রাত্তিরে ভেতর-বাড়ির বারান্দায় আসন পেতে বসে আবার এক বিপুল আয়োজনের সম্মুখীন হওয়া গেল। পুজোর পরাতের মত বড় বগী থালায় সরু চড়ুইপাখির নখের মত চালের ঘিভাত, ভেড়ার মাংসের কোর্মা, রুইমাছের কালিয়া, তিন-চার রকমের মিষ্টি।
বলরাম—করেছ কি! এত কখনও খাওয়া যায়? আর তাও বিকেলে ওই জলযোগের পর? তুলে নাও—এর অর্ধেকও আমি খেতে পারব না।
রামদুলাল বলল—আমার এই চাকরটি বড় ভাল রাধে। পাকা হাত। শুধু রান্নার জন্যই ষাট টাকা দিয়ে ওকে রেখেছি। আপনাকে রেধে খাওয়াবে বলে ওকে নিয়ে এলাম। আপনি না খেলে আমরা কষ্ট পাব। এমন কিছু বেশি তো নয়, খেয়ে নিন।
খাওয়ার গল্প আর বার বার করব না। এই প্রসঙ্গেই রামদুলালের কথাটা মনে এল বলে তোমাদের ভোজের বহরটার একটু ইঙ্গিত দিলাম। এক কথায় এরপর দুবেলা এরকম নানা বিচিত্র পদ তৈরি হতে লাগল আমার জন্য।
রাত্রেও শুয়ে ঘুম আসে না। একে চাপ খাওয়া হয়ে গিয়েছে, তার ওপর মনে কেমন একটা অমঙ্গলের ভাব। আমাদের গাঁয়ের সেই সাধুর কথা মনে আছে তো? সে বলেই দিয়েছিল, আমার এ ধরনের ক্ষমতা হবে।
পরদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। এইখানেই গল্পের আসল অংশের শুরু।
সকাল আটটা হবে। বৈঠকখানায় বসে আছি। রামদুলাল গিয়েছে স্নান করতে শচী বাড়ি নেই। বিকেলে ক্ষীর দিয়ে কি একটা খাবার তৈরি হবে, তাই সে গিয়েছে খাটি দুধের সন্ধানে। বাড়ির ডানদিকের কোণে বারান্দার শেষে খুব সুন্দর একটা স্নানের ঘর আছে, জমিদার সখ করে বানিয়েছিল। তার মেঝে সাদা পাথরে বাঁধানো, বুক অবধি দেওয়াল মোজেক করা। কানাই চাকর সকালে পুকুর থেকে স্নানের জল তুলে তাতে এনে রেখেছে। পুকুরেও অনায়াসেই স্নান করা চলত। কিন্তু নতুন বাড়ি কেনা হয়েছে, সব কিছু ব্যবহার করা চাই তো! রামদুলাল সেখানেই স্নান করছে।
হঠাৎ দরজার কাছে একটা আওয়াজ শুনে দেখি রামদুলাল এসে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। তার মুখ ভয়ে বিকৃত। বেচার কাঁপছে ঠকঠক করে। স্নান করতে করতে মাঝপথে বেরিয়ে এসেছে বোঝা যাচ্ছে। কাপড় ভেজা, গায়ে জল—মোছবার সময় পায়নি। বললাম—কি হয়েছে? ভয় পেলে নাকি?
রামদুলাল প্রথমটা কথাই বলতে পারে না। এই সক্কালবেলা কি দেখে অত ভয় পেল ও? ধমকে বললাম কি হয়েছে বলবে কিনা?
ও বলল—আমার সঙ্গে আসুন।
পেছন পেছন গেলাম। স্নানঘরের দরজার কাছে এসে ভেতরে মেঝের দিকে আঙুল দিয়ে কি দেখিয়ে রামদুলাল বলল—ওই, ওই যে—
প্রথমে কিছু বুঝতে পারলাম না। সাদা পাথরে বাঁধানো সুন্দর পরিষ্কার মেঝে কি দেখাচ্ছে রামদুলাল?
