শুনে সাধু চমকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সে কি! তোমার ঠাকুর্দা জ্বরাসুরের পুজো করেছিলেন। সে যে বড় সাংঘাতিক দেবতা। তার কথা তোমার ঠাকুর্দা জানলেন কি করে?
বললাম, ঠাকুর্দার অনেক পুরনো পুঁথি ছিল। আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি, তাতেই পেয়েছিলেন।
সাধু বললেন, কিন্তু সমস্ত বিবরণ পড়েও তিনি পুজোয় নেমেছিলেন? পুজোর সংকল্প কার নামে হয়েছিল? বললাম—ঠাকুর্দার নামেই। বাবা নিজের নামে করতে চেয়েছিলেন, ঠাকুর্দা রাজী
হননি—
—পুঁথিটা আস্ত ছিল?
এবার আমার মনে পড়ে গেল। বললাম, না, শেষের পাতার অর্ধেকটা কিভাবে যেন পুড়ে গিয়েছিল। অবশ্য তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি—
সাধু বললেন, হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে।
অবাক হয়ে বললাম, কি রকম?
সাধু উঠে গিয়ে ভেতর থেকে একটা পুথি নিয়ে এলেন। আমাকে বললেন, এই দেখ। আমার কাছেও একখণ্ড আছে। শেষ পাতা পুড়ে না গেলে ঠাকুর্দা দেখতে পেতেন, জ্বরাসুরের পুজোর নিয়মের শেষে সাবধান করে দিয়ে লেখা আছে—যার নামে সংকল্প হবে, ছ’মাসের মধ্যে তার মৃত্যু হবেই। ছ’মাস পরেই তো তোমার ঠাকুর্দা মারা গিয়েছিলেন বলছ?
আমি নির্বাক হরে বসে রইলাম। আজ কোথায় বা স্নেহময় ঠাকুর্দা, কোথায় বা ঠাকুমা—মা-বাবা? সব স্বপ্নের মত মিলিয়ে গিয়েছে।
একটু পরে বললাম, সাধুজী আপনার বোধ হয় একটু ভুল হচ্ছে—
উনি বিস্মিত হয়ে বললেন, ভুল?
–হ্যাঁ। ও পাতাটা আস্ত থাকলেও ঠাকুর্দা পুজো করতেন। আমি ঠাকুর্দার নয়নের মণি ছিলাম।
সাধু চুপ করে রইলেন।
আমিও আর কিছু বললাম না। কিন্তু আর একটা কথা আমার মনে ঘোরাফেরা করছিল। এখন তা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তা হচ্ছে এই যে, ঠাকুর্দা নিজেই ও পাতার শেষটা পুড়িয়ে ফেলেছিলেন। পাছে কেউ পড়ে ফেলে তাকে বাধা দেয়—তাই। আমাকে ঠাকুর্দা বড়ই ভালবাসতেন।
তারানাথ গল্প থামিয়ে চুপ করে রইল। জল চকচক করছে নাকি তার চোখে? এই প্রথম আমি আর কিশোর তারানাথের গল্পের শেষে বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠাতে পারলাম না।
০৫. ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই
তারানাথ বলল—ক্ষমতার অপব্যবহার করতে নেই। শুধু তন্ত্রমন্ত্রের মাধ্যমে পাওয়া ক্ষমতার কথা বলছি না, জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই সংযমের খুব প্রয়োজন। নইলে বিপদ ঘনিয়ে আসে। গিয়ে বড় বড় রাজা-রাজড়াদেরও কি অবস্থা হয়েছে?
