অঙ্কুর – ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়

রাত তখন কত তা বলতে পারব না। কেননা আমি ঘড়ির দিকে তাকাই নি। হঠাৎ কলিংবেলটা বেজে উঠতেই ঘুম ভেঙে গেল। জিরো পাওয়ারের আলোটা জ্বলছিল তাই সুখশয্যা ছেড়ে টিউব লাইটের সুইচটা অন করলাম। আলো জ্বলে উঠতেই কলিংবেল থেমে গেল।

দরজা খোলার আগে সাড়া দিলাম—কে?

বাইরে টক টক শব্দ।

আবার বললাম—কে?

—একবার দরজাটা খুলুন না?

নারীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। এই প্রচণ্ড শীতের রাতে কেরে বাবা! বললামকাকে চাই?

—আমি ডাক্তার সেনকে চাইছি। বিশেষ দরকার।

নিশ্চয়ই কোন ডেলিভারি কেস। গাইনি হওয়ার বড় জ্বালা। অথচ উপায় নেই। প্রসূতি এবং নবজাতকেরা জীবন মরণ সমস্যা হলে যেতেই হবে। এই মফঃস্বল শহরে। আমি আসবার পর থেকে ঠাকুরের কৃপায় একবারও ব্যর্থ হইনি। আমার হাতে যেসব শিশু জন্মগ্রহণ করেছে তারা সবাই সুস্থ। কাজেই এই অঞ্চলে ডাক্তার হিসেবে আমার যথেষ্ট সুনাম হয়েছে।

আমি চোর ডাকাত বা দুষ্ট লোকের ভয় করি না। তার কারণ এখানকার মানুষজন খুব ভালো। এরা আর যাই করুন না কেন আমার কোন ক্ষতি করবে না। করলে এরাই বিপদে পড়বে। আমি গভীর রাতে এলাকা থেকে বহুদূরে ভাঙা বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা যন্ত্রণাকার ভিখারিনীকেও বিনা পারিশ্রমিকে সন্তান প্রসব করিয়ে এসেছি। আবার অনেক প্রাসাদোপম অট্টালিকার ভেতরেও বৃষ্টি বাদল মাথায় নিয়ে হাজির হয়েছি মধ্যরাতে।

আবার টক টক শব্দ—দরজাটা খুলুন। আমি নির্ভয়ে দরজা খুললাম।

দরজার সামনে বোরখা ঢাকা এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। এই প্রচণ্ড শীতে শির শির করে কাঁপছেন তিনি।

–বলুন।

-আপনিই কি ডাঃ সেন? আমি একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

—ভেতরে আসুন।

মহিলা ভেতরে এলে দরজা বন্ধ করলাম। যদিও এটা আমার নীতিবিরুদ্ধ ও করলাম রাত গভীর এবং শীতের দাপট বেশি বলে। সারা গায়ে শালটা মুড়ি দিয়ে আরামকেদারায় বসে মহিলাকে বসতে বললাম।

মহিলা বসতে বসতে বললেন—এমন অসময়ে আপনাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে সত্যিই খুব অন্যায় করেছি। অথচ বিশ্বাস করুন এ ছাড়া কোন উপায় ছিল না।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কি। কে এই রহস্যময়ী? এত রাতে আমাকেই বা তার কিসের প্রয়োজন? তবে এই মুহূর্তে আমাকে যে শীতের কামড় খেয়ে বাইরে বেরতে হবে না তা বেশ বুঝতে পারলাম।

শুধু বুঝতে পারলাম না এই বোরখার আড়ালে যিনি লুকিয়ে আছেন তিনি কি রকম। কুমারী না সধবা? যুবতী না বিগতযৌবনা? তবে তার শ্বেত-শুভ্র দুটি হাত ও পায়ের পাতা দেখে বুঝলাম যে বোরখার আড়ালে এক বিদ্যুত্বর্ণা লুকিয়ে আছেন।

তিনি কিছু বলছেন না দেখে আমিই বললামবলুন, এত রাতে আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?

মহিলা কি যেন বলতে চাইলেন অথচ বলতে পারলেন না। তাঁর গলাটা একবার একটু কেঁপে উঠল শুধু।

আমি বললাম-এই প্রচণ্ড শীতে এত রাতে এসেছেন, আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই? একটু কফি খাবেন?

সুরেলা গলার মহিলা বললেন—পেলে ভালো হয়। আমি উঠে গিয়ে হিটারে জল গরম করতে দিলাম।

—আপনি একা থাকেন বুঝি।

-হ্যাঁ। তবে আমার একজন লোক আছে। বেচারি বুড়ো মানুষ। পাশের বাড়িতে থাকে। একটু কফির জন্য তাকে আর ডাকলাম না।

–এ ব্যাপারে আমি কি আপনাকে একটু সাহায্য করতে পারি? অবশ্য যদি আপনার সংস্কারে না বাধে।

–না না, ও কিছু নয়। আমার কোন সংস্কার নেই। তবে আপনি আমার অতিথি। আর এই কাজে আমি অভ্যস্থ। তাই–।

—আপনার বউ নেই?

—আমি এখনো বিয়ে করিনি।

কথা বলতে বলতেই কফি তৈরি করলাম। এক কাপ নিজে নিয়ে এক কাপ এগিয়ে দিলাম তার দিকে। রহস্যময়ী নারী কফির পেয়ালাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর আমার দিক থেকে একটু সরে গিয়ে আমার দিকে পিছন হয়ে ঘরের চারিদিক দেখতে দেখতে কফি খেলেন।

এই সময় আমার খুব ভয় হল। কে ইনি? এমন স্পর্ধা কি করে হল? রাত দুপুরে ঘরে ঢুকে ঘরের চারিদিক এইভাবে দেখার মানে কি?

আমি একটু গম্ভীর হয়ে বললাম— শুনুন, আপনি কি বলতে চান তা চটপট বলে ফেলুন। এখন অনেক রাত। আমার চোখে ঘুম আছে তার ওপর এই শীতে আমি আপনাকে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না।

মহিলা মৃদু হেসে আমার সামনে টি-পটে কফির শূন্য পেয়ালাটা নামিয়ে রেখে বললেন—খুব ভয় পেয়ে গেছেন, না? ভাবছেন নিশ্চয়ই কোন জিন কবরখানা থেকে উঠে এসেছে। অথবা বোরখার আড়ালে লুকিয়ে আছে কোন ফুলন দেবী।

আমার মনের ভাব ঠিক বুঝতে পেরেছেন তো? আশ্চর্য। অসাধারণ বুদ্ধিমতী মহিলা। বললামনা, মানে সারাদিন রোগিনীদের সংস্পর্শে থাকার ফলে আমি খুব ক্লান্ত। আবার সকাল থেকেই শুরু হরে পরিশ্রম। তাছাড়া এক্ষুণি এই মুহূর্তেই হয়তো কোন মরণাপন্ন প্রসূতির জীবন রক্ষার জন্য ছুটতে হবে, কিংবা কোন নবজাতককে দেখাতে হবে পৃথিবীর আলো। কাজেই আমারও তো বিশ্রামের প্রয়োজন।

রহস্যময়ী এবার আমার মুখোমুখি বসলেন। তারপর বললেন—আমি অত্যন্ত বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। আপনি যদি আমার একটু উপকার করেন তাহলে চিরকৃতজ্ঞ থাকব। নাহলে হয়তো আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।

—সেকি।

—হ্যাঁ। সে ভারি লজ্জার কথা।

আমি বললাম—শুনুন। রাত দুপুরে আমি কোন অচেনা মহিলার লজ্জার কথা শুনতে রাজি নই। সবে ডাক্তারি পাশ করে মফঃস্বল শহরের এই হাসপাতালে চাকরিটা জুটিয়েছি। এটাকে আমি খোয়াতে চাই না। আপনি কে, কেন এবং কোথা থেকে এসেছেন কিছুই বুঝতে পারছি না। এই অবস্থায় কোন জরুরি কল নিয়ে হঠাৎ কেউ এসে পড়লে আমার ঘরে আপনাকে দেখবে। তাতে আমার বদনাম হবে।

—আয়্যাম স্যরি ডক্টর। আমার বক্তব্য আমি এখুনি পেশ করছি।

–তার আগে আপনার মুখের, ঢাকাটা সরাতে হবে। আপনার মুখ না দেখলে আমি কথা বলব না।

বাঃ! বেশ বললেন তো? রাতদুপুরে আপনি পরস্ত্রীর মুখ দেখবেন? ছিঃ ছিঃ। আপনার মতো লোকের এ মানায় না।

—আপনি তাহলে যেতে পারেন।

বলার সঙ্গে সঙ্গেই নেকাবটা সরে গেল। আর এক পরমাসুন্দরীর মুখ প্রকাশিত হল সেই কালো নেকাবের আড়ালে। ঈশ্বর তার তুলির টানে এমন একটি মুখ এঁকেছেন যে সে মুখের তুলনা নেই। শুধু নেকাব নয়, বোরখার আড়াল থেকেও সেই মুর্তে রাজহংসীর মতো যে শরীরটা বেরিয়ে এলো তা দেখে অস্থির না হয়ে থাকতে পারে না কেউ। আমি চোখের পাতা ফেলতেও ভুলে গেলাম। বেশ কিছুদিন আগে এই এলাকায় একবার এই বিদ্যুত্বর্ণাকে দূর থেকে দেখেছিলাম। তখন বোরখা ছিল না। দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মনে আছে চোখে চোখ পড়তেই চোখের ভাষায় মৃদু ধমক দিয়ে বিদ্যুতের মতো সরে গিয়েছিলেন উনি। আর আজ এই গভীর রাতে যৌবনের পশরায় রূপের প্রদীপ জ্বেলে সেই তিনি যে এমনভাবে আমার ঘরে এসে হাজির হবেন তা কি ভাবতে পেরেছিলাম?

