-এই দেখ, কানাই জেলে কত বড় মাছ দিয়ে গিয়েছে। রাত্তিরেই রান্না করে খেয়ে না ফেললে এই গরমে পচে যাবে। যাও, উনুনে আঁচ দাও দেখি। ছোটবউমা মশলা বেটে ফেল। মাছটা কিছুক্ষণ পড়ে থাক—একেবারে তাজা ইলিশ খেতে ভাল লাগে না। একটু সময় গেলে স্বাদ হয়। যাও, জালা থেকে পাটনাই বালাম চাল সের দুই বের করে নাও। খোকাদের এখন ডেকে কাজ নেই। রান্না হয়ে গেলে ওরা উঠে খাবে এখন।
সময় যায়। উনুন ধরে গেল। মশলা বাটা হয়ে গিয়েছে। দুই বৌ গালে হাত দিয়ে বসে মাছটার পেটে আঙুলের চাপ দিয়ে পরীক্ষা করছেন। দুই বৌ আশায় আশায় তাকাচ্ছেন শ্বশুরের দিকে। রামরাম মাথা নেড়ে বলেন, উহু, আরও এক টিপ বসবে।
আবার পায়চারি। আবার অপেক্ষা।
রাত তিনটেয় হয়ত হুকুম হল রান্না শুরু করবার।
কাজেই ঠিক সময়ে গেছেন রামরাম। আরও আগে গেলেও কেউ দুঃখ করত না। দুপুরের মধ্যে দেহ নিয়ে বেরিয়ে পড়তে পারলে ভাল হত। কিন্তু বেলা নটা থেকে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হল বিকেল অবধি। একটু করে থামে, সবাই মিলে বেরুবার উদ্যোগ করি, আবার ঝুপকুপ করে শুরু হয়।
যতীন ঘোষাল বলল, আকাশের গতিক তো ভাল না। চৌধুরীমশায়, আবার বৃষ্টি আরম্ভ হলে বিপদ
ঘনরাম উত্তর দিলেন, কি আর করা যাবে? গিয়ে তো পৌঁছোই—
কৃষ্ণরাম বললেন, সেখানে কোনো ছাউনি-টাউনি কিছু নেই? জল এলে মাথা বাঁচানো যাবে তো?
যতীন ঘোষাল বললেন, আহা, সে রয়েছে। কিন্তু সেটা তো বড় কথা নয়—আমরা–হয় বৃষ্টিতে না ভিজলাম, কিন্তু জল হলে তো আর দাহ করা যাবে না। সারারাত বসে থাকলে মৃতদেহ বাসী হয়ে যাবে। বিপদ হল—
কৃষ্ণরাম বললেন, একটু পা চালিয়ে এগোন—
গ্রামের ধার দিয়েই নদী। শ্মশান নদীর ধারে হলেও গ্রামের কাছে নয়। নদীর উজানে মাইল দেড়েক গিয়ে তবে। সেখানে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল।
কেউ কোথাও নেই। কাছে দূরে অপার্থিব স্বরে শেয়াল ডাকছে। মেঘ থমকে আছে সারাটা আকাশ ভরে। আমার তখন যদিও সতেরো-আঠারো বছর বয়েস, কিন্তু শ্মশানে সেই নিয়ে বোধ হয় পনেরো-কুড়িবার যাতায়াত হয়ে গিয়েছে। বলতে কি, শ্মশান জায়গাটা আমার কোনদিনই খুব একটা ভীতিকর বলে মনে হয় নি–বরং বেশ পবিত্র বলে মনে হত। কিন্তু সেদিন আমার কেমন যেন গায়ে কাটা দিতে লাগল। আজ এখানে যেন একটা খারাপ কিছু ঘটবে, একটা অমঙ্গলজনক কিছু দেখতে পাব।
শ্মশানবন্ধুদের জন্য একটা চালাঘর বাধা আছে। তার নিচে মৃতদেহ নামানো হল। ওসব দেশে দাহ করার কাঠ কিনতে পাওয়া যায় না। চৌধুরীবাড়ির চারজন চাকর মাথায় করে কাঠের বোঝা বয়ে আনছিল। ঘনরাম আর কৃষ্ণরাম তামাক খেতে লাগলেন। যতীন ঘোষাল দায়িত্ব নিয়ে কাজে লাগলেন—এই ছেলেরা! আর বসে কেন বাবা? চটপট একটা লম্বা গর্ত খুঁড়ে কাঠ সাজিয়ে ফেলো—ভালোয় ভালোয় কাজটা হয়ে গেলে বাচি! আর বিশ্রাম করতে হবে না, দেখছ না আকাশের অবস্থা?
