তিনি আবার লম্বা হয়ে শুয়ে চোখ বুজলেন। অবাঙালী ভদ্রলোক সেই যে খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়েছেন, সারারাত ট্রেনের দুলুনি ঝাঁকুনি বা আমাদের কথাবার্তার শব্দে। তার নিদ্রার কিছুমাত্র ব্যাঘাত ঘটেনি। এসব নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ মানুষ দেখলেও হিংসে হয়।
রাউলকেল্লা পৌঁছনো পর্যন্ত সত্যিই আমার আর ঘুম হল না। শুক্লা নবমীর চাঁদ পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, সট সফ্ট পিছিয়ে যাওয়া বড় বড় গাছগুলোর দীর্ঘ ছায়া মাটিতে। হঠাৎই একটা কালো গ্রানাইটের টিলা লাইনের পাশেই, ক্ষীণধারা ঝর্না নেমে এসেছে তার গা বেয়ে। আর সবকিছুর ওপর সেই ম্লান হয়ে আসা শেষরাতের মায়াবী জ্যোৎস্না। সম্মোহিতের মত বাকি রাতটুকু জানালার পাশে বসে কাটিয়ে দিলাম।
ট্রেন যখন রাউরকেল্লা পৌঁছল তখনও ভাল করে ভোর হয়নি। আমরা তিনজন যখন স্টেশনের বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখনও মানুষজন জাগেনি, দু-তিনটে ছোট গুমটি দোকান আছে—বোধহয় চা বা খাবারের, সেগুলো বন্ধ। কেবল মাথায় পাগড়ি জড়ানো এক বৃদ্ধ নলওয়ালা পেতলের কলসীতে করে চা বিক্রি করছে। তাকে ডেকে সবাইকে চা দিতে বলা হল। ভঁড়ে চুমুক দিয়ে মেজকর্তা বললেন–সিমডেগা থেকে জিপ নিয়ে লোক আসবার কথা ছিল, কী হল তাদের বুঝতে পারছি না তো–
প্রথম ভাঁড় শেষ করে মেজকর্তা চাওয়ালাকে বললেন–আর একবার করে দাও, এই এতেই দাও—
দ্বিতীয়বারের চায়ে যখন চুমুক দিচ্ছি, তখনই একটা রঙওঠা উইলির জিপ নানারকম শব্দ করতে করতে স্টেশন চত্বরে এসে ঢুকল। তার থেকে নেমে হহ করে আমাদের সামনে দাঁড়াল এক অদ্ভুত চেহারার মানুষ। অদ্ভুত বলছি এই কারণে যে, লোকটি কেবলই লম্বা—তার শরীরের অন্য কোনও মাত্রা নেই। সরু সরু কয়েক টুকরো বাঁশের ওপর পোশাক-আশাক জড়ালে যেমন দেখায়, একেও ঠিক তেমনি দেখতে। ছোটবেলায় পাঁকাটি আর তালপাতা দিয়ে তৈরি একরকমের খেলনা সেপাই মেলায় বিক্রি হতে দেখেছি, এই মানুষটিকে দেখে সে কথা মনে পড়ে গেল।
লোকটি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বারদুই প্রবল হোঁচট খেয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়ে নির্ভুলভাবে মেজকর্তাকে দলপতি হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে বলল–নমস্কার। আমি জলধর পণ্ডা।
মেজকর্তা বললেন—নমস্কার। তুমি আমাদের সিমডেগা অফিসের ওভারসিয়ার?
