বেলা আন্দাজ সাতটায় সুন্দরবন ডেসপ্যাচ-সার্ভিসের একখানা কলকাতাগামী স্টিমারের সঙ্গে দেখা হল। নাম ‘বুরানওয়ালি’। দু’খানা ফ্ল্যাট দু’দিকে নিয়ে চলেছে। সেখানে নদী এত ছোট যে আমাদের স্টিমার একপাশে দাড় করিয়ে তাকে পথ দিতে হল।
বেলা প্ৰায় সাড়ে এগারোটার সময় একখানা ছোট নৌকা দেখা গেল। বোঝা গেল লোকালয় কাছে এসেছে। অল্পক্ষণ পরে নদীর ধারে গাছের তলায় কয়েকটা বানরের দেখা পাওয়া গেল। শুনলুম অনেক ভাগ্যবান লোক আমার মতো সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে স্টিমারে যেতে হরিণের দল ও রয়্যাল বেঙ্গল বাঘ দেখতে পেয়েছে। আমার ভাগ্য বানরের উপর আর উঠল না।
মুসলমানদের এটা রোজার মাস। স্টিমারের দোতলার পিছনের ডেকে যেখানে মাল বোঝাই আছে তার কতকটা পরিষ্কার করে তেরো-চোদ্দোজন স্টিমারের খালাসি ও কর্মচারী সূৰ্যাস্তের পর নামাজ পড়ে। একসারে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ওঠাবসা করে; দেখতে বেশ। এর অনেকটাই যে আমাদের পূজা-অৰ্চার মতোই বাহ্যিক কসরত মাত্র তা মনে করতে ঠিক এখন ইচ্ছা হচ্ছে না। নমাজের পর সকলে গোল হয়ে বসে রোজা ভাঙে অর্থাৎ খেতে আরম্ভ করে। এক-এক থালায় দু-তিনজন খাচ্ছে। খাদ্য ডাল ভাত এবং একটা কিছু তরকারি। এরা সমস্ত দিন উপবাসী থেকে স্টিমারের খালাসির হাড়ভাঙা খাটুনি মুখ বুজে সমানে খেটে যাচ্ছে। পূর্ব-বাংলার এই মুসলমান খালাসিদের দেখে বাঙালির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে একটু ভরসা হয়।
সারেং বলছে, আজ রাত আন্দাজ দশটা-এগারোটায় স্টিমার খুলনা পৌঁছবে। তারপর খুলনা থেকে বরিশাল যাবে চার-পাঁচ জায়গায় থেমে মাল নামাতে নামাতে। স্টিমারের কেরানিবাবু (বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক) বললেন যে, বৃহস্পতিবারের পূর্বে বরিশাল পৌঁছানো যাবে না। আমার রবিবার কলকাতা পৌঁছতেই হবে। সুতরাং এবার আর গৌয়ালন্দ পর্যন্ত যাওয়া হল না। বরিশাল থেকেই বরিশাল-খুলনা এক্সপ্রেস স্টিমারে খুলনা হয়ে কলকাতা ফিরব।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বুধবার। ভোর ৭টা
কাল রাত দশটায়, যখন খুলনা পৌঁছতে মাত্ৰ ঘণ্টা দুই দেরি, তখন কুয়াশার জন্য স্টিমার নোঙর করতে হল। কুয়াশা কিছু বেশি নয়; জ্যোৎস্নায় নদীর পারের গাছপালা বেশ দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু কুয়াশার জন্য সার্চলাইটের আলো ভাল না খোলায় শেষে নৌকা চাপা পড়ে এই ভয়ে সারেং স্টিমার নোঙর করে রাখে। আজ ভোররাত্রে ছেড়ে এই মাত্র খুলনা পৌঁছল। বেলা বারোটা আন্দাজ বরিশাল রওনা হবে। এখন নেমে তোমাদের একটা টেলিগ্রাম করতে ও এই চিঠি পোস্ট করতে যাচ্ছি। এ-সব কাজ স্টিমারের লোকেরাই করত, কিন্তু শহরটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছা।
২৬ ডিসেম্বর ১৯৩৪
বুধবার। সন্ধ্যা
