ধুবড়িতে স্টিমার প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়াল। স্টিমার থেকে লোকজন নেমে গেল বাজার করতে। আমার বাটলার একটা বড় কাতলা মাছ কিনে নিয়ে এল। অতি সুস্বাদু টাটকা মাছ। ধুবড়ি থেকে আমাদের স্টিমার চলল। ফ্ল্যাট-বিনির্মুক্ত হয়ে। বাকি ফ্ল্যাটখানি হেমেন্দ্ৰবাবুকে নিয়ে এখানেই রয়ে গেল এবং সম্ভব দু-একদিন থাকবে। আশা করি ধুবড়ি শহরে গুণজ্ঞ লোকের অভাব নেই।
ধুবড়ি ছাড়ার পর থেকেই নদীর দুই ধারে পাহাড়ের সারা দেখতে দেখতে এসেছি। ব্ৰহ্মপুত্রের মতো প্ৰকাণ্ড নদীর মাঝ থেকে দুই তীরে এমন পাহাড়ের দৃশ্য পৃথিবীতে নাকি খুব কম দেখা যায়। গাছে-গুলো ঢাকা কৃষ্ণাভ সবুজ সব পাহাড়। নন-কো-অপারেশনের সময় মহাত্মা যখন অসমে এসেছিলেন তখন এক অভিনন্দনের উত্তরে অসমবাসীদের বলেছিলেন, ‘Your bewitchingly beautiful ountry–জাদুকরী সৌন্দর্যের দেশ তোমাদের। ব্ৰহ্মপুত্র ও তার দুই কুলে নীল পাহাড়ের এই সারা দেখলে এ বর্ণনার যাথার্থ্য বোঝা যায়।
বিকাল তিনটেয় স্টিমার বিলাসীপাড়া এল। শীতের ব্ৰহ্মপুত্ৰ নিস্তরঙ্গ, মনে হয় যেন স্থির। কেবল পূর্ব-বাংলার ধানখেতের দিকে দ্রুতধাবমান কচুরিপানার ছোট বড় ঝাড় তার অন্তরের গতিবেগ জানান দিচ্ছে। এই জলের উপর রৌদ্রের খেলা ও স্টিমারের সামনের ডেকের ছাদে তার আলোছায়ার কঁপিন-লীলা সারা দুপুর দেখতে দেখতে এসেছি। বিলাসীপাড়ার স্টেশন-ফ্ল্যাটের ঠিক পিছনেই এক সারা পাহাড় এবং বিলাসীপাড়ার পর অনেক পাহাড় নদীর বেশ কাছাকাছি। একটা তিন-চুড়াওয়ালা পাহাড়ের দিকে আমাদের স্টিমার এগিয়ে চলেছে। নদীর জলে তার অকম্পিত ছায়া বহুক্ষণ ধরে দেখছি, যেন কোনও মন্দিরের ছায়া।
স্টিমারের পিছনে সূর্যস্ত হল। পশ্চিম-আকাশের সোনার রং নদীর এদিকের জল রাঙিয়ে রাখল অনেকক্ষণ।
রাত আটটায় স্টিমার গোয়ালপাড়া পৌঁছল।
২
আজ রবিবার সকাল থেকেই আকাশে মেঘ, নদীর উপর কুয়াশা এবং প্রচণ্ড শীত। সমস্ত দিন সূর্যের অস্তিত্বের কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কেবল দুপুরকেলার কাছাকাছি দু-চার মিনিটের জন্য এক ঝলক রোদ, আর বিকালে সূৰ্যাস্তের সময় পশ্চিম-আকাশের কালো মেঘে। গলানো সোনার একটা চওড়া রেখা।
নদী ও তার পাড়ের দৃশ্যও বদলে গেছে। পাহাড় বড় চোখে পড়ছে না। নদীতে নৌকা বিরল এবং দক্ষিণের যে উচু পাড়ের কাছ ঘেঁষে প্রায় সারাদিন স্টিমার চলেছে তাতে লোকালয় খুব কম। কেমন একরকম শুকনো চেহারার লম্বা ঘাস সে পাড়ের উপর। আকাশের ধূসর মেঘে ঢেউশূন্য ঘোলাটে নদী। মনটা দমে গেল। সারা দুপুর একটামাত্র জানিলা খোলা রেখে কেবিনে শুয়ে শুয়ে জে বি প্রিস্টালির একটা উপন্যাস পড়ছি। ইয়র্কশায়ারের নিম্ন-মধ্যশ্রেণির তরুণ-তরুণীর লন্ডনে প্রণয়লীলার কাহিনিতে ব্ৰহ্মপুত্রের উপর কেমন মন বসছে না।
