কুঞ্জকামিনী বললেন—ওসব জানা আছে। আসলে আমাকে নেমন্তন্নর লিস্টি থেকে বাদ দেবার ইচ্ছে, আমি কি বুঝি না? তা কুঞ্জ কায়েনীকে অত সহজে বাদ দেওয়া যাবে না ভাই, সে কথাটা বলতে নিজে চলে এলুম।
জ্যাঠামশাই হাতজোড় করে বললেন—ও কী কথা দিদি, সত্যিসত্যিই আজ বিকেলে আমি যেতাম। আপনাকে বাদ দিয়ে এ গ্রামের কোনো শুভ উৎসব সম্ভব নাকি!
দিদিকে ভেতরবাড়ি থেকে এনে প্রণাম করানো হল। কুঞ্জকামিনী দিদির চিবুক ছুঁয়ে চুমু খেয়ে বললেন—তোমার ভাল নাম তো সিন্ধুলতা, না খুকি?
মাথা নেড়ে দিদি জানাল-হ্যাঁ।
কুঞ্জপিসি বললেন–যাও মা, ভেতরে যাও। এই তো আর কদিন বাকি, এখন খুব সাবধানে থাকবে। বাড়ির বাইরে একদম বেরুবে না। বিয়ের আগে খুব সাবধানে থাকতে হয় জান তো? যাও
দিদি ভেতরে গেলে কুঞ্জপিসি জ্যাঠামশাইকে ডেকে কাছে বসিয়ে বললেন-গোলোক, তোমার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে। বস্তুতঃ সেই কথা বলতেই আসা। নইলে আজকে তুমি নেমন্তন্ন করতে যাবে সে তো আমি জানতামই—
জ্যাঠামশাই কুঞ্জপিসির দিকে একমুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন—নেমন্তন্ন করতে যাবো, সেটা যে জানতেন তাতে আমার সন্দেহ নেই, কিন্তু আজই যে যাবো তা কী করে জানলেন?
কুঞ্জকামিনী সামান্য হাসলেন, বললেন—আমি জানতে পারি।
কুঞ্জকামিনীর বিচিত্র চরিত্র সম্বন্ধে আমাদের গ্রামের লোকেদের মধ্যে নানারকম মত প্রচালিত ছিল। কুঞ্জপিসি নিখুঁতভাবে মানুষের আসন্ন বিপর্যয়ের কথা বলে দিতে পারতেন, অনেকে বলে তিনি নাকি পশুপাখির ডাক শুনেও অনেক কিছু বুঝতে পারতেন—এবং সবক্ষেত্রেই দুর্বিপাক থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায়ও বলে দিতেন। এই কারণেই তাকে সকলে শ্রদ্ধা করতো, মানতো। অমঙ্গলের থার্মামিটার বলে মনে করার চেয়ে সবাই তাঁকে স্নেহময়ী পরিত্রাণকত্রী হিসেবে ভালবাসত। গ্রামর বয়স্ক মানুষেরা বলতেন কুঞ্জপিসীর ছোটবেলায় হিমালয় থেকে একজন সাধু এসে পিসির বাপের বাড়ির গ্রামে কয়েকদিন বাসা বেঁধেছিলেন। কুঞ্জপিসীকে কোলে নিয়ে তাঁর বাবা গিয়েছিলেন সাধুকে প্রণাম করতে। পিসিকে দেখে সাধু অবাক হয়ে বলেছিলেন—এ তো খুব উচ্চদশার মেয়ে তোমার ঘরে জন্ম নিয়েছে। একটা কথা বলি, মনখারাপ কোরো না। তোমার এ মেয়ের বিয়ে হবে বটে, কিন্তু সংসারধর্ম এর কপালে লেখা নেই। তার বদলে এক সুন্দর, দিব্য জীবন তোমার মেয়ে লাভ করবে। কিছু ক্ষমতা এ নিয়েই জন্মেছে, কিছু ক্ষমতা আমি দিয়ে যাচ্ছি। বহু মানুষের উপকার করতে পারবে তোমার এই মেয়ে।
