—যাঃ, তা কেন করবে?
—কোন কারণে হয়ত মালিকের ওপর রাগ আছে।
—না রে। এরা সবাই পুরনো আর বিশ্বাসী লোক। দেখছিস না মালিকের এতবড় ক্ষতি হয়ে গেল বলে সবাই সার দিয়ে বসে কাঁদছে। এরা কেউ নয়—
—তা হলে?
—জানি না।
ধন্য ঘনরামের স্থৈর্য চুপ করে দাঁড়িয়ে তিনি আগুনের বিধ্বংসী কাণ্ড দেখলেন। তার মুখ দেখে এমন কি যতীন ঘোষালও কোনো সমবেদনার কথা বলতে সাহস করল না।
আগুন যখন প্রায় নিভে এসেছে, ঘনরাম ভৃত্যদের মধ্যে কাউকে হাক দিয়ে। বললেন, এই, কে আছিস; বাড়ি থেকে গোটাকতক সুপুরি নিয়ে আয় তো—
যতীন ঘোষাল ভয়ে ভয়ে বললেন, সুপুরি কি হবে চৌধুরমশাই?
ঘনরাম উত্তর দিলেন না।
কে একজন কাগজের ঠোঙায় সুপুরি নিয়ে এল। ঠোঙা হাতে ঘনরাম ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক নিভে আসা অগ্নিকুণ্ডে দু-একখানা করে সুপুরি ছুড়ে দিতে লাগলেন। কৃষ্ণরাম এগিয়ে এসে ভীত গলায় বললেন, এসব কি হচ্ছে দাদা?
ঘনরাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসলেন। বললেন, আগুনকে দিচ্ছি। সবই তো খেলো, এবার একটু মুখশুদ্ধি করুক—
কৃষ্ণরাম হাত ধরে দাদাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
এরপর ঘনরাম জেদ ধরলেন শিবরামের বিয়ে দেবেন। দাদার জেদ দেখে বিপন্ন হয়ে কৃষ্ণরাম বললেন, কিন্তু দাদা, শিবু এখনো পড়ছে। এ সময়ে বিয়ে দিলে ওর পড়াশুনো আর হবে না—
ঘনরাম ভাইয়ের আপত্তিতে কান দিলেন না। বললেন, বোকামি করিস না কেষ্ট। বুঝে দেখ, আমাদের বংশের বৃদ্ধি নেই একদম! ওই শিবুই যা কিছু তোর-আমার ভালোমন্দ কিছু হলে শিবু ভেসে যাবে। ওকে তাড়াতাড়ি সংসারী করে দেওয়াই ভাল।
শিবরামের বিয়ে হয়ে গেল।
এর বছরখানেক পরে এক জ্যোৎস্নারাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে পান মুখে দিয়ে শুতে এসে একবার জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন ঘনরাম। পিক ফেলবার জন্য জানলা দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঘনরাম দেখলেন বাগানে নতুন লাগানো কলমের আমগাছটার নিচে চাদের আলোয় ক্ষুধিত দৃষ্টি নিয়ে শ্রীপদ দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে শ্রীপদ বলল, মনে আছে তো? তার ডাকে কমলা ছুটে এলেন।–কি হয়েছে গো?
–দেখ দেখি বাগানে আমগাছের তলায় ও কে দাঁড়িয়ে?
কমলা তাড়াতাড়ি জানালার কাছে গেলেন–কই, কেউ নেই তো?
ঘনরাম বিহুল গলায় বললেন, নেই? তাহলে কোথায় গেল?
—কে?
—যে দাঁড়িয়েছিল ওইখানে?
ভীত কমলা স্বামীকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সেদিন ছিল শুক্লা ত্রয়োদশী। কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশীতে ঘনরাম মারা গেলেন। মাত্র তিপ্পান্ন বছর বয়েস হয়েছিল তার।
কৃষ্ণরাম ভয় পেলেন কিনা জানি না, কিন্তু কেমন যেন উদাস মত হয়ে গেলেন।
সময় গড়িয়ে যেতে লাগল। বছর দুই পরে একটি ছেলে হল শিবরামের। এই সময়টা আমি গ্রামে ছিলাম না, সাধুসন্ন্যাসীর সঙ্গ করে বেড়াচ্ছিলাম শ্মশানে-মশানে! এই সময়ে বীরভূমের এক শ্মশানে মাতু পাগলীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়—সে গল্প তো তোমরা জানো!