বিকাল চারটেয় পলাশবাড়ি স্টেশন এল। পাড়ে অনেকগুলি বড় নৌকা বাঁধা। ঘাটের উপর কমললেবু, ডিম ও পায়রা বিক্রি হচ্ছে। পলাশবাড়ি থেকে আবার উত্তরদিকে পাহাড়ের সার দেখা দিল এবং ঘণ্টাখানেক পর পলাশবাড়ি ছাড়লে এক পশলা অল্প বৃষ্টি হয়ে ভাঙা মেঘের মধ্যে দিয়ে চাঁদের দেখা পাওয়া গেল। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। পাতলা মেঘে ঢাকা চাঁদের আলোতে তীরের পাহাড় ও নদীতে তার ছায়া কেমন একটু অবাস্তব মনে হচ্ছে। সাড়ে ছাঁটার মধ্যে স্টিমার পাণ্ডুঘাট এসে পৌঁছেছে। শিলংযাত্রীদের পারাপারের স্টিমার অনেক আলো জ্বলিয়ে ঘাটে লেগে আছে। রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল, এখনও পাণ্ডুঘাটেই আছি। সামনে গৌহাটি শহরের আলো দেখা যাচ্ছে।
২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৬
সোমবার
কাল সমস্ত রাত স্টিমার পাণ্ডুঘাটেই নোঙর করেছিল। আজ ভোর ছাঁটায় সেখান থেকে রওনা হল। স্টিমার ছাড়ার শব্দ পেয়ে ওভারকোট চাপিয়ে সামনের ডেকে এলুম। গৌহাটি ও শিলং যাত্রাপথের অল্পবিস্তর পরিচিত পাহাড় নদীর দু’ধারে; তাদের মাথায় মাথায় কালচে সাদা মেঘের মতো কুয়াশা জমে আছে। স্টিমার উমানন্দভৈরবের কাছ দিয়ে গেল। ব্ৰহ্মপুত্রের মাঝখানে গ্রানাইট পাথরে ধার-বঁধানো উচুভিতের উপর বড় বড় গাছের ঘন বন, তার মধ্য দিয়ে ভৈরবের মন্দিরের চুড়া দেখা যাচ্ছে। গৌহাটি শহরের তখনও ঘুম ভাঙেনি, নদীর ধারের রাস্তায় লোক-চলাচল নেই। শহরের একদিকটার প্রায় সমস্ত দৈর্ঘ্য উজিয়ে গৌহাটির বাজার-ঘাটে স্টিমার লাগল। বেলা তখন সাতটা।
গৌহাটি শহর কামরূপ জেলার সদর; অসমীয়াদের রাষ্ট্র, শিক্ষা ও সাহিত্য-প্রচেষ্টার কেন্দ্র। কিন্তু প্রদেশের রাজধানী শিলংয়ের শৈলচুড়ায়, যা না উত্তর-অসমের অসমীয়াদের, না। দক্ষিণ-অসমের বাঙালিদের জায়গা। সেই পাহাড়ের চূড়ায় বসে বোধহয় রাজপুরুষেরা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে উত্তর-দক্ষিণ দেখেছেন, অসমীয়া ও বাঙালি কেউ কারও চেয়ে প্রবল হয়ে না ওঠে।
প্রাচীন পুথিপত্রে ও শিলালেখ-তাম্রশাসনে গৌহাটির নাম দেখা যায় গুবাকহট্ট, বোধহয় গোরুর হাট নয়, সুপারির হাট। মেধাতিথির মনুভাষ্যে দেখেছি, দেশের একটা নির্দিষ্ট ভূভাগকে বলত হাট্ট। বোধহয় ওটা ছিল ইকনমিক ইউনিট’-এর নাম, যে ভূখণ্ডের লোকেরা বড় বড় বেচাকেন। একজায়গায় করত এবং সম্ভব হাটবাজারের হাট কথাটা সেখান থেকেই এসেছে। যা হোক, শব্দের প্রত্নতত্ত্বে আর দরকার নেই। ক্ৰমে বেলা বাড়তে লাগল। স্টিমার থেকে মাল নামছে বিস্তর। ডাকহাঁকে জনছি গৌহাটি ও শিলং দু’জায়গার মাল নামছে, আর তাদের তফাত করে রাখা হচ্ছে। ক্ৰমে বাজারঘাটে ধোপাদের কাপড় কাচা শুরু হল। একটা ছোট ফ্ল্যাটের সামনে বসে একটি খালাসি খুব মনোযোগ দিয়ে একটা নীল কোর্তায় সাবান ঘািষছে। রাস্তা দিয়ে দু’খানা মোটরগাড়ি চলে গেল। আজ পাঁচদিনের পর মোটরগাড়ি দেখে মনটা একটু খুশি হয়ে উঠল। নাগরিক জীবনের অভ্যাসের এমনি ফল!