রাত দুটোয় ফুলছড়ি ঘাটে স্টিমার পৌঁছল এবং মালপত্ৰ নামিয়ে উঠিয়ে ছাড়ল ভোরা-রাত সাড়ে চারটেয়। লােগবার ডাকাডাকি ও ছাড়বার হাঁকাহীকিতে আমারও ঘুম ভেঙেছিল।
বৃহস্পতিবার সমস্ত দিন এসেছি শীতের যমুনার পরিচিত রূপ দেখতে দেখতে। ভাঙন-ধরা উচু পাড়, কলাগাছ আমগাছে ঘেরা খোড়ে চালের বসতি; সাদা বালুর নিচু চর রৌদ্রে ঝিকি ঝিক করছে; সাদা পাল তুলে, কচিৎ রঙিন পালের, নৌকা চলেছে; মাঝে মাঝে জেলে-ডিঙি’। গোয়ালন্দের দিকে ছোট বড় স্টিমার যাচ্ছে, স-ফ্ল্যাট ও ফ্ল্যাটহীন। ব্ৰহ্মপুত্রের এ অংশকে আমাদের দেশে বলে যমুনা। একসময় এখােন দিয়ে যমুনা নামে ছোট এক নদী ছিল, ব্ৰহ্মপুত্ৰ চলত ভিন্ন ধারায় ময়মনসিংহ শহরের নীচ দিয়ে। উনবিংশ শতাব্দীর আরম্ভকালে কি-এক নৈসৰ্গিক বিপ্লবে, ব্ৰহ্মপুত্রের মূলধারা নিজের পথ ছেড়ে এই যমুনার খাদ দিয়ে বহতা হল। ব্ৰহ্মপুত্রের পুরনো খাদ আজ হীনস্রোত। লাঙলবন্দের অষ্টমীমান তার পূর্ব-গৌরবের স্মৃতি জাগিয়ে রেখেছে।
8
আজ সকাল ন’টায় সেকেন্ড ক্লাস কেবিনের পিছনে হাওয়া থেকে একটু আড়ালের জায়গায় হরবোলার মজলিস বসল। স্টিমারের বাবু ও খালাসিদের অনেকে এবং ডেকযাত্রীদের প্রায় সকলেই উপস্থিত হল। কেবল এলেন না হেমেন্দ্রবাবুর সহকমী তার ফ্ল্যাটের বাবুরা কেউ। ঈর্ষা এমনি জিনিস! গায়ের র্যাপারে মাথা-মুখ ঢেকে দু-একটা বাদে বিজ্ঞাপনের লিস্ট-মাফিক সব ডাক হেমেন্দ্রবাবু আমাদের শোনালেন। প্রতি ডাকের প্রস্তাবনা করলেন ইংরেজি শব্দে বা ছোট ইংরেজি বাক্যে এবং কেন জানি না, তার ব্যাখ্যা দিলেন হিন্দিতে, যদিও তার শ্রোতাদের সকলেই ছিল বাঙালি। বোধহয় হেমেন্দ্রবাবু দূরদর্শী লোক, ভবিষ্যতের রাষ্ট্রভাষায় এখন থেকেই নিজেকে অভ্যস্ত করছেন। মজলিস ভাঙলে তাকে কেবিনে ডেকে এনে কিছু দক্ষিণা দিলুম; বললেন, টাকার জন্য কিছু নয়, শুনিয়েই তার আনন্দ। একেবারে খাঁটি গুণীর কথা। বাড়ির পরিচয় নিয়ে জানলুম, তাঁরা পাঁচ ভাই, চারজন নানা জায়গায় চাকরি করেন, একজন বাড়িতে থাকেন। চারটি মেয়ে, দুটি ছেলে। বড় ছেলেটির বয়স চোদো, ইস্কুলে পড়ে। একটি মেয়ের বিয়ে দিতে বাকি। বাপ অনেক সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন, কীসব মামলা-মোকদ্দমায় বিশেষ কিছু অবশিষ্ট নেই। বললেন, সবই অদৃষ্ট। আমার কলকাতার ঠিকনােটা নিলেন। জানালেন, যদি কলকাতায় যান (র্তার এক ভাই সেখানে চাকরি করে) তবে আমার বাড়ির ছেলেমেয়েদের একবার হররোলার বোল শুনিয়ে আসকেন। বোধহয় সন্দেহ হয়েছে, আমি হরবোলার ডাকের তেমন রসজ্ঞ শ্রোতা নাই।
