- বইয়ের নামঃ বাংলার পল্লীগীতি
- লেখকের নামঃ চিত্তরঞ্জন দেব
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১.১৪.০১ ব্রত অনুষ্ঠান
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান
বাংলার লোক-সংগীত তথা লোকসাহিত্যে বাংলার মহিলাদের দান যে নেহাৎ নগণ্য নয় এ কথা আমরা একাধিকবার বলেছি, এবং তার যথাযথ প্রমাণও দেবার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। একথা বলা নিতান্তই অতিরিক্ত বলে মনে হতে পারে যে বাংলায় প্রচলিত অধিকাংশ লৌকিক ব্রত অনুষ্ঠানের “কথা” ও তৎসম্পর্কিত ছড়া কিংবা গানগুলির প্রায় সবটাই বাংলার পুরনারীদের দান। এই সব ব্রতকথা, ছড়া ও গানের মাধ্যমে একদিকে যেমনি পাই সামাজিক খবরাখবর অন্যদিকে মহিলাদের কাব্য প্রতিভারও তারিফ না করে কোনো উপায় নেই।
এক কথায় বার মাসে তের পার্বণের দেশ এই বাংলায় এমন মাস খুব কমই আছে যে-মাসে একটা না একটা ব্রত বা অনুষ্ঠান নেই। কাজেই আমরা এই পরিচ্ছেদে মাস ভেদে ব্রত কথার বিবরণ অতি সংক্ষেপে কিছু কিছু দিয়েই “ধর্ম অনুষ্ঠান প্রসঙ্গ শেষ করব।
১.১৪.০২ কুমারী ব্রত বা শিবপূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – কুমারী ব্রত বা শিবপূজা
একদিকে চৈত্র উৎসব শেষ হল চৈত্র সংক্রান্তির দিনে, অন্যদিকে ঘরে ঘরে শুরু হল কুমারী ব্রত। চৈত্র উৎসব যেমন শৈবানুষ্ঠান ছাড়া আর কিছু নয়, তেমনি কুমারী মেয়েদের বৈশাখের কুমারী ব্রতও শিব পূজা ছাড়া আর কিছু নয়। পতি হিসাবে শিব হল মেয়েদের আদর্শ। পুরাণে এ সম্পর্কে বিলক্ষণ নজির আছে, হয়ত এ কারণেই বাংলার মেয়েরা কৈশোর থেকেই শিব পূজা করতে শুরু করে। এ শিব পূজায় পুরোহিতের কোনো দরকার নেই। সংস্কৃতের কঠিন শ্লোকও উচ্চারণ করবার কোনো প্রয়োজন হয় না। তারা নিজেদেরই তৈরী ছড়া আউড়ে কখনও বা সমস্বরে সুর করে ছড়া বলে যায়। চৈত্র মাসের সংক্রান্তির দিন খুব ভোরে উঠে মেয়েরা বেলে মাটি দিয়ে ছোট ছোট শিব মূর্তি তৈরী করে। পরে সকলের শিবমূর্তি একত্রে বসিয়ে, আবার কখনও ব্রতী একা থাকলে শুধুমাত্র তার নিজের শিবমূর্তিটি তামার টাটের উপর বসিয়ে তাঁর সামনে ভোগ দেয় ফলমূল, আলোচালের নৈবেদ্য, জ্বালিয়ে দেয় ধূপদীপ, পরে শুরু করে শিবকে স্নান করাতে।
এই স্নানের সময়ো মন্ত্র আছে; তবে এ মন্ত্র তাদের নিজস্ব বানানো মন্ত্র। তারা ডান হাতে ধরে ঘটি কা কমণ্ডলুর মাথা, বাঁ হাতে স্পর্শ করে ডান হাতের কনুই, পরে বলতে থাকে :
শিল শিলাটন শিলে বাটন
শিল অঝ্ঝর ঝরে
স্বর্গ হতে বলেন মহাদেব
“গৌরী কি বর্ত করে?”
