নেয়ে-খেয়ে গুরখা স্টিমারে বসে বসে গোয়ালন্দের শীতের পদ্মা দেখছি। সামনে একটা প্রকাণ্ড চর পড়েছে। ওপরের জল দেখা যাচ্ছে না, দূর-গাছের কালো রেখায় তার প্রসারটা অনুমান করছি। দুপুরবেলা স্টিমার-নৌকার চলাচল অনেকটা কম। ক্রমে গুরখার ছাড়বার সময় হল; কলকাতা থেকে চাটগা মেল এসে পৌঁছেছে। স্টিমার থেকে নেমে সুপারভাইজারবাবুর ফ্ল্যাটে মালপত্র রেখে, উপরে এক টুকরো ঘাসের জমি ছিল সেখানে আস্তানা করা গেল। চাঁদপুর থেকে স্টিমার পৌঁছল বেশ একটু দেরি করে। খুব ভিড়। সাদা সাহেব ও পোশাকি কালো সাহেবদের সংখ্যাও কম নয়। লোকজন নেমে গেলে ধীরে সুস্থে সে স্টিমারে ওঠা গেল। নাম ‘এমু, অর্থ যা-ই হোক। কেবিনে মালপত্র রেখে সেখানেই রাত কাটাব স্টিমারের লোকজনদের জানাচ্ছি, এর মধ্যে সুপারভাইজারবাবুর লোক এসে খবর দিল, আমার স্টিমার ‘দোয়ারি’ এসে ঘাটে লেগেছে এবং আমাকে নেবার জন্য তাঁরা এখনই স্টিম-লঞ্চ আনছেন। একটু পরেই। ‘হাতি’ নামধেয় লঞ্চ ‘এমু’র পাশে এসে লাগল। এ লঞ্চখানিকে ইতিমধ্যে বহুবার উজান-ভাটি করতে দেখেছি। হাতি-আরোহণ যে আমার ভাগ্যেও ছিল তা তখন মনে করিনি। দু-চার মিনিটের মধ্যেই হাতি আমাকে দোয়ারিতে পৌঁছে দিলে। দূর অতি সামান্য, এর জন্য স্টিম-লঞ্চ আনবার কোনও দরকার ছিল না। স্টিমার-কোম্পানির অতিরিক্ত সৌজন্যে তাদের শুভকামনা না করে পারছি না। তাদের ব্যাবসা বর্ধিত হোক। যত কমে হয় তাঁরা যেন এদেশি লোকদের খাটিয়ে নিতে পারে। এখানে ওখানে ছোটখাটো দেশি স্টিমার-কোম্পানি গড়ে উঠে তাদের মুনাফার অঙ্কে যেন ঘাটতি না ঘটায়।
২
‘দোয়ারি’ বেশ বড় স্টিমার। উঠে সামনের ডেকে আসতেই জানা গেল, আমার এ বাহনটি বড় কেউকেটা নয। সেলুনের সামনে এক পিতলের ছোট প্লেট আঁটা, তাতে খোদা রয়েছে। যে, যুদ্ধের সময়, ১৯১৭ সাল থেকে ১৯২০ সাল, এ স্টিমার নিজের স্টিমে (‘under her own steam’) ৩৪২৬ মাইল চলে বসরা পৌঁছে টাইগ্রিস নদীতে ‘rendered invaluable transport service’–সৈন্য ও মাল টানার অমূল্য কাজে নিজেকে লাগিয়েছিল; এবং যুদ্ধশেষে নিজ বাষ্পবলেই আবার কলকাতায় ফিরে আসে। সুতরাং যে সেলুনে বসে আমি খাচ্ছি ও লেখাপড়া করছি, সার্জেন্টি-মেজর ও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট প্রমুখ বীরেরা ছোট বড় ‘পেগ’ পার করে নিশ্চয়ই তাকে ধন্য করেছেন, এবং তাদের কেউ কেউ কুট-আল-আমারায় তুর্কিদের হাতে ধরাও বোধহয় পড়েছিলেন। স্টিমারটির উপর সন্ত্রম জন্মাল।