এবার আমারই গলা কাঁপার পালা—আ-আ-আপনি।

-হ্যাঁ আমি। মিসেস হেনা আলম।

—আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

—কি করে বুঝবেন? আমার এই রূপ যে বিধ্বংসী অগ্নিশিখা। তাই তো একে বোরখা দিয়ে ঢেকেছিলাম। দেখতে চাইলেন বলেই দেখালাম। যাক, যে কথা বলতে এসছিলাম। আপনাকে আমার একটা উপকার করতে হবে।

—আই মাস্ট ডু ফর ইউ।

—আমি সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। আমার এটাকে অ্যাবরশান করাতে হবে।

আমি শিউরে উঠলাম—মিসেস আলম। একি বলছেন আপনি?

—যা বলছি ঠিকই বলছি ডাক্তার।

—আমি জানি আপনি অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের বউ। আপনার স্বামী বর্তমান। এ ক্ষেত্রে এই ব্যাপারে তাঁরই আসা উচিত ছিল। তার বদলে এই গভীর রাতে আপনি।

—আসতে বাধ্য হয়েছি। কেননা অ্যাবরশানের ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয়। আমার স্বামীর অজান্তেই এটা আমি করাতে চাই।

-কিন্তু ….।

—এর মধ্যে কোন কিন্তু নেই ডাক্তার।

—আপনি অন্যত্র যেতে পারেন। কারণ আমি এসব কাজ করি না। যদিও আমি গাইনি তবুও শিক্ষার ঐ দিকটা আমি বেছে নিইনি। তার কারণ আমার ধর্ম মানুষকে পৃথিবীর আলো দেখানোর সুযোগ করে দেওয়া। তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া নয়। বিশেষ করে প্রথম অবস্থায় হলেও একটু ভেবে দেখতাম। কিন্তু এখন বাচ্চাটার পুরো বডি ফর্ম করে গেছে। এই অবস্থায় ও কাজ আমার পক্ষে অসম্ভব।

হেনা আলম দু’হাতে আমার হাত দুটি জড়িয়ে ধরলেন। ওঁর পরশে আমি দুর্বল হয়ে পড়লাম। সেটা বুঝতে পেরে আমার দুটি হাত ওঁর বুকের মধ্যে টেনে নিলেন উনি। সে কি দারুণ উন্মাদনা। আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম কিন্তু কেন আপনি এ কাজ করতে চলেছেন?

—এই সন্তান আমার বাঞ্ছিত নয়।

—তাহলে আগে আসেননি কেন?

—তখন বুঝতে পারিনি সে আমাকে এইভাবে ঠকাবে বলে।

–কে সে?

—আপনি আচ্ছা লোক তো? কোন নারী কি পারে তার গোপন প্রেমিকের কথা পর পুরুষকে বলতে?

এই শীতেও আমার তখন ঘাম দেখা দিল।

হেনা আলম আমার আরো কাছে এগিয়ে এলেন। উঃ সে কি মদির উষ্ণতা। আমাকে যেন পাগল করে দিল। হেনা আলমের সুললিত করুণ কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পেলাম—ডাক্তার!

-বলুন।

—আমার উপকার করবেন না?

–না। এ কাজ আমি করি না।

–আপনাকে আমি অনেক টাকা দেবো। আমার গায়ের সমস্ত গয়না দেবো। বিনিময়ে আপনি আমার এই উপকারটুকু করুন।

–মিসেস আলম, আপনি একটু কষ্ট করে অন্য কোথাও চলে যান। —উপায় থাকলে যেতাম।

—উপায় নেই বলেই এত রাতে লুকিয়ে এইভাবে এসেছি। সুইসাইড করলে এক্ষুনি আমার সমস্ত প্রবলেম সলভ হয়ে যায়; কিন্তু আমি বাঁচতে চাই ডাক্তার!

—আমি আপনাকে বাঁচাতে পারলাম না।

হেনা আলম উঠে দাঁড়ালেন। তারপর করুণ চোখে একবার আমার দিকে। তাকিয়ে আবার নিজেকে বোরখায় ঢেকে নিঃশব্দে চলে গেলেন।

উনি চলে যাবার অনেক পরেও আমি দরজায় খিল দিতে ভুলে গেলাম।

.

পরদিন সোনাঝরা সুন্দর সকালে গত রাত্রের ঘটনাটা ঘুমের ঘোরে একটা দুঃস্বপ্নের মতোই মনে হল আমার কাছে। আমাদের হসপিটালে এক প্রসূতি কদিন ধরেই কষ্ট পাচ্ছে। আজ একবার শেষ চেষ্টা করে দেখব স্যালাইন দিয়ে পেন আনাবার। না হলে বাধ্য হয়েই সিজার করতে হবে।

আমার কাজের লোকটি এলে তাকে রান্নার ব্যবস্থা করতে বললাম। তারপর টুক করে সামান্য কিছু বাজারও করে আনলাম। আমার এই ঘোরাফেরার মধ্যে বারবারই কিন্তু হেনা আলমের কথাটা মনে হতে লাগল। তাঁর প্রস্তাব আমার পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব হ’ল না। তাই বলে সত্যিই কি তিনি আত্মহত্যা করবেন? যদি করেন, তাহলে কিন্তু দুটি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী হবো আমি। অ্যাবরশনে সমস্যাটা মিটেই যায়। অথচ আমি কি করে এই কাজটা করি? একটি শিশু, প্রকৃতির নিয়মে সে আপন বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যখন পূর্ণ রূপ পেয়ে গেছে তার হাত পা চোখ মুখ সব কিছুই যখন যথাযথ নিয়মে তৈরি হয়েছে তখন তাকে তার আত্মপ্রকাশের আগেই মাতৃগর্ভ থেকে জোর করে টেনে এনে গলা টিপে মেরে ফেলাটা…। না না না এ কাজ করলে আমি পাগল হয়ে যাবো। অর্থের লালসায় এ কাজ যারা করে করুক। আমি করতে পারব না। আমার সারা শরীর যেন সেই দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে উঠল। অসহায় শিশুর অন্তিম আর্তনাদ যেন টা ট্যা করে আমার কানের কাছে বাজতে লাগল। এ কাজ আমাকে মেরে ফেললেও হবে না। আমি অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করলাম।

ঘরে ফিরে স্নান খোওয়া সেরে চলে গেলাম হসপিটালে। নতুন একজন পেশেন্ট ভর্তি হয়েছে এই মাত্র। বাড়িতে ডেলিভারি হতে গিয়ে বিপর্যয় ঘটিয়ে বসেছে। নার্স আয়া সবাইকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম লেবার রুমে। ভুলে গেলাম হেনা আলমের কথা! অনেক পরিশ্রমের পর যথাযথ নিয়মে ভগবানের ইচ্ছায় ডেলিভারিটা করাতে পারলাম। প্রসূতির অবস্থা ভালো নয়। তবে বাচ্চাটা ভালো আছে। লাল রক্তের ড্যালা। যেন একটা। কি সুন্দর কচি মুখ। হাত পা নেড়ে চিউ চিউ করছে দুষ্টুটা। এই রকম একটি শিশুকে কখনো মাতৃগর্ভ থেকে বার করে এনে গলা টিপে মারা যায়?

আবার মনে পড়ল হেনা আলমের কথা। সারাদিনে বার বার চেষ্টা করেও হেনা আলমকে ভুলতে পারলাম না। হেনা আলমের প্রেমিক কে তা জানি না। তবে এটুকু জানি এই শহরের উপকেণ্ঠ পাহাড়ের গায়ে যে মার্বেল প্যালেসটা, সেটা হেনা আলমের! এখানকার দুদুটো সিনেমা হলের মালিক হেনা আলম। এ ছাড়াও একটি বস্তি, ধান কল ও অয়েল মিলের মালিক হেনা আলমরা। হেনা আলম মমতাজ সুন্দরী। মুঘল হারেমের রূপসীদের কথা যেন মনে করিয়ে দেয় হেনা আলম। কিন্তু কেন তার এই পদস্খলন? হেনা আলমের স্বামীকে আমি দেখিনি। হেনা আলমের মতো সুন্দরীকে যিনি রাজার ঐশ্বর্য দিতে পেরেছেন তিনি যেমন তেমন লোক নন। অথচ সেই মানুষকে ফাঁকি দিয়ে ঐ প্রাসাদের অভ্যন্তরে কি করে পর পুরুষের সন্তান গর্ভে ধারণ করেন উনি তা আমার বোধগম্য হল না।

সে রাতেও অনেকক্ষণ ধরে হেনা আলমের মুখ মনে করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। রাত তখন বারোটা। শীতের রাত। প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহে সারা শহর, পাহাড় পাহাড়তলি কনকন করছে! গাছ থেকে পশুপক্ষি মরে পড়ে যাচ্ছে। জঙ্গল থেকে বড় বড় গাষ্ট্রে শুকনো গুঁড়ি এনে গাছতলায় ধুনি জ্বালানো হয়েছে! যাতে অধিক সংখ্যক পশুপক্ষী মরে না যায়।

ডোরবেলটা বেজে উঠল।

আঃ। সেরেছে। এই রাতে আবার কোথায় যেতে হয় কে জানে?

উঠে গিয়ে আলো জ্বেলেই সাড়া দিলাম—কে?

—আমি।

পরিচিত কণ্ঠস্বর। বুকটা যেন কেঁপে উঠল। লু জিজ্ঞেস করলাম কে আপনি?

–এরই মধ্যে ভুলে গেলেন।

হেনা আলম। হেনা আলম ছাড়া আর কেউ নয়। অপ্রত্যাশিত কিন্তু প্রত্যাশিত। সেই একই আবদার করবেন হয়তো। করুন। বু তো কিছুক্ষণের জন্যও দেখতে পাবো সেই চৌধবি কা চাঁদকে। দরজাটা খুলে দিলাম।

আজ আর কালো বোরখা নয়। কাশ্মিরী সিল্কের ওপর নানা রকম কাজ করা বোরখা। সেই সঙ্গে এক মধুর সৌরভে গোটা ঘর ভরে গেল। এ সৌরভ কাল ছিল না।

দরজাটা খোলা ছিল। হেনাই বন্ধ করলেন। আজ আর বলতে হ’ল না। মুখের ঢাকা নিজেই প্রালেন। তারপর একটা কৌচের ওপর বসে যেন ওনার নিজেরই বাড়ি এমনভাবে বললেন—কি হ’ল বসুন।

আমি গত রাতের মতোই সারা গায়ে শাল জড়িয়ে নার মুখোমুখি বসলাম। হেনা বললেন আমি চলে যাবার পর কাল রাতে নিশ্চয়ই আপনি ভালো করে ঘুমোতে পারেন নি?