নড়ে আশা নড়ে পাশ নড়ে সিংহাসন
হর গৌরী কোলে করে গৌরী আরাধণ।।
এরপরে প্রণাম মন্ত্র, তাও তাদেরই তৈরি ছড়া :
আকন্দ বিল্বপত্র আর গঙ্গাজল
এই পেয়ে তুষ্ট হোন ভোলা মহেশ্বর।।
এইভাবে তারা তাদের ব্রত সমাপন করে সেদিনের মতো চলে যায় যে যার কাজে; গোটা বৈশাখ মাস ধরে এইভাবে শিবপূজা করে সংক্রান্তির দিন করে উদযাপন।
১.১৪.০৪ হরির চরণ
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – হরির চরণ
বৈশাখ মাসকে এক কথায় বলা যায় পুণ্য মাস। এই মাসে যে কত রকমের ব্রত নিয়মের কথা শুনতে পাওয়া যায় তার আর ইয়াত্তা নেই। অঞ্চল ভেদে একই ব্রত বিভিন্ন নামে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। অনেকগুলি ব্রত আছে যেগুলি পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে উভয় স্থানেই প্রচলিত, ছড়ার ভিতরকার পার্থক্যও খুব সামান্যই দেখা যায়। ‘হরির চরণ’ ব্রতটি সেই শ্রেণীর। এতেও ঠিক বৈশাখ মাসের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, কুমারী মেয়েদের দেখা যায় পিতলের থালায় বা বাটায় চন্দন দিয়ে এক জোড়া পা আঁকতে। এই পদযুগলই হল শ্রীহরির পাদপদ্ম। বালিকারা সেই থালার উপর একটি করে ফুল ফেলে দিয়ে মন্ত্র পড়তে থাকে :—
হরির চরণ, হরির পা, হরি বলেন ‘মা গো মা,’
কোন্ ভাগ্যবতী পূজে মা?
সে ভাগ্যবতী কী চায়?
আপনাকে সুন্দর চায়, রাজ রাজেশ্বর স্বামী চায়,
গিরিরাজ বাপ চায়, দশরথের মত শ্বশুর চায়,
মেনকার মত মা চায়, দুর্গার মত আদর চায়,
বসুমতীর মত ক্ষমা চায়, দরবার আলো বেটা চায়।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতগণ নিশ্চয় বলবেন, শিশুদের মনে প্রথম থেকেই শ্বশুর, শ্বাশুড়ী ও শ্বশুরবাড়ির কথা ঢুকিয়ে দেওয়া কেন? আমরা এ কথার জবাবে শুধু বলব, বাঙালী সব সময়েই তাদের মেয়েদের দেখাতে চেয়েছে কল্যাণময়ী মাতৃরূপে। তাই শিশু বয়স থেকেই তাদের প্রার্থনা করতে শেখায় :—
হবে পুত্র মরবে না,
পৃথিবীতে এক ফোঁটা চোখের জল পড়বে না।
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে, মরণ যেন হয় গঙ্গার জলে।
১.১৪.০৫ পুণ্যি পুকুর
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – পুণ্যি পুকুর
‘পুণ্যি পুকুর’ ব্রত পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের উভয় অঞ্চলেই দেখতে পাওয়া যায়। ছড়াও প্রায় একই রকমের, তবু আমরা পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত একটি ‘পুণ্যি পুকুর’ ব্রতের ছড়াই আপনাদের আকছে তুলে ধরব। বৈশাখ মাসের প্রায় সবগুলি ব্রতই কুমারী ব্রত না হলেও এর প্রত্যেকটি ছড়াতেই লক্ষ্য করবেন এর ভিতর মেয়েরা সব সময়ই চায় একদিকে পিতৃকুলের অপরদিকে শ্বশুর কুলের মঙ্গল। শৈশব হতে মেয়েদের এই ভাবে ঘরের এবং পরের মঙ্গল কামনা করবার পদ্ধতি শিক্ষা দেওয়া হতো বাংলার মেয়েদের। তাই আজও গ্রামাঞ্চলে ঘুরলে শোনা যায় এই সব ব্রত কথা। অতি সংক্ষিপ্ত এসব ব্রত কথা। উঠোনের মাঝখানে ছোট একটি চৌকোণা পুকুর তৈরী করে পহেলা বৈশাখ থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত তার ভিতর প্রতিদন এক ঘটি জল ঢেলে দিয়ে ছড়া বলে, আর একটি করে ফুল ফেলে দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায় :
