২
গৌহাটি থেকে রওনা হতে বেলা বাজল এগারোটা। বেলা দুটোরও পর পর্যন্ত ডাইনে পাহাড়ের সার চলছে নদীর প্রায় পাড় ঘেঁষে। নিবিড বনে ঢাকা পাহাড়; হঠাৎ মাঝে মাঝে এক-একটা পাহাড়ের খানিকটা অনাবৃত কালে পাথরে মোড়া, প্ৰকাণ্ড ঐরাবতের পাশের মতো। এক সার পাহাড়ের পিছনে আর-এক সার তারপর আবার এক সার, দূরে দূরে আরও সব সারের মাথা দেখা যাচ্ছে, অতি পাতলা নীল ওড়নার মতো ফিকে নীল কুয়াশায় Tাকা। এক জায়গায় একটা পাহাড় তার সঙ্গীদের ছেড়ে আড়াআড়ি সোজা চলে এসেছে জলের মধ্যে, নদীর সঙ্গে পরিচয় নিবিড় করতে। উলটোদিকের পাড় একটা চরের জিহ্বা অনেকদূর নদীর মধ্যে এগিয়ে দিয়েছে। এ জায়গাটা স্টিমার পর হল অতি ধীরে ও সাবধানে। পাশ দিয়ে যাবার সময় নদীর এই দুঃসাহসী প্রণয়ীর রূপটি দেখতে পেলাম। প্রকাণ্ড প্ৰকাণ্ড পাথরে মোড়া পা, তার উপর পালিশ-কালো পাথরের চওড়া বুক খাড়া উঠে গেছে, রুদ্ধদুয়ার মন্দিরের কপাটের মতো।
বাঁদিকের পাহাড় সব দূরে দূরে। তৃণলেশহীন উচু চর চলেছে মাইলের পর মাইল— ব্ৰহ্মপুত্রের তরঙ্গলাঞ্ছনা পাশে আঁকা। অনুজ্জ্বল রৌদ্রে মনে হচ্ছে যেন চুনারি পাথরে তৈরি। আজও আকাশে মেঘ আছে, তবে রোদকে ঢাকতে পারেনি, শুধু নিষ্প্রভ করেছে।
ডানদিকের পাহাড়ের প্রাচীরটা যখন একটু একঘেয়ে বোধ হচ্ছে এমন সময় হঠাৎ পাহাড়
গেল দূরে সরে। পূর্ব-বাংলার শীতের নদীর পরিচিত রূপটি ফুটে উঠল। এখানে ওখানে ছড়ানো চরের শুভ্ৰ বালু কেটে কালো নীল জলের ধারা, দিকচক্রবালে গাছের ঘন সবুজ রেখা।
বেলা পড়ে আসছে; কেবিনের সামনে বেতের কুর্সিতে রোদে বসে আছি। সম্মুখে একটা গোল চর, চারদিকে নীল পাহাড়; যাঁরা ছিল নদীর পাশে, বাঁেক ঘুরে মনে হচ্ছে তাঁরা যেন নদীর মাঝ থেকে উঠেছে। একখণ্ড কালো মেঘ। সূর্যকে আড়াল করেছে–রুপালি জরির পাড়-দেওয়া নীলাম্বরীর আঁচল; মাঝখানে একটা চোখ-ঝলসানো গোল ফুটো দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে; নদীতে রঙের স্রোত। সব মিলে মনে হচ্ছে যেন টার্নারের একখানা छदि।
একটা চরের ওপারে নদীর মধ্যে সূৰ্য অস্ত গেল; আগুনের প্রকাণ্ড গ্লোব। ঘড়িতে পাঁচটা ছ’ মিনিট। অনেকটা পুবে চলে এসেছি। শুক্রবার দিন সূৰ্যাস্তের সময় ঘড়িতে ছিল পাঁচটা পনেরো মিনিট। তবে আমার এ হাতঘড়িকে বৈজ্ঞানিক পৰ্যবেক্ষণের ভিত্তি করা চলে না। ওর তিনদিনের গতিবিধির ফল। অনেক সময় চমকপ্ৰদ।
স্তব্ধ ব্ৰহ্মপুত্রের বুকের উপর সন্ধ্যা নেমে এল। পুবে প্রতিপদের সোনালি চাঁদ, পশ্চিম-আকাশে বৃহস্পতি জ্বলজ্বল করছে।
ইন্দ্র ফ্ল্যাট, তেজপুর
২৯ ডিসেম্বর ১৯৩৬
মঙ্গলবার
ভোরে কেবিন ছেড়ে বাইরে এসেই দেখি, বাঁয়ে তেজপুর শহর দেখা যাচ্ছে। স্টিমার ঘাটে লগতে দেরি হল না। মালপত্র গুছিয়ে স্টিমারের লোকদের বিদায়সম্ভাষণ জানিয়ে এখানকার স্টিমার-স্টেশনের ওয়েটিং ফ্ল্যাট ইন্দ্ৰ’তে এসে ওঠা গেল। ফ্ল্যাটের এক কেবিন দখল নিয়ে নীচে নেমে অর্থাৎ ব্ৰহ্মপুত্রের চর ভেঙে উপরে উঠে গেলুম শহরে। পোস্ট আপিস থেকে তোমাদের টেলিগ্রাম পাঠিয়ে একটা ঝরঝরে রকম ফোর্ড ট্যাক্সিতে সমস্ত শহর ঘুরে বেড়ালাম। ট্যাক্সিওয়ালার বাড়ি সিলেট, ছেলেবেলা থেকে এখানেই আছে। কিন্তু তেজপুর শহরের উপর তার অসীম অবজ্ঞা; বললে এটা শহর না শহরের আকার! সিলেট শহরে ট্যাক্সি চলে ষাটখানা, এখানে পাঁচখানা চলা কঠিন।
ইন্দ্ৰ ফ্ল্যাটে নাওয়া-খাওয়া সোরে, সামনের ডেকে একটা আরাম-কেদারায় রৌদ্রে পা ছড়িয়ে প্রিস্টলির সেই উপন্যাসটা পড়ছি, আর ব্ৰহ্মপুত্রের স্রোত ও নদীর পড়েটিলার উপর টিনের বাংলোগুলি চেয়ে দেখছি।
তেজপুর শহরের গল্প মুখেই শুনো।