কী, বেরুচ্ছে যে, টাকার ব্যবস্থা করে যাও। একঝলক তাকায় দিব্যেন্দু। পার্স থেকে টাকা বার করে নীতার হাতে গুঁজে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। অন্যদিন অফিস যাওয়ার সময় নীতার মেজাজ ভালো থাকলে গেট অব্দি সঙ্গে যায়, দিব্যেন্দুও মাঝে মাঝে পিছন ফিরে হাত নাড়ে। আজ একবারও ফিরে তাকায়নি, নীতাও আসেনি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রোজই স্টেশন অব্দি হেঁটে যায়, আজ যেন পা চলছে না। একটা রিক্সা নেবে কি না ভাবছে
কীরে শালা, একেবারে দার্শনিক হয়ে গেলি যে। ডাইনে বাঁয়ে তাকানোর সময় পাসনে। চকিতে ঘাড় ফিরিয়ে পিছন তাকাতেই দিব্যেন্দু দেখে ইন্দ্রকে, বাইকে বসে এক পা মাটিতে। দুপা পিছিয়ে ইন্দ্র কাছে আসতেই—কীরে শালা, অফিস যাবি তো! ওঠ পেছনে, স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসি।
মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেয় দিব্যেন্দু, ভাবে ভালো সময়ে এসেছে ইন্দ্র। ওর বহুদিনের বন্ধু ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী।
বুঝলি ইন্দ্র, ভালোই হল মাইরি। আজ একটু দেরি হয়ে গেল বেরুতে, ভাবছিলাম—
রাখ তো তোর ভাবনা। শোন সকাল সকাল অফিস থেকে ফিরে নীতা আর পিঙ্কিকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে চলে আয়। রাতে খাওয়া-দাওয়া ওখানে।
তা-হঠাৎ–
আরে এসব হঠাৎই হয়। একটা মারুতি বুক করেছিলাম। আজ ডেলিভারি পাব। রমা বলল, রাতে একটু ঘরোয়া ছোটখাটো পার্টি দিতে হবে। ব্যস, সকাল থেকেই ঘুরছি। তোর বাড়ি যাব বলেই বেরিয়েছি।
তা ভালোই হল, রাস্তায় পেয়ে গেলি। কী বল?
হ্যাঁ, তা ঠিক। তবু তোর বউকে বলে আসব বাবা। নইলে একেবারে আমার আদ্যশ্রাদ্ধ করে ছাড়বে।
কথায় কথায় স্টেশন এসে যায়। দিব্যেন্দুকে নামিয়ে ইন্দ্র চলে যায়। প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায় দিব্যেন্দু, অন্যদিনের চেয়ে আজকে মানুষের ভিড় বড্ড বেশি মনে হয় ওর। ভাবে, তবে কি ট্রেনে গোলমাল! একটা সিগারেট ধরায়। পর পর কয়েকটা টান নিয়ে পোড়া সিগারেটের শেষটুকু টোকা মেরে ফেলে দেয় ট্রেন লাইনে। দিব্যেন্দু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে, সিগারেটটা পুড়তে পুড়তে একেবারে ফিল্টারের কাছে। হঠাৎ স্টেশনের লাউড স্পিকারে সুকণ্ঠী ললনার ঘোষণা
দত্তপুকুর স্টেশনে হকার পুলিশ সংঘর্ষে ট্রেন চলাচল সাময়িক বন্ধ আছে। যথা সময়ে পরবর্তী খবর জানিয়ে দেওয়া হবে।
ধস শালা, কপালটাই খারাপ। জানতাম কপালে আজ দুর্ভোগ আছে। মনে মনে বিরক্ত হয় দিব্যেন্দু। নাঃ আর রিস্ক নয়, চার্টার্ড বাসেই যেতে হবে। তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চৌমাথার দিকে হাঁটতে থাকে।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছতেই কন্ডাক্টরের চিৎকার ডালহৌসি, ডালহৌসি।