পুণ্যি পুকুর পুষ্প মালা
কে পূজেরে দুপুর বেলা,
আমি সতী নিজ ব্রতী
সাত ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী,
হবে পুত্র মরবে না,
চোখের জল পড়বে না,
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে
মরণ যেন হয় এক গলা গঙ্গাজলে।
চার বছর ধরে ঠিক একই নিয়মে এই ব্রত করে শেষ বছর করতে হবে উদযাপন। এইবার পুরোহিত ডাকতে হবে, তিনি শাস্ত্রীয় পূজানুষ্ঠান করবেন। অশ্বত্থ নারায়ণের ব্রতের মতো, এ ব্রতেও লাগে সোনার ও রূপোর তৈরি মাছ, বেলপাতা ইত্যাদি। সাধ্যানুসারে নিমন্ত্রণ অথবা ব্রাহ্মণ ভোজন এতো আমাদের ধর্মের একটা অঙ্গই।
১.১৪.০৭ ইতু পূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – ইতু পূজা
অগ্রাহয়ণের সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এই একটা মাস প্রতি রবিবার ভোরে বাসী বিছানায় বসে পশ্চিমবঙ্গের পুরনারীদের দেখা যায় ইতুপূজা করতে। ইতু শস্যের দেবী। একটি মাটির সরার উপর মাটির ঘট বসাতে হয়। এই মাটির ঘটই হলো ইতু ঘট। ঘটটি পূর্ণ করা হয় দুধ দিয়ে। ঘটের মধ্যে দেয় কল্মী ফুল ও আম্ রপল্লব; তাছাড়া সরার উপর পুঁতে দেওয়া হয় ধানের শীষ, যবের শীষ, কল্মীলতা, কচু গাছ। এই ব্রত না করে ব্রতীরা জল খায় না।
ইতু পূজার উদ্দেশ্য হলো সংসারের সুখ ও ঐশ্বর্য কামনা। পূর্ববঙ্গে একেই বলে ‘চুঙ্গির ব্রত’। চুঙ্গি অর্থে চোঙ্গ। সেখানে ঘটের পরিবর্তে বাঁশের চোঙ্গ ব্যবহার করা হয়—এইমাত্র পার্থক্য। সাধারণতঃ ব্রতী নিজেই এই ব্রতের ছড়া বলে সেদিনের মতো ব্রত সাঙ্গ করে।
কোথাও কোথাও পাড়া-প্রতিবেশীরা একত্র হয়ে বসে একজন ইতুর ব্রত কথা বলে, আর ব্রতীরা হাতে ফুল নিয়ে বসে বসে শুনে যায় ব্রত কথা :
অষ্ট লোক পালনী মাতা সংসারের সার
জগৎ পালনে মাতা যারে অবতার।
খণ্ডিয়া পাপ দারিদ্র্য সকল
সকল বিপদে বন্ধন হয় যায় রসাতল।
তোমার মহিমা কে কহিতে পারে
তোমার মহিলা (ও গো) কে বুঝিতে পারে,
একচিত্ত হয়ে যেবা যম লোক তরে।
ধর্মরাজ বলে আয়লেন নরপতি,ব্
রাহ্মণ কুলে তারা ব্রাহ্মণে বিদ্যাবতী।
জয়া-বিজয়া তার কন্যা দুইখানি,
অরণ্য ভ্রমিয়া তারা নানা দ্রব্য আনে
প্রভাতে ভিক্ষার তরে আইলেন দ্বিজবর
বনের মধ্যে আছে এক সরোবর।
স্ত্রী সহ পুরুষ সহ কাটত বিধি
নিয়ম করিয়া তারা দিলেন তিন ডাক
আসিবারে দিব বরত বিস্তর
না আসিব দিব শাপত বিস্তর,
কর পাঠ, কর রানী, কর নমস্কার।
হাসিতে খেলিতে গেল যত নারীগণ