বাটলার সাদের আলির বয়স কম, হাসিমুখ ও চটপটে। লোকটিকে দেখে খুশি হলুম। বাড়ি বিক্রমপুর। অসমে চা-কর সাহেবদের বাটলারি অনেকদিন করেছে। বছরখানেক নানা সাংসারিক গোলযোগে বাড়ি বসেছিল। স্টিমার-কোম্পানির বাবুরা গোয়ালন্দ থেকে তাকে আমার জন্য জুটিয়েছেন, কারণ সে নাকি দেশি ও ইংলিশ খানা দুই-ই রাঁধতে ওস্তাদ। পরীক্ষায় দেখছি সাটিফিকেটটা ভুয়ো নয়। লোকটা রাধে ভাল। কোম্পানির এক বাবু এসে আমার তদবির করে গেলেন এবং যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে বিষয়ে স্টিমারের লোকদের সতর্ক করলেন।
চারটে-আন্দাজ বেলায় দোয়ারিতে উঠেই শুনলুম, স্টিমার এখনই ছাড়বে। ছাড়তে ছাড়তে হল সন্ধ্যা সাতটা। দু’খানা ফ্ল্যাট দু’দিকে বেঁধে রওনা হওয়া গেল। আশা ছিল ভূতপূর্ব তারিণীগঞ্জ স্টেশনের ঝাউগাছের সার ও তেওতা ইস্কুলের নদীর ধারের বোর্ডিং দেখতে পাব। কিন্তু রওনা হওয়ার আগেই রাত্রি এসে গেল, চোখে আর কিছু পড়ল না।
৩
ভোরবেলা উঠে খবর নিয়ে জানলুম, আমাদের টাঙ্গাইল যাওয়ার স্টিমার-স্টেশন পোড়াবাড়ি ছাড়িয়ে এসেছি এবং সিরাজগঞ্জের দিকে চলেছি। আমাদের এ স্টিমার ফুলছড়ি ঘাটের আগে কোথাও ভিড়বে না, কারণ তার পূর্বের কোনও জায়গার মাল এতে নেই এবং এটা প্যাসেঞ্জার স্টিমার নয়। বেলা এগারোটায় সিরাজগঞ্জ ছাড়ালুম। শহর থেকে অনেক দূরে এক চরের নীচে স্টেশনের ফ্ল্যাট; চারের উপর কয়েকখানা মালগাড়ি রেল-স্টিমারের সংগমস্থল ঘোষণা করছে। বিকােল তিনটের পর স্টিমার জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে একটু থামল, কোনও মাল দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারে নয়, বোধহয় নিজেকে রিপোর্ট করতে।
স্টিমারে একলা চলেছি; এ পর্যন্ত স্টিমারের বা দুই ফ্ল্যাটের বাবুদের কেউ আলাপ-পরিচয় করতে আসেননি। কিন্তু একটু পরেই জানলুম তাদের মধ্যে গুণী লোকের অভাব নেই। সন্ধ্যার একটু আগে অনন্তের হাত দিয়ে আমাকে একটুকরো কাগজ পাঠিয়ে একটি ভদ্রলোক একটু সরে দাড়ালেন। কাগজখানি দেখলুম একটি বিজ্ঞাপন, লাল কালিতে ইংরেজি হরফে ছাপা। ‘Very nice Very nice!! Horbolla Sound’– অতি চমৎকার! অতি চমৎকার!! হরবোলার বোল’। এবং তারপর বিড়াল, মুরগি, দাড়কাক, দুই বিড়ালের ঝগড়া, শেয়াল-কুকুরের কলহ প্রভৃতি দ্বাদশ দফার উল্লেখ করে বলা হয়েছে ‘that’s all? — ‘এই শেষ’। নীচে নাম ‘হেমেন্দ্রমোহন রায়, Sounder— শব্দোৎপাদক’। গ্রাম ও পোস্ট আপিস বিঝারি, জেলা ফরিদপুর।
এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করে পরিচয় দিলুম। গোলগাল কালো চেহারা, মুখে পাকা-কাঁচা দাড়িগোঁফের খোঁচা, মাথায় একটি নাতিকৃশ টিকি, বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ। স্টিমারের ডাইনে যে ফ্ল্যাটখানি বাঁধা আছে তার কেরানি; ছব্বিশ বছর স্টিমার-কোম্পানির কাজ করছেন। ঠিক হল আগুমীকাল সুকালে, খ্রিস্টমাসের দিনে, হরবোলার বৈঠক বসবে।