স্টিমারের পাশ দিয়ে ক্ৰমাগত জেলে-নৌকা চলেছে। স্টিমারের লোকেরা মাছ কেনার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। ‘হালদার, মশায় প্রভৃতি অনেক সম্মানের সম্বোধনে জেলেদের ডাকা হল; কিন্তু কারও নৌকাতেই নেই, তাঁরা সবে মাছ ধরতে বেরিয়েছে। হালের কাছে এক-একজন জেলের আত্মসমাহিত গভীর মুখ দেখে, শেকসপিয়রের কোন একটা সংস্করণে ‘কোরিয়লেনাস’-এর এক ছবি দেখেছিলাম, তাই হঠাৎ মনে পড়ে গেল।
বেলা আন্দাজ ন’টায় কুয়াশা কেটে গেলে স্টিমার চলতে শুরু করল। দু’পাশে দূরে কাছে অসংখ্য নৌকা চলেছে–জেলে-ডিঙি, যাত্রীর নৌকা, বোঝাই কিস্তি। দু-তিনখানা নামজানা যাত্রী-স্টিমার বেগে বিপরীত দিকে চলে গেল।
মাঝে মাঝেই লম্বা নিচু কাঁচি চর জলের ওপর ভেসে উঠেছে। কতক বালু ভেজা, ধূসর, কতক সাদা ধবধবে–ভোরের রৌদ্রে চিকচিক করছে। অল্প পরেই গোয়ালন্দের স্টিমার-ঘাট দেখা গেল। স্টিমারের সাের তিন-চার থাকে ঘাটে লেগে আছে, কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে ধোঁয়া উঠছে। বড় বড় ফ্ল্যাট মাঝ-নদীতে ছেড়ে দেওয়া। এক পাশে নৌকার সার। পাড়ের উপর গোয়ালন্দ-চরের বাজারের হালকা ছাউনি ও ততোধিক হালকা বেড়ার দোকানঘর; আর সেই রকমেরই রেলের টিকিট আপিস ও পোস্ট-টেলিগ্ৰাফ আপিসবাবুদের কোয়ার্টার্স-সমেত।
নেয়ে-খেয়ে স্টিমার থেকে নামার সময় বাটলার মীেলা বক্স অনুনয় জানালে যে, মাছ-তরকারি কেনার পয়সা যে আমি দিয়েছি। এটা যেন স্টিমার কোম্পানির কর্তৃপক্ষ না জানে। তাকে অভয় দিলুম।
দোয়ারি স্টিমার
২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৬
শুক্রবার
ঢাকা মেল ভোর পাঁচটায় গোয়ালন্দ পৌঁছল। অর্থাৎ তখনও ভোর হয়নি, বেশ অন্ধকার। নারায়ণগঞ্জ ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের যাত্রীদের হাকডাক আরম্ভ হল, কিন্তু আমার তাড়া নেই। যদিও স্টিমার-কোম্পানির জগন্নাথ ঘাটের সাহেব জানিয়েছিল, তাদের যে স্টিমার ১৯শে কলকাতা থেকে রওনা হয়েছে সুন্দরবন ঘুরে তার ২৩শে গোয়ালন্দ পৌঁছবার কথা, কিন্তু আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতুম, ২৪শে পর্যন্ত যে স্টিমার পৌঁছলেই মঙ্গল। সুতরাং পাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করছি, এমন সময় তোমার চাকর অনন্ত নিজেকে রাস্তাঘাটে চটপটে প্রমাণ করার জন্য, আমি নেমে না-ডাকতেই বিছানা বঁধতে হাজির। তার এই অভূতপূর্ব কর্মপ্রবণতায় বাধা না দিয়ে উঠে পড়া গেল। বেশ ফরসা হলে গাড়ি থেকে নামব এবং নেমে দিনটা এবং সম্ভব রাত ও তার পরদিন দুপুর পর্যন্ত কোথায় কাটাব ভাবছি, এমন সময় দুটি টিকিট-চেকার ভদ্রলোক উপস্থিত হলেন, একটি হিন্দু অন্যটি মুসলমান। টিকিট দেখানো গেল, কিন্তু তখনই বুঝলুম টিকিট দেখা একটা