শনিবার সপ্তমীতে থাকিবে নিয়মে
রবিবারে ব্রতের কথা শুনিবে প্রভাতে
দুইভগ্নী ব্রত করে, করে একমনে,
দুই বোনে কথা শোনে শোনে একমনে।
কাটিলেন অশ্বারিয়া মঙ্গল আঁকিয়া
রাজা লয়ে যান হস্তে ধরিয়া।
ললাট লিখন রাজা হের বিধির ফল
কাটিল অষ্টম বুড়ি বছর অষ্টম সুফল
হাড়িকীর ব্রতের কথা হল সমাপন
যারে যা মনবাঞ্ছা করহ পূরণ।
গোটা মাস এইভাবে ব্রতকথা শুনে পৌষ সংক্রান্তির দিন সেই সরায় বসানো ঘট এবং অন্যান্য জিনিসপত্র সহ মেয়েরা দল বেঁধে যায় নদীর ঘাটে কিংবা পুষ্করিণীর পাড়ে। একে একে টুসু ভাসান দেবার মতোই তারা ভাসিয়ে দেয় তাদের যার যার ইতুর ঘট ও সরা। সাঙ্গ হয় ইতু পূজার পালা সে বছরের মতো।
১.১৪.১০ গো-ক্ষুর ব্রত
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – গো-ক্ষুর ব্রত
‘গো-ক্ষুর’ ব্রত—কোনো কোনো জায়গায় বলে গোরুর ব্রত। কৃষিপ্রধান ভারতে গো-জাতির স্থান অতি উচ্চে। তার কাছে মানব সমাজের ঋণ অনেক। তাই তাকেও দেবতা জ্ঞান পূজা করতে তাদের বাধেনি। পৌষ মাসের শুক্লা তৃতীয়ায় (অথবা অন্য কোনো দিন) দেখা যায় বাড়ির গিন্নীরা অতি ভোরে উঠে বাড়ির গোহালঘর নিকোয়, তারপর গাভীগুলির (স-বৎসা হলে তো কথাই নেই) শিং-এ তেল মাখায়, কপালে সিন্দুরের টিপ দেয়, দেয় চন্দন কুম্কুমের ফোঁটা, তারপর গলায় পরিয়ে দেয় মোটা একছড়া ফুলের মালা। এরপর বাড়ির এবং পড়শী মেয়ে বৌরা সবাই এগিয়ে আসে ব্রত করতে। প্রথম গোরুর ক্ষুরে দেয় জল—তারপর তার মুখের কাছে ধরে দেয় আলোচাল, ফল প্রভৃতি দিয়ে সাজানো নৈবেদ্যের থালা। ব্রতীরা ধূপ দীপ জ্বালিয়ে প্রকৃতপক্ষে দেব মূর্তিকে পূজা করার ভঙ্গিতেই গলবস্ত্র হয়ে গাভীর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে :
গো গোবিন্দ সুরধুনী,
চার ক্ষুরে দিয়ে পানী।
মাথায় নৈবেদ্য মুখে ঘাস,
বর্তীরা গ্যাল স্বর্গ বাস।
এই দিন গাভীকে আর বাঁধা হয় না, সে নিজের ইচ্ছামত চরে বেড়ায়। সন্ধার দিকে গোহালে ফিরলে আবার তার সুমুখে ধূপ দীপ জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আর দেওয়া হয় এক আঁটি করে নতুন ঘাস।
১.১৪.১১ বনদুর্গার পূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – বনদুর্গার পূজা
মাঘ মাস পড়বার সাথে সাথেই পল্লীবাংলার বিশেষ করে যশোহর, নদীয়া ও চব্বিশ-পরগণার কোনো কোনো অঞ্চলে বালক বালিকারা শুরু করে দেয় ‘বনদুর্গার’ পূজা। তবে এর জন্য তৈরী হতে থাকে প্রায় দশ বার দিন আগে থাকতেই। এই সময় মধ্যে তারা প্রচুর পরিমানে পূজার ফুল সংগ্রহ করে। ফুলই বনদুর্গা পূজার প্রধান উপকরণ। যে কোনো ফুল দিয়েই এ পূজা হতে পারে। কয়েক বাড়ি বা ঘরের ছেলে মেয়ে মিলে এক একই ছোট দল তৈরী করে নেয় নিজেদের ভিতর। তারপর তারা নিজেদের পূজার জন্য একটি বেদী তৈরী করে। মাঘ মাসের