–বটেই। আমার ভবঘুরে জীবনের একেবারে প্রথম দিকে ঘটেছিল। তখনও আমি বীরভূমের মাতু পাগলীকে দেখিনি। চা এনেছিস? রাখ এই তক্তাপোশেই—নাও, চা খাও—
আমরা চায়ে চুমুক দিলাম। তারানাথ গল্প শুরু করলে।
আমার বয়েস তখন বাইশ-তেইশ। বাড়িতে আর ভাল লাগে না। আমাদের গ্রামের ধারে বাঁধানো বটতলায় একবার এক বিচিত্রদর্শন সাধু এসে সাত-আটদিন বাস করেছিল। সামনে ধুনি জ্বালিয়ে চুপ করে বসে থাকে। মাথায় চূড়ার মত উচু জটার ভার। চোখ দুটো বেশ শান্ত। গ্রামের অনেকেই তার কাছে গিয়ে দুধ, ফলমূল এসব দিয়ে আসত। বৌ-ঝিরা বায়ন করত মাদুলিতাবিজের জন্য। সাধু কিন্তু কখনও ভড়ং দেখায়নি, অলৌকিক শক্তি দেখিয়ে ভক্ত যোগাড়ের চেষ্টা করেনি। কেউ বেশি বিরক্ত করলে বলত—আমি কিছু জানি নে মা, আমার কোন ক্ষমতা নেই। ভগবানকে ডাক, ভগবান সব ঠিক করে দেবেন। বেশি ধরাধরি করলে বলত—আচ্ছা যা, আমি তোর হয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করবো। এই সততার জন্য এবং কারো কাছ থেকে পয়সা না নেওয়ায় সাধুর ওপর আমার কেমন একটা আকর্ষণ জন্মালো। গেলাম একদিন সাধুর বটতলায়।
একদিকে বসে আছি। নানারকম লোক এসে নানান বায়না করছে সাধুর কাছে। সাধু সবাইকেই হেসে বিদায় করছে। এসব মিটতে মিটতে বিকেল গড়িয়ে অন্ধকার নেমে এল। এবার আমি আর সাধুই কেবল রয়েছি বটতলায়।
পাশ থেকে একখানা চালাকাঠ তুলে ধুনিতে গুজে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে সাধু বলল, আয়, এগিয়ে এসে বোস।
আমি সাধুর সামনে ধুনির এপাশে গিয়ে বসলাম। ধুনির আলোয় সাধু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সন্ন্যাসী হবার ইচ্ছে আছে, না?
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
––তোর সে-সব হবে না। তবে তোর কপালে অনেক সাধুসঙ্গ আছে দেখছি। কিছু শক্তিও পাবি। কিন্তু সংসারে থাকতেই হবে তোকে।
আমি বললাম, আপনি তো কাউকে কিছু বলেন না। আমাকে এত কথা বলছেন। কেন?
সাধু একটু চুপ করে বসে থেকে বলল, তোর কপালে তন্ত্রসাধনার চিহ্ন আছে— কিন্তু অস্পষ্ট। তার অর্থ কিছুদূরে গিয়ে তারপর ফিরে আসতে হবে। এ চিহ্ন না দেখতে পেলে তোকে এসব কথা বলতাম না। তোর অধিকার আছে জানার।
আমি উৎসুক হয়ে উঠলাম। বললাম, আর কি দেখতে পাচ্ছেন সাধুজী?
—আর যা দেখতে পাচ্ছি তা খুব ভাল নয়।
—কি রকম?
–বছরখানেকের ভেতর তোর খুব বড় বিপদ আসছে। ভালই হয়েছে আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে তোর। নইলে প্রাণসংশয় হতে পারত।
বললাম, কি রকম বিপদ কিছু বলবেন না? তাহলে তার থেকে বাঁচব কি করে?