–না পারিনি।

—আসলে আমার এই দেহতে এত রূপ কিভাবে যে তৈরি হয়েছিল তা নিজেই আমি ভাবতে পারি না। আয়নায় যখন নিজেকে দেখি তখন মনে মনে হিন্দুদের মতো পঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে নিজেকে আরতি করি। তাই মরতে আমার ইচ্ছে করে না ডাক্তার। এর পরে আবার যদি কখনো রদেহ নিয়ে পৃথিবীতে আসি তখনো কি এই রূপ আমি পাবো?

আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে চোখের পাতা না ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হেনা আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন–কি ঠিক করলেন ঐ ব্যাপারে?

আমি যেন কিছুই জানি না এমনভাবে বললাম–কোন ব্যাপারে?

—সেকি! কাল যে ব্যাপারে কথা বললাম। মানে যে ভাবেই হোক ওটা করাতেই হবে।

আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল। এই হেনা আলমের গর্ভে যে শিশু আছে সেটা ছেলে কি মেয়ে জানি না। মেয়ে হলে সে হয়তো হেনা আলমের চেয়েও সুন্দরী। হবে। ছেলে হলে হবে নবাবজাদা। তার আবির্ভাবকে আমি কোন অধিকারে বাধা দেবো? তোক সে অবাঞ্ছিত। বু সে শূন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ। তাকে আসতে দিতেই হবে। আমি বললাম–এ কাজ যে কখনো করিনি মিসেস আলম।

–জানি। কিন্তু আমার জন্য এটুকু আপনাকে করতেই হবে। যে ভুল আমি একবার করেছি জীবনে সে ভুল দ্বিতীয়বার করব না। আপনাকে আমি কথা দিলাম ডাক্তার।

–মিসেস আলম। আজ যাকে আপনি অবাঞ্ছিত মনে করছেন একদিন তো তাকেই চেয়েছিলেন একান্তভাবে? ওর পিতা আপনার ঘৃণ্য হতে পারেন কিন্তু ঐ শিশুটা আপনার কাছে কোন অপরাধটা করল শুনি? ও তো ওর পরম নির্ভরযোগ্য স্থান ভেবেই আপনার জঠরে নিশ্চিন্তে নিজের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

হেনা আলম দুহাতে আমার দুটি হাত আবার জড়িয়ে ধরলেন। আবার সেই উষ্ণ প্রশ। এবার নিজেই আমার কোলের ওপর নুয়ে পড়ে বললেন–সেন্টিমেন্টাল হবেন না ডাক্তার, প্লিজ। আপনি যা বলছেন আমি ব বুঝতে পারছি। কিন্তু লুও আমি এ কাজ করতে চাইছি কেন জানেন? এর পিতা অর্থাৎ যাকে ভালোবেসে আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সে আর কখনো আমার কাছে ফিরে আসবে না। আমার স্বামী মেহবুব আলম এই অঞ্চলে সব চেয়ে ধনী এবং মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। বছর দুই আগে একটি সাংঘাতিক বিস্ফোরণে তার দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায় একটা পাও বাদ দিতে হয় কেটে। ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি এক পায়ে চলেন। তার বীভৎস মুখের দিকে তাকালে ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। এর ফলে স্বামীর সঙ্গে সহবাসে আমার রুচি হয় না। উনি বিচক্ষণ লোক। নিজেও সেটা বোঝেন। তাই আমাকে বিরক্ত করেন না। এই সময় আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়র একটি ছেলেকে ভালো লাগে আমার। সে আমাকে কথা দেয় আমায় নিয়ে সে দূরে বহুদূরে চলে যাবে। যেখানে মেহবুব সাহেবও আমাদের নাগাল পাবেন না। আমি তাকে বিশ্বাস করি। এবং তার সঙ্গে গোপনে মিলিত হই। অবশ্যই সেটা সন্তান উৎপাদনের জন্য নয়। দেহসুখের লালসায়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য যে সে আমাকে ছেড়ে গেছে। এখন এই সন্তানের আমি কি পরিচয় দেবো? কোথায় রাখব একে? একা যে কোথাও চলে যাবে এখান থেকে, যাবই বা কোথায়? এই রূপই যে আমার শত্রু হবে। তাছাড়া মেহবুব সাহেবের ঐ বিশাল ঐশ্বর্যও তো ভোগ করতে পারব না আর।

আমি আমার কোলের ওপর থেকে হেনা আলমের মাথাটা তুলে নিলাম। বললাম–ভারী মুশকিলে ফেললেন দেখছি।

—একটা উপায় বার করুন ডাক্তার।

—কোন রকমে আপনি কি একবার আমার সঙ্গে এই শহরের বাইরে যেতে পারবেন?

—ক্ষেপেছে? যেখানে রাতের অন্ধকারে গোপনে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছি সেখানে কি করে আমি শহরের বাইরে যাবো? আমাকে এখানকার

বাই চেনে। আমি যখন ঘর থেকে বেরোই তখন বেয়ারা দরোয়ানরা আমাকে ঘিরে থাকে। এ কাজ এখানে করতে হবে ডাক্তার। তার জন্য আপনি যা চান যত টাকা চান দেবো। আমার শরীর খারাপের অছিলায় আমার লোক দিয়ে আপনাকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে আমার বাড়িতেই এই কাজ করাব আমি।

—সেকি।

–এছাড়া উপায় নেই।

এতক্ষণ নেকাবের ঢাকা সরিয়ে রাখলেও সেই সুদৃশ্য বোরখার আড়ালে ছিলেন হেনা আলম। এবার বোরখা মুক্ত হয়ে গলার বহুমূল্য নেকলেসটি খুলে আমাকে দিলেন। বললেন—এর সবগুলিই হীরে। এটা অগ্রিম হিসেবে দিলাম। আর টাকা। কত টাকা চাই আপনার? যা চাইবেন তাই পাবেন।

আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না।

হেনা আলম আমার খুব কাছে এগিয়ে এলেন। এসে ঠিক গত রাতের মতোই আমার হাত দুটি ওঁর বুকের ওপর নিয়ে বললেন—একবার শুধু আমাকে দেখুন। তাকান আমার মুখের দিকে। আপনি দয়া না করলে আমাকে অকালেই ঝরে যেতে হবে। হেনা আলমের পরশে কি যাদু আছে? হয়তো। আমি যেন মোমবারি মতো গলে যেতে লাগলাম। এই অনিন্দ্যসুন্দরীকে আমার বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে এই মুহূর্তে ওর মুখ চুম্বন করতে ইচ্ছে হল। কি যে হয়ে গেল আমার তা জানি না। হঠাৎ ওর হাত দুটি আমি নিজের মুঠোয় ধরে নিয়ে বললাম আমি রাজি।

সেই মুহূর্তে হেনা আলমের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল উনি যেন স্বর্গ জয় করে ফেলেছেন। আমরা হাত দুটিতে আলতো করে প্রেমিকার মতো চুমু খেয়ে আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে বললেন—আমি জানি ডাক্তার, রাজি আপনি হবেনই। সত্যি, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ দেবো। তাহলে শুনুন! এই নেকলেসটির দাম কম করেও এক লাখ টাকা। এবার নগদ আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন।

আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম টাকা আমি চাই না মিসেস আলম। আর ঐ নেকলেসেও আমার প্রয়োজন নেই। ওটা আপনি নিয়ে যেতে পারেন।

–সেকি! হেনা আলম লঘু পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তারপর ঠিক সেই আগের মতোই আমরা হাত দুটি ধরে বললেন—এত টাকার প্রলোভন আপনি কি জন্য ছেড়ে দেবেন?

—শুধু মাত্র আপনার জন্য।

—তার মানে?

—আমি আপনাকে চাই। আপনার রূপে আমি এমনই মুগ্ধ যে আপনার যৌবনের উত্তাপ আমাকে পেতেই হবে। এই মুহূর্তে আপনার চেয়ে লোনীয় আমার কাছে আর কিছুই নেই। যদি আপনি কোন রকম সংকোচ না করে আমার বিছানায় চলে আসতে পারেন তাহলে আমি আপনার প্রস্তাবে এক কথায় রাজি।

হেনা আলমের দু’চোখে যেন আগুন জ্বলে উঠল। বললেন ডাক্তার! আপনি আগুন নিয়ে খেলা করতে চাইছেন। আমার দেহটা বাদ দিয়ে আপনি অন্য কিছু চান।

—দেখুন, যে কাজ আমি করতে চাই না, যে কাজে আমার বিপদ এবং আপনার জীবনের ঝুঁকি আছে সে কাজ যদি নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে করতে হয় তাহলে তা এমন কিছুর জন্য করব যা দুর্লভ।

—এই আপনার শেষ কথা?

—হ্যাঁ।

হেনা আলম নেকলসেটা গলায় পরে বোরখা মুড়ি দিয়ে যেমন এসেছিলেন ঠিক তেমনি চলে গেলেন।

আমি দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। আমার সর্বাঙ্গ তখন কামনার আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। এঃ। আমি কি বোক। কেন যে ওকে যেতে দিলাম। এই নিঝুম রাতে জোর করে ওকে আমার বিছানায় শোয়ালে নিশ্চয়ই ও চেঁচামেচি করত না। সুন্দরী রমণীকে জোর করেই ভোগ করতে হয় এই চিরকালের নিয়মটা ভুলে গিয়েই ভুল হল। তাই সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলাম।

.