পয়লা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত প্রতিদিন অতি ভোরে এবং সন্ধ্যায় দলের ছেলে মেয়েরা এসে ঘিরে বসে সেই বেদী মণ্ডপ। তারপর তারা শুরু করে পূজা। এই পূজায় পুরোহিতের কোনো দরকার নেই, তারা নিজেরাই পুরোহিত। এ পূজার মন্ত্রও কিছু নেই। কেবল কতকগুলি ছড়া—এর প্রায় সবগুলিই তাদের নিজেদেরই তৈরী। এর ভিতর একাধারে তাদের সাংসারিক খবরাখবরের কাহিনী, রাধা-কৃষ্ণ, হর-গৌরীর কাহিনী সব কিছুই পাওয়া যায়।
ভোরবেলা সূর্য উঠবার এখনও অনেক দেবী (কারণ, সূর্য উঠলে আর পূজা হবে না) ছেলে মেয়েরা সব বেদীর চারদিক ঘিরে বসে শুরু করে বন্দনা গাইতে :—
উঠরে উঠরে সূজ্জ্য উদয় দিয়া,
বায়ণ বাড়ির পাছ দিয়ে।
বায়নের মেয়েরা বড়ই সিয়ানা,
পৈতা জোগায় লো অতি বিয়ানা।
এরপর একে একে বলে যায় অনেক ছড়া। পূর্বেই বলেছি এসব ছড়ার ভিতর নির্দিষ্ট কোনো নীতি বা রীতি নেই। এর ভিতর একাধারে বিয়ের ছড়া থেকে বিরহের সব কিছুই থাকা সম্ভব। যতক্ষণ না সূর্য উদিত হয় ততক্ষণ এইভাবে ছড়ার পর ছড়া বলতে থাকে, তারপর যে যার ঘরে চলে যায়। আবার সবাই এসে জোটে সন্ধ্যা বেলা। এইবার ধূপ, দীপ সব জ্বালিয়ে দেয় সেই বেদীর উপর। হাতের ফুল ছিটাতে ছিটাতে তারা আবার শুরু করে ছড়া বলতে। একে বন্দনা গীতিও বলতে পারেন :—
সাজ এসরে সাঁজনা গীতি।
ক্যানরে সবে এত রাই।।
বাড়ির কাছে ভাঙা বন।
তাই ভাঙ্তি এতক্ষণ।।
এক কড়ার ঘুটি মুচি দুই কড়ায় ঘি।
সাজ পরদীপ লাগাল বয়ণগের ঝি।।
বায়ণ ঝি, বায়ণ ঝি বলে আলাম তোরে।
তোর গৌরাঙ্গের বিয়ে শনি মঙ্গল বারে।।
এ ছাড়া আরতিত ছড়াও আছে আলাদা। প্রদীপ হাতে নিয়ে ছেলে মেয়েরা বেদীর সুমুখে আরতি করতে করতে সমস্বরে ছড়া গায় :—
গঙ্গা পার করহে, না করিলে পার।
হাতের বাজু বাঁধা থুয়ে মারব সাঁতার।।
সকল সখি পার করিতে লাগবে আনা আনা।
রাধিকারে পার করিতে লাগবে কানের সোনা।।
আমরাতো গোপের মেয়ে সোনা কথায় পাব।
হাতের বেসাতি ভাসে গেলি উপোস করে রব।।
নলোক দেবে, বাজু দেবে, দেবে কানের ফুল।
তবেই না নিয়ে যাব ওপারেরি কূল।।
পাঠকগণ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন এ ছড়ার সঙ্গে বনদুর্গার কোথাও কোনো সম্পর্ক মাত্রই নেই। এ পূজাও যেমনি বালকদের তেমনি এ ছড়াগুলিও প্রায়ই তাদের রচনা। তারা বুড়ো-বুড়িদের মুখে রামায়ণ মহাভারত ও পুরাণের কাহিনী যেরূপ শোনে সেগুলিই তারা ছড়ার আকারে এখানে পরিবেশন করে।
বনদুর্গার পূজার তাৎপর্য সম্পর্কে যতটুকু যানা যায়, এ পূজা করলে নাকি ফোঁড়া, পাঁচড়া প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের, ‘পাঁচড়া পূজা’ এবং পশ্চিমবঙ্গের ‘ঘেঁটু’ পূজার বেশ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। এ বিষয়ে পরে আলোচনা করা হবে। এই প্রসঙ্গে বনদুর্গার প্রণাম মন্ত্রটি লক্ষ্য করা যাক। এর ভিতর দেখা যায় এঁকে বলা হয়েছে, ‘হে দেবতা (ঠাকুর) তুমি ফোঁড়া, পাঁচড়া প্রভৃতি নিয়ে চলে যাও, আবার যখন আসবে তখন টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড় নিয়ে এসো’ :—
