মোটের ওপর কেউ আমার অসুখটাকে বিশেষ অমিল দিল না। দেবার কথাও নয়। জ্বরজারি বাচ্চাদের হয়েই থাকে, আবার সেরেও যায়।
কিন্তু দিনদশেক বাদেও যখন আমার জ্বর কমল না, তখন সবার টনক নড়ল। ঠাকুর্দার কানে সহসা সংসারের কোনো খবর পৌঁছয় না, নিজের ঘরে বইপত্র আর দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে মগ্ন থাকেন। আমার জ্বরের দশম দিনে ঠাকুর্দা এসে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে গায়ের উত্তাপ দেখলেন। ঠাকুমা লম্বা ঘোমটা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, তাকে বললেন, আগে আমাকে খবর দাওনি কেন? তারপর বাবার দিকে ফিরে বললেন, কাল সকালে উঠে মহকুমা শহর থেকে জীবন ডাক্তারকে ডেকে আনবে–
বাবা ক্ষীণস্বরে বললেন, আজ্ঞে, জীবন ডাক্তার?
—হ্যাঁ। ঘোড়ার গাড়ি করে নিয়ে আসবে। আরো আগে আনা উচিত ছিল। টাইফয়েডে দাঁড়ালে কি হবে ভেবে দেখেছ?
বাবার মুখ শুকিয়ে গেল। তখন টাইফয়েড একটা কালান্তক রোগ বলে গণ্য হত। ব্যাকটিরিও ফাজ আবিষ্কার হয়নি। শুধু জলচিকিৎসা হত। বাবা পরের দিনই দুপুরের মধ্যে শহর থেকে বড় ডাক্তার নিয়ে এলেন। ডাক্তারবাবু বুকে নল বসিয়ে, পেট টিপে, জিভ দেখে এবং মা আর ঠাকুমাকে অনেক প্রশ্ন করে তারপর বললেন, টাইফয়েড বলে মনে হচ্ছে না।
বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ম্যালেরিয়া?
—উঁহু। কাঁপুনি নেই, লিভার-টিভার নয়—জুরও তো একই ভাবে চলছে ছাড়ছে না। ম্যালেরিয়াও নয়—
-তাহলে?
–বলতে পারছি না। আরো ক’দিন দেখতে হবে। একটা থার্মোমিটার কিনে রাখুন, রোজ তিন-চারবার জ্বর দেখে লিখে রাখবেন। আপাতত একটা ওষুধ লিখে দিয়ে যাচ্ছি, সেটা খেয়ে কেমন থাকে জানালে তারপর দেখা যাবে।
অর্থাৎ আন্দাজে চিকিৎসা শুরু হল। এই সবে আরম্ভ, এর পরে কত যে ডাক্তার এল আর কত যে ওষুধ খেলাম তার ইয়ত্তা নেই। পেটের মধ্যে ডাক্তারখানা খোলবার যোগাড় করে ফেললাম। কিন্তু বিচিত্র জ্বর কিছুতেই কমল না। প্রায় দু’মাস হয়ে গেল। আমি তখন হাড়সার রোগ হয়ে গিয়েছি, মুখের ভেতর একটা তেতো স্বাদ সব সময় থাকে। জানালার ধারে শুয়ে দেখি গ্রামের হরেন, রামু, শিবেন—এরা সবাই গুলতি হাতে পাখি মারতে যাচ্ছে কিংবা ছিপ হাতে চৌধুরীদের পুকুরের দিকে চলেছে। আমাকে দেখে ওরা জিজ্ঞাসা করে, কিরে, জ্বর কমল?