পরদিন সকালেই সেই মর্মান্তিক সংবাদটা কানে এলো। মিসেস হেনা আলম আত্মহত্যা করেছেন। ধ্বরটা শুনেই শিউরে উঠলাম আমি। উঃ কি ভয়ঙ্কর। হেনা আলম মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। কিন্তু ওর গর্ভের সেই সস্তানটা! সেটাও যে দম বন্ধ হয়ে মরে গেল। হায় ভগবান! সেই অসহায় মহাপ্রাণ, যেটা মাতৃগর্ভ থেকে একটু একটু করে বেড়ে উঠছিল …!

।এমন সময় হঠাৎ আমার সামনে যারা এসে দাঁড়াল তাদের দেখব বলে আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। ভয়ে আমার মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।

—ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট মিঃ সেন।

আমি মড়ার মতো ফ্যাকাসে মুখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম—হোয়াই?

—সেটা থানায় গেলেই জানতে পারবেন। —কেন এখন পারি না?

–আপনি কি শুনেছেন মিসেস আলম সুইসাইড করেছেন?

–শুনেছি। কিন্তু তার সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক!

—আছে বৈকি। মরবার আগে তিনি একটি চিঠি লিখে গেছেন। তাতে লিখেছেন তার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। তার স্বলতার সুযোগ নিয়ে আপনি তার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে তাকে প্রতারণা করেছে। এবং তাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচনা করেছে।

আমি চিৎকার করে উঠলাম না না না। সী ইজ এ লায়ার। এঘ সত্যি নয়। এ মিথ্যা। আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ। আপনারা বিশ্বাস করুন।

–আমাদের বিশ্বাস অবিশ্বাসে কিছুই যায় আসে না মিঃ সেন। আপনার সততা প্রমাণ করার জন্য আদালত আছে। আপনি ভিমরুলের চাকে হাত দিয়েছেন। এখন ঠ্যালা সামলান। থানায় চলুন। মেহসুর সাহেব আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

আমার গা মাথা যেন পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল। এই আকাশে চন্দ্র সূর্য কি সত্যিই ওঠে? ওঃ মাই গড়। হেল্প মি।

.

আমার মান ইজ্জত চাকুরির নিরাপত্তা সব কিছুই এক লহমায় বিপন্ন হয়ে পড়ল। এক কথায় জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেল আমার। ঐ সুন্দরী কুহকিনী কেন যে এ কাজ করল? কেন যে এইভাবে প্রতিশোধ নিল আমার ওপর তা ভেবেই পেলাম না। এখন ভাবছি কাল রাতে ঐ রকম প্রস্তাব না করে তার কথায় রাজি হলেই ল্যাঠা চুকে যেত। যেহেতু আমার অসহযোগিতায় তাকে মরতে হল সেই রাগে আমারও সর্বনাশ করে গেল সে। পুলিশ ঠিকই বলেছে আমি ভিমরুলের চাকেই হাত দিয়েছি। আমার সাধ্য কি যে মেহবু সাহেব্বে সঙ্গে লড়ি? সাধ্য থাকলেও হেনা আলমের ঐ রকম স্বীকারোক্তির পর আমার বাঁচাও তো অসম্ভব। আইনের চোখে আদালতের বিচারে আমার কি শাস্তি হবে জানি না। তবে মেহবু সাহেব যে আমাকে জ্যান্ত কবর দেবেন তা বুঝতেই পারছি।

থানার লকআপে প্রায় আধ ঘন্টা রাখার পর পুলিশ প্রহরায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হল মেহবুব সাহেবের মার্বেল প্যালেসে। একটি বিলাসবহুল হলঘরের মতো বড় ঘরে আমাকে এনে যখন বসানো হল তখন মেহবুব সাহেবের চেহারার দিকে। তাকিয়ে শিউরে উঠলাম। কী পৈশাচিক মুখ। এর চেয়ে একটা হায়না ভালো। এখানকার পুলিশ প্রশাসন সবাই সন্ত্রস্ত মেহবুব সাহেবের প্রতিপত্তি এবং ব্যক্তিত্বের কাছে।

মেহবুব সাহেবের চোখ কালো চশমায় ঢাকা। ক্রাচ দুটি কৌচের গায়ে ঠেস দিয়ে রাখা। টেবিলের ওপর একটা দোনলা বন্দুক। বাঘ মারা। একটি ব্লাঙ্ক ক্যাসেট লাগানো টেপ রেকর্ডার। সেটা চালিয়ে দিয়ে তিনি বললেন—আপনিই ডাক্তার সে?

—হ্যাঁ।

–বসুন।

ঘরে একটা সঁচ পড়লেও যেন শব্দ হবে।

মেহবুব সাহেব পুলিশ এবং তার লোকেদের বললেন—আপনারা একটু বাইরে যান। আমি না ডাকা পর্যন্ত কেউ এ ঘরে ঢুকবেন না বা এর ধারে কাছে আসবেন না।

ভীত সন্ত্রস্ত সবাই চলে গেল।

মেহবুব সাহেব বললেন বয়স কত? দেখে তো ছেলেমানুষ বলেই মনে হচ্ছে। বিয়ে থা করেছে?

ভয়ে ভয়ে বললেন—না।

—আমার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার অবৈধ সম্পর্ক কত দিনের?

আমি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম—মেহবুব সাহেব! আল্লা কসম। ঈশ্বরের দোহাই। আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ।

—আমার স্ত্রীর ঐ স্বীকারোক্তিটা তাহলে মিথ্যা। কি বলুন? মেহবুব সাহেব এবার বন্দুকটা হাতে নিলেন। তারপর সেটা নিয়ে খেলা করতে করতে বললেন কাল রাত্রেই বোধ হয় আপনি শেষবারের মতন আমার স্ত্রীর দেহটা ভোগ করেছেন, তাই না?

আমি মাথা নত করে বললাম না না না। আপনি বিশ্বাস করুন আমি তার কোন ক্ষতি করিনি।

মেহবুব সাহেবের পৈশাচিক মুখে হিংস্রতা যেন প্রকট হয়ে উঠল। বললেন রাতের অন্ধকারে ঐ রকম একজন সুন্দরী যুবতী আপনার ঘরে গেল আর আপনি তাকে ভোগ না করেই ছেড়ে দিলেন? এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?

—আপনি তো সবই জানেন দেখছি।

—আমার স্ত্রীর ব্যাপারে আমি জানব না তো কি অন্য তোক জানবে? রাতের অন্ধকারে সে বেরিয়ে গেল, কোথায় গেল আমি জানব না? বলতে বলতেই বন্দুকে গুলি পুরে মেহবুব সাহেব বললেন—এটা কার জন্য তৈরি করলাম বলুন তো?

জানি না।

—আপনার জন্য। রাতের অন্ধকারে যে যুবক এক অসামান্যা সুন্দরীকে। নাগালের মধ্যে পেয়েও তাকে ভোগ করতে পারে না এটা তরা জন্যই খরচা করা উচিত। আপনিই বলুন না তাকে গুলি করে মারাটা উচিত কি না?

—আপনার কথার আমি কোন ঘের পাচ্ছি না মেহবুব সাহেব।

–না পাবার তো কিছু নেই। একজনকে ভোগকরার জন্য মেরেছি একজনকে করার জন্য মারব।

—মারবেন। তবে তার আগে ওর পোেস্টমর্টেম রিপোর্টটা একবার দেখুন। আমার রক্ত পরীক্ষা করান। মনে কোন সন্দেহ রাখবেন না মেহবুব সাহেব। আমি ওকে ভোগও করিনি। ওর গর্ভে আমার সন্তানও নেই!

—আমি জানি ডাক্তার। সব জানি। ওর গর্ভে এ অবৈধ সন্তানের বীজ যে বপন করেছে আমি তাকে নিজে হাতে গুলি করে মেরেছি। ও কিন্তু সেটা বুঝতে পারে নি। মানে আমি বুঝতে দিই নি। ওর প্রেমিককে মারবার আগে তাকে ভয় দেখিয়ে এমন একটা চিঠি আমি লিখিয়ে নিয়েছি যাতে ওর ধারণা হয়েছে ওর প্রেমিক ওকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ও তো আপনাকে অনেক কিছু দিতে চেয়েছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনি ওর অ্যাবরশানটা করালেন না কেন?

—আমি কখনো ও কাজ করিনি সাহেব। টাকার লোভে ঐ পাপ আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাছাড়া ওতে ওর জীবনের ঝুঁকি ছিল।

–আপনি খুব ধর্মভীরু লোক দেখছি। ভ্রূণ হত্যা করেন না। সুন্দরী যুবতীকে রাত্রিবেলা বেডরুমে একা পেয়েও তাকে জোর করে ভোগ করেন না। টাকার লোভ করেন না। আপনাকে দিয়ে এ জগতের কোন কাজটা হবে শুনি। এক্কেবারে যা তা লোক মশাই আপনি। যাক। আমার তরফ থেকে একটা সামান্য উপহার আপনাকে দিচ্ছি। এই নিন। এটা বাড়ি নিয়ে খুলে দেখবেন।

–কী আছে এতে?

—একটা বিশাল অঙ্কের টাকার চেক। আমি জানি এই ঘটনার পর আপনি আর এখানকার হাসপাতালে চাকরি করবেন না। নিজেই ইস্তফা দিয়ে চলে যাবেন। তাই সাময়িকভাবে যাতে আপনার কোন অসুবিধা না হয় সেইজন্যে এটা আপনাকে আমি দিচ্ছি। বলে একটি বড় খাম এগিয়ে দিলেন মেহবুব সাহেব। তারপর কি ভেবে যেন সেটা আবার চেয়ে নিয়ে তার ওপর নিজের নাম সই করে আমার নামটা খস খস করে লিখে দিলেন।

আমি অবাক হয়ে বললাম—শুনেছিলাম আপনি অন্ধ। কিন্তু আশ্চর্য। যেভাবে আপনি লেখালিখি করছেন বা এত কিছুর ওপর নজরদারি করছেন তাতে তো আপনাকে অন্ধ বলে মনেই হচ্ছে না।

মেহবুব সাহেব হেসে বললেন—শুনেছে ঠিকই। এক মারাত্মক বিস্ফোরণে আমার এই রকম দশা হয়েছিল। একটা পা গেছে। মুখটাও পুড়ে ঝলসে গেছে। দৃষ্টিশক্তিও হারিয়েছিলাম। তবে বহু চেষ্টার পর এবং বহু চিকিৎসার পর দুটি চোখেই অল্প অল্প দেখতে পাই। কিন্তু এ কথা আমি কাউকে বলিনি। এমনকি আমার স্ত্রীকেও না।

আমি অভিভূত হয়ে বললাম-কেন?