অছিলা মাত্র। মুসলমান ভদ্রলোকটি একটি খাজনার মোকদ্দমা প্ৰথম আদালতে হেরেছিলেন। কিন্তু আপীলে জিতেছেন; প্রতিপক্ষ হাইকোর্ট করেছে। মোকদ্দমার হাইকোটে ফলাফল সম্বন্ধে আমার মতটা জানলে বাধিত হবেন। অবশ্য অনন্তের কাছে আমার ব্যবসায়ের পরিচয়টা সংগ্ৰহ হয়েছে। শুকনো ডাঙায় মাছ ও আরও একটা জিনিসের লোভ সামলানো কঠিন–কবিকঙ্কণ বলেছেন; উকিল দেখলে মোকদ্দমার পরামর্শ লিস্টে জুড়ে দেওয়া যেতে পারে।
এদের কাছে জানলুম, গোয়ালন্দে দিন-রাত কাটাবার ও সুসানাহারের প্রশস্ত জায়গা হচ্ছে চাঁদপুর মেল স্টিমার। চাঁদপুরগামী স্টিমােরখানি ঘাটে লেগেই আছে, বেলা একটার আগে ছাড়বে না। এবং সেখানি রওনা হবার অল্প সময়-মধ্যেই কলকাতাগামী চাটগা মেলের যাত্রী নিয়ে চাঁদপুর থেকে স্টিমার পৌঁছবে এবং পরদিন বেলা একটায় ছাড়বে। নিশ্চিন্ত হয়ে বেলা সাতটা আন্দাজ চাদপুর মেল স্টিমারে গিয়ে ওঠা গেল। যে ফ্ল্যাট দিয়ে ওঠার পথ সেখানেই ঘাট-সুপারভাইজারবাবুর আপিস। তার কাছে যেতেই তিনি অত্যন্ত ভদ্রতা দেখালেন এবং জানালেন, আমার আগমনবার্তা পূর্বেই হেড-আপিস থেকে পেয়েছেন। আমার স্টিমার ‘দোয়ারি’ এখনও পৌঁছয়নি। পৌঁছনোমাত্র আমাকে খবর দেবেন।
চাদপুর মেল স্টিমারগুলি, যা ঢাকা মেল স্টিমারও বটে, বেশ আরামের। এ স্টিমারখানির নাম ‘গুরুখা’। দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে স্টিমার থেকে নেমে পড়া গেল। অভিপ্ৰায়, মেঠো রাস্তা দিয়ে প্রাতভ্ৰমণ ও কিঞ্চিৎ কবিত্ব করা। একটা রাস্তা ধরে অনেকটা দূর যাওয়া গেল, কিন্তু রাস্তার ধারে মাঝে মাঝে দু-এক জায়গায় সরষে-ফুল ফুটলেও চার দিকে কেমন একটা অগ্ৰাম্য নীরস ভাব। গোয়ালন্দের নদীর ধারের যাত্রী ও মাল-চলাচলের ক্ষিপ্ৰ জীবন ও তার আনুষঙ্গিক দরমার-বেড়া-দেওয়া টিনের চালের বাজার তার পিছনের গ্রাম্য প্রকৃতির রস শুষে নিয়েছে। বিরক্ত হয়ে ফিরে এসে বাজারে ঢোকা গেল। অগ্ৰাম্য গ্রামের চেয়ে বাজারের জীবনাচাঞ্চল্য অনেক ভাল। মনে হল একটি নাপিত পেলে নিজের হাতে কামানোর দায় থেকে একটা দিন রেহাই পাওয়া যেত। লুঙ্গিপরা চেকদার কোটি গায়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলুম। এখানে নাপিত পাওয়া যায় কি না। লোকটি বোধহয় গোয়ালন্দের অধিবাসী; তার ‘পেট্রিয়টিজমে’ আঘাত লাগল। বিজ্ঞ তাচ্ছিল্যের ভাবে জানালে, গোয়ালন্দ শহরে আবার নাপিতের ভাবনা। একটা দিক দেখিয়ে বললে, সেদিকে অনেক নাপিত দেখতে পাব। গিয়ে দেখি দুজন নাপিত রয়েছে; একজন নিজ ব্যবসায়ের কাজে ব্যস্ত, অন্যটি যন্ত্রপাতি শানাচ্ছে। বেকার নাপিতৃটিকে স্টিমারে এনে ক্ষৌরি হওয়া গেল। লোকটির বাড়ি মুঙ্গের জেলায়, বাইশ বছর গোয়ালন্দে নাপিতি করছে। নাপিত-ভাবনাহীন গোয়ালন্দ শহরে কোনও বাঙালি নাপিত চোখে পড়েনি।