আমরা তখন সবেমাত্র কলেজের পাঠ শেষ করেছি। অনেক ছাত্র ও আমাদের মতো অনতিপূর্ব-ছাত্র এ সম্মিলনে উপস্থিত ছিল। মনে হল আমাদের চেষ্টা ও শ্রমের পুরস্কার পেয়ে গেলাম।
৩
আমাদের ছাত্রজীবনে রবীন্দ্রনাথের এ প্রভাব অবশ্য ‘বাহ্য’। মনে তার কাব্য ও সাহিত্যের যে স্পর্শ সেই স্পৰ্শই অন্তরতম, আর তার যা ফল সেই ফলই চরম ফল। নিশ্চয় আমাদের সকলে সে স্পর্শ পায়নি। যাঁরা পেয়েছিল তাদের অনেকের মনে যে ফল ফলেছিল তার স্বরূপ বলছি।
আমরা যখন কলেজে পড়ি তখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় চলছে, dark age। ইংরেজি সাহিত্যের যে রস আমাদের পূর্বতনদের চিত্ত সরস করেছিল, ইউরোপের যে নব বিদ্যা ও চিন্তা তাদের মনকে মোহমুক্তির নাড়া দিয়েছিল— তাকে প্ৰসন্ন ঔদার্যের সঙ্গে গ্রহণ করতে আমাদের মনে এসেছিল সংকোচ। ও-বিদ্যা ও-চিন্তায় যে আমাদের দেশের কোনও দান নেই, অথচ তাকে আয়ত্ত করাই উচ্চশিক্ষা; আমাদের অধ্যাপকেরা যে তাকে যাচাই করেন না, কেবল ওর ভার নিজের মন থেকে আমাদের মনে নামিয়ে দেন, তার পীড়ায় আমাদের মনের গ্রহণের শক্তি সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল না। এ বিদ্যার সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের বিস্ময় দেশ থেকে কেটে গিয়েছিল, কিন্তু মনের মাটিতে শিকড় চালিয়ে তার অন্ধুরোদগম আরম্ভ হয়নি। সুতরাং আমাদের কাছে। এ বিদ্যা ছিল পরীক্ষা পাশের উপায় মাত্র অর্থাৎ বোঝা আচাৰ্য জগদীশচন্দ্রের অভ্যর্থনার গানে–
‘জয় তব হোক জয়
স্বদেশের গলে দাও তুমি তুলে
যশোমালা অক্ষয়।….
দুঃখ দীনতা যা আছে মোদের
তোমারে বঁধি না রয়।’
যে মনঃপীড়া প্রচ্ছন্ন আছে আমরা ছাত্রদের অনেকে তার গ্লানি থেকে মুক্ত ছিলাম না। আজ এ দুঃস্থত কতকটা দূর হয়েছে। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দৃষ্টি ও কর্মশক্তির কল্যাণে।
আমাদের মন্দ ভাগ্যে আমাদের সাহিত্যের পাঠও যথোচিত আনন্দের ছিল না। ওর মধ্যেও ছিল একটা বড় রকম বোঝার ভার। সাহিত্য বলতে অবশ্য বোঝাত ইংরেজি সাহিত্য। সংস্কৃত কাব্য যা দু’-একখানা পড়ানো হত তা সাহিত্য হিসাবে নয়, কী হিসাবে বলা কঠিন। কাব্যকে তার কবিত্ব থেকে বিমুক্ত করে তার anatomy-র উদঘাটন ছিল সংস্কৃত অধ্যাপকের কাজ। এবং সে anatomy-র বেশির ভাগ osteology, অস্থিবিদ্যা। কিন্তু ইংরেজি সাহিত্যের ঐশ্বৰ্যও আমাদের কেবল আকর্ষণ করেনি, তার মধ্যে একটা স্পর্ধা যেন আমাদের আঘাত করত। পাঠ্য নির্বাচনে বড় ছোট লেখকের ভেদ ছিল না। ইংল্যান্ডে কিঞ্চিৎ সুনাম থাকলেই তিনি ছিলেন আমাদের পক্ষে যথেষ্ট শ্রেষ্ঠ লেখক, যদিও সম্ভব ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বাইরে তার