—আসলে আমার স্ত্রীকে আমি খুব ভালবাসতাম, আপনিই বলুন না কেন ওইরকম একজন নারীকে ভালো না বেসে কি পারা যায়? তা যাক। যখন বুঝতে পারলাম আমার এই অবস্থার পর ও অন্যের অনুগামী তখন মনে মনে খুবই দুঃখ পেলাম। কিন্তু সব জেনেও ওকে আমি বাধা দিই নি। নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিয়েছিলাম। পরপুরুষের সঙ্গে ও উপগত হোত। এক বিছানায় শুতো। সবই দেখতাম! এমন কি আমাকে অন্ধ ভেবে আমার সামনেই পরস্পরকে আলিঙ্গন চুম্বন করত। সব সহ্য করেছিলাম। কিন্তু যখন টের পেলাম ওরা অবাধ স্বাধীনতা পাবার আশায় আমার প্রচুর ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে বরাবরের জন্য এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করছে তখন আর থাকতে পারলাম না। প্রতিহিংসা নেবার জন্য তৎপর হলাম এবং ওদের একজনকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিলাম। তারপর আমরা স্ত্রী যখন আপনার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করল তখনও আমি ওর পিছু নিয়ে সব কিছু দেখলাম। আপনার দরজায় কান খাড়া করে ভেতরের কথাবার্তা শুনলাম। আপনার আদর্শ এবং ব্যক্তিত্বকে অভিনন্দন জানাই। তবে শেষ দিন অবশ্য আপনি ওর কাছে। অন্য একটি প্রস্তাব রেখেছিলেন। কিন্তু জোর করেন নি। তাতে অবশ্য আমি অসন্তুষ্ট নই। কেননা এটা হওয়াই স্বাভাবিক। তবে অর্থলোভে ঐ ঘৃণ্য কাজটি যে আপনি করেননি তার জন্য সামান্য একটু পুরস্কার অন্তত আপনার পাওয়া উচিত। তাই বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কয়েকটা চেক আপনাকে দিলাম এবার আপনি যেতে পারেন।

—আপনি?

—ডাক্তার! দেরি করবেন না। মনে রাখবেন আপনি এখনো আসামী এবং পুলিশ আপনার জন্যে দরজার বাইরে অপেক্ষা করছে। আমাকে আমার বাকি কাজটুকু করতে দিন।

আমি চলে এলাম।

তবে ঘরের দরজা পার হবার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দুকের গুলির শব্দ শুনে ছুটে গেলাম তার কাছে, থুতনির নীচে বন্দুকের নলটা ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপেছেন মেহবুব আলম। টেপরেকর্ডার যন্ত্রেই সেই গুলির শব্দ ধরা পড়েছে। পুলিশের উদ্দেশ্যে লেখা একটা চিঠিও পড়ে আছে টেবিলের ওপর।

ততক্ষণে বাড়ির অন্যান্য লোকজন এবং পুলিশ, বাই ছুটে এসেছে।

টেপ রেকর্ডারে বলা কথা এবং তার চিঠির বিবরণ অনুযায়ী পুলিশ আমার বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগ তুলে নিল এবং আমাকে সসম্মানে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল।

বলা বাহুল্য কয়েকদিনের মধ্যে আমি নিজের চেষ্টায় অন্য জায়গায় বদলি হয়ে গেলাম। হেনা আলম আমার সুন্দর জীবনের এক সকরুণ স্মৃতি। এটা তো ঠিক, শুধুমাত্র আমারই গোঁড়ামিতে সেই প্রস্ফুটিত ফুলটিকে অকালে ঝরে যেতে হল। তাই মেহবুব সাহেবের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া ঐ চেকগুলো গ্রহণ করতে বিবেকে বাধল আমার। আসার সময় আমি সেগুলো পুলিশের হাতেই জমা দিয়ে এলাম।

অণুবীক্ষণ – কুণালকিশোর ঘোষ

স্বপনে তাহারে কুড়ায়ে পেয়েছি, রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…। গানটা এইমাত্র শেষ হল। টিভির অ্যানাউন্সার পরের গানটার প্রথম কলি ঘোষণা করার ভিতরেই শ্রাবণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন, উদাস। হুড়মুড় করে ছোটবেলাটা উঠে আসছিল? নাকি তিনি নিজেই দুড়দাড় করে ছোটবেলায় ফিরে ফিরে যাচ্ছিলেন?

মা! চেতলার সেই বিশাল ছাদ-এর ওপর তিন কামরার ফ্ল্যাট! সারা ছাদ ভরে মা কেমন বাগান করেছিল। বাবা হাসতে হাসতে মাকে কতবার যে বলত—এত ছাদ নয়। এ আমার গিন্নির ফুলছাদ। সন্ধেবেলায় আশ্চর্য একটা সোনালি রোদ্দুর মাখা থাকত আকাশে। গুঁড়ো গুঁড়ো বাতাস। কঁক বেঁধে চড়ুইপাখি নামত মায়ের ফুলছাদে। বাবা তখনও ফেরেনি। আমরা দু’বোন চুপটি করে মায়ের গান শুনতাম। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রগীতি, রজনীকান্ত সবই তো মায়ের ওই গুনগুনানি শুনেশুনেই শেখা।

পুরনো ছাদ, পুরনো ফুলের গন্ধ, পুরনো সন্ধেবেলার গানের স্মৃতি এই পুড়ে যাওয়া দুপুরকে ঠেলে ঠেলে দিয়ে কেমন করে যে এগিয়ে এল শ্রাবণী জানেন না।

শ্রাবণীর চোখ বোজা। বোজা দু’চোখের ওপর গোল গোল করে কাটা শশার টুকরো। দেওয়াল ঘড়িটা একটুক্ষণ সর সর একটা শব্দ করল—ঢং। তার মানে দেওয়াল ঘড়ির—একটা। আসলে এখন একটা সাত। পুরনো এই ঘড়িটা ঠিক টাইমই দেয়। তবে সাত মিনিট পিছিয়ে থেকে।

—আমরা এমনিই ভেসে যাই…। পরের গানটা শুরু হয়েছে। এই দুপুর বেলায় এমন গান। কে শোনে? ভাবতে ভাবতেই শ্রাবণীর মনে হল, আমি তো শুনছি। আমার মতো হাজারটা লোক নিশ্চয়ই শুনছে। কিন্তু…? টিভি চালিয়ে কেউ কি শুধু শোনে? দেখতে তো হবেই। কিন্তু আমি?

শ্রাবণীর হাসি পেল। তাকে এখন আধঘণ্টা দু’চোখের ওপর গোল করে কাটা শশার টুকরো রাখতেই হবে। ‘চোখের দু’পাশের কালিমা শশার ছোঁয়ায় উধাও’—পড়েছে। সেই বিখ্যাত রূপচর্চার বইতে।

—এ বড় কষ্টের। শ্রাবণী নিজেকে বললেন।—টিভি শুনব। দেখব না? এ হয় নাকি? রেখেছি স্বপনে ঢাকিয়া…যখন শুনছিলাম তখনও শশা দিয়ে চোখ ঢেকে ছিলাম। কিন্তু এখন? এখন তো মায়ের গুনগুন করে গাওয়া সেই গানটা হচ্ছে। আলোর মতো হাসির মতো কুসুমগন্ধ রাশির মতো শুনতে শুনতে বোজা চোখেই পুরনো দিনের ছাদ থেকে নেমে এসে জানলার পর্দা ফেলা তার এই বেডরুমে ঢুকে পড়লেন।

শ্রাবণী জেগে জেগে চোখ বুজে রয়েছেন। তাই কোনও স্বপ্ন আসছে না। বোজা চোখের ভিতর অনেক ছবি উঠে আসছিল। অসংলগ্ন। পরম্পরাবিহীন সে সব ছবি। মা। ছাদ। ঝকবাঁধা চড়ুই-এর দল। তারপরই আবার শ্রবণা। মেয়ের কথা মনে আসতেই একপেশে এক হাসি ঠোঁটের কোণায় উঠে এল। নার্সিংহোম থেকে ছাড়া পাওয়ার আগেই নিজের সঙ্গে মিলিয়ে মেয়ের নাম রেখেছিলেন। সেদিনের ন্যাপিতে জড়ানো শ্রবণা আজ আঠারো বছরের অনার্স পড়া লেডি। কি তরতর করে বছগুলো বয়ে গেল।

আজ অনেকদিন পর শ্রাবণী নিজেকে একটু ঝাড়পোেছ করার সময় পেয়েছেন। শ্রবণার মর্নিং কলেজ। দুপুরগুলো সবটাই তো মেয়ের। আয়নার সামনে একটু যে দাঁড়াবেন, তেমন সুযোগ তো নেই। আজ বলল, বন্ধুর কাছে নোটস নিতে যাচ্ছে। এই সুযোগে নিজেকে নিয়ে একটু…।

-নোটস্-এর নাম করে এই ভর দুপুরে বেরোল। সত্যিই নোটস্ তো? যা! কি সব ভাবছি। প্রেম করলে ও আমাকে ঠিকই বলবে। আজকালকার মেয়েরা অনেক ম্যাচিওরড। আমাদের মতো হাবুডুবু খাওয়া নয়।

হাবুডুবু শব্দটা কেন যে হঠাৎ উঠে এল! বোজা চোখের শ্রাবণী শুয়ে শুয়ে বিরক্ত হচ্ছিলেন। সত্যিই তো তিনি হাবুডুবু খেয়েছিলেন। তাঁর সেই উনিশ কুড়ি বছর বয়সে। চেতলার সেই ছাদভরা বাগানওয়ালা ফ্ল্যাট। মা। বাবা। দু-বোন। আশুতোষ কলেজের মর্নিং সেকশন। সব একেবারে নিখুঁত। নিখাদ। হঠাৎ কি যে হল পুজোর শাড়ি কিনতে গেল বেহালাতে। শখের বাজারে থাকে মৌসুমী। হিস্ট্রি অনার্সের বেস্ট ছাত্রী শ্রাবণীর গলায় গলায়। ফোন করে বলল, চলে আয়। গড়িয়াহাটকেও বিট করেছে। কী কালেকশন! ভাবতে পারবি না।

