- বইয়ের নামঃ চিতা
- লেখকের নামঃ চণ্ডী মণ্ডল
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
চিতা – চণ্ডী মণ্ডল
অসময়ে দার্জিলিং-এ এসে পড়েছে অবনী।
ফুল নেই। ফুলের মতো মরসুমী টুরিস্টের মেলা নেই। কাঞ্চনজঙ্ঘারই দেখা নেই–ধূসর জমাট মেঘের আড়ালে অদৃশ্য।
অবশ্য ম্যাল আছে। আর ঘোড়া।
ঠিক প্রমোদ ভ্রমণে আসে নি অবনী। সিজিনের শেষে আসার কারণ আর্থিক। এই কারণেই সম্ভবত, নেই নেই করেও দু চারশ পর্যটক এখনো আছে। ষাট টাকার ডবল বেড রুমে তিরিশ টাকায় কে না দুদিন বেশী থাকতে চায়! এরই মধ্যে যেদিন আবহাওয়া একটু ভালো থাকে, সকাল হওয়ায় আগেই সেদিন সকলে হৈ হৈ করে হোটেল থেকে বেরিয়ে পড়ে।
সকাল থেকে দুপুর—বিকেলের আগে পর্যন্ত কে কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে থাকে। বিকেল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সকলেই ম্যালে এসে হাজির হয়। যেন দার্জিলিং এ থাকার হাজিরা খাতাটা থাকে ম্যালে।
দুপুরেই বা তার আগেই ম্যালে চলে আসে দু-একজন। দুপুরের স্নান খাওয়া সকাল সকাল সেরে হোটেল থেকে সোজা চলে আসে। একটা বেঞ্চ দখল করে বসে সারাদিনের জন্যে।
যেমন শিপ্রা।
দার্জিলিং-এ বেড়াবার জায়গায় গাড়িতে চড়ে বা হেঁটে যেভাবেই যেখানেই যাওয়া যাক, চড়াই-এর ধকল সহ্য করতেই হবে একটু-আধটু। সেটুকুই সহ্য করবার সামর্থ নেই। শিপ্রার। অনেক দিন ধরে শিপ্রা খুব অসুস্থ।
অসুখটা কি বড় বড় ডাক্তাররা কেউ ধরতে পারছে না। কেউ কিডনির চিকিৎসা করেছে। কেউ হার্টের। কেউ ফিমেল ডিজিজের। কেউ মানসিক চিকিৎসার কথা ভেবেছে। সব অসুখই কিছু কিছু থাকতে পারে পারে, কিন্তু শিপ্রার আসল অসুখটা কি সঠিক ডায়গনোসিস করা যাচ্ছে না। সবাই বলে সেরে যাবে—সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। দু বছরে ঠিক কিছুই হয়নি। শিপ্রা আরো রোগা আরো বেশী রক্তশূন্য হয়ে গেছে। ঘুমোতে পারে না। মন খুলে কথা বলতে পারে না। প্রাণ খুলে হাসতে পারে না। সব সময় চোখে মুখে আতঙ্ক আর অস্থির ভাব।—একটা চেঞ্জ দরকার, সব ডাক্তার এক মত হয়ে বলেছে—জল হাওয়ার চেঞ্জ চাই।
শিপ্রাকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছিল অবনী গত বছর। পনের দিনের মতো ছিল সেখানে। কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি—শিপ্রার মধ্যে চেঞ্জের কোন লক্ষণই দেখা যায়নি! সমুদ্রের উত্তাল উচ্ছ্বাস, আবেগের এক কণা পায়নি শিপ্রার শরীর, মন। মাঝখান থেকে অবনীর পনের দিন ছুটি আর পাঁচশর বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। টাকাটা কিছু নয়, শিপ্রার সেরে ওঠাটাই জরুরী। ছমাস পরেই তাই আবার শিপ্রাকে নিয়ে এসেছে চেঞ্জে। মনোরম এই শৈলশহরে।
কিন্তু সাতদিন ধরে শুধু ম্যালেই বসে আছে শিপ্রা।
