‘ঠিক বলেছ। এবার তাহলে শেষ করি। না, রমলাকে একবার জিজ্ঞেস করা দরকার। তার যদি কোনও ফরমাস থাকে!’
মিসেস লাহিড়ীকে ডেকে পাঠানো হল। তিনি খসড়াটা শুনে বললেন, ‘আসল কথাই তো বাদ দিয়েছ। ভাল বংশের মেয়ে হবে, সংসারের কাজকর্মও জানা চাই। বয়সটাও বলে দাও। কুড়ি বছরের বেশী হলে খোকার সঙ্গে মানাবে না।’
মায়ের সঙ্গে মেয়েও এসেছিল। সে বলল, ‘আর নাচগানের কথাও তো লেখোনি। অন্তত গান। জানলে চলবে কেন?’
লাহিড়ী সাহেব যোগ করলেন, সদবংশজাত, গৃহকর্মনিপুণা, সঙ্গীতজ্ঞা, অনূর্ধ্ব কুড়ি বছর বয়স্কা ব্রাহ্মণ পাত্রী আবশ্যক। সদ্য তোলা ফটোসমেত যোগাযোগ করুন।
ঘোষ সাহেবের দিকে চেয়ে একটু যেন কৈফিয়তের সুরে বললেন, আমার অবিশ্যি জাত সম্বন্ধে কোনো অমত ছিল না। কিন্তু রমলার আবার বামুন না হলে চলবে না।’
রমলা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘তা যাই বল, আমার ঠাকুর আছেন—সেখানে আমি যাকে-তাকে ঢুকতে দিতে রাজী নই।’
সবটা যখন পড়ে শোনালেন মিস্টার লাহিড়ী, ঘোষ সাহেব বললেন, ‘এক কাজ করলে হয় না? অত কথা না বলে শুধু লেখখা—একটি তিলোত্তমা আবশ্যক। তাতে অনেক খরচ বাঁচবে, আর আমাদের বক্তব্যও ঠিক ঠিক বলা হবে।’
লাহিড়ী হাসলেন, ‘তা মন্দ বলেনি। বিশেষণের লিস্টিটা বড় বেশী লম্বা হয়ে গেল কিন্তু। কোনটা কাটা যায় বল!
মিসেস বললেন, কোনোটা কাটতে হবে না। ঐ বেশ আছে। ছেলের যুগ্যি মেয়ে চাই তো!’
লাহিড়ীর মনে মনে সন্দেহ ছিল, এরকম অর্থাৎ এত অধিক গুণান্বিতা মেয়ে কারো ঘরে আছে কিনা। বললেন, ‘দেখা যাক, কি রকম রেসপন্স পাওয়া যায়!
ফটো সকলে দেননি। অন্যান্য বিষয় পছন্দ হলে পরে পাঠাবেন বলে জানিয়েছেন। যে কখানা ফটো পাওয়া গেল, তার মধ্যে বেশির ভাগই সরিয়ে রেখে দিলেন রমলা। তাঁর ছেলে সত্যিই সুপুরুষ। সুতরাং মেয়ের রূপ সম্বন্ধে কড়াকড়ি করার অধিকার তাঁর আছে। দু’তিনটি ছবি তাঁর। নজরে পড়লা
বাকি চিঠিগুলো পড়বার পর স্বামী-স্ত্রীতে পরামর্শ করে মাত্র দুটি পার্টিকে ছবি পাঠাতে লেখা হল।
কদিনের মধ্যেই ছবি এসে গেল। তারপর ঘোষ সাহেব, তাঁর স্ত্রী এবং আরো দু’তিনটি আত্মীয় বন্ধু নিয়ে নির্বাচন-সভা বসল। ঘণ্টা দুইয়ের অধিবেশনে নানা তরফ থেকে বিচার-বিবেচনা করে তিনটি কনেকে দেখতে যাওয়া স্থির হল। দেখার পর আবার একদফা দীর্ঘ আলোচনা। তাতে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেল না। কোনো না কোনো বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিল তখন ঠিক হল তিনজনের একটি সিলেকশন বোর্ড গঠন করা হোক। কর্তা-গিন্নী তো থাকবেনই, পারিবারিক বন্ধু ও বিচক্ষণ ব্যক্তি হিসাবে রইলেন মিস্টার ঘোষ।
চেহারা, শিক্ষা, কণ্ঠস্বর, রুচি, হাবভাব ইতাদি বিষয়ের একটি দীর্ঘ তালিকা তৈরি হল এবং প্রত্যেকটির জন্যে আলাদা আলাদা নম্বর বসালেন তিন বিচারক। এমনি করে যারা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়স্থান অধিকার করল তাদের মধ্যেও অমিল রয়ে গেল। বোর্ডের একজন মেম্বার যে মেয়েকে ফার্স্ট বলে ঘোষণা করলেন, অন্য একজনের মার্কসীটে তার স্থান হল সেকেন্ড। তখন নিজেদের মধ্যে একটা রফা করে একটি পাত্রীকে নির্বাচন করা হল। সে সত্যিই তিলোত্তমা।
ঘোষ বললেন, আমাদের কাজ তো চুকল, কিন্তু ছেলের পছন্দ অপছন্দ জানতে হবে তো! ‘সে সময় কই?’ বলে উঠলেন লাহিড়ী, ‘তিনদিন পরেই সে এসে যাচ্ছে। থাকবে মাত্তর দু সপ্তাহ তার মধ্যেই সব কিছু মিটিয়ে বৌ নিয়ে চলে যাবে। কনেপক্ষকে তৈরি হতে হবে তো। আমাদেরও একটা আয়োজন আছে। একেবারে নমোনমো করে সারা যাবে না। কাজেই আমাদের সিলেকশানই ফাইনাল তুমি কী বল, রমলা?’
