রামদুলাল আমাকে আদর করে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে পাঁচশোটা টাকা দিয়ে প্রণাম করল। আমি আপত্তি করেছিলাম, বাধা দিয়ে সে বলল—আপনি বুদ্ধি না দিলে আমরা কি মেঝে খুঁড়তে যেতাম?
এর দিন দশেক পরে রামদুলালকে আবার একবার দেখেছিলাম। আমার বাড়িতে এসেছিল দুই ছেলেকে নিয়ে, মুখে হাসি। বললাম—কি হে, কি খবর?
-–আজ্ঞে, আত্মার আশীর্বাদ সত্যিই আছে।
—কি রকম?
রামদুলাল খুশির হাসি হেসে বলল—মাড়োয়ারী ব্যাটা গতকাল বিল পেমেন্ট করেছে। তারানাথ গল্প থামাল। রাত বেড়ে চলেছে। রামদুলালের সত্তর হাজার টাকা হল বটে, কিন্তু আমাদের কাল আবার আপিস যেতে হবে। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে বাড়িমুখে রওনা হলাম।
০৩. রামরাম চৌধুরীর মৃতদেহ
তারানাথ বলল—রামরাম চৌধুরীর মৃতদেহ নিয়ে যখন গ্রাম থেকে বেরুলাম তখন দিনের আলো নিভে এসেছে। শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহ। সেবার বৃষ্টি হয়েছিল খুব মাঠে-ঘাটে জল থৈ থৈ করছে। পথ পেছল, সারাদিন জল হয়ে সবে একটু ক্ষান্তি দিয়েছে। কিন্তু বিশেষ ভরসা পাওয়া গেল না, আকাশে মেঘের কোলে কোলে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ-ঠাণ্ড শিরশিরে বাতাস দিচ্ছে পুব দিক থেকে। গায়ের মাতব্বর যতীন ঘোষাল ডেকে বলল—তাড়াতাড়ি পা চালাও হে সব, জল তো আবার এল বলে!
যতীন ঘোষাল বললে কি হবে, তাড়াতাড়ি পা চালাবার উপায় নেই কোনো। আলের ওপর দিয়ে রাস্তা, তারপর কিছুদূর গিয়ে মাইলখানেক মাঠ ভাঙতে হবে। এটেল মাটি বৃষ্টিতে ভিজে বিউলির ডালের মত হড়হড়ে হয়ে আছে, তাতে কাধের ওপর চৌধুরীমশায়ের দুধ-ঘি-খাওয়া শরীরের ভার। অনেক বয়েসে মারা গেলে কি হয়, রামরাম চৌধুরী বিশাল পুরুষ ছিলেন। যদি পা হড়কায় এবং স্বগত চৌধুরীমশায় আমাদের কারও ওপরে পড়েন, তাহলে তাকেও এযাত্রা চৌধুরী মশাইয়ের সঙ্গী হতে হবে।
আমরা দলে রয়েছি পনেরো-ষোলো জন মানুষ। খাটিয়ার সামনের দিকে ডাইনে-বায়ে কাঁধ দিয়েছেন রামরাম চৌধুরীর দুই ছেলে–ঘনরাম আর কৃষ্ণরাম। তাদের দুজনেরই বয়েস হয়েছে পঞ্চাশের ওপরে। কয়েক পা গিয়ে হাপিয়ে যাচ্ছেন, গায়ের ব্রাহ্মণ ছোকরারা এগিয়ে পালা করে তাদের রেহাই দিচ্ছে।
চৌধুরীরা ঠিক জমিদার না হলেও আমাদের গ্রামের সবচেয়ে ধনী ভূস্বামী ছিলেন। ধনোপার্জনের ব্যাপারে রামরামের কোন নীতির বালাই ছিল না। সুদের ব্যবসাতেও প্রচুর টাকা করেছিলেন। রামরাম মারা গেলেও তার খাতকদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবার কোন কারণ ঘটল না। ঘনরাম এবং কৃষ্ণরাম বৈষয়িক ব্যাপারে উপযুক্ত ছেলে। পিতৃব্যবসায় সমান তেজে বজায় থাকবে।
রামরাম চৌধুরী হঠাৎ মারা গেলেন। চুয়াত্তর বছর বয়েস হয়েছিল বটে, কিন্তু দিব্যি স্বাস্থ্য, সপ্তাহে দু-দিন পাঠার মুড়ো খান। দেড়সের দুধ জুলি দিয়ে আধসের করে সকালের জলখাবার। একটা গোটা ইলিশ কিম্বা ভরপেট খাওয়ার পর কুড়িটা বড়মাপের ল্যাংড়া আম তো কোনো ব্যাপারই ছিল না। জীবনে একটা চোয়া ভেঁকুরও তোলেন নি। এইরকম মানুষ রামরাম তিনচারদিন আগে খেতে বসে কয়েক গ্রাস মুখে তুলে তারপর খাওয়া থামিয়ে কেমন ভাবে যেন ভাতের থালার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বড় পুত্রবধূ কমলা, ঘনরামের স্ত্রী, পাশে বসে পাখা নেড়ে হাওয়া করছিলেন। শ্বশুরের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল দেখে তিনি মনে মনে শঙ্কিত হলেন। ভোজনবিলাসী বদমেজাজী লোক, কি ক্রটি হল কে জানে! নিজের হাতে পাকা রুই মাছের কালিয়া, সরষে-বেগুন, পোস্তর বড়া—এসব করেছেন। রান্না খারাপ হলে সারাদিন এর জের চলবে।
মৃদু গলায় কমলা জিজ্ঞেস করলেন, রান্না কি ভাল হয়নি?
