আমাদের মাথার ওপর ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, আমরা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে হা করে দেখছি ওই অলৌকিক দৃশ্য। যেভাবে আমরা আগুন নিভিয়ে দিয়ে এসেছি তাতে তা আর জ্বলে ওঠার সম্ভাবনা খুবই কম। আর এই প্রবল বর্ষণের ভেতর আগুন জ্বলছেই বা কি উপায়ে?
আমাদের গা বেয়ে জল পড়ছে। এত ভিজে গিয়েছি যে শুকোতে এক হস্তা লাগবে মনে হচ্ছে। কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতাম জানি না, একসময় ভবেশ ভট্টচার্য বললেন—কৃষ্ণরাম, চল। এ সময় পথে দেরি করতে নেই। ঈশ্বরের নাম নাও—ঈশ্বর পরমকারুণিক।
চৌধুরীবাড়ি পৌঁছে সবাই নিমপাতা দাঁতে কেটে লোহা ছুঁয়ে শুদ্ধ হলাম। এতরাতে এই বৃষ্টিতে আর কেউ বাড়ি গেল না, চৌধুরীদের বৈঠকখানায় বসে নানা গল্প হতে লাগল। ভেতরবাড়ি থেকে শ্মশানবন্ধুদের জন্য গৃহিণীরা আলাদা আলাদা কাসার জামবাটিতে ঘন দুধ, মর্তমান কলা, আখের গুড় আর চিড়ে পাঠিয়ে দিলেন ফলার করবার জন্য। ঘনরাম কিছু পরে বৈঠকখানায় এসে বসলেন। তার মুখ গম্ভীর। যতীন ঘোষাল কয়েকবার সময়োচিত কি সব কথা বলতে গিয়ে তেমন সাড়া না পেয়ে দমে গিয়েছেন। ঘনরাম কেবল মাঝে মাঝে বলছেন, বাবার চিতা ফের জ্বলে উঠল কেন পণ্ডিতমশাই? কিছু বলতে পারেন? ভবেশ ভট্টাচার্য উত্তর দিচ্ছেন, ঈশ্বরকে ডাকো। কোনো প্রশ্ন করো না, তাকে বিশ্বাস করো—
কিছুদিন কেটে গেল। দুই ভাই বিষয়সম্পত্তির কাজ নিজেদের হাতে নিয়েছেন। দুজনে খুব ভাব, সম্পত্তি ভাগ করার প্রশ্ন ওঠে নি। তাছাড়া ঘনরাম অপুত্রক, তার মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই তার অংশ কৃষ্ণরামের ওপর বর্তাবে। কৃষ্ণরামের একটিমাত্র ছেলে—শিবরাম। সে বর্তমানে কলকাতায় থেকে কলেজে পড়ে। পিতার মৃত্যুদিনের ঘটনা আস্তে আস্তে সবাই ভুলে যাচ্ছে।
এ কাহিনীর কিছু কিছু ঘটনা পরে আমি লোকের মুখে শুনেছি, কারণ চৌধুরী বাড়ির ভেতরে কি ঘটছে তা বাইরে থেকে আমার জানা সম্ভব নয়। তবে একটা কথা। ভুলে যাবার আগেই এখানে বলে রাখি, রামরামের মৃত্যুর দুদিন পরে গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে নদীর উজানে হবিবপুরের বাঁকে শ্রীপদর মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল।
একদিন সন্ধ্যেবেলায়, তখন কাছারির আমলাদের ছুটি হয়ে গিয়েছে—ঘনরাম নিচে রয়েছেন, কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে এখনই ওপরে আসবেন। কৃষ্ণরাম দোতলার বারান্দায় কুশাসন পেতে আহিকের উদ্যোগ করছেন, হঠাৎ নিচে থেকে দাদার ক্রুদ্ধ গলা শুনতে পেলেন। ঘনরাম যেন রেগে গিয়ে কাকে বলছে—না! না! যাও—
তখনো আহ্নিক শুরু করেন নি, একটু অবাক হয়ে পায়ে পায়ে নিচে নেমে এলেন কৃষ্ণরাম। দেখলেন একতলার টানা বারান্দায় একটা মোটা থামের পাশে অন্ধকারের মধ্যে ঘনরাম দাঁড়িয়ে রয়েছেন। তার মুখ পাংশু। আশেপাশে আর কেউ নেই। বিকেল পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটায় কাছারি শেষ হবার পর এই সা চারকবাকরদেরও একটু ছুটি থাকে। তারা বাগানের শেষে নিজেদের ঘরে বসে হয়ত তামাক খাচ্ছে। তাহলে কাকে বকছিলেন ঘনরাম?