এবার যাওরে ঠাকুর ফোট পাঁচড়া নিয়ে।
আবার এসো ঠাকুর শঙ্খ শাড়ি নিয়ে।
এই ভাবে গোটা মাঘ মাসটা পূজা করবার পর সংক্রান্তির দিন বিকালে ছেলেরা মহা উল্লাসের সাথে সেই বেদীতে সঞ্চিত এক মাসের ফুল, দূর্বা গুছিয়ে নিয়ে নিকটস্থ কোন জলাশয়ে বিসর্জ্জন দিয়ে আসে।
১.১৪.১২ ভাই-ফোঁটা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – ভাই-ফোঁটা
‘ভাই-ফোঁটা’ সম্পর্কে বাঙালী সমাজের কাছে খুব বেশী কিছু বলবার দরকার হবে বলেতো আমার মনে হয় না। ‘ভাইফোঁটা’ হল ভাইয়ের জন্য বোনের মঙ্গল কামনা। সারা বছরই বোন সে ছোটই হউক, কি বড়ই হউক, দাদা বা ভাইয়ের কাছ থেকে কিছু না কিছু পেয়ে আসছে, শুধু এই দিনটিতেই বোনের কাছে ভাইয়ের প্রাপ্য। এর সঙ্গে নেপালীদের “তিওহার” উৎসবের একটা বেশ মিল আছে। ভাই-বোনের যে মধুর সম্পর্ক—তাকে ভিত্তি করে ভারতের অন্যান্য জায়গায়ও অন্য রকম উৎসব চালু আছে। আপাততঃ আমাদের বাংলার ‘ভাই-ফোঁটা’ উৎসবের সম্পর্কে একটু আলোচনা করা যাক।
কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিকেই বলা হয় ভাতৃদ্বিতীয়া বা ভাই-দ্বিতীয়া। কেউ কেউ বলেন ‘যম-দ্বিতীয়া’। ফলশ্রুতি অনুসারে যমরাজের ভগ্নী যমুনা এই বিশেষ দিনে যমরাজকে ভাই-ফোঁটা দিয়েছিল। সেই থেকেই এই প্রথাটির প্রচলন। এর ছড়ার ভিতরও এর যেন একটু আভাস মেলে। এই দিন ভোর থেকেই প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে বোনেদের ভিতর সাজ সাজ রব পড়ে যায়। কেউ কেউ এই দিনে ভাইকে কী কী খাওয়াবে সেই নিয়ে আগে থেকেই জল্পনা-কল্পনা শুরু করে, তার ব্যবস্থার জন্য প্রস্তুতও হয়। কেউ কেউ যতক্ষণ না ভাইয়ের কপালে, ফোঁটা দেওয়া হয় ততক্ষণ জলস্পর্শও করেনা। কোথাও সকালে কোথাও বা প্রদোষে (সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে) ভাই-ফোঁটা দেবার প্রথা আছে। অনেকের ভিতর আবার ভাই-ফোঁটায় বারদোষ দেকেহো সে বছর ভাই ফোঁটা বন্ধ থাকে। তাদের শনি-মঙ্গলবার ভাই-ফোঁটা পড়োলে তারা ফোঁটা দেয়না, শুধু ভাইয়ের হাতে খাবারের থাকা তুলে দেয়। অনেকেই খাবারের সঙ্গে ভাইকে নতুন জামা কাপড় দিয়ে থাকে। যার যেমন সাধ্য, সে সেই ভাবেই ভাইকে ফোঁটা দেয়। তাদের বিশ্বাস এই দিন এই ছড়া বলে ভাইকে চন্দন তিলক পরিয়ে দিলে ভাইয়ের পরমায়ু বৃদ্ধি হয়।
সকালে বা সন্ধ্যায় যখনই হোক না কেন, ভাইকে বসান হয় পিঁড়ি অথবা কোনো আসনের উপর। তার সামনে জ্বালিয়ে দেয় প্রদীপ, আর সুমুখে থাকে একখানা বাটা, তাতে থাকে ধান, দূর্বা প্রভৃতি। এরই পাশে থাকে এক থালা (যার যেমন সাধ্য) মিষ্টি সামগ্রী।