উত্তর না দিয়ে রামরাম গেলাসের জল দিয়ে পাতের ওপরেই হাত ধুয়ে ফেলে শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে কমলাকে বললেন, ঘনা আর কেষ্টকে আমার ঘরে আসতে বল—
এসব ঘটনা আজই সকাল থেকে ঘনরাম আর কৃষ্ণরামের মুখে শুনেছি। ঘনরাম খিড়কির পুকুরে ছিপ ফেলে বসেছিলেন, কৃষ্ণরাম বৈঠকখানায় বসে সামনের মোকদ্দমার সাক্ষীদের তালিম দিচ্ছিলেন। বাপের তলব আদালতের সমনের চেয়েও ভয়ানক—দুই ছেলে ধড়মড় করে উঠে ভেতরবাড়িতে হাজির হলেন।
শোবার ঘরে রাতের আগে আসেন না রামরাম। দু’ছেলে গিয়ে দেখলেন বাবা বিছানায় শুয়ে। ঘনরাম বললেন, কি হয়েছে বাবা?
—এখানে এসে বোস দুজনে।
–কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?
একটু চুপ করে থেকে রামরাম বললেন, আমার যেখানে যা আছে তোরা বুঝে নে, আমার আর বেশি সময় বাকি নেই।
অবাক হয়ে কৃষ্ণরাম বললেন—সে আবার কি? শরীর কি অসুখ বলে মনে হচ্ছে? বলো তো কালীগতি কবিরাজকে একটা খবর দিই?
-থাম্। এ কবিরাজ ডাকবার ব্যাপার নয়। আমি টের পেয়েছি আমার ডাক এসেছে। দুপুরবেলা খেতে বসে আমার মুখে ভাত তেতো লাগল।
–ভাত তেতো লাগল। তাতে কি? রান্না পুড়ে গিয়েছিল?
-না, এ সে-রকম তেতো না। এ অন্যরকম তেতোভাব। মানুষ মরবার আগে তার মুখে ধানের ভাত তেতো লাগে। তোরা সব বুঝে নে—নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করবি না—আমি সব চুলচেরা ভাগ করে দিয়ে গেলাম। উইল রেজেষ্ট্রি করা আছে। ওই দেয়াল আলমারি খুলে মোটা লম্বা খামটা নিয়ে আয় দেখি—
মোটামুটি এই ঘটনা। ছেলেরা বিষয়টাকে আমল দেয়নি। তিনদিন পর আজ সকালে ঘুম কখন পরপারে রওনা হয়েছেন।
সত্যি বলতে কি, লোক-দেখানো শোক কিছুটা করতে হলেও রামনামের মৃত্যুতে কেউই খুব একটা ব্যথিত হয় নি। ছেলেরা পঞ্চাশ পার করেও সম্পত্তির পুরো কর্তৃত্ব হাতে পাচ্ছিলেন না—প্রৌঢ় বয়েসে বাপের অধীন থাকা বড় কষ্টের। পুত্রবধুরাও শ্বশুরের বিখ্যাত মেজাজ ও সময় অসময়ে নানান উদ্ভট ফরমায়েস খাটা থেকে রেহাই পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। রাত গেল। তখন খাওয়াদাওয়া শেষ করে যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে। রামরাম ইলিশ হাতে এসে বলল—কি বলছেন বাবা?