তারানাথের চাইতে বয়েসে অনেক ছোট হলেও আমি বা কিশোরী আর ঠিক যাকে ছোকরা বলে সে দলে পড়ি না। তবু তারানাথ আমাদের মাঝে মধ্যে ছোকরা বলে সম্বােধন করে এবং আমরা মেনে নিয়ে থাকি।
কিশোর বলল—তত্ত্বকথা শুনতে ইচ্ছে করছে না, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার বিষয়ক কোনো জমাট গল্প বলেন তো শুনি।
তারানাথ হেসে বলল—কারো সর্বনাশে কারো পৌষ মাস হয় এ কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। একটা জমাট গল্প মানে কোনো একজনের ভয়ানক বিপদের গল্প তো? তোমাদের গল্পের যোগান দিতে হলে দেশে হাহাকার পড়ে যাবে।
বললাম—অনেকদিন ভাল গল্প হয়নি। আজ কোনো ফাকি চলবে না। আজ গল্প বলতেই হবে।
তারানাথ বলল—একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। কিন্তু কারো কষ্ট নিয়ে বা দুঃখের ইতিহাস নিয়ে গল্প ফেঁদে বসতে আমার সঙ্কোচ হয়। তবু বলছি এই কারণে যে, এর ভেতর দিয়ে একটা জনশিক্ষার কাজও হয়ে যাবে।
কিশোরী বলল—জনশিক্ষার ব্যাপারটা গল্পের শেষে মর্যালের মত জুড়ে দেবেন এখন। আপাতত গল্পে আসুন।
তারানাথ আমাদের দিকে ইঙ্গিতবহ উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাতেই কিশোর তার পকেট থেকে পাসিং শো-র প্যাকেট বের করে সামনে রাখল। মৌজ করে কয়েকটা টান দিয়ে বলতে শুরু করল—দেখ, আমি একজন সাধারণ মানুষ। যাকে সাধক বলে আমি তা নই। কারণ সত্যিকারের সাধনা করবার সুযোগও আমি কোনোদিন পাইনি, পেলেও করতাম কিনা সন্দেহ। আসল ব্যাপারের চেয়ে এই পথে পথে বেড়িয়ে বেড়ানো, নানা বিচিত্র চরিত্রের মানুষের সঙ্গে আলাপ হওয়া—জীবনের এই দিকটাই আমাকে বেশি মুগ্ধ করত। নইলে সত্যিকারের সাধনা করলে আমি অনেকদূর উঠতে পারতাম। তোমাদের এতদিন বলিনি, আমার একবার প্রকৃত তান্ত্রিক দীক্ষাও হয়েছিল! গুরুর নাম বলব না, তার বারণ আছে। এবং আমার দীক্ষাও হয়েছিল শুভলগ্নে। তান্ত্রিক দীক্ষা অনেক বিচার করে লগ্ন দেখে দিতে হয়। শুক্লপক্ষে দীক্ষা হয় না। কৃষ্ণপক্ষের পঞ্চমী, সপ্তমী—এসব তিথি খুব ভাল। অক্ষয় তৃতীয়া বা দশহরার দিন হতে পারে। কিন্তু তন্ত্রমতে এসবের চেয়েও প্রশস্ত দিনে আমার দীক্ষা হয়।
কিশোরী বলল—যেমন?
—আমার দীক্ষা হয়েছিল সূর্যগ্রহণের সময়। গুরু যজ্ঞ শেষ করে আমার কপালে তিলক একে যখন গলায় পদ্মবীজের মালা পরিয়ে দিলেন, তখন মাথার ঠিক ওপরে সূর্যে গ্রহণ লেগে রয়েছে। গুরু আমার কাধে হাত রেখে বলেছিলেন—তোর উন্নতি হবে। এমন লগ্ন সবাই পায় না। উন্নতি অবশ্য কিছু হয়নি, তবে কয়েকটা ক্ষমতা পেয়েছিলাম সে তো তোমরা জানোই গুরু এ-ও বলে দিয়েছিলেন—বেটা, সাধনা করলে অসীম শক্তি পাবি। কিন্তু সেই শক্তি নিজের স্বার্থে অপরের ক্ষতি করবার জন্য কাজে লাগালে সর্বনাশ হবে। তন্ত্রের এই নিয়ম। সাবধান থাকিস্-পা যেন না ফসকায়।
গুরুর কথামত চলতে পারিনি। অপরের ক্ষতি করিনি বটে, কিন্তু লোভে পড়ে আধ্যাত্মিক উন্নতির বদলে বৈষয়িক উন্নতি চেয়েছিলাম। ফলে শক্তি কমে গিয়েছে। নেহাত মধুসুন্দরী দেবী বলেছিলেন, কোনোদিন ভাত-কাপড়ের জন্য ভাবতে হবে না— তাই চলে যায় একরকম করে।