পুথি থেকে পুজোর মন্ত্র নকল করে নিয়েছেন।
বেলা নটা নাগাদ ঠাকুর্দা আমার বিছানার পাশে এসে কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখলেন। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, খুব কি কষ্ট হচ্ছে দাদু?
বললাম, হ্যাঁ।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঠাকুর্দা বললেন, আর ভয় নেই। এইবার সেরে যাবে। নে, ওঠ দেখি—আমার সঙ্গে চল—
ঠাকুমা বললেন, না না, ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ও এখানেই থাক—
ঠাকুর্দা মৃদু গলায় বললেন, কিন্তু পুজোর জায়গায় ওকে থাকতে হবে যে।
—না, ও যাবে না—
ঠাকুর্দা আমার মায়ের দিকে ফিরে বললেন, বৌমা, ওঁকে বঝাও তো বলে যে আমার নাতিকে আমি কারও চেয়ে কম ভালবাসি না।
মা চুপ করে রইলেন।
আমি বিছানা থেকে কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাব। বাড়ির পেছনদিকে খিড়কির পুকুর। তার পাড়ে এনে ঠাকুর্দা বাবাকে বললেন, যাও, ওকে ধরে চান করিয়ে দাও। হাত ধরে নামাও পৈঠা দিয়ে–
পরিবারের সবাই আপত্তি করার ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমার গায়ে তখন কম করে একশ তিন জ্বর। বাবা বিনা বাক্যব্যয়ে আমাকে পুকুরে ডুব দিইয়ে আনলেন। ঠাকুর্দার হাতে গামছা আর নতুন কাপড় ছিল। সেই কাপড় পরে পূজোর জায়গায় গেলাম।
সব লোক যেন কেমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঠাকুরের মূর্তির সামনে বসে ওপরদিকে তাকালাম।
এই প্রথম জ্বরাসুরের মূর্তির সঙ্গে চোখাচোখি হল।
ওঃ, কি ভয়ানক মূর্তিই না বানিয়েছে হরিশ কুমার। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ শরীরে বড় বড় তিনটে ভাটার মত লাল চোখ। গায়ে পেরেকের মত খোঁচা খোঁচা কাঁটা। তিনটে মাথা, ছটা পা। পৃথিবীর সব কুশ্রীতাকে একত্র করে এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের জন্ম দিয়েছে এর স্রষ্টা।
বাবা-ঠাকুর্দা আগেই স্নান সেরে নিয়েছিলেন। তারা দুজনে আমার দু’পাশে বসলেন। পুজো শুরু।
চারদিকে বেদম ঢাকের আওয়াজ। ধুনোর ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। রামজীবন চক্রবর্তি দৃপ্তম্বরে মন্ত্রপাঠ করে চলেছেন। আমি দুর্বল শরীরে কোনোমতে আসনে বসে আছি মাত্র। ঠাকুর্দা একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছেন।
ঘণ্টাখানেক বাদে পুজো শেষ হল। রামজীবন হেঁকে বললেন, সরে যাও সব এবার বলি
ঠাকুর্দা কত করেছিলেন আমার জন্যে। অত বড় মূর্তি গলাতে কত ছাগল বলি দিতে হবে তার ঠিক কি? কাজেই নিখুঁত দেখে বহু ছাগল যোগাড় করে রাখা ছিল। ঠাকুর্দার ইঙ্গিতে নিবারণ কামার রামদা হাতে এগিয়ে এসে কাজ শুরু করল।
সমবেত সবাই নির্বক আতঙ্কে তাকিয়ে দেখছে। অত মানুষ জড়ো হয়েছে সেখানে, কিন্তু এতটুকু শব্দ নেই কোথাও। জ্বরাসুরের শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে টাটকা রক্তের ধারা। সেই লাল রক্তে স্নান করে বিকট মূর্তিকে যেন বিকটতর লাগছে। একটু একটু করে ধুয়ে যাচ্ছে রঙ, গলে যাচ্ছে চোখ-মুখ-বিকৃত অর্ধগলিতাঙ্গে কি বীভৎস হাসি হাসছে দুঃস্বপ্নের দেবতা! বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না, চোখ সরিয়ে নিলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখি অনেকেই এ দৃশ্য সহ্য করতে পারেনি। কখন নিঃশব্দে পূজামণ্ডপ শূন্য হয়ে এসেছে। সেই শূন্যতার মধ্যে কেবল একটু বাদে বাদে উঠছে নামছে নিবারণ কামারের রামদা। তারও চোখ জুরাসুরের মত লাল হয়ে উঠেছে, সর্বাঙ্গে চকচকে ঘাম।
