—বেশ, তাই হবে।
পরের মাসে বিরজার সঙ্গে আমাদের গ্রামের ষ্টেশনে গিয়ে নামলাম কত বছর পরে। সেই হারানো শৈশবের সোনালী দিনগুলো স্বপ্নের মত মনে আসে। হায়, যা যায় তা একেবারেই যায়।
স্টেশন থেকে আমাদের গ্রাম সাত মাইল, আর বিরজার গ্রাম মাইল দশেক। স্টেশনে নেমে দেখি আমাদের জন্য গরুর গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিরজা ব্যবস্থা করে রেখেছিল আগে থেকে। গরুর গাড়ি চেপে অনেক বছর পরে আবার কাচা রাস্তা দিয়ে দুলতে দুলতে যাওয়া! এত ভালো লাগছিল যে, বিচার করে দেখে বুঝতে পারলাম শহরে বাস করলেও শহরকে আমি আদৌ ভালোবাসি না। গ্রাম আমার রক্তে মিশে রয়েছে।
চড়ুইটিপ গ্রামটা দেখতে ভালো। গ্রামের প্রান্ত দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ছোট্ট একটি নদী। নদীর ধারে ঝোপঝাড়। সমস্ত গ্রামে কোথাও খুব ঘন জঙ্গল না থাকলেও ছাড়া ছাড়া গাছপালা প্রচুর। তিনচারটে পাকা বাড়ি চোখে পড়ল। এ ছাড়া সবই হয় চালাঘর, নয়তো করোগেট টিনের ছাদওয়ালা বাড়ি।
বিরজা আর তার দাদার বাড়ি পাশাপাশি, মধ্যে একটুকরো জমি। পাশাপাশি, কিন্তু মুখ দেখাদেখি নেই। যে বাড়িতে বিরজা আমাকে এনে তুলল, সে বাড়ি সে নতুন করেছে। ছোটবেলায় আমি এসেছিলাম পাশের ওই পুরনো বাড়িতে, যেখানে এখন অম্বিকাভূষণ থাকেন।