–জ্বরাসুরের।
–জ্বরাসুর? সে কি জিনিস?
ঠাকুর্দা তাকে ব্যাপারটা আদ্যোপান্ত বুঝিয়ে দিলেন। সময় নেই মোটে। এগারো দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। বারোদিন পরে পুজো।
-–কর্তামশাই, মূর্তি দেখতে কেমন হবে?
ঠাকুর্দা একটু ইতস্তত করে বললেন, তিনটে মাথা হবে, বুঝলে? ছটা পা, ছটা হাত—পেছনে একটা মোটা ল্যাজও থাকবে।
—আজ্ঞে–ল্যাজ?
—হ্যাঁ। ল্যাজে আর গায়ে বড় বড় কাটা। গায়ের রঙ ঘোর কালো। তিনটে লালরঙের বড় বড় চোখ হবে, তার ভেতর একটা চোখ থাকবে কপালে। লাল জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছেন জুরাসুর। কি, পারবে তো?
একটা নিঃশ্বাস ফেলে হরিশ বলল, আজ্ঞে পারব। তবে কথা হচ্ছে কি, এ পুজো কি না করলে হত না? কেমন কেমন ঠেকছে যেন
—আরে রাখ তো, তুমিও দেখি মেয়েদের মত আরম্ভ করলে। যে রোগের যে ওষুধ, বুঝলে না? যাও, কাজ করো গে—
জ্বরাসুরের পুজো নাকি বসতবাড়ির ভেতরে করতে নেই। তাই আমাদের বাড়ির বাইরে যে করে দিল হরিশ কুমোর। ইতিমধ্যে গ্রামে এবং গ্রামের বাইরে রটে গিয়েছে ঠাকুর্দা নাতির অসুখের জন্য কি এক বিকট মূর্তি বানিয়ে পুজো করছেন। রোজ সকাল থেকে সামিয়ানার তলায় ব্যাপারটা চাক্ষ দেখবার জন্য ভিড় লেগে থাকত। হরিশ কুমোরও ওস্তাদ লোক। এখন বুঝি মানুষটা খাটি শিল্পী ছিল। কেবলমাত্র বর্ণনা শুনে অভূতপূর্ব কিছু সৃষ্টি করা চাট্টিখানি কথা নয়। সুন্দরকে যে সৃষ্টি করে সে যেমন বড় শিল্পী, আবার ভয়ানক বীভৎস রস যে সৃষ্টি করতে পারে সেও বড় শিল্পী বইকি। হরিশ মাথা ঘামিয়ে এমন এক বিকট মূর্তি তৈরি করল, যা দেখে পুজোর দিন আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হয়েছিল।
এদিকে সব আয়োজন মোটামুটি হয়ে গেল। শুধু পুরুত ঠিক করা বাকি। ঠাকুর্দা নিজেই পুজো করবেন ঠিক করেছিলেন কিন্তু এবার ঠাকুমা স্বমূর্তি ধরে ঝাঝালো গলায় জানিয়ে দিলেন যে ঠাকুর্দা বিপত্নীক হবার পর যা খুশি তাই করতে পারেনতার আগে নয়। ঠাকুর্দা—সামান্য হলেও—ঠাকুমাকে ভয় করতেন। ফলে তিনি গ্রামের তিন-চারজন পুরুত বামুনের থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে দরিদ্র রামজীবন চক্রবর্তীকে পাকড়াও করলেন। তখন জ্বরাসুরের মূর্তি প্রায় তৈরি হয়ে এসেছে। সে বেচারি ঠাকুরের চেহারা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল—আজ্ঞে, এ আমার সাধ্যে কুলোবে না—
ঠাকুর্দা কার্যোদ্ধারের নানা বাস্তব উপায় জানতেন। তার মধ্যে সবচেয়ে ফলদায়ী উপায়টি প্রয়োগ করলেন। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ও, তোমার অসুবিধে হবে বলছ? থাক তাহলে। জোর করে কাউকে দিয়ে কোন কাজ করানো উচিৎ নয়—বিশেষত পুজো-আচ্চা। সাঁতরাগাছি থেকেই তাহলে পুরুত আনাতে হবে দেখছি। আসলে অনেকগুলো কাপড়, থালা-বাসন, ফলফলাদি—তাছাড়া এক মুঠো টাকা দক্ষিণা-এসব বাইরের গ্রাম থেকে এসে কেউ নিয়ে যাবে— এটা চাই না বলেই তোমাকে বলছিলাম। বরং দক্ষিণা কিছু বেশি লাগলেও গ্রামের পুরুত করলেই ভাল হত। তা তোমার যখন অসুবিধে–