তারপরে দেখতে পেলাম জিনিসটা। মেঝের একটা পাথরের টালিতে যেন আবছা একখানা মুখ ফুটে উঠেছে। ঠিক। পুরো মুখ নয়—মুখের আদল মাত্র। চেষ্টা করলে বোঝা যায়। স্ত্রীলোকের মুখ। কারণ লম্বা চুলের আভাস দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সে মুখ সুন্দর নয়। কেমন যেন ভাঙাচোরা অবয়ব। যেন কষ্টে মুখ বিকৃত করে আছে।
এ আবার কি? মেঝের পাথরে কে ছবি আঁকল? কি দিয়ে আঁকল? রামদুলালকে জিজ্ঞাসা করলাম—এ ছবি এখানে কি করে এল?
—আজ্ঞে তা কি করে বলব?
—যখন বাড়ি কিনলে তখন ছিল না?
-–আজ্ঞে বাড়ি কেনার কথা কি বলছেন, আজ সকালে কানাই জল তুলে রাখছিল, আমি দাঁড়িয়ে তদারক করছিলাম—তখনও ছিল না। এই এখন চান করতে করতে হাতফসকে সাবানটা পড়ে গেল, তুলতে গিয়ে একেবারে চোখাচোখি! কি হবে ঠাকুরমশায়? বড় শখের বাড়ি–
বললাম–আচ্ছা তুমি আগে স্নান শেষ করে নাও। ভয় নেই, আমি এই দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম।
ভয়ে ছিটকিনি না দিয়ে কোনমতে দরজা ভেজিয়ে বাকি স্নানটুকু সেরে বেরুল রামদুলাল। মানুষ ভয় পেলে কি রকম হয়ে যায় তা আজ দেখলাম। প্রথম দিন রামদুলালকে কত ব্যক্তিত্ববান পুরুষ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু যা ধরাছোয়া যায় না, এমন অপ্রাকৃত ঘটনার সম্মুখীন হয়ে সে ব্যক্তিত্ব কখন বাতাসে উবে গিয়েছে।
বৈঠকখানায় বসে রামদুলাল বলল—এসেই ব্যবসার অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। বাজারে অনেক দেনা। এক ব্যাটা মাড়োয়ারীকে প্রায় সত্তর হাজার টাকার মাল সাপ্লাই করেছিলাম—তার দরুণ বিল সে কিছুতেই দিচ্ছে না। কেবল আজ-কাল বলে ঘোরাচ্ছে। মাড়োয়ারীর সঙ্গে কি আমরা পারি? আমারই ভুল হয়েছিল ওখানে মাল দেওয়া। কি করব, লোভে পড়ে গেলাম। এখন যদি বিল না আদায় হয়, তাহলে আমার ব্যবসা ডুববে। নালিশ করে টাকা আদায় করতে করতে তো আর ব্যবসা থাকবে না। এদিকে এই চিন্তা, এত টাকা দিয়ে বাড়ি যদি বা কিনলাম—এখন তাতে বাস করতে পারছি না। আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে ঠাকুরমশায়।
বললাম—আরে দাঁড়া ও। এত ব্যস্ত হলে চলবে কেন? ব্যবসায় লাভ-ক্ষতি, জোয়ার-ভাটা আছেই। ভেঙে পড়ার কিছু নেই। আর এ বাড়ির কথা বলি—আমার মনে হয় তোমাদের ভয়ের কিছু নেই।
–ভয়ের কিছু নেই?
-মনে হয়, না। ভেবে দেখ, যে আত্মাই এমন করুক না কেন, তার যদি তোমাদের ক্ষতি করবার ইচ্ছে থাকত, তাহলে সে তো তা অনায়াসেই করতে পারে। এতদিন চুপ করে আছে কেন?
রামদুলাল বলল—তাহলে ওই কান্নার শব্দ?
বললাম—হয়ত সেটা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করবার জন্য। সে হয়ত কিছু বলতে চায়।
-তাহলে এখন আমি কি করব?
-তুমি কিছুই করবে না। আমি আরও কয়েকদিন থাকব। দেখি কি হয়। যা করবার আমিই করব।
শচীদুলাল এসে স্নানঘরের মেঝেতে ছবিটা দেখল। তবে সে বাপের চেয়ে সাহসী। ভয় পেলেও মুখে কিছু বলল না।