শ্রাবণী শাড়ি দেখবে কি! শাড়ি দেখছে তো মা। শ্রাবণী দেখল, একদম পুঁচকে একটা ছেলে। লজ্জা লজ্জা মুখ করে ক্যাশ কাউন্টারে বসে রয়েছে। ওই নাকি মালিক। প্রেমে পড়ে গেল। হাবুডুবু খাওয়া প্রেম।

বিয়ে হয়েছিল। বাবাই দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছিলেন। সব নিয়ম মেনে। তারপর কিন্তু অনেকদিন আর কোন সম্পর্ক রাখেননি। শ্রাবণী মজুমদার যে নিজেকে শ্রাবণী সাহা বানিয়ে ফেলতে পারে এটা মা বাবার স্বপ্নে ছিল না।

শ্রাবণী তখন হাবুডুবুতে ডুবে আছে। একটা কথা বিয়ের রাত থেকেই বুঝতে পেরেছিল, অনিল সাহা খুব পোষমানা বর হবে। চাইতেই সব পাওয়াগুলো কেমন হাতের মুঠোয় উঠে উঠে এল। নিজের সংসার, নিজের বর, নিজের মেয়ে। সবটাই শুধু নিজের। নিজের ইচ্ছেমতো সবাইকে শুধু তৈরি করে নেওয়া।

বিয়ের বেশ কিছুদিন পরেও খুব ঘন মুহূর্তে স্বামীর দৃষ্টি দেখে শ্রাবণী মনে মনে প্রীত হত। এমন মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়েছে যেন এটা কোনও অন্য গ্রহের বিস্ময়কর এক নারী শরীর। ভালো লাগত। খুব ভালো।

–কিন্তু এখন…? শ্রাবণী নিজেকে বললেন, এখন ও যেন কেমন অন্যমনস্ক। থেকেও যেন নেই। খ্যাক করে ওঠার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু…। সেই পোষমানা ভাবটা কখন যেন মিইয়ে গেছে।

পর্দা ফেলা জানলার ফাঁক-ফোকর দিয়ে মনখারাপের বাতাস এসে শ্রাবণীকে নাড়িয়ে দিতে চাইছিল। উড়িয়ে।সত্যিই তো…। শ্রাবণীর মনে হল। ইদানীং তো ও সেই মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে হামলে পড়ে না। কেমন যেন গুটিয়ে থাকা পুরুষ। দোকান বড় হয়েছে। কর্মচারী বেড়েছে। কাজ। ক্লান্তি। সবই বুঝলাম। তা বলে…। আমি কি বুড়িয়ে গেছি? কি করে? এখনও তো ক্যালেন্ডারের দিন মেপেই মাসে মাসে ঐটে হয়ে যায়। ও কি বুড়ো হয়েছে? যাঃ, ছেচল্লিশ কি একটা বয়স? পুরুষমানুষের ছেচল্লিশ কোনও বয়সই নয়। তবে…?

…এমনিই এসে ভেসে যায়… শেষ হল। শ্রাবণী বিছানা ছাড়লেন। চোখের ওপর সেঁটে দেওয়া শশার টুকরো দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। খুব হাল্কা, তৃপ্ত, গর্বিত একটা হাসি ঠোঁটের কোণ বেয়ে উঠে আসছিল—আমি এখনও চোখে পড়ার মতন। চোখের কোণে কালিমারা কোথায়? ওরা ওই গানের সঙ্গে বুঝি ভেসে গেছে। ভালো লাগল। খুব ভালো।

সেই ভালো লাগা নিয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খেছেন আর গুনগুন করছেন।—এমনিই এসে ভেসে যায়…।

কি ভেসে যায়? কোথায় ভেসে যায়? কেন ভেসে যায়? খেয়ালই করছেন না। গুনগুন করে ভাসিয়েই দিচ্ছেন। সেই গুনগুনানির ভেতর ফোন এল।

একটা হাঃ হাঃ চিৎকার। তারপরই স্ব কিছু অন্ধকার।

ওষুধের গন্ধে গা গুলিয়ে উঠেছিল। শ্রাবণী জানেন না। উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক দেখার আগেই দুটি যুবক এগিয়ে এসে কি কথা যে বলেছিল, শ্রাবণী তাও জানেন না। দুটো শব্দ কানে কিল মেরেই চলেছে, হার্ট অ্যাটাক। একটি নার্সের পিছনে পিছনে আই সি সি ইউতে ঢুকলেন। অনিলের চোখ বোজা নাকে নল। মাথার কাছে দেওয়ালে ছোট্ট টিভি সেট-এর মতো মনিটরিং মেশিনটায় দুটো সরু সরু লাইন ভাঙছেগড়ছে, ভাঙছেগড়ছে করতে করতে বাঁদিক থেকে বেরিয়ে ডান দিকে মিলিয়ে যাচ্ছিল।

নার্সটি গোপন কথা বলার ঢঙ-এ ফিসফিসিয়ে বলল, বাইরে চলুন। শ্রাবণী ফ্যালফ্যাল করে আবার দেখলেন, শব্দ না করে টিভি সেট-এর মতো মনিটরিং মেশিন, নল গোঁজা নাক। বোজা চোখ। বেরিয়ে আসতে হল।

নার্স বলল, আর কেউ আসেননি? একা? শ্রাবণীর মাথা নাড়া দেখে কিছু বুঝতে পারল না। বলল, এই টুলটায় বসুন। এখন ভিজিটিং আওয়ার নয়। ঠিক আছে, বসুন, নার্স চলে গেল।

নার্স চলে যেতে শ্রাবণী একা হয়ে গেলেন। কী ভীষণ একা। বাইরে কি এখন ট্রামবাস চলছে? লোকের ভিড়? গা-পোড়া রোদ্দুর? এ জায়গাটা এমন কেন? শীত শীত করা নির্জনে। হাসপাতালটার নাম কি যেন? এন.আর.এস.। এখানে নিয়ে এল কেন? ছেলে দুটো কি যেন বলছিল, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া..। শিয়ালদা স্টেশন। শিয়ালদায় কি করছিল? শ্রবণা কোথায়? ও কি জানে না, ওর মায়ের কত বড় বিপদ? এই সময় তুই পাশে থাকবি না? কেমন মেয়ে?

শ্রাবণী কোনও পথ পাচ্ছিলেন না। চিন্তার সব পথগুলোর মাঝখানে কে যেন ‘নো-এনট্রি’ বোর্ড লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কান্না পাচ্ছিল। ভয় হচ্ছিল। নিদারুণ সেই অসহায়তাকে শ্রাবণী এক ঢোকে গিলে ফেললেন। এখানে ঘড়ি নেই। শ্রাবণী ঘড়ি পরে আসেননি। সময় যে কতটা বয়ে গেছে বুঝতেই পারলেন না।

দুড়দাড় করে শ্রবণা উঠে এল। পেছনে মল্লিকবাবু আর দোকানের দুজন কর্মচারী। শ্রবণা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, মা। শ্রাবণী সেই নার্সটির নকলে ফিসফিসিয়ে বললেন, আস্তে। জোরে কথা বলো না। তোমার বাবার হার্ট অ্যাটাক। নাকে নল গুঁজে শুয়ে রয়েছে। আমার সঙ্গেও কথা বলেনি।

শ্রবণা মাকে দেখল। যা বোঝবার নিজেই বুঝল। কথা বাড়ায়নি।

মাঝে মাঝে গম্ভীর মুখের এক একজন ডাক্তার আই সি ইউতে ঢুকে যাচ্ছেন। অনিলের মুখের দিকে এক পলক চেয়েই, খাটের সঙ্গে লাগানো চার্টটায় চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে আসছেন। অনিলের চোখের পলক পড়ছে না। একই ভাবে বোজা। কাঁচের জানালার এপাশ থেকে শ্রাবণী সব কিছুই লক্ষ্য করে যাচ্ছিলেন।

সন্ধের মুখে দুজন কমবয়সি ডাক্তার একসঙ্গে ঢুকলে, শ্রাবণী কেমন যেন সাহস পেয়ে তাদের পেছনে পেছনে ঢুকে পড়লেন। তারা বেরিয়ে আসার সময় জিজ্ঞেস করলেন—আচ্ছা ও কখন কথা বলবে? দুজন ডাক্তারই একসঙ্গে থমকে গেল। একজন বলল, কথা? বলবে? অপরজন বলল,–হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলবে। তবে এখন তো…।

মল্লিকবাবু অনেকদিনের কর্মচারী। সেই শশুরের আমল থেকে। অনিলকেই নাম ধরে ‘তুমি’ বলেন। এতক্ষণ পর এগিয়ে এসে বললেন—বৌমা, এবার তুমি ওঠো। আমরা সকলে তো রয়েছি। কাঁধের ব্যাগটা আমাকে দাও। আমি তোমাদের পৌঁছে। দিয়ে আসছি।

ব্যাগটা অনিলের। হাসপাতালে ঢোকার মুখে সেই ছেলে দুটো শ্রাবণীকে দিয়ে যায়।

‘ব্যাগটা আমাকে দাও’, শুনে শ্রাবণীর দাঁত কিড়মিড় করে উঠল। দুহাত দিয়ে ব্যাগ জড়িয়ে ধরে তীব্র গলায় বললেন—না। না। আমার কাছে থাক।

অমন হিংস্র হয়ে ওঠার দরকার ছিল না। শ্রাবণী এখন বেখেয়ালি। হঠাৎ বোধহয় ভাবলেন স্বামীকে কেউ কেড়ে নিতে চাইছে।