আমি মাথা নাড়ি। ওরা চলে যায়।
মা আর ঠাকুমা প্রায় খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। বাবার থমথমে মুখ দেখলে আমার বুকের মধ্যে কেমন করে। এর ভেতর একদিন তিনি কোলকাতা থেকেও বড় ডাক্তার ধরে আনলেন। সবই হল, কিন্তু আমার অসুখ সারল না। জ্বর খুব একটা বাড়ে না, কিন্তু গায়ে থেকেই যায়—ছেড়ে যায় না একেবারে। ওঃ, সে বড় ভয়ানক সময় গিয়েছে। একদম কাহিল হয়ে পড়েছিলাম। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়া বার ক্ষমতা ছিল না। প্রথম দিকে ঠাকুমা কোলে করে বাথরুমে নিয়ে যেতেন, তারপর থেকে ওগুলো বিছানাতেই সারতে হত। আমার কোনো মৃত্যুভয় হয়নি, কারণ ওই বয়েসে শিশু মৃত্যুকে চেনে না। কেবল খেলতে যেতে পারি না বলে, বাড়ি থেকে বেরুতে পারি না বলে মন খারাপ লাগত।
একদিন কেবল ভয় পেয়েছিলাম। বিকেলের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছি—তখন আমার ঘুমোবার সময়ের কোনো ঠিক ছিল না, সব কেমন উলটোপালটা হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনই শুয়ে থাকা তো—যখন-তখন ঘুমিয়ে পড়তাম। একদিন বিকেলে জেগে উঠে দেখি আধো অন্ধকার ঘরে মা রয়েছেন। ভয় পেয়ে বলে উঠলাম, মা, কি হয়েছে?
মা প্রথমে উত্তর দিতে পারলেন না—এখন বুঝতে পারি কান্নায় তার গলা বুজে গিয়েছিল। উত্তর না পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, কি হয়েছে? তোমরা আমন করে তাকিয়ে রয়েছে কেন?
ঠাকুমা এগিয়ে এসে আমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বললেন, কিছু হয়নি, চিৎকার করছিস কেন? থাম, শরীর অস্থির করবে
-–মা কথা বলছে না কেন?
—পুজো করতে যাবে কিনা, তাই এই তো চান করে এল, আজ যে বৃহস্পতিবার। পুজো না করে কথা বলতে নেই–-
তখনকার মত চুপ করে গেলাম বটে, কিন্তু আমার বালকমনে ঘটনাটা গভীর ছাপ ফেলল। জুরের ঘোরে ঘুম থেকে উঠলে এমনিতেই মস্তিষ্ক যথাযথ কাজ করে না, তার ওপর অন্ধকার ঘর—মায়ের আমনভাবে তাকিয়ে থাকা—এই প্রথম আবছাভাবে অনুধাবন করতে পারলাম আমার জটিল কিছু একটা হয়েছে, এবং সেজন্য বাড়ির সবাই খুব চিন্তিত।
দু-মাস হয়ে যাবার পর ঠাকুর্দা বাবাকে আবার কোলকাতা পাঠালেন। যে বড় ডাক্তার আমাকে একবার দেখে গিয়েছিলেন তাকে আবার নিয়ে আসা হল। ডাক্তারবাবু অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখলেন, নানারকম জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তারপর চুপ করে বসে রইলেন।
খাটের এধারে ঠাকুমা দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি বললেন, কেমন বুঝলেন ডাক্তারবাবু?
ডাক্তার হাত জোড় করে বলেন, আমাকে আর লজ্জা দেবেন না। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। সব রকম পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে, জ্বর ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গও নেই। এ অবস্থায় কি চিকিৎসা করব? অন্য ডাক্তার হলে লজ্জা বাঁচানোর জন্য যাহোক কিছু প্রেসক্রিপশন করে দিয়ে যেত। কিন্তু তা করতে আমার বিবেকে বাধে।
অনেক অনুরোধেও তিনি ফী নিলেন না। বললেন, না মশাই, টাকা নিতে পারব। না। এখনও পুরোপুরি চশমখোর হতে পারিনি। যদি একান্তই না ছাড়েন, তবে আমার ফেরবার ভাড়াটা বরং দিন।
গ্রাম্য বাঙালী পরিবারের যা বৈশিষ্ট্য, এরপর সবাই দৈব ওষুধের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নারাণপুরে কে নাকি ঠাকুর পেয়েছে, সেখানে গিয়ে ধর্না দিলে ওষুধ পাওয়া যায়। নারাণপুর আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মাইল দূরে। অন্য কেউ গেলে হবে না, রোগীকেও অবশ্যই যেতে হবে। তা অম্লশূলের বা মৃগীর রোগী হলে না হয় গেল, কিন্তু দু মাস ভুগে আমি তখন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারি না, আমি অত পথ যাব কি ভাবে?