‘আমারও মনে হয়, খোকা আমাদের কথার উপর কথা বলবে না। সে তো সেদিনও লিখেছে, তোমরা যা কিছু করবার করে রেখো। আমি দিন-পনরোর বেশী থাকতে পারব না।’
‘তাছাড়া ইন্দু আমাদের সেরকম ছেলে নয়।’ বেশ গর্বের সঙ্গে যোগ করলেন লাহিড়ী, ‘সব ব্যাপারেই বাপ-মার ওপর নির্ভর।’
পাত্রীপক্ষকে পাকা কথা দেওয়া হল। পাত্রের শিক্ষাদীক্ষা, চাকরি ইত্যাদি বিষয় আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফটোও পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা তো হাতে স্বর্গ পেলেন।
এয়ারপোর্টের নিষিদ্ধ এলাকার বাইরে সদলবলে অপেক্ষা করছেন লাহিড়ী-দম্পতি ও তাঁদের মেয়ে শিপ্রা, মিস্টার ও মিসেস ঘোষ এবং আরো কিছু আত্মীয়-বন্ধু। ভাবী বৈবাহিককেও নিয়ে এসেছেন লাহিড়ী সাহেবা কনেকেও আনবার ইচ্ছা ছিল, সে সলজ্জ সঙ্কোচে এড়িয়ে গেছে।
ঠিক সময়ে বিশাল জেট এসে দাঁড়ালা যাত্রীরা নামতে শুরু করেছে। ঐ তো শীর্ষেন্দু! একটু কাছে আসতেই শিপ্রা বলল, ‘দাদা কি দারুণ সুন্দর হয়েছে, দেখ মা!
মা অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন একটা কি বলতে গেলেন, স্বর ফুটল না। কাছে এসে প্রণাম করতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেনা দু চোখ জলে ভরে গেল শীর্ষেন্দু বাবাকে প্রণাম করে বলল, ‘তোমাকে একটু রোগা দেখাচ্ছে বাবা!
‘ও নো, আমি ঠিক আছি।’বলে ছেলের পিঠে হাত রাখলেন।
মিস্টার ও মিসেস ঘোষ এবং অন্যান্য পরিচিত সকলকেও যথাযোগ্য সম্ভাষণ করল শীর্ষেন্দু। শিপ্রার পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বলল, ‘তুই এত বড় হয়ে গেছিস! আমি ভাবছিলাম কোনো আননোন লেডি ফ্রেন্ড অব দা ফ্যামিলি নমস্কার করতে যাচ্ছিলাম।’
ভাবী বৈবাহিকের সঙ্গে ছেলের পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন লাহিড়ী, সেই মুহূর্তে শীর্ষেন্দু পিছন ফিরে একটি মেয়ের বাহু ধরে এনে দাঁড় করাল ওঁদের সামনে ঘোর কালো রঙ, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিকের প্রলেপ, মোটাসোটা, বেঁটে, চওড়া কপাল, সামনের দাঁত দুটো ভীষণ উঁচু। পরিচয় করিয়ে দিল—’মিস নবুটু, মাই ফিয়াঁসি। আফ্রিকার মেয়ে। ওর বাবার লন্ডনে মস্ত বড় হোটেল আছে। ও সে-সব দেখাশুনো করে। লন্ডন এয়ারপোর্টে আলাপ প্লেনে সিট পড়েছিল পাশাপাশি সেখানেই প্রোপোজ করলামা শী হ্যাজ এগ্রিড ইন্ডিয়া দেখতে এসেছে। একসঙ্গেই ফিরব।’