ফুলছড়ি ঘাটের পর থেকে ধুবড়ি পর্যন্ত আমাদের স্টিমার প্রতি স্টেশনে থেমে থেমে যাবে। কারণ, এই জায়গাটা চলাচলের রাজ্যে নন-রেগুলেটেড প্ৰভিন্স। কোনও রেল নেই এবং স্টিমার-সার্ভিস যা আছে তা আমাদের সময়কার ‘সবুজপত্রের চেয়েও তারিখের শাসন কম মানে। অসম-সুন্দরবন ডেসপ্যাচ সার্ভিসের অনিয়মগামী স্টিমারগুলিই (যা স্টিমার-কোম্পানির টাইম-টেবলের ভাষায় ‘are not run to a timing—কোনও নির্দিষ্ট সময় মাফিক চলে না) এখানকার দূর-গমনের একমাত্র বাহন। সেইজন্য এ স্টিমারগুলি উজান-ভাটিতে এ জায়গাটায় প্রতি স্টেশনে প্ৰায় থামে, মালও নেয়, লোকও নেয়। এবং কাপড়ের গাট, কেরোসিন তেলের টিন, রঙের ড্রাম, হালকা জাপানি মালের কাঠের বাক্স (দেখলুম একটা প্ৰকাণ্ড বাক্স একজন মুটেই স্টিমার থেকে নামাচ্ছে), লোহার শিক, তার, কড়াই, গ্যালভানাইজড় বালতি প্রভৃতি সভ্যতার উপকরণ ব্ৰহ্মপুত্রের দুই কুলে ছড়িয়ে চলে। বেলা একটায় চিলমারি এলুম। চিলমারির কাঁসা-পিতলের বাসন, বিশেষ এখানকার অতি সুডৌল গাভু, একসময় বিখ্যাত ছিল। এখন কিছু নেই। চিলমারির বন্দরে এখন যে কারবার চলে সে শুধু পাট ও অন্য কৃষিবস্তু চালান দেবার। দেশ হয়তো industrialized হচ্ছে, কিন্তু বাংলার গ্রামগুলিকে আমরা খুব দ্রুতগতিতে বিশুদ্ধ Agriculturize করছি। সঙ্গে যে দুই ফ্ল্যাট এসেছিল তার একখানিকে এখানে রেখে যাওয়া হল; ওতে পাট বোঝাই হয়ে চালান যাবে। চিলমারি থেকে গারো পাহাড়ের সার আকাশের সীমান্তে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে।
চিলমারি থেকে অল্প দূরে ব্ৰহ্মপুত্রের অন্য পারে রৌমারি স্টেশন। সেখানে পৌঁছতে হল ফ্ল্যাটখানি খুলে রেখে দুই চরের মাঝ দিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত অপ্রশস্ত ধারায় অনেক দুর উজিয়ে গিয়ে। এখানে-ওখানে তার মধ্যে বহু নিচু কাঁচি চর। নদীর কালো জল ও চারের শুভ্র বালু পাশাপাশি অপরাহের রৌদ্রে অপূর্ব মায়ার সৃষ্টি করেছে। একটু দূরে একটা চর প্রায় ঢেকে চখাচখির বাঁেক বসেছে। তাদের ধূসর চঞ্চল পাখায় চারটি যেন কঁপিছে, মনে হয় পন্মের পাতায় ঢাকা পদ্মকন। একদিকের উচু কায়েম চরে একটা তাঁবু পড়েছে, অনেক লোক আনাগোনা করছে; নীচে একখানা বড় নৌকা বাঁধা। হাকিমের সফর না জমিদারবাবুর শিকার ঠিক বোঝা গেল না।
রাত প্ৰায় এগারোটায় স্টিমার যাত্রাপুর পৌঁছল। যাত্ৰাপুর রংপুর জেলায় এবং বাংলাদেশের শেষ স্টিমার-স্টেশন। এরপর থেকে অসমের গোয়ালপাড়া জেলার এলাকা।
২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৬
রবিবার
শনিবার ভোর সাতটায় ধুবড়ি আসা গেল। ধুবড়ি গোয়ালপাড়া জেলার হেড কোয়ার্টার্স এবং স্টিমার-লাইনের একটা অংশের হেড-আপিস। নদীর ধারে ধারে ছোটখাটো সুন্দর শহরটি। বছর-কয়েক পূর্বে এক মোকদ্দমায় ধুবড়ি এসে অনেকদিন ছিলুম, বোধহয় মনে আছে। ব্ৰহ্মপুত্রের পাড়ের উপরে যে রাস্তা দিয়ে সকাল-সন্ধ্যা বেড়াতে যৌতুম সে রাস্তার ধারে ফরেস্ট-আপিসের দোতলা টিনের বাংলো, এস ডি ও-র (যিনি এখানকার combined hand–একাধারে ম্যাজিষ্ট্রেট, সাবিজজ, রেভিনিউ অফিসার) বাংলো, নদীর খাড়া পাড়ের উপর তিন দিক জলে ঘেরা, বেশ কবিত্বপূর্ণ কিন্তু একটু আশঙ্কাজনক অবস্থিতির উকিল-লাইব্রেরি, ধুবড়ি ছাড়ার পথে স্টিমার থেকে সব দেখতে দেখতে গেলুম। ভিক্টোরিয়া গার্ডেনের লগাও নদীর ধারেব যে বাংলোটিতে ছিলুম সেটি কিন্তু চোখে পড়ল না।