বাবা ভেবে ভেবে উপায় বের করলেন। ঘোড়ার গাড়িতে যেতে পারব না, কারণ ঝাঁকুনিতেই মরে যাব তাহলে। বাবা বললেন, ওকে পালকিতে করে নিয়ে যাব। দাঁড়াও পালকির ব্যবস্থা করি।
পালকিতে আমাকে নিয়ে ঠাকুমা চললেন, বাবা-ঠাকুর্দা পেছন পেছন এলেন গরুর গাড়িতে। মন্দিরের ভেতর ঠাকুমার কোলে সারারাত শুয়ে রইলাম। সেসময় অতিরিক্ত ভুগে আমার যেন মাথার মধ্যে কেমন গোলমাল হয়ে গিয়েছিল। প্রায়ই রাত্তিরবেলা আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখতাম। এখানেও শেষরাত্তিরে কি একটা হিজিবিজি স্বপ্ন দেখলাম, তার কোনো মাথামুণ্ডু নেই—এমন কি সকালে মনেও করতে পারলাম না। সেবায়েৎ সকালে জিজ্ঞাসা করল, কিছু আদেশ-টাদেশ পেয়েছ খোকা?
আদেশ কাকে বলে? ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, আজ্ঞে না তো, তবে একটা স্বপ্ন দেখেছি—
—কি স্বপ্ন?
–তা এখন আর মনে পড়ছে না।
সেবায়েৎ বলল, তা যাক গে, ওই দেখলেই হবে।
কি সব পুজো দেওয়া হল, একটা মাদুলি ঝুলিয়ে দেওয়া হল আমার হাতে। সেবায়েৎ কোশায় করে অনেকখানি চরণামৃত এনে আমাকে হাঁ করিয়ে খাইয়ে দিল। তাতে বহুদিনের ফুলবেলপাতার গন্ধ।
আবার পালকি করে বাড়ি। মাদুলিতে কি ফল হল তা বুঝতে পারা গেল না, কিন্তু চরণামৃত খেয়ে জ্বরের ওপর আমার হল ভয়ানক পেটখারাপ। অসুখ চলতেই লাগল। দিনদশেক বাদে বাবা একদিন টান দিয়ে মাদুলিটা ছিড়ে বাইরে ফেলে দিলেন।
একদিন—সময় সন্ধ্যেবেলা—পরিষ্কার মনে পড়ছে দৃশ্যটা, ঠাকুর্দা এসে আমার বিছানার পাশে দাঁড়ালেন। বাবা বাইরের কাজকর্ম সেরে আগে থেকেই এসে বসেছিলেন। ঠাকুর্দা কিছুক্ষণ চুপ করে আমাকে দেখে বললেন, কেমন আছিস আজ?
ভুগে ভুগে কেমন আছি বোঝবার ক্ষমতা লুপ্ত হয়েছিল। তাই বললাম, ভাল আছি।
ঠাকুর্দা বললেন, হু। তোর জন্য একটা পুজো করা হবে, বুঝলি? তাহলেই তোর অসুখ সেরে যাবে।
বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পুজো? কি পুজো?
ঠাকুরদা আমার পায়ের কাছে বিছানায় বসলেন, বললেন, কাল রাত্তিরে পড়তে পড়তে একটা জিনিস পেলাম—ভগবানই পাইয়ে দিলেন বলতে পার। আমার ঠাকুর্দা নরনাথ ঘোর তান্ত্রিক ছিলেন, তা তো তোমরা জানোই। তন্ত্রসাধনার ওপর অনেক বই ছিল তার। তার মধ্যে বেশির ভাগই হাতে লেখা পুথি। কিছু কিছু নষ্ট হয়েছে, কিছু চুরি গিয়েছে—আবার কিছু রয়েও গিয়েছে। তারই একটা বই পড়তে গিয়ে কাল রাত্তিরে একটা ঘটনা পড়লাম, বুঝলে?
ঠাকুমা বললেন, কি?
—লেখক বলছেন, যদি কারও দীর্ঘদিন ধরে কালান্তক জ্বর চলতে থাকে, এবং কিছুতেই সে জ্বর না সারে তাহলে বুঝতে হবে তাকে জ্বরাসুরে আক্রমণ করেছে।
–জ্বরাসুর আবার কে?