রামজীবনের দুই বয়স্ক মেয়ে তখনও অবিবাহিতা। একমাত্র ছেলে পড়াশুনা এবং পৈতৃক ব্যবসা ছেড়ে গ্রামে গ্রামে সখের যাত্রা করে বেড়ায়। কাজেই রামজীবন ইতস্তত করে বললেন—আজ্ঞে না, অসুবিধে আর কি! তবে নিয়মকানুন জানিনে, তাই—এ পুজো তো বড় একটা হয় না।
—নিয়ম আমি তোমাকে বলে দেব।
তিনদিন ঠাকুর্দা পুঁথি নিয়ে বসে সকাল-সন্ধা রামজীবনকে বোঝালেন। শেষদিন বললেন—এবার একটা দরকারী কথা বলি, শোন। এ ঠাকুরের মূর্তি কিন্তু বিসর্জন হবে না।
রামজীবন বললেন—বিসর্জন হবে না? তবে কি থাকবে?
—না, থাকবেও না।
—তবে?
ঠাকুর্দা কিছুক্ষণ চুপ করে বোধ হয় ভাবলেন কিভাবে ব্যাপারটা বললে ভাল হয়। তারপর বললেন, রামজীবন, পূজো হয়ে গেলে জুরাসুরের মূর্তিটা গলিয়ে ফেলতে হবে।
গলিয়ে ফেলতে হবে! মানে, ওপর থেকে জল ঢেলে মাটি গলিয়ে—
বাধা দিয়ে ঠাকুর্দা বললেন, জল দিয়ে নয়, রক্ত দিয়ে।
—রক্ত!
-হ্যাঁ। বলির পশু আগে থেকেই এনে রাখতে হবে। পুজো হয়ে গেলে একের পর এক বলি পড়বে, আর সেই রক্ত দিয়ে স্নান করানো হবে ঠাকুরকে। বলি চলবে যতক্ষণ না সমস্ত মাটি গলে কাঠামো বেরিয়ে পড়ছে। যত পশু লাগে লাগুক।
রামজীবন নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। ঠাকুর্দা বোধ হয় তার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলেন, হাত দুটাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, রামজীবন, আপত্তি করো না ভাই। আর তোমাকে টাকার লোভ দেখাব না। আমার নাতির অসুখ—তার কথা ভাবো। আমার বিশ্বাস এ পুজো না করলে সে বাচবে না। রাজী হও ভাই—
মাথা নিচু করে রামজীবন বললেন, ভয় পাবেন না। কথা যখন একবার দিয়েছি, কোনো কারণেই আর ফেরত নেব না। আপনার নাতিকে আমি আশীর্বাদ করছি—
এইভাবে অমাবস্যা এল। ভোর থেকে বাইরে পুজোর জায়গায় জোড়া ঢাক বাজছে। আগের রাত থেকে বাড়ির কেউ আর ঘুমোয় নি। মা এবং ঠাকুমা সারারাত জেগে পুজোর সাজ করে দিয়েছেন। সাধারণত সে সময়ে কারও বাড়ি কোনো কাজ উপস্থিত হলে পাড়ার সবাই সাহায্য করতে আসত। কিন্তু জ্বরাসুরের মূর্তি দেখে কারও সে সদিচ্ছা জাগেনি। তবে আগে না এলেও পূজোর দিন সকাল থেকেই আশেপাশের চার-পাঁচখন গ্রাম থেকে লোকজন এসে ভিড় করল। তাদের মধ্যে মূর্তির সামনে কুশাসনের ওপর স্নান করে গরদের কাপড় পরে বসে আছেন রামজীবন চক্রবর্তী। তার হাতে কোষ্ঠীর মত গোল করে পাকানো কাগজ—তাতে তিনি ঠাকুর্দার।