—কি হয়েছে দাদা?
ঘনরাম প্রথমে কোনো উত্তর দিলেন না। কৃষ্ণরাম বললেন, চল, ওপরে চল–
দাদার হাত ধরে ওপরে আনবার সময় কৃষ্ণরাম লক্ষ্য করলেন দাদার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
ঘরে এনে দাদাকে বসিয়ে কৃষ্ণরাম বললেন, কি ব্যাপার? চেঁচালে কেন?
নিতান্ত সংকটেও ঘনরাম নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে লজ্জা পেতেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, শ্রীপদকে দেখলাম।
আশ্চর্য হয়ে কৃষ্ণরাম বললেন, শ্রীপদ সে কি কথা? কোথায়?
–-কাছারি শেষ করে ওপরে আসছি, একতলার বারান্দায় উঠতেই একটা থামের পেছন থেকে বেরিয়ে এল। সেই চেহারা, বুঝলি? সেদিন যেমন দেখেছিলাম—
-কিন্তু তা কি করে হবে দাদা? আমাদের সামনেই তো—পরে দেহও ভেসে উঠেছিল, সে খবর তো জানো? তুমি আলো-আঁধারিতে ভুল দেখেছ—
ঘনরাম দৃঢ় গলায় বললেন, না, আমি ঠিকই দেখেছি। শ্রীপদ আমার সঙ্গে কথাও বলল।
—কথা বলল? কি রকম?
–সেদিনের মত আঙুল তুলে আমাকে বলল, চৌধুরমশাই, মনে আছে তো?
কৃষ্ণরামের গা ছমছম করে উঠল। ঘনরাম বললেন, কেষ্ট, তুই কলকাতা থেকে শিবুকে আনিয়ে নে কিছুদিন বাড়িতে রাখ। লোকের আশীর্বাদ ফলে না, কিন্তু অভিশাপ ফলে যায়। বাড়ির ছেলে বাড়িতে এসে থাকুক–
বাবার জরুরি তার পেয়ে শিবরাম বাড়ি এল। সে আধুনিক ছেলে, এসব কুসংস্কারে তার বিশ্বাস নেই। তবু বাবা-জ্যাঠার সঙ্গে তর্ক করে মাসখানেক দেশের বাড়িতে রয়ে গেল।
আঘাতটা এল অন্য দিক দিয়ে।
শিবরাম বাড়ি আসার সাত-আটদিন পর চৌধুরীবাড়িতে আগুন লাগল। মুল বাড়ি পাকা, আগুনের আঁচে কিছু ক্ষতি হলেও বড় রকমের বিপর্যয় কিছু হল না। কিন্তু উঠোনের দশ-বারোটা ধানের গোলা পুড়ে একদম ছাই হয়ে গেল। সব মিলিয়ে প্রায় চারশে মণ ধান। পাড়াগাঁয়ে দমকল থাকে না, আগুন দেখে আমরা দৌড়ে গেলাম, সমস্ত গ্রাম ভেঙে পড়ল। পেছনের দীঘি থেকে বালতি বালতি জল নিয়ে ছুড়ে দেওয়া হতে লাগল অগ্নিকুণ্ডের ভেতরে কিন্তু আগুন ততক্ষণে বেশ ভালরকম ধরে উঠেছে, দু-এক বালতি জলে কিছু হবার নয়। লম্বা লাইন করে দাঁড়িয়ে আমরা জলের বালতি হাতে হাতে আগুনের কাছে পৌঁছে দিচ্ছিলাম। আমার পাশে ছিল হরেন, সে বলল—একটা ব্যাপার কিন্তু অদ্ভুত, বুঝলি?
বললাম, কি?
—সবগুলো গোলায় একসঙ্গে আগুন ধরলো কিভাবে? একেবারে গায়ে গায়ে তো দাঁড়িয়ে নেই। আশ্চর্য। এ যেন মনে হচ্ছে কেউ নুড়ো হাতে সবগুলোতে আগুন দিয়ে বেড়িয়েছে। হ্যারে তারানাথ, চাকরগুলোর ভেতর কেউ করেনি তো?