ঘনরাম মারা যাবার পর বছর দশেক আর কোনো ঘটনা ঘটল না চৌধুরী বাড়িতে। বাড়ির এবং গ্রামের লোকেরাও আগের সমস্ত ঘটনাকে নেহাত সমাপতন বলে মেনে নিল।
কৃষ্ণরামের বয়েস এখন ষাট। একদিন দুপুরে বসে তিনি কি সব কাগজপত্র দেখছেন, বেলা আড়াইটে-তিনটে, বা বা করছে চৈত্রমাসের দুপুর—তার আট বছরের নাতি বলরাম এসে বলল, দাদামশাই, একটা লোক আপনাকে খুঁজছিল—
কৃষ্ণরাম বললেন, কে রে? কোথায়?
–বাইরে। আপনার নাম করে বলছিল—
কৃষ্ণরাম একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, যা, এখানে নিয়ে আর তোর মামার বাড়ির কেউ না তো
—নাঃ, তাদের সবাইকে আমি চিনি। এ লোকটা ভিখিরিমতন, নোংরাপানা—
কৃষ্ণরাম রীতিমত অবাক হয়ে বললেন, ভিখিরি এসে নাম ধরে আমার খোজ করছিল?
—হ্যাঁ। কালোমত লোকটা, খালি গা। চোখদুটো দেখলে ভয় করে দাদামশাই! আমাকে দেখে একটা আঙুল তুলে লোকটা বলল—কৃষ্ণরামকে গিয়ে বোলো, তার মনে আছে তো? ও হ্যাঁ, লোকটা নিজের নাম বলল শ্রীপদ, শ্রীপদকে মনে আছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বলল। কে লোকটা দাদু?
বিবর্ণমুখে কাজ ফেলে নাতিকে কোলে নিয়ে ভেতরবাড়িতে উঠে গেলেন কৃষ্ণরাম।
এক মাসের মধ্যে সন্ন্যাসরোগে কৃষ্ণরাম গত হলেন।
দেশের জমিজমা ভাগচাষীদের দিয়ে ছেলে-বৌ আর মাকে নিয়ে শিবরাম কলকাতায় চলে গেল। সেখানে সে বড় চাকরি করে। আধুনিক ছেলে, চাষবাসে বা বিষয়কর্মে তার তেমন উৎসাহ নেই। কমলাও সঙ্গে গেলেন।
এ কাহিনী বলতে আমার ভালো লাগছে না। রামরামের মৃত্যুর পর থেকে সবটাই মরে যাবার, উড়ে-পুড়ে যাবার ইতিহাস। যতই দোষ থাক, কিছু মানুষ খুব কষ্ট পাচ্ছে—এ দেখতে বা ভাবতে ভালো লাগে না। তবু শুরু যখন করেছি, শেষ অবধি বলি।
কৃষ্ণরাম সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করার পর বছরদশেক সব শান্ত। গল্প বলার সময় দশ বছর কথাটা এক নিঃশ্বাসে বলা গেলেও দশ বছর কাটতে ঠিক দশ বছরই লাগে। এই দীর্ঘ সময়ে পারিবারিক অভিশাপের স্মৃতিটা আবছা হয়ে এল। মানুষ দুঃখের স্মৃতি ভোলবারই চেষ্টা করে, বা একটা অবচেতন প্রচেষ্টা সব সময়েই থাকে— তার সঙ্গে কালের ব্যবধান মিলে চৌধুরী পরিবার থেকে কালো ছায়াটা একেবারে মুছে গেল।
এখন বলরামের বয়েস ষোলো, শিবরামের বয়েস বছর চল্লিশ। কলকাতায় যে বাড়িটা ভাড়া নিয়ে শিবরাম ছিল, তার তিনদিকে ঘর মাঝখানে উঠোন। উঠোনে চৌবাচ্চা। স্নান করা, বাসনমাজ বা কাপড়কাচা ইত্যাদি উঠোনেই সারা হয়। উঠোন থেকে রোয়াকে ওঠবার সিড়িতে বড় উঁচু উঁচু ধাপ। কমলা আর নিরুপমার (কৃষ্ণরামের স্ত্রী) বয়েস অনেক হল, অত উঁচু ধাপ ভেঙে বারান্দায় উঠতে কষ্ট হয়! শিবরাম জনাতিনেক মিস্ত্রি ডাকিয়ে পুরনো সিড়ির দু-দিক দিয়ে নতুন করে কয়েকটা ধাপ গাথাবার ব্যবস্থা করল। সেদিন তার অফিসে জরুরি কাজ আছে, না গেলেই নয়। অফিস থেকে সন্ধ্যেবেলা ফিরে শিবরাম দেখল গাথনির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। বলরাম বলল, তোমার আজ ফিরতে দেরি হল বাবা?