—আইজ্ঞাঁ।
জলধর পণ্ডার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যে সে কোন অঞ্চলের মানুষ তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে যে মানুষ ভাল তাও তার বিনীত কথা বলার ভঙ্গি আর আচরণে বোঝা যায়।
-–ঠিক আছে। আমাদের মালপত্রগুলো জিপে ওঠাবার ব্যবস্থা করো। যেতে যেতে কথা হবে—
আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জিনিস কারোই খুব বেশি নেই, একটা করে তোরঙ্গ আর একটা করে বিছানার বাণ্ডিল। কেবল সার্ভেয়ার নির্মলবাবুর জরিপের কাজে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তিনটে বড় কাঠের তালা-লাগানো বাক্সে চলেছে। দুরবীন-চেনথিওড়োলাইট এবং আরও কী কী সব। জিপের সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসলেন মেজকর্তা। আমি, নির্মলবাবু আর জলধর পেছনের দু-সারি মুখখামুখি সিটে ভাগ করে। গাড়ি যখন চলতে আরম্ভ করল তখন ভোরের আলো বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে। জলধর। বলল—এখনও শহরের দোকানপাট কিছু খোলেনি। চলুন, কুড়ি-বাইশ মাইল গেলে বিরমিত্রাপুর বলে একটা ছোট জায়গা পড়বে। সেটা বিহার আর উড়িষ্যার বর্ডার, সেখানে। একটা খাবারের দোকানে সকালে খুব ভাল কচুড়ি আর জিলিপি ভাজে, বহু লোক ভিড় করে খেতে আসে। আমরাও ওই দোকানেই খেয়ে নেব। আপনাদের খুব খিদে পেয়ে গিয়েছে নিশ্চয়–
সামনের সিট থেকে মুখ না ঘুরিয়েই মেজকর্তা বললেন—কচুড়ির সঙ্গে কী দেয়?
একটু অবাক হয়ে জলধর বলল—আইজ্ঞাঁ?
-বলছি কচুড়ির সঙ্গে সে দোকানে কী দেয়? ডাল, না তরকারি?
—অঃ, না তরকারি না—ডাল দেয়। বুটের ডাল—
একটা নিঃশ্বাস ফেলে মেজকর্তা বললেন—আমি ছোটবেলায় যে ইস্কুলে পড়তাম, সেই স্কুলের দারোয়ান শান্তি টিফিনের সময় ছেলেদের কাছে বিক্রি করার জন্য লুচি ভাজত।
লুচির সঙ্গে দিত আলু, কুমড়ো আর পেঁয়াজ দিয়ে রান্না একটা তরকারি। সত্যি কথা বলতে কী, ওই তরকারির লোভেই আমরা শান্তির লুচি কিনে খেতাম। সে স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। বড় বড় সাইজের লুচি, দু-পয়সা করে দাম নিত–
বললাম—এক একজন লোকের রান্নার হাত খুব ভাল হয়। ঠিকই বলেছেন–
মেজকর্তা বললেন—এক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু ভাল রান্নার নয়। এখন বুঝতে পারি দুটো কারণে শান্তির রান্না আমাদের ভাল লাগত। প্রথম কারণ, তখন অল্প বয়েস, বাড়ির আটপৌরে রান্নার বাইরে অন্য কোনও ভাল খাবার খাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল না। সেই অনভিজ্ঞ রসনায় দোকান থেকে কিছু কিনে খেলেই তা মধুর লাগত। দ্বিতীয় কারণ, রান্নায় কুমড়োর সঙ্গে পেঁয়াজের ব্যবহার, আমাদের পরিবারে, বা সাধারণভাবে বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজে ছিল না। সেই নতুনত্বটাও আকর্ষণ করত।
একটু থেমে মেজকর্তা আবার বললেন—বছরদুয়েক আগে কী একটা কাজে আমার ছোটবেলার সেই ইস্কুলে একবার যেতে হয়েছিল। কাজ সেরে বেরুবার সময় হঠাৎ মনে হল একবার শান্তির খোঁজ করে যাই। স্কুলের বড় ফটকের পাশে দুখানা নিচু ধরনের টালির ঘরে সপরিবারে শান্তি বাস করত। ঘরদুটো দেখলাম একইরকম আছে। ডাকাডাকি করতে একজন নজদেহ বৃদ্ধ বেরিয়ে এসে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল-কাকে খুঁজছেন?