২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বৃহস্পতিবার
খুলনা ছাড়িয়ে এখন বরিশাল জেলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আজ ভোর থেকেই নদীর দুই পাড়ে নারকেল-সুপারির সার চলেছে অবিচ্ছেদে। কিন্তু নদীর চেহারা গেছে বদলে। দুই পাড়ের সুস্পষ্ট সীমারেখার মধ্যে বহতা নদীর যে সুষমা। এ নদীর তা নেই। খুলনার নদীর চেয়ে এ নদী প্রশস্ততর, কিন্তু এর দুই পাড়ই ঢালু, আর সে পাড় বালুর নয়, কাদার। নদীতে স্নানের ঘাট বড় দেখছিনে। গ্রামগুলি সব নদীর থেকে দূরে দূরে। কালকের খুলনার নদী ছিল তরুণী কলহাসিনী গৃহলক্ষ্মী, আর এ যেন ঈষৎস্কুলাঙ্গী প্রৌঢ়া গৃহিণী–সিঁথিতে সিন্দূর, পরনে চওড়াপাড় শাড়ি, কিন্তু কপোলে কপালে কৰ্কশ বলিরেখা দেখা দিয়েছে।
আমাদের সারেঙের মতে বরিশালের লোকের মতো সুখী লোক কোথাও নেই। এদের সকলেরই যথেষ্ট ধানের জমি আর নারকেলের বাগান আছে, যাতে ধান ও নারকেল ফলে অসম্ভব রকম। এদের নাকি ধারকর্জে নেই। আর প্রায় সকলের বাড়ির কাছ দিয়েই নদী কি নালা গিয়েছে, তাতে মাছের যেমন ভাবনা নেই, যাতায়াতেরও তেমনি সুবিধে। যে বাড়ির পাশ দিয়ে নদী কি নালা যায়নি সে বাড়িতে নাকি লোকে সহজে মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না। এই সঙ্গে সারেং আরও একটা খবর জানালে। খুলনার মেয়েরা নাকি লঙ্কামরিচ বাটে না; তাদের রান্না যে কী করে হয় তা রহমত আলির বুদ্ধির অতীত।
আমাদের এ স্টিমার সব স্টেশনে থামে না; যেখানকার মাল আছে কেবল সেখানেই থামে। আর একশো মনের চেয়ে কম হলে সে স্টেশনের মাল এ স্টিমারে বোঝাই হয়নি। কিন্তু যে স্টেশনে থামছে সেখানেই দেরি হচ্ছে অনেক। কারণ স্টিমারকে স্টেশনে ভিড়তে হচ্ছে আগে ফ্ল্যাট-দুখানি মােঝ-নদীতে খুলে রেখে; আবার যাবার মুখে ও-দুখানিকে দু’পাশে বেঁধে নিতে হচ্ছে। এইরকম কসরত করতে করতে বেলা দশটার পর পৌঁছলুম হুলার হাট স্টেশনে। স্টেশনটি একটু বড় এবং এর মালও আমাদের স্টিমারে আছে যথেষ্ট।
২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যা
সাড়ে-তিনশো মন মাল নামিয়ে হুলার হাট ছাড়তে বেলা বারোটা বেজে গেল। বেলা প্ৰায় দেড়টার সময় পৌঁছলুম কাউখালি বলে এক স্টেশনে। ছোট স্টেশন, মালও নামল অল্প। আর সৌভাগ্যক্রমে এবারে ফ্ল্যাট নিয়েই স্টিমার পাড়ে লাগতে পারল। ভাবলুম কাউখালি ছেড়ে রওনা হতে দেরি হবে না। এমন সময় সারেঙের অ্যাসিস্ট্যান্ট এক ছোকরা জানালে যে, স্টিমার এখন এইখানেই নোঙর করে থাকবে যতক্ষণ না ভাঁটা আরম্ভ হয়। আর খুলনাগামী বরিশাল এক্সপ্রেস স্টিমার পাস না করে–অর্থাৎ রাত প্ৰায় সাড়ে আটটায়। সারেং এসেও সেই খবর দিল। এখান থেকে বরিশাল যেতে, কতক দূর যেতে হয় একটা সরু খাল দিয়ে। সেইজন্য নিয়ম যে, ফ্ল্যাটগ্ৰস্ত স্টিমারগুলি বরিশালের দিকে যাবে ভাটার সময়, আর বরিশাল থেকে আসবে যখন জোয়ার।