সন্ধের পর ধীরে ধীরে হেঁটে হোটেলে ফিরে যায়। রাতটুকুর জন্যে। সকাল সাতটা সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙ্গে, তখন থেকেই ম্যাল-এ আসবার জন্যে তৈরী হতে থাকে—দুপুরের আগেই চলে আসে।
ভোরে সবাই প্রচণ্ড শীতের মধ্যে কাঁপতে কাঁপতে টাইগার হিলে ভীড় করে দাঁড়িয়ে। এক অলৌকিক সূর্যোদয় হবে—সারা পুবের আকাশ, সারা আকাশ সারা পৃথিবী আশ্চর্য আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে। প্রত্যাশায় উত্তেজনায় আনন্দে আবেগে রোমাঞ্চে মানুষগুলোর মুখের আদলই বদলে যায়—সাধারণ একজন মানুষ অসাধারণ মহিমাময়। হয়ে যায়। সেই সময়টায় রোজই অবনী স্ত্রীর রোগ শয্যার পাশে আলাদা খাটে শুয়ে থাকে। হয়তো জেগেই থাকে। ঘুমিয়ে থাকলে স্বপ্ন দেখে হয়তো। হয়তো কোন দুঃস্বপ্ন।
অবনীর দেখা হয় না দার্জিলিং-এর কিছুই। বিখ্যাত সিনচর লেক, ঘুম মন্যাট্টি, বাতাসিয়া লুপ, ভিকটোরিয়া ফলস-বোটানিক্যাল গার্ডেনও কিছুই না। শিপ্রা অবশ্য বলে, তুমি কেন আমার জন্যে সারাদিন এক জায়গায় বসে থাকবে, তোমার কি ভালো লাগে—যাও না কোথাও বেড়িয়ে এসো।
অবনী হ্যাঁ না কিছু বলে না। অবনী জানে শিপ্রা মনে মনে চায় না অবনী দূরে দূরে একা একা ঘুরে বেড়াক। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে, তার আগে থেকেই শিপ্রার এই অদ্ভুত দুর্বলতা। কিছুতেই অবনীকে চোখের আড়ালে যেতে দেবে না।
ম্যালের চারদিকটা অবশ্য দেখে নিয়েছে অবনী। শিপ্রা বেঞ্চে বসে থাকে। অবনী মাঝে মাঝে উঠে পায়চারি করে। বেশী দূরে যায় না। দু একবার তবু চলে গেছে শিপ্রার চোখের আড়ালে।
ম্যালের উত্তর দিকে যে বাগানটা, বাগান নয়, বন-গহন জঙ্গল। জঙ্গলটা ঘিরে একটা রাস্তা আছে। ম্যাল থেকেই রাস্তাটা বেরিয়ে জঙ্গলটাকে পাক দিয়ে আবার ম্যালে ফিরে এসেছে। রাস্তাটা নির্জন খুব। ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারের জন্যেই যেন রাস্তাটা। ম্যাল থেকে বেরিয়ে সেই রাস্তা ধরে মিনিট পনের হেঁটে গেলে দেখা যায় দূরে হ্যাপিভ্যালি। কুয়াশা না থাকলে দেখা যায় হ্যাপিভ্যালির সবুজ গভীর বিস্তার। অনেক দুরে ধূ ধূ করছে ভূটান সীমান্ত। সবুজ পাহাড়-এর ঢেউ। পিছনে কয়েকটা ধূসর গিরিশৃঙ্গ। তারপরেই সেই অলৌকিক হিমগিরি, আলোক সুন্দর কাঞ্চনজঙ্ঘা।
অবনী কুয়াশার দিকে চেয়ে কল্পনায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছে! দু একদিন পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছে। একটা বাঁক পেরিয়ে পুবের দিকে ফিরতেই আবার একটা ভ্যালি। তারপর আর একটা। একটা বিশাল উপত্যকা। ঘন সবুজের ওপর সুতোর মতো রাস্তা আঁকাবাঁকা, অসংখ্য। ওইখানে দার্জিলিং-এর ভুটানী বস্তি। খাদ নেমে গেছে আরো নীচে। উপত্যকার ওপারে অনেক দূরে সবুজ পাহাড়। পাহাড়ের ওপর আকাশ। খাদের গভীর থেকে মেঘ উঠে পাহাড়ের গা বেয়ে আকাশে জমে—সেই মেঘ তারপর একসময় সবেগে নেমে আসে। দেখতে দেখতে ভুটানী বস্তি ঢেকে ফেলে, তারপর ধেয়ে আসতে থাকে ম্যালের দিকে।