লেখা ইউরোপে আর কেউ পড়েনি। ব্রিটিশ শাসন যেমন নির্বিবাদে মানার জিনিস, ব্রিটিশ কবি ও লেখকের শ্রেষ্ঠত্বও ছিল তেমনি নির্বিচারে স্বীকারের বস্তু। এবং এ শ্রেষ্ঠত্ব আমাদের বুঝিয়ে দিতে অধ্যাপকদের ক্রটি ছিল না, অবশ্য ইংরেজ সমালোচকের বই থেকে টুকে এনে। আমাদের সময় English Men of Letter, পর্যায়ের অনেক বই অবশ্য পাঠ্য ছিল। তাতে আমরা দেখতুম যে ইংরেজ লেখক মাত্রই অতি শ্রেষ্ঠ লেখক। যে কবি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলা যায় না। তিনিও নাকি failure of a great poet। নিজের বোধ ও রুচি দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যের ভালমন্দ বিচার অধ্যাপকেরা কখনও করতেন না। সেটা হত খৃষ্টতা। ইংরেজি সাহিত্য আমাদের কাছে অনেকটা ছিল কার্জনি আমলের ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যের একটা দিক।
কলেজের শিক্ষার এই inferiority complex আমাদের চিন্তাকে কবেছিল ভীরু ও পঙ্গু, রসবোধকে করেছিল অস্বাভাবিক ও অনুদার। মনের এই দুরবস্থা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয়ে। তার কাব্যে আমরা সেই রাস পেলাম মন যাকে গ্ৰহণ করল। দ্বিধাহীন আনন্দে। তার নাম আমাদের অধ্যাপকদের কেউ কখনও উচ্চারণ করেননি, কিন্তু আমরা মনে জানলুম যেসব সাহিত্যের তাঁরা ‘নোট’ লেখান এ সাহিত্য তার থেকে খাটো নয়। এবং এ সাহিত্য যে লেখা হচ্ছে আমাদেরই মুখের ভাষায়, আর যিনি লিখেছেন তাকে আমরা আমাদের মধ্যেই মাঝে মাঝে পাই–এ হয়েছিল আমাদের মনের বিশল্যকরণী। রবীন্দ্রনাথের কাব্যই যে প্রথম-যৌবনে যথার্থ সাহিত্যিক রসে আমাদের মনকে সরস করছিল। কেবল তা নয়, তার সাহিত্যই আমাদের মনের দীনতা ঘুচিয়ে ইংরেজি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের শ্রেষ্ঠত্বের দিকে আমাদের মনকে অনুকুল করেছিল। তার সাহিত্যের আলোচনায় আমাদের মনে হয়েছিল যে আমরা নিজের মনে সাহিত্য-বিচারের একটি কষ্টিপাথর পেয়েছি যা ইংরেজি পুথি থেকে ধার-করা নয়, যাতে সোনাকে সোনা এবং পিতলকে পিতল বলেই চেনা যায়।
আমাদের কলেজে পড়ার সময়েই ‘প্রাচীন সাহিত্যের প্রবন্ধগুলি প্ৰায় লেখা হয়। আমাদের সাহিত্যিক রুচি ও অনুভূতির গড়নে সেগুলি ছিল অমূল্য। তাতেই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম যে কালিদাসের কাব্য মল্লিনাথের টীকা নয়, বাল্মীকির রামায়ণ-ধর্মসংহিতা থেকে ভিন্ন।
আমাদের কলেজের শিক্ষার পাথরের চাপ রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও সাহিত্যই বিদীর্ণ করেছিল –
‘ওরে চারিদিকে মোর ।
এ কী কারাগার ঘোর,
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখী,
এসেছে রবির কর।’
আষাঢ় ১৩৪৮