কাউখালির স্টেশনমাস্টারবাবু দেখা করতে এলেন। পরিচয় দিলেন তিনি আমার স্বজাতি। অবশ্য সারেঙের কাছে উপাধিসমেত আমার নামটা শুনেছেন। তার বাড়ি এই জেলাতেই ঝালকাটির কাছে; গ্রামের নামটা ভুলে গেছি। এখানে পাঁচ বছর আছেন। স্টেশনের লাগাও কোয়ার্টার্স, গোলপাতার। কাছেই একটা বন্দর, স্টিমার থেকে দেখা যায়। কাছাকাছি লোকজন অনেক আছে। কিন্তু এ জায়গায় নাকি খাবার জিনিসের ভারী অসুবিধা। বাঙালির খাবার দুধ আর মাছ, তা এ নদীতে মাছ বেশি পাওয়া যায় না; আর দুধের সের যখন অন্য সব জায়গায় পাঁচ-ছ’ পয়সা তখন এখানে, ঠিক কত বললেন মনে নেই, তবে তিন আনার কাছাকাছি একটা মারাত্মক সংখ্যা। নেমে গিয়ে চারটে ডাব পাঠিয়ে দিলেন। একটা খেয়ে দেখলুম। অতি চমৎকার মিষ্টি জল। রোজা ভাঙার পর শরীর ঠান্ড করবার জন্য সারেংকে একটা দিলুম। সে বলছে তার মন ভাল নেই। তিনজন খালাসির জ্বর, একজনের হাতে চোট লেগেছে। শর্ট হ্যান্ডে কাজ চালাতে হচ্ছে। বোধহয় কালকের কালিয়ার কাছের ব্যাপারটারও মন খারাপের সঙ্গে কিছু সম্পর্ক আছে।
স্টেশনের কিছু পুবে পশ্চিম-মুখ হয়ে স্টিমার নোঙর করল। এই নদীর নাম কাউখালির খাল। বয়ে যাচ্ছে এখানে পুবে-পশ্চিমে। অল্পদুর পুবে নদীটি দু’ভাগ হয়ে এক ধারা গেছে উত্তরে বানারিপাড়ার দিকে, আর দক্ষিণে সরু। ধারাটি পার হয়ে আমরা যাব বরিশাল। ডাইনে সুপারি-নারকেলের দেয়ালে ঘেরা অর্ধচন্দ্ৰাকৃতি দুটি ধানক্ষেত। সব ধান কাটা হয়নি, বোধহয় শুকিয়ে গেছে; কেমন একটা শুষ্ক নিস্ফল চেহারা। বানারিপাড়ার বাঁকের কাছটিতে গাছপালাগুলি বুকে পড়ে নদীর আয়নায় মুখ দেখছে। তার উলটো দিকে নদীর ঠিক পাড়ের উপরেই একটা বড় সুপারি।-বাগান। নদীর ধার দিয়েই রাস্তা, বোধহয় যাচ্ছে বন্দরের দিকে। বড় বড় নৌকা গুণ টেনে চলেছে সেই রাস্তা দিয়ে।
সূৰ্য পশ্চিমে ঢলতে আরম্ভ করেছে। ডেক রৌদ্রে ভরা। সামনের নদীর জল গলানো সোনা, চোখ ঝলসে যায়।
বেলা পড়তে শুরু হল। নদীর পাড়ের রাস্তাটি দিয়ে লোক-চলাচল আরম্ভ হয়েছে। খানিকটা ফাঁকা জায়গাতে অনেকগুলি ছেলে জুটে হাডু-ডু খেলছে। ছোট ছেলেদের এক দল, আর তার চেয়ে বড়দের এক দল। তাদের চেয়ে বড় চার-পাঁচটি ছেলে খেলছে না; নানা রঙের র্যাপাব। গায়ে, দাঁড়িয়ে গল্প করছে ও খেলা দেখছে। এরা সম্ভব মাতকাবর বনে গেছে। সুপারিনারকেল বনের ওপারে সূর্য অস্ত গেল। পশ্চিম-আকাশে আর নদীর জলে গোলাপি আভা। ক্রমে সন্ধ্যা ঘোর হয়ে আসছে। উত্তর-পারে খানচারেক বড় নৌকা এক সার বেঁধে নোঙর করল। দক্ষিণের রাস্তায় একজন একটা হ্যাসাক জ্বালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বন্দর থেকে বোধহয় গ্রামের দিকে। আমাদের স্টিমারের পিছনের ডেকে নমাজের আজান দিচ্ছে। চারদিক ক্ৰমে স্তব্ধ অন্ধকার হয়ে এল। কেবল মাঝে মাঝে নৌকার দাঁড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।