২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৪
শুক্রবার
কাল রাতে এক্সপ্রেস স্টিমার চলে গেলে রাত দশটায় আমাদের স্টিমার নোঙর তুলে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হল। কিন্তু কয়েকশো গজ গিয়েই বানারিপাড়ার বাঁকের মুখটার অল্প দূরে আবার নোঙর করল। কুয়াশায় সার্চলাইট খেলছে না। সেখানেই সারারাত কাটল, সকালটাও কেটে যাচ্ছে। কারণ বরিশাল-খুলনা মেল স্টিমার পাস না করলে যাবার জো নেই। সে স্টিমার এখানে পৌঁছবার কথা সকাল ন’টায়, কিন্তু দশটা বেজে গেলেও তার দেখা নেই। খুলনা থেকে বরিশাল এক্সপ্রেস স্টিমার এখান দিয়ে রাত তিনটেয় যাওয়ার কথা, গেল বেলা প্ৰায় নটায়। কুয়াশার খেলা। ‘আলোরে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।’
গেল মাছ কিনতে। স্টিমার যেখানে নোঙর করে আছে তার কাছেই বাজার। সূর্যোদয়ের কিছু পর থেকেই বহু ছোট নৌকা বাজারের দিকে চলেছে পসরা নিয়ে। তরিতরকারির নৌকা, বোধহয় অল্প মাছের নৌকা, আর বেশির ভাগ নৌকার জিনিস হচ্ছে ধান ও খেজুরের রস। খেজুরের রস নৌকা করে স্টিমারে বিক্রি করতে এনেছে।
বাটলার ও উপেন মাছ কিনে ফিরল। একটা ছোট রুই মাছ ও একটা ইলিশ মাছ এনেছে। মাছ নাকি বাজারে বেশি নেই। কাউখালির স্টেশনমাস্টারবাবু কালই সে অভিযোগ করেছিলেন। স্টিমার সরু খালটিতে ঢুকলা। খালের নাম বারুশী কি বারণী তা নােয়াখালি জেলার সারেং ও চাটগাঁ জেলার তার অ্যাসিস্ট্যান্টের উচ্চারণে ঠিক বোঝা গেল না। যা হোক, ফ্ল্যাটসমেত স্টিমারের পক্ষে খাল যে বারণী তাতে সন্দেহ নেই। খালে ঢুকেই এতে চলাফেরায় এত বিধি-নিষেধের কারণ বোঝা গেল। খালটি এত সরু যে দু’ফ্ল্যাট-সুদ্ধ আমাদের স্টিমার তার প্রায় সবটাই জুড়ে চলেছে। খালে ঢোকার অল্প পরেই খুলনা-যাত্রী মেল স্টিমারের সঙ্গে দেখা। আমাদের স্টিমার দাড় করিয়ে কোনও গতিকে তাকে পথ দেওয়া হল।
লোকালয়ের ভিতর দিয়ে খালটি বেঁকে বেঁকে চলেছে। বরিশালের সব জায়গার মতো দু’ধারে নারকেল খেজুর সুপারির বন। ঘরের চালে লাউ-এর লতা, আশেপাশে কলাগাছ। খাল থেকে সরু সরু সব নালা বেরিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে গেছে। তাদের উপর বাঁশের বঁকানো উচু সাঁকো, কচিৎ কাঠের পুল।
খাল যখন এসে বড় নদীতে পড়ল তখন বোলা প্ৰায় একটা। সেই বড় নদীর একরকম মুখেই ঝালকাটির স্টেশন ও বন্দর। এই ঝালকাটি স্বদেশির যুগে যে খুব বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল তা সম্ভব মনে আছে। ফ্ল্যাট দুখানি খুলে রেখে স্টেশনে লাগতে লাগতে প্ৰায় দুটো বাজল। এ স্টিমার বরিশাল পৌঁছতে রাত প্ৰায় নটা-দশটা হবে। বরিশাল থেকে এক্সপ্রেস স্টিমার ছেড়ে আসে সন্ধ্যা ছাঁটায়। সুতরাং এবার আমার বরিশাল-দর্শন বরিশালের সৌভাগ্যে হল না। ঝালকাটিতেই নেমে পড়া গেল। বরিশাল থেকে খুলনা এক্সপ্রেস স্টিমার এখানে রাত আটটায় পৌঁছবে। ততক্ষণ ঝালকাটিতেই অপেক্ষা করব।