আর ঠিক এই কারণেই কুঞ্জকামিনী আমাদের গ্রামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কারো কোনো দুঃসময়ে তিনি খবর না দিলেও এসে দাঁড়াতেন, একটা অদ্ভুত কিছু ভবিষ্যৎবাণী করতেন, এবং তা অবধারিতভাবে ফলে যেত। সিদ্ধবাক হিসেবে কুঞ্জপিসির একটা খ্যাতি রটে গিয়েছিল। মাধবখুড়ো জব্বলপুর যাবার জন্য বাক্সবিছানা গুছিয়ে বের হচ্ছিলেন, গরুর গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাতে মালপত্র তুলে তিনি দরজায় তালা লাগাচ্ছেন, এমন সময় কুঞ্জকামিনী বামুনপাড়া যাবার পথে থমকে দাঁড়ালেন। বললেন—কী ব্যাপার মাধব? কোথাও যাচ্ছ বলে মনে হচ্ছে–
মাধবখুড়ো তালাতে চাবি ঘুরিয়ে একবার টেনে দেখে ফিরে দাঁড়ালেন। বললেন–হ্যাঁ দিদি। জব্বলপুরে বড়ছেলেটা কাজ করে, বহুদিন থেকে তার কাছে যাব যাব ভাবছি। যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। তা এবার একটু সুযোগ পেয়ে বেরিয়ে পড়েছি। এমন সময়ে এলেন দিদি, একটু বসতেও বলতে পারলাম না, বড় খারাপ লাগছে–
কুঞ্জকামিনী একবার আকাশের দিকে তাকালেন, চোখ বুজে কী ভাবলেন, তারপর বললেন-না মাধব, তোমার এখানে একটু বসেই যাই। দরজা খোলো—
মাধবখুড়ো অস্বস্তিতে পড়লেন। এ কেমন কথা বলছেন কুঞ্জকামিনী? এক্ষুণি না রওনা হলে বারো মাইল দূরের শহরে গিয়ে বাস ধরতে পারবেন না, আর বাস না পেলে জংশনে গিয়ে মেল ট্রেন পাবেন না। এদিকে কুঞ্জকামিনীর কথাও অমান্য করা যায় না। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তার, যা বলেন তা খেটে যায় বলেও নামডাক আছে। মাধবখুড়ো বিব্রত হয়ে বললেন—আমার বাড়িতে বসবেন এ তোত আমার সৌভাগ্য। কিন্তু দিদি, অপরাধ নেবেন না, এখনই না বেরুলে যে আমি ট্রেন পাবো না—
হিমশীতল গলায় কুঞ্জকামিনী বললেন—তোমাকে ট্রেন পেতে হবে না। তোমার যাওয়া বাতিল। কেন খামোকা বকাচ্ছ মাধব? দরজা খুলে দাও, বসি—
এবার মাধববুড়ো ভয় পেয়ে গেলেন। কুঞ্জকামিনীর চোখে কী এক অনির্দেশ্য রহস্যের ছায়া। এ মানুষের কথা অমান্য করা যায় না। তিনি আবার দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে। ঢুকলেন, তালপাতার চাটাই এনে বসতে দিলেন কুঞ্জকামিনীকে। বললেন—কী ব্যাপার, দিদি।
–কীসের কী ব্যাপার?
—আমাকে যেতে বারণ করলেন কেন?
কুঞ্জকামিনী একটু রাগত স্বরে বললেন–বেশ করেছি বারণ করেছি। গুরুজন মানুষের কথা না হয় শুনলেই। অত কৈফিয়ৎ চাইছ কী জন্যে? আর যদি একান্তই যেতে ইচ্ছে করে তাহলে বেরিয়ে পড়, গাড়ি তো দাঁড়িয়েই আছে—
গাড়োয়ান নিবারণ ঘরামি এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে বলল—-খুড়োমশাই, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু, এর পরে হলে আর বাস ধরাতে পারব না–
মাধববুড়ো একটু ইতস্তত করলেন, একবার কুঞ্জকামিনীর দিকে তাকালেন, তারপর বললেন–ইয়ে, নিবারণ, আজ আর আমার যাওয়া হবে না। তুমি বরং মালপত্রগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে দাওয়ায় এনে রাখ–