মায়ের মুখ-চোখের অবস্থা দেখে শ্রবণা আজ এই ঘরে শুতে চেয়েছিল। শ্রাবণী বড় বড় করে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,—ওমা! না, না, ঠিক আছে। কিছু হবে না। সারাদিন তোর এত ধকল গেল। যা, শুয়ে পড়।

মেয়ে আড়চোখে মাকে দেখল।—কোথায় যেন অঙ্ক মিলছে না। নিঃশব্দে নিজের ঘরে ফিরে গিয়েছিল।

শ্রাবণী নিজেও জানেন না। জানেন না? হয়তো জানেন। কিন্তু এ মুহূর্তে কোন কিছুই তো ঠিকঠাক কাজ করছিল না। শ্রাবণী তাই বুঝতেই পারলেন না, নিজেকে বড় বেশি একা পেতে চাইছেন। একদম একা।

ঘড়ির সর-সর। তারপরই ঢং ঢং করে দশটা বাজল। ঘড়ির শব্দে চমকে উঠেছিলেন। কী চুপচাপ! ঘরটা। এত শব্দে ঘোর কেটে গেল। দরজা খোলা। আলোটাও জ্বলছে। সেই জ্বলা আলোয় দেখলেন—ইস। এঁটো ব্যাগটা এখনও খাটেই রেখে দিয়েছি। অনিলের টিফিন নেওয়া কাঁধে ঝোলানো সেই ব্যাগটা।

অলস হাতে নামিয়ে রাখতে গিয়েও বুকের কাছে নিয়ে এলেন।—এমা! টিফিন কৌটো তে ভর্তি। খায়নি।

না খাওয়া টিফিন কৌটো। বার করলেন। একটা ঠোঙা।ঠোঙা আবার কিসের? আঙুরে ভরা ঠোঙা বেরিয়ে এল।—ভরা নয়তো। কে যেন অনেকগুলো

খেয়ে নিয়েছে। এই তো। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এখান ওখান থেকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া। অনিল টিফিন না খেয়ে আঙুর খেয়েছে?

দুপুর দুটোর গরম রাত দশটায় অনেকটা নেমে এসেছে। মাথার ওপর বন বন করে ফ্যান ঘুরছিল। তাও…, শ্রাবণী দেখলেন, তাঁর গলা বেয়ে ঘামের একটা দাগ দরদর করে নেমে যাচ্ছে। হাত দুটো কি কেঁপে গেল? সেই কঁপা হাতে শ্রাবণী আবিষ্কার করলেন। ব্যাগের এক কোণে, গোপাল বড় সুবোধ ছেলের মুখ নিয়ে এক প্যাকেট কনডোম শুয়ে রয়েছে। পুরো প্যাকেট তো নয়। কেউ যেন একটা ছিঁড়ে নিয়েছে। একটা ভয়ংকর বরফের টুকরো শ্রাবণীর হৃৎপিণ্ডে ঝাঁপটা মারল। ঝাঁপটা? না ছোবল। নিমেষের ভেতর সেই সাপের কিলবিলানি শ্রাবণীর পা থেকে মাথার স্নায়ু পর্যন্ত উঠে এসে, ক্লান্ত এই মহিলাকে অসাড় করে দিল।

—আঙুর! কনডোম! অনিল তো কোনদিন এসব জানত না। ফলের ভেতর, আম, পেঁপে আর সবেদা। এই তো খায়। কনডোম নিয়ে কত হাসাহাসি। পরতে গেলেই সময় নষ্ট। সেই লোকের ব্যাগে…। কে শেখাল?

শ্রাবণী কাঁদছেন। নিঃশব্দ। আকুল। সর্বস্বান্ত হওয়ার তীব্র ভয় মেশানো সেই কান্না। কী আশ্চর্য। শ্রাবণী বুঝতে পারছেন না কেন। তবুও এই নষ্ট মুহূর্তে টকটক করে কত সুন্দর সব ছবি উঠে আসছিল। বিয়ের আগের দোকানের সেই লাজুক অনিল। মায়ের ‘ফুলছাদ’ দেখে বলেছিল, এত উঁচু ছাদেও এমন বাগান হয়। এর পরে তো আকাশেও বাগান হবে। বেহালার অন্যতম আদি, ‘লক্ষ্মী শাড়ি সংসার’, বিয়ের পরপরই কেমন ‘শ্রাবণী শাড়ি এম্পোরিয়াম’ হয়ে গেল। যা চেয়েছি তাই হয়েছে। চাইতে তো হয়নি। না চাইতেই সব কিছু পেয়ে গেছে। তুমি যে বড় পোবমানা। আমার হিস্ট্রিতে অনার্স। তোমার কি অনিল? মনে আছে? কেমন মজার মুখ করে বলত,দোকান মালিক হব। আর হিসেব শিখব না? সেই জন্যেই তো পিতাঠাকুর পাশ কোর্সের বি.কম বানিয়ে দোকান ফিট করে দিল। তোমাদের বাড়ির জলখাবার আমার বিয়ের পরেই কেমন ব্রেকফাস্ট হয়ে গেল! মনে পড়ছে? কি হল? বলো না। মনে পড়ছে? মনে পড়ছে।

একটা ‘গোঁ’-এর ভেতর থেকে এক কথা বারবার বলে চলেছেন। শ্রাবণীর কি খেয়ালে রয়েছে। অনিল এখন হাসপাতালের আই সি সি ইউতে? বাঁচবে কি বাঁচবে না ডাক্তাররাও জানেন না।

শ্রাবণীর খেয়ালই নেই। তিনি সেই তখন থেকে নিজের হেরে যাওয়ার বিরুদ্ধে লড়েই চলেছে। কার সঙ্গে? জানেন না। তবু এই লড়াই লড়ছে—আজ শশা দিয়ে শখের দাগ উঠিয়েছি। কার জন্যে। বল? কার জন্যে? তোমাকে ‘শ্রী’ থেকে ‘মিস্টার’-এ উঠিয়েছে কে? জান না? শুয়ার। বাটামাছের ঝোল না খেয়ে আঙুর খাওয়া হয়েছে? কার সঙ্গে রে? পোষমানা কুকুর? শ্রাবণী হাঁপালেন। শ্রাবণী কাঁদলেন। শ্রাবণী বোধহয় শুয়ে পড়লেন। দুঃখের কান্নার ভেজানো সেই সুখের বালিশ-এ। রাতের পর সকাল আসে। জাপানে আসে। সাইবেরিয়ায়। বেহালাতেও এসেছিল। বেহালার সকাল, সকাল সকাল এসে দেখল, শ্রাবণী দাঁতও মেজে একদম তৈরি।

শ্রবণা বলল, মা তুমি যাচ্ছ? আমি যাব? শ্রাবণী হাসলেন। সে হাসিতে আনন্দ মজা কিছু ছিল না। শুধু ক’খানা দাঁত বার করতে হয়, তাই। মুখে বললেন, অনার্স ক্লাশগুলো করে আয়। আমি তো থাকবই। মনে মনে খুব বিশ্রিভাবে হাসলেন। সেই খ্যানখেনে হাসির ভেতর, মনে মনেই বেরিয়ে এল, আমি তো যাচ্ছি সতীনের খোঁজে। মায়ের সতীন দেখতে তোর ভাল লাগবে?

শ্রবণা অনেকক্ষণ মায়ের দিকে চেয়ে কি যেন খোঁজবার চেষ্টা করল, খুঁজে পায়নি। আজ তিনদিন। শ্রাবণী আসেন। আই সি সি ইউ-এর বাইরে এই টুলটায় ঠায় বসে থেকে লক্ষ করেন, অনিলকে দেখতে কে এল। এসেছে অনেকে। তবে মহিলা বিশেষ নয়। যারা এসেছিল সবাই তো কাছের আত্মীয়া। আজ দুপুর বেলা হঠাৎ শ্রাবণী জানেন না কেন, সেই ছেলে দুটোর কথা খুবই মনে হল—-ওদের ঠিকানা রাখলেই হত। ওরাই তো ব্যাগ খুলে বাড়ি আর দোকানে ফোন করেছিল। আচ্ছা, কনডোম দুটো কি ওদের চোখে পড়েছিল? ওরা কি দেখেছে? অনিল যখন মাথা ঘুরে পড়ে যায় তখন কেউ ওর পাশে ছিল কি না? ইস বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এখন সতীনকে কোথায় খুঁজে পাই…? টুলের উপর চুপটি করে বসে, শ্রাবণী মনে মনে বকবক করেই চলেছেন।

শ্রবণা এসেছিল। বাবাকে দেখে গেছে।—সেই একই। মাকে ওঠাতে পারেনি। সন্ধ্যায় আবার আসবে বলে ফিরে গেছে। বিকেল শেষের আগে এক দঙ্গল এলেন। মহিলাই বেশি। শ্রাবণী এঁদের চেনেন না। শাড়িব্লাউজ মাখানো পারফিউমের গন্ধে হাসপাতালের ওষুধ গন্ধ উধাও। সবার পেছনে মল্লিকবাবু ধীর পায়ে উঠে এসে বললেন, এঁরা বেহালা বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিত্রি সব কমিটি মেম্বার। অনিলের কথা শুনে খুব শোক পেয়েছেন। ‘শোক’ কথাটা কানে যেতে শ্রাবণী সবার হাতের দিকে তাকালেন-যাক বাবা! সন্দেশ কিংবা রজনীগন্ধা আনেনি।

শ্রাবণী এক একজনের দিকে আড়চোখে চাইছে, মানে, এক একজন মহিলার দিকে। আর তৎক্ষণাৎ + চিহ্ন-সেঁটে দিচ্ছেন। এক দুই করে সবার গায়েই দেখলেন,—চিহ্ন আঁটা। কেবল একজনের গায়ে শ্রাবণী খুব অবাক হয়ে দেখলেন, বয়স বোঝা যাচ্ছে না। চল্লিশও হতে পারে। কিংবা কম। পুরুষ্ট গা হাত পা শুধু নয়, বেশ মোটার দিকে। সাদা শাড়ি-ব্লাউজ এর গা বেয়ে না দেখা একটা খাই খাই গন্ধ উঠে আসছিল। অনিলের খুব কাছে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার ভেতর আড়ে আড়ে শ্রাবণীকেও দেখে গেলেন—আমার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করছে নাকি? শ্রাবণী মনে মনে বিড়বিড় করলেন—ওই তো ছিরি। আমার এই স্লিম ফিগারের পাশে, ওই টপ মার্কা চেহারা। দাঁড়াতে পারবে? সাহস আছে বলতে হবে।