একসময় চারদিকের রঙিন থকথকে কাদার মধ্যে জুরাসুরের মূর্তির অবয়বহীন কাঠামোটা দাঁড়িয়ে রইল কেবল। আর সব নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আমি এলিয়ে পড়েছি ঠাকুর্দার কোলের ভেতর। ঠাকুর্দা বুকের মধ্যে ধরে আমাকে বাড়িতে নিয়ে এলেন। আবার আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হল। অবস্থা দেখে ঠাকুমা আমার মাথা কোলে নিয়ে বসলেন, বাবা নিজে বাতাস করতে লাগলেন পাখা দিয়ে। মা চোখে আঁচল দিয়ে কাঁদছেন। কেবল ঠাকুর্দা অবিচলিত, তিনি তখনই আবার বেরিয়ে গেলেন। জ্বরাসুরের কাঠামোটা নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে দাহ করে ফেলতে হবে। তাই নাকি নিয়ম।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কি জানো—জ্বরাসুর জাগ্রত দেবতা বলেই হোক, বা ঠাকুর্দার দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির ফল হিসেবেই হোক—সবাইকে অবাক করে পরদিন আমার জ্বর ছেড়ে গেল। গেল এবং আর এল না। তারপরও কিছুদিন বাড়ির সবাই ভয়ে ভয়ে থাকত, একটু বাদে বাদে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখা হত। কিন্তু সত্যিই জ্বর আর এল না।
ঠাকুর্দার সম্মান দারুণ বেড়ে গেল। শুধু পরিবারের ভেতরে নয়, আশেপাশের বহু গায়ের লোক তাকে একজন বিচক্ষণ মহাপুরুষ বলে মনে করতে লাগল। সারাদিন। ধরে বিস্তর লোক নানান পরামর্শ নিতে আসত। ফুর্তির চোটে ঠাকুর্দা অর্ডার দিয়ে কাশী থেকে উৎকৃষ্ট অম্বুরী তামাক আনালেন। অবশ্য এ সম্মান বেশিদিন ভোগ করতে পারেননি তিনি। আমার জ্বর সারার ঠিক ছ’মাসের মাথায় ঠাকুর্দা মারা যান। যন্ত্রণাহীন মৃত্যু, কাউকে কষ্ট দিলেন না, বিছানাতেও পড়ে রইলেন না। একদিন সকালে তাকে ডাকতে গিয়ে দেখা গেল বিছানায় তার প্রাণহীন দেহ পড়ে। রাত্তিরে ঘুমের মধ্যে কখন প্রাণ বেরিয়ে গিয়েছে। বোধ হয় মৃত্যু আসন্ন অনুভব করে ইষ্টমন্ত্র জপ করছিলেন, কারণ ডানহাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কর ধরা ছিল। সবাই বলল—সন্ন্যাস রোগ। এইভাবে ঠাকুর্দা চলে গেলেন।
ঘটনাটা এইখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হল না। বিধাতাপুরুষ বড় রসিক। আমি জানতাম না যে এই ঘটনার একটা বৃহত্তর উপসংহার রয়েছে। জানলাম প্রায় পচিশবছর পরে। তখন আমার অনেক সাধুসঙ্গ করা হয়ে গিয়েছে। পাকা ভবঘুরে তান্ত্রিক তখন। একদিন ঘুরতে ঘুরতে এক গ্রামের প্রান্তে একজন সাধুর মঠে আশ্রয় নিয়েছি সন্ধ্যেবেলা। বেশ সৌম্যদর্শন সাধু। ভারী ভাল ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে। তার আদেশে তার শিষ্যরা আমাকে যত্ন করে খাওয়াল রাত্তিতে। সুন্দর শোবার জায়গা করে দিল। পরদিন সকালেই আমি চলে যাব। তাই রাত্তিরে খাওয়ার পরে সাধুর কাছে তার আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে গেলাম। প্রাথমিক আলাপের পর নানা বিষয়ে কথাবার্তা আরম্ভ হল। অনেক রাত অবধি গল্প চলল, কথায় কথায় সাধুকে জ্বরাসুরের পুজোর ব্যাপারটা বললাম।