সাধু বলল, তা আমিও ঠিক বলতে পারছি না। জানলে নিশ্চয় বলতাম। তুই এসে বসবার পর থেকেই আমার মনে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন তোর দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি তোর পেছনে একটা অন্ধকারের স্তুপ যেন চাপ বেঁধে আছে।
আমি চমকে পেছন দিকে তাকাতেই সাধু হেসে বলল, তুই দেখতে পাবি না, আমি দেখতে পাচ্ছি।
আমি বললাম, এক বছরের মধ্যেই যে বিপদ ঘটবে তা কি করে বলছেন? আগে বা পরেও তো হতে পারে।
–-ওটা আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। বোধ হয় ভুল করিনি।
চুপ করে বসে রইলাম। বলা বাহুল্য সাধুর কথা শুনে একটু গা শিরশির করছিল। কেউ যদি জানতে পারে তার পেছনে একটা অদৃশ্য চাপবাধা অন্ধকার ঘুরছে তাহলে তার ভাল লাগার কথা নয়। তার ওপর নির্জন জায়গা–গ্রামের বাইরের দিকে বটগাছটা। ধুনিতে পটপট করে কাঠের গাট পোড়বার শব্দ হচ্ছে। সাধু আর আমি ছাড়া কোনোদিকে আর কেউ নেই।
সাধু বলল, তোকে আমি একটা জিনিস শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। ভাল করে শিখে রাখ। যদি কোনোদিন কখনও বিপদ আসছে বলে মনে হয়, কি কোনো অস্বস্তি বোধ করিস, তাহলে এই প্রক্রিয়াটা করবি। যতই বিপদ আসুক, প্রাণটা বেঁচে যাবে।
বললাম, কি প্রক্রিয়া সাধুজী?
সাধু বলল, নে, ভাল করে দেখ। আর এই মন্ত্রটা মুখস্থ করে নে। একে বলে গাত্রবন্ধন।
শিখতে বেশিক্ষণ লাগল না। বললাম, কিন্তু বিপদ যে আসছে, তা বুঝতে পারব কি করে?
সাধু একটু হাসল, তারপর বলল, তুই ঠিক বুঝতে পারবি। তোর কপালে তন্ত্রসাধনার চিহ্ন আছে, বললাম না? সময় হলে আমার মত মনের মধ্যে বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠবে। আমি যেমন আজ তোর বিপদ বুঝতে পারলাম।
বললাম, কিন্তু আমি তো পারিনি।
—আজ থেকে তোকে কিছুটা শক্তি দিলাম। যা, ভালমন্দ যাই আসুক, তুই আগে থেকে আন্দাজ করতে পারবি।
আমি হাতজোড় করে বললাম, আমাকে আপনার শিষ্য করে নিন। আমি দীক্ষা নেব আপনার কাছে।
সাধু ভ্রূ কুঁচকে বলল, ওসব হবে-টবে না। আমি কাউকে শিষ্য করি না। আবদার করিস না—যা, কেটে পড়।
—আবার কবে আপনার দেখা পাব?
—এমনিতে দেখা পাবি না। তবে যদি সত্যি কখনও তোর প্রাণসংশয় ঘটে, তাহলে তোকে সাবধান করে দেব।
তারপরেই একটা আধপোড়া কাঠ তুলে নিয়ে ধুনি খুঁচিয়ে দিতে দিতে বলল—যা যা, ভাগ—পালা!
বাড়ি ফিরে এলাম। পরদিনই সেই সাধু আস্তানা ভেঙে কোথায় চলে গেল কে জানে। পরদিন বিকেলে বটতলায় গিয়ে দেখি শুধু নিভে যাওয়া ধুনির ছাই আর কতগুলো আধপোড়া কাঠ পড়ে আছে।
মাসখানেক কাটল। কিছুই যেন আর ভাল লাগে না। কেবলই বাড়ির বের হয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। পথ যেন দারুণ আকর্ষণে টানছে। কেবল যে ধর্মের স্পৃহা তা নয়, একটা ভবঘুরেমি পেয়ে বসল। আরো কিছুদিন এভাবে কাটাবার পর একদিন সত্যিই কয়েকটা জামাকাপড় আর দশটা টাকা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।