বেলা দশটার মধ্যেই স্টিমার খুলনা ছেড়ে রওনা হল। এখন চলেছি মানুষের ঘরকন্নার সাথি ছবির মতো ছোট নদী দিয়ে। দুই পাড়ে ধানক্ষেত। ধান কাটা শেষ হয়েছে। বাদামি রঙের ফাকা মােঠ; গোরু চরছে। মাঝে মাঝে চৌকো সরষেক্ষেত, হরিত-কপিশ–সব ফুল এখনও ফোটেনি। একটু পর-পরই লোকালয়; খোড়ো ঘর, ঢেউ-তোলা টিনের ঘর–আম, নারকেল, কলাগাছে ঘেরা। কচিৎ একটা পাকা বাড়ি, সম্ভব জমিদাববাবুদের। স্নানের ঘাটে লোকের ভিড়; পাড়ের উপর ছাগলছোনা লাফাচ্ছে। কোথাও নদীর ধারে হাটের জায়গা; বেড়াহীন ছোট ছোট টিনের চালা, গোটকয়েক টিনের চাল টিনের বেড়ার ঘর–স্থায়ী দোকান ও মহাজনদের গুদাম৷ উজান-ভাটিতে নৌক চলেছে নানা ধরনের–পাল তুলে, দাড় টেনে, লাগি ঠেলে। পাড়ের উপর দিয়ে লোক-চলাচলের পথ, নানা বেশের লোক চলেছে–কারও মাথায় ছাতি, কারও কঁধে মোট। নদীর দুই পারে দূর দিয়ে চলেছে শ্যামল গাছের সার। এ নদীর যাঁরা নাম দিয়েছিল মধুমতী, তাদের রুচির প্রশংসা করতে হয়।
ক্ৰমে দুপুর গড়িয়ে গেল। স্নানের ঘাট সব খালি হয়ে এসেছে। এক-এক জন লোক তাড়াতাড়ি এসে চট করে দুটো ডুব দিয়ে তখনই উঠে যাচ্ছে।
আমাদের সারেং রহমত আলির নৌক চাপা দেবার ভয় অত্যন্ত বেশি। বোধহয় কোনওদিন ও কাজ করে বিপদে পড়েছিল। কিন্তু খোঁড়ার পা-ই খানায় পড়ে। বেলা যখন দুটো, আর স্টিমার এসেছে কালিয়া গ্রামের কাছাকাছি, তখন স্টিমারের বাঁ দিকের ফ্ল্যাটের সঙ্গে একখানা বড় পাট-বোঝাই নৌকার একটা মৃদু-রকম ঠোকাঠুকি হল। ফলে নৌকখানি হল কিঞ্চিৎ জখম, তবে বেশি কিছু নয়। দোষ কাকেও বড় দেওয়া যায় না। দুই ফ্ল্যাট সমেত আমাদের স্টিমারের এই ছোট নদীতে ঘোরাফেরা একটু সময়সাধ্য, আর জোর বাতাস থাকতে চেষ্টা করেও নৌকাখানা সময়মতো সরে যেতে পারেনি। এরকম ঘটনা ঘটলে সারেংকে নিকটবতী পুলিশ-থানায় রিপোর্ট পাঠাতে হয়। স্টিমারের লোকজনদের মধ্যে অনেক জেলার লোক ছিল–চাটগাঁ, নোয়াখালি, কুমিল্লা, ঢাকা, ময়মনসিং।। দেখলুম। সকলে একমত যে, এ অঞ্চলের লোক বড় সহজ নয়; তিলকে তাল করে তোলার মতো কল্পনার জোর নাকি এদের প্রচুর আছে। সারেঙের ইচ্ছ, তার রিপোর্টটা ইংরেজিতে লেখা হয়। স্টিমারে চলনসই। ইংরেজি লেখকের অভাব, সুতরাং ঘটনার রিপোর্টটা লিখে দিতে হল। কালিয়া স্টেশনে স্টিমার থামিয়ে স্টেশনমাস্টারবাবুকে সেই রিপোর্ট দেওয়া হল থানায় পাঠিয়ে দেবার জন্য। তার মুখে শুনলুম, এখানে ইতিমধ্যেই রটে গিয়েছে যে, স্টিমার একখানা পাঁচশো-মনি বোঝাই নৌক চাপা দিয়ে একবারে ডুবিয়ে দিয়েছে। কালিয়া ছাড়বার অল্পক্ষণ পরে স্টিমারের কেরানিবাবু এলেন একটা লেখার খসড়া নিয়ে। তিনি নাকি স্টিমারের নিবপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তি; এরকম ঘটনার একটা রিপোর্ট তাকেও লিখে রাখতে হয়। যা লিখেছেন তা তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না। লেখার উপর চোখ বুলিয়েই কারণটা বুঝলাম। সেটা আমার লেখা সারেঙের রিপোর্টেব্য হুবহু নকল। কী করা যায়–ওকেই অদল-বদল করে নিরপেক্ষ তৃতীয় ব্যক্তির রিপোর্ট করে দেওয়া গেল।