স্টিমারের লোকের ও স্টেশনের লোকের উপদেশে এখানকার ডাকবাংলায় এসে উঠেছি। সারেং ও স্টিমারের পাঁচ-ছ’জন খালাসি সঙ্গে এসে পৌঁছে দিয়ে গেল। এখানকার স্টিমারআপিসের লোকেরাও খোঁজ-খবর নিচ্ছে। এইমাত্র একজন মুসলমান কর্মচারী ডাকবাংলায় এসে জিজ্ঞাসা করে গেলেন, কোনও কিছুর প্রয়োজন আছে কি না, এবং বলে গেলেন সময়মতো আমার জিনিসপত্র নিতে লোক পাঠিয়ে দেবেন, আমি যেন কোনও চিন্তা না করি। ডাকবাংলাটি স্টিমার-ঘাট থেকে বেশি দূর নয়। দু’কামরা টিনের ঘর, বাঁশের সিলিং ও বেড়া। মেঝে সিমেন্ট করা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে এই চিঠি লিখছি। সামনে রাস্তাব ওপারেই একটা বড় ধানক্ষেত। ধান পেকেছে, এখনও কাটা হয়নি। তারপর নদী। নৌকার চলমান পাল দেখা যাচ্ছে। ওপারের সুপারি-নারকেল-বনের নীচ দিয়ে চলন্ত বড় নৌকার ছই দেখতে পাচ্ছি। উত্তর দিকটায় নদীর জল অনেকটা দেখা যাচ্ছে–রৌদ্রে গলা ইস্পাতের মতো ঝকঝকি করছে। তার এক পাশে স্টেশনের ফ্ল্যাটের কুশ্ৰী দেহটা।
ডাকবাংলার সামনের ছোট মাঠটায় দুটি খঞ্জন নেচে বেড়াচ্ছে। রোগা একটা বাছুর ঘাস খাচ্ছে। সামনে রাস্তার পাশে চারটে ঝাউগাছ। একটার গা ঘেঁষে এক খেজুরগাছ, হাঁড়ি বঁধা রয়েছে। একটা কাক হাঁড়ির মুখে গলা ঢুকিয়ে রসাকর্ষণের বৃথা চেষ্টা করছে। ডাকবাংলার উত্তর ঘেঁষে এক ঘোলা জলের ডোবা। তার ওপারে মিউনিসিপ্যাল আপিস, তার পর পুলিশের থানা। তারপরে বাজারের সব টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। ছ’দিন জল-প্রবাসের পর ডাঙার জীবের ডাঙা মন্দ লাগছে না।
‘মুলতানি’ স্টিমার
২৫ ডিসেম্বর ১৯৩৫
সন্ধ্যা
এবারে কাল যখন স্টিমার ঝালকাটি পৌঁছল তখন সন্ধ্যা ঘোর হয়েছে। দু’খানা ফ্ল্যাটের একখানাকে এখানেই খুলে রাখা হল; ওতে নাকি কাছাড়ের মাল আছে, অন্য স্টিমারে টেনে নিয়ে যাবে। সুমামাদের এ স্টিমার কলকাতা থেকে বরাবর কোথাও না-থেমে এসেছে; কেবল খুলনাতে আড়কাঠি তুলে নেবার জন্য নদীর মধ্যেই অল্পীক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। আমার বাটলারের এবং স্টিমারের লোকজনদের কাঁচা রসদের পুজি ফুরিয়ে এসেছে। সুতরাং তা সংগ্রহের চেষ্টা ঝালকাটিতে স্টিমার লাগানো হল। এ অসময়ে তরিতরকারি কিছু পাওয়া গেল না। বাটলার মাছ ও মুগের ডাল কিনে আনল। পথে আমার খাদ্য সংগ্রহের জন্য স্টিমার-কোম্পানি কিছু-কিঞ্চিৎ অবশ্য বাটলারের হাতে দিয়েছিল। সেটাকে উপেক্ষা করে বাটলারের নামবার সময় সে জন্য তাকে কিছু দিয়ে দিয়েছিলুম। মনে হচ্ছে বুড়ো বাটলারের কর্মে উৎসাহ ও সেলামের বহর দু-ই বেড়েছে।