ঠাকুর্দা বিব্রত হয়ে বললেন, সে তোমাকে বোঝানো কঠিন হবে। জ্বরাসুরকে দেবতাও বলতে পার, আবার উপদেবতাও বলতে পার। এরা শুধু অনিষ্টই করতে পারে। পুঁথিতে লিখছে জ্বরাসুরের বিধিমত পুজো করলে জ্বর কমে যায়।
ঠাকুমা শঙ্কিত গলায় বললেন, না, ও পুজো তোমায় করতে হবে না।
ঠাকুর্দা বললেন, কেন?
—না, ওসব ঠাকুরের নামই শুনিনি কখনো। আর কিবা নামের ছিরি, শুনলেই শরীর হিম হয়ে আসে। দরকার হলে চেনাজানা ভাল ঠাকুরের পুজো করো—ও তোমায় করতে হবে না।
ঠাকুর্দা বাধা পেয়ে রেগে গেলেন। তিনি কারো পরামর্শে মত বদলাবার পাত্র ছিলেন না, নিজে যা ভাল বুঝতেন তাই করতেন। বললেন, ব’কো না, আমি কি আমার নাতির খারাপ চাই। আমি ঠিকই করছি। আমার ঠাকুর্দার পুঁথি, বহুদিন আগেকার মস্ত এক সাধকের লেখা। তা কি কখনো ভুল হতে পারে? ভগবান পাইয়ে দিয়েছেন।
—তা এ পুজো করবে কি করে? মন্তর-তত্তর পাবে কোথায়?
ঠাকুর্দা খুশি হয়ে বললেন, ওইটেই তো মজা! জ্বরাসুরের পুজোর সমস্ত বিধি ওই বইতেই সংস্কৃতে লেখা রয়েছে। দেখবে? দাঁড়া ও, দেখাই–
একটু বাদেই ঠাকুর্দা তার পুথি নিয়ে ফিরে এলেন। পুরনো দিনের হাতে তৈরি কাগজের পুথি, তাতে মোটা খাগের কলমে কালো কালিতে লেখা অক্ষর। বলা বাহুল্য, মা বা ঠাকুমা কেউই বিন্দুবিসর্গ বুঝলেন না—কিন্তু ঠাকুর্দা মহা উৎসাহে গড়গড় করে দুর্বোধ্য সংস্কৃত পড়ে গেলেন অনেকখানি। তারপর এক জায়গায় থেমে গিয়ে বললেন—এই হল পুজোর নিয়ম আর মন্ত্র, বুঝতে পারলে তো?
দেবভাষার মোহ বড় সাংঘাতিক। ঠাকুমা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানালেন। ঠাকুর্দা বললেন, আমার ভাগ্যও খুব ভাল। ঠিক এর পরেই পুঁথির এই পাতাটা কিছুটা পুড়ে গিয়েছে। এই দেখ—
দেখলাম সত্যিই পাতার অর্ধেকটা কিভাবে যেন পুড়ে গিয়েছে বটে।
ঠাকুর্দা বললেন, তাতে অবশ্য কোনো ক্ষতি হবে না। পোড়া জায়গায় আগেই পূজাবিধি সম্বন্ধে লেখাটা শেষ হয়ে গিয়েছে। আর বারোদিন বাদে অমাবস্যা, ওদিনই পুজো দেব।
বাবাকে বললেন, হরিশ কুমোরকে খবর দিস তো কাল আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য—ঠাকুর গড়াতে দিতে হবে।
বাবা বললেন, ঠাকুরও গড়ানো হবে নাকি?
–তা হবে বইকি! নইলে পুজো হবে কি করে?
–কেমন ঠাকুর?
ঠাকুর্দা একটু কেশে বললেন—ইয়ে, পুঁথিতে যা বর্ণনা রয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে। জ্বরাসুরের চেহারা-মানে, খুব একটা সুন্দর নয় আর কি। তা সে আর কি করা যাবে—
পরের দিন হরিশ কুমোর এসে হাজির হল। ঠাকুর্দা আদৌ ভূমিকা না করে তাকে। বললেন, তোমাকে একটা নতুন ধরনের মূর্তি বানিয়ে দিতে হবে পুজোর জন্য। পারবে তো?
—আজ্ঞে, কিসের মূর্তি?