তাড়াতাড়ি উঠে একটা জায়গা নিয়ে বসে পড়ে দিব্যেন্দু। ট্রেন বন্ধ। সুতরাং ভিড় বাড়তে থাকে তরতরিয়ে। বাসের পেট ভর্তি। ড্রাইভার স্টর্ট নেয়। বাস চলতে থাকে। দিব্যেন্দুর পাশের সিটে বয়স্ক ভদ্রলোক জানলার পাশে বসে একমনে কাগজ পড়ছেন। দিব্যেন্দু একবার ভালো করে দেখে সিটে গা এলিয়ে দেয়। সকালের ঘটনা বারবার ওর চোখের সামনে ভাসছে। মনটা উদাস হয়ে যায় নিমেষে। ভাবে, নীতা ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। মেজাজ রুক্ষ, চালচলনে অন্যমনস্কতা। খোঁচা দিয়ে কথা বলা। নীতার এই হঠাৎ পরিবর্তন দিব্যেন্দুকে ভাবায়। অথচ বিয়ের পর কী ভালোই না লাগত নীতাকে। দিব্যেন্দুর অফিসের হেড ক্যাশিয়ার রবীনবাবুর রেফারেন্সে নৈহাটি নদীয়া জুট মিলের অ্যাকাউনটেন্ট যাদব চক্রবর্তীর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে করে। বাড়িতে সবাই পছন্দ করত নীতাকে। এই তো কবর আগে মায়ের সেরিব্রাল অ্যাটাকের সময় কী সেবাটাই না করেছে। পিঙ্কি তখন ছোট। ও একাই সব সামলেছে। অথচ সেই নীতা ইদানিং
ভাবতে কষ্ট হয়। তবু ভাবে দিব্যেন্দু, তবে কি ওর নিজের কোনো ত্রুটি। কিন্তু তাইবা কী করে। কোনো বাজে নেশাও নেই, নেই অবাঞ্ছিত কোনো মেলামেশা। অফিস বাড়ি আর মাঝে মধ্যে অফিস ক্লাবে শখের থিয়েটার। অভাব অনটন তো সব সংসারই থাকে— ওদেরও আছে। কিন্তু না খেয়ে না পরে তো নেই। তবে কেন নীতার এই পরিবর্তন।
দিব্যেন্দুর পাশের বাড়ি অংশুদের। ওরা স্বামী-স্ত্রী আর একটা ছেলে। দিব্যেন্দুর অনেক পরে চাকরি পেয়েও বেশ গুছিয়ে নিয়েছে ও। তারপর ইন্দ্র, সেও ব্যবসাপত্র করে হঠাৎ আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। যদিও লোকে বলে ওদের আয় নাকি সঠিক পথে নয়। কদিন আগে ইন্দ্র নীতাকে বলেছিল ওর ব্যবসার পার্টনার হতে, কিন্তু মত দেয়নি। এ নিয়ে নীতার সঙ্গে বেশ কদিন কথা বন্ধ ছিল। তবু মাথা নোয়ায়নি দিব্যেন্দু। তবে কি নীতাকে অর্থ-বিত্ত, সম্পদের সর্বনাশা নেশায় ধরেছে। বিকট শব্দে গাড়ি হঠাৎ থেমে যায়। বাসের ভিতরে সবাই একে অপরের গায়ে পড়ে। একযোগে ড্রাইভারকে গালমন্দ। এতক্ষণ চুপচাপ থাকা দিব্যেন্দুর পাশের বয়স্ক লোকটি চেঁচিয়ে বললেন কী হে পাইলট সাহেব। কাল রাতের খোঁয়াড়ি ভাঙেনি বুঝি।
পেছনের লোকটা সমর্থন করে চেঁচিয়ে বলে ঠিক বলেছেন মশাই। বড় বেয়াদপ এরা। যা খুশি তাই করে।
আরে চাপুন মশাই। আর একজন চেঁচিয়ে বলে—দেখছেন না, সামনে হঠাৎ অটোরিক্সা এসে গ্যাছে। না দেখে খালি পাঁয়তাড়া। কথা কাটাকাটির মাত্রা বাড়তেই বাসও চলতে শুরু করে। দিব্যেন্দু আবার শরীর এলিয়ে দেয় বসার সিটে। সকালের ব্যাপারটা বারবার লাটুর মতো ঘুরতে থাকে মাথায়। হঠাৎ সোজা হয়ে বসে নিজের মনেই বলেনা, না, আর কম্প্রোমাইজ নয়। প্রতিদিন এভাবে যুদ্ধ করা যায় না। মেয়েদের এত জেদ ভালো নয়। তাছাড়া পিঙ্কি বড় হচ্ছে, এভাবে দিনের পর দিন ওর সামনে সিনক্রিয়েট করে ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। এর চাইতে কোথাও চলে গেলে ভালো হয়। এ ভাবে ডিপ্রেসনে ভুগতে ভুগতে কোন দিন না পাগল হতে হয়, ভাবে দিব্যেন্দু।