নিঃশব্দে কাজ হতে লাগল। কেবল পুরুত ভবেশ ভট্টচাযের গুনগুন করে গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের পাঠ শোনা যাচ্ছে। আর হুঁকোর সুরসুর শব্দ।
আমরা ক’জন ক্লান্ত হয়ে চালাঘরের আড়ালে তামাক খেতে গিয়েছি—আমাদেরই বন্ধু হরেন, সে তামাক খায় না, এক চিতা সাজাচ্ছে। চালা থেকে বেশ কিছুটা দূরে চিতা সাজানো হয়েছে—যাতে বর্ষার জোরালো হাওয়ায় আগুনের ফুলকি উড়ে এসে না পড়ে। আমরা তামাক খেতে খেতে হঠাৎ শুনলাম হরেনের ভীত গলা—কে? কে রে ওখানে?
আমরা দৌড়ে গেলাম, চালার তলা থেকে ঘনরাম, কৃষ্ণরাম, যতীন ঘোষাল এরা সব বেরিয়ে এলেন। ঘনরাম তার স্বভাবসিদ্ধ ভারী গলায় হেকে বললেন, কি হয়েছে হরেন?
কয়েকটা লণ্ঠন মাত্র সম্বল। বিরাট প্রান্তরের অন্ধকার তাতে আর কতটুকু দূর হয়? লণ্ঠন উঁচু করে তুলে দেখলাম হরেন ফ্যাকাশে মুখে পাশের ঝোপ-ঝাড়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
বললাম, কি হয়েছে রে?
পাংশু মুখে হরেন বলল, ওই ঝোপের মধ্যে কে দাঁড়িয়ে ছিল। স্পষ্ট নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনলাম। আমি চেঁচিয়ে উঠতেই জলা ভেঙে ওইদিকে পালিয়ে গেল।
শুনেই আমাদের গ্রামের সাহসী ছেলে বলে খ্যাত ঈশ্বর বাগচী হইহই করে একটা লাঠি হাতে ঝোপটার ওপর বেশ কয়েক ঘা বসিয়ে দিল। একটা ব্যাঙও বেরুল না সেখান থেকে।
আমরা বললাম, কোথায় কি রে?
হরেন সাহসী বলে খ্যাত না হলেও নিতান্ত ভীতু নয়। দেখলাম সে ঠকঠক করে কপিছে। সে বলল, না ভাই, তোমরা বললে তো হবে না, পায়ের শব্দ আর নিঃশ্বাসের আওয়াজ আমি স্পষ্ট শুনেছি। একেবারে গা ঘেঁষে ওই জল-জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল।
যতীন ঘোষাল বললেন, আচ্ছা থাক্ থাক, এখন কাজ শুরু করে দাও। আর তোমরাও বাপু বিদঘুটে। অসময়ে তোমাদের ইয়ে চাগিয়ে উঠল। বন্ধুকে একলা ফেলে যাবার কি দরকার ছিল?
এত গোলমালেও একমাত্র ভবেশ ভট্টচার্য গীতাপাঠ থামান নি। শান্ত হয়ে বসে একই ভাবে গুনগুন করে পড়ে চলেছেন—ন জায়তে মিয়তে বা কদাচিৎ–
ঘনরাম এবং কৃষ্ণরাম পিতার যা যা শেষকৃত্য সব করলেন। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠল।
যতীন ঘোষাল রামরাম চৌধুরীর কাছে বেশ কিছু টাকা ধারতেন। ছেলেদের সুনজরে থাকলে সেটা মাপ হয়ে যেতে পারে এই আশায় ক্রমাগত বলে চলেছেন, সেই থেকে বৃষ্টি আটকে আছে। হবে না কেন? কতবড় একটা পুণ্যবান মানুষ! তার শেষ কাজে কি ভগবান বাধা দিতে পারেন? আহা, গ্রাম একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। অমন মানুষ আর হবে না—