ভাই প্রথমে বোনের দেওয়া নতুন কাপড় পরে বসে এসে পিঁড়ি বা আসনের উপর। বোন পানের বোঁটায় করে কাজল পরিয়ে দেয় ভাইয়ের চোখে, তারপর বাঁ হাতের কনিষ্ঠা অঙ্গুলীর সাহায্যে চন্দন নিয়ে ভাইয়ের কপালে পড়িয়ে দিতে দিতে মন্ত্র (?) বা ছড়া বলতে থাকে :—
প্রতিপদে দিয়ে ফোঁটা, দ্বিতীয়াতে নিতে,
আজ হতে ভাই আমার, যমের ঘরে
নিমের অধিক তিতে।
ঢাক বাজে, ঢোল বাজে, আরও বাজে কাড়া,
বোনের ফোঁটা না নিয়ে ভাই,
না যেও যম পাড়া।
না যেও যমের ঘর,
আজ হতে ভাই আমার রাজ রাজেশ্বর।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দেই আমার ভাইর কপালে ফোঁটা।
ভাইর কপালে দিলুম ফোঁটা,
যম দুয়ারে পড়লো কাঁটা।।
তিনবার চন্দন সহ এই শ্লোক (ছড়া) বলে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেয় বোন, আর প্রতিবার শ্লোক (ছড়া) বলা শেষ হলে ঐ কনিষ্ঠা অঙ্গুলী দ্বারা মাটিতে একটি করে কাটা X চিহ্ন এঁকে দেয়। তারপর বোন ছোট হলে ভাইকে কিংবা ভাই ছোট হলে বোনকে প্রণাম এবং মিষ্টির থালা তুলে দেয় ভাইয়ের হাতে, আর ভাই বড় হলে বোনকে, কিংবা বোন বড় হলে ভাইকে দূর্বা দিয়ে করে আশীর্বাদ।
১.১৪.১৫ পাঁচড়া পূজা
প্রথম খণ্ড : লৌকিক ধর্ম-উৎসব ও অনুষ্ঠান । চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : ব্রত অনুষ্ঠান – পাঁচড়া পূজা
পশ্চিমবঙ্গে যেমনি ঘেঁটু,যশোহর-খুলনা জেলায় যেমনি বনদুর্গার পূজা, তেমনি পূর্ববঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে বিশেষ করে ফরিদপুর জেলায় দেখা যায় ‘পাঁচড়া’ পূজার ধুম। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে দেশে যখন খুব ফোঁড়া-পাঁচড়ার ধুম লেগে যায় তখন দেয়া যায় গাঁয়ের মেয়ে বৌদের এ ব্রত করতে। এর আয়োজন বিশেষ কিছু নেই—পুরুত তো দূরের কথা! গাঁয়ের ভিতর সব চাইতে যে পুরান হিজল গাছটা থাকে সেখানেই এসে জড়ো হয় গাঁয়ের মেয়ে বৌরা। এখানে আসবার আগে তারা একটা ভাঙ্গা কুলায় করে নিয়ে এসেছে পাঁচড়া দেবীর পূজার উপকরণ, যথা—বইন্যা গাছের ফুল, কুমড়ার ফুল, ধুতুরার ফুল, ইঁদুদের মাটি, বাসী উনুনের ছাই। প্রভৃতি। এই সব উপকরণ সাজিয়ে নিয়ে হিজল গাছের তলায় বসে পাঁচড়া দেবতার উদ্দেশ্যে বলতে থাকে :—
হ্যাচড়া মাগীর প্যাঁচরা চুল,
তাইতে লাগে বইন্যার ফুল।
বইন্যার ফুল না তো ধুতুরার ফুল,
ধুতুরার ফুল না লো কুমড়ার ফুল,
কুমড়াড় ফূল না লো লাউয়ের ফুল,
লাউয়ের ফুল না লো বাসী আঁখার ছাই,
বাসী আঁখার ছাই না লো ইন্দুরের মাটি,
ইন্দুরের মাটি না লো ভাঙ্গা চাড়া
হিজল গাছে দিয়া সাড়া,
পাঁচড়া মাগীরে কর গেরাম ছাড়া।
এইভাবে কদিন ধরে পাঁচড়া পূজা করবার পর শেষ দিন তারা প্রত্যেকে নিম হলুদ দিয়ে স্নান করতঃ—যারা ব্রত অনুষ্ঠান শুনএ আসে না—বিশেষ করে পুরুষরা তাদেরও কপালে এই পূজার নিম হলুদ একটু ছুঁইয়ে দেয় যাতে তারাও পাঁচড়া চুলকানীর হাত থেকে রক্ষা পায়।