খুব গভীর গোপন চিন্তার ভেতরেই শ্রাবণী হঠাৎ হোঁচট খেলেন—স্লিম ফিগার। আমার? কিন্তু ওই স্লিম ফিগারকে তো অনিল ইদানীং তেমন করে চাইছিল না। তেমন করে কেন? চাইছিলই না তো। মুখে না বললেও, আমি কি বুঝিনি? আমাতে কি অরুচি এসেছিল। ‘অরুচি’ শব্দটা কোথা থেকে যেন একদলা বমি নিয়ে এল। শ্রাবণী এখন খুব শক্ত। এতটুকুও বমি না করে ড্যাবড্যাব চোখে দেখলেন, সাদা শাড়ি ব্লাউজের সারা গায়ে + চিহ্ন, + চিহ, আর + চিহ্ন।

হেরে যাবার কান্না কাদলেন। মনে মনে। অনেকক্ষণ ধরে।

এখন অনেক রাত। গভীর রাতে গোপন কান্নারা খুব সহজে বেরিয়ে আসে। শ্রাবণীর বেলায় তেমন কিন্তু হল না। হাসপাতালেই কান্নার কোটা বোধহয় শেষ করে এসেছেন। সেই শেষ বিকেল থেকেই ভেবেছিলেন, লুকোনো সতীন এতক্ষণ পাকড়াও হয়েছে। কিন্তু তা তো নয়। + চিহ্ন মার্কা সাদা শাড়ি বেশ ভালো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দুটো হাত ধরে কেমন বললেন, শ্রাবণী দেখা হল। কিন্তু বড্ড অসময়ে। অনিলদা ভালো হয়ে উঠুক। তোমাদের আমি বোয়াল মাছের পাতুরি খাওয়াব। খেয়েছ? কোন ভয় নেই। তোমার মুখ দেখেই বুঝেছি। এমন মেয়েকে বেশি দিন কষ্ট পেতে হবে না। চলি। ভালো থাকবে। খুব ভালো।

সতীন খোঁজার সব রাস্তাগুলোই বন্ধ। কোন মেয়ে কি সতীন হতে চায়? কেউ নয়। কেউ নয়। মেয়েরা তো মেয়ে। অনেক ঘেরাটোপ দিয়ে নিজেদের ঘিরে রাখে।

সেই ঘেরাটোপ খুলে একদিন তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন। চেতলার ‘ফুলছাদ’ থেকে বেহালার একতলার বাড়িতে। অনেকগুলো সিঁড়ি নামতে হয়েছিল। কম বয়সের উচ্ছাসে নেমে আসাটা সেদিন চোখে পড়েনি। বেহালার বাড়িও ধীরে ধীরে তিলা করেছিলেন। এখানেও ফুল ফুল সবই আছে। তবে…, আজ এই বয়সে এসেও শ্রাবণীর মনে হল,—ওগুলো বোধহয় প্লাস্টিকের নকল ফুল। জাঁক আছে। কিন্তু ফুলের হৃদয়ের গন্ধ কোথায়? চারপাশ ঘিরে যা কিছু করেছি সবটাই কি এমন হৃদয়হীন? জাঁকসর্বস্ব। তা না হলে…।

অনেক কান্না, অনেক হেঁচকি। কতবার নাক মোছার পর শ্রাবণী দেখলেন, ড্রেসিং টেবিলটার একেবারে যা তা অবস্থা। এখানে ওখানে ছেঁড়া কাটা চুল। আবছা ঝুল। সারা ড্রেসিং টেবিলটা জুড়ে একটা নোংরা আস্তরণ। একবার ভাবলেন, পরিষ্কার করবেন। কিন্তু না, থাক। কি হবে? ভাবতে ভাবতে কি যেন চোখে পড়ল।ওগুলো কি? কাছে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন। গোল গোল করে কাটা দু’টুকরো শশা। আধপচা, প্রায় শুকনো শশার টুকরো দুটো আরও গোস্লা পাকিয়ে গেছে। ঠিক যেন দুটো পচা চোখ।

অনের রাতের অনেক কান্নার শেষে, হাতের তেলোয় ধরা গোল্লা পাকানো শশা দেখতে দেখতে শ্রাবণী ফিসফিস করে নিজেকে বললেন,—এমন পচা চোখ নিয়ে সতীন খুঁজে বেড়াব? মা গো!

রাত বয়েই যাচ্ছিল।

অনিকেত – সঞ্জয় ব্রহ্ম

রাতের খাওয়া সেরে অনিকেত বসার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিল। স্ত্রী বিজয়ার তখন সংসারের কাজ গুছিয়ে রাতে শোবার সময়। পাঁচ বছরের মেয়ে শ্রীপর্ণা ঘুমিয়ে পড়েছে।

টেলিভিশনে কোন একটা চ্যানেলে তখন অর্থনৈতিক বিষয়ের ওপর বিতর্কে অংশ গ্রহণ করেছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদগ্ধ পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ। অনিকেত খুব মনোযোগ দিয়ে এদের আলোচনা শুনছে। স্ত্রী বিজয়া এসে পাশের সোফায় বসল। তার মুখটা কঠিন। চোখে মুখে বিরক্তি ভাব। কপাল কুঁচকে রয়েছে। সে হঠাৎ বলে ওঠে,—তোমার বাবা একটা অর্থপিচাশ। তুমি একটা অপদার্থ, তাই তোমার নাকের ডগা দিয়ে তোমাকে কাঁচকলা দেখিয়ে সম্পত্তি ভাগ হয়ে গেল।

অনিকেত টেলিভিশনের ঐ অনুষ্ঠানটি মন দিয়ে শুনছিল। সে বিজয়ার ঐ আকস্মিক বাক্যবাণে প্রায় কার কণ্ঠে বলে, কেন আমার জন্য তিনতলার ছাদের ঘরটা তো আছেই। বাবার অবর্তমানে ঐ ঘরটা তো আমার। প্লাস ক্যাশ।

বিজয়া মুখ ভেঙ্গিয়ে হাত নেড়ে অঙ্গভঙ্গি করে বলে, নিচ তলার ঘর…ক্যাশ!–বাবার অবর্তমানে তুমি কচু পাবে।

অনিকেত একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে, আচ্ছা তুমি হঠাৎ আমার পৈত্রিক সম্পত্তি নিয়ে পড়লে কেন? সে প্রসঙ্গ তো আমিও তুলতে পারি। আইন অনুযায়ী পৈত্রিক সম্পত্তিতে তোমারও সমান অধিকার রয়েছে।

তুমি তো খুব লোভী দেখছি। পরের সম্পত্তিতে লোভ।

বাবা কি তোমার পর নাকি?

দেখ ফালতু কথা বলবে না। আমি কেন বাবার বাড়িতে ভাগ বসাতে যাবো। বাবা আমাকে খরচা করে বিয়ে দিয়েছেন।

অনিকেত দৃষ্টি টেলিভিশনের দিক থেকে সরে এসেছে। সে এবার বিজয়ার মুখোমুখি হয়ে কুঁচকে বলে, খরচা করে? তুমি তোমার বাবার হয়ে ওকালতি করছ। কর। কিন্তু তোমার বাবাও কম ধুরন্ধর না। আমাদের পক্ষ থেকে দাবীহীন বলায় ওনার তো পোয়াবারো হয়েছিল। ঐ যা দিয়েছেন সব তোমাকে। তোমার গয়নাগাটি। আর আত্মীয় ডেকে খাওয়ানো। তাও-তো সে খাবার খেয়ে আমার দুই অফিস কলিগ। অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। কাজেই তোমার বাবা একটা পয়লা নম্বরের…কথাটা শেষ করে অনিকেত।

বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠে। তুমি আমার বাবাকে গালি দেবে না। খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিচ্ছি। তোমার কোন ধারণা নেই—একটা মেয়ে বিয়ে দিতে কত খরচ। নিজের একটা মেয়ে হয়েছে তো; বুঝবে তাকে পার করতে কত খরচ। তখন মুরোদ কত দেখব।

বিজয়ার দিকে আঙুল তুলে অনিকেত বলে তুমি কিন্তু প্রসঙ্গ ছেড়ে এখন উল্টোপাল্টা বলছ, চুপ করবে?

ইস্ আমি উল্টোপাল্টা বলছি। আর তুমি যা বল ঠিক বল? মাসের আজ কুড়ি তারিখও হয়নি। এখনই তোমার পকেট গড়ের মাঠ। টাকা চাইলে পাওয়া যায় না।

মাসের শেষে পকেটের দুরুবস্থা সব চাকরীজীবির-ই হয়।

সবার হয় না। হয় তোমার মত পাঁচু কেরাণীর। এ কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছ কেন?

এবার অনিকেতের আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। সে বলে, জেনে শুনে তোমার বাবা কেরাণীর সাথে বিয়ে দিলেন কেন?—ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, টাকাওয়ালা ব্যবসাদার খুঁজলেই পারতেন।

সেটা তোমার বাবার আদিখ্যেতা। আমাকে দেখার পর থেকেই এ মেয়ে সুলক্ষণা, এর সাথেই ছেলের বিয়ে দেব। আর বিয়েটা তাড়াতাড়ি দেবার জন্য কত মিষ্টি মিষ্টি কথা। নইলে কত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আমাকে প্রপোজ করেছিল।

বেশ তো তাদের কাঁধে ঝুলে পড়লেই পারতে।

অনিকেতের এই কথা শুনে, বিজয়া এবার তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। ঝুলে পড়া মানে কি বোঝাতে চাইছো? তার মানে আমি তোমার বোঝা?

আহ্ বোঝা হতে যাবে কেন? আমার রোজগারের ওপর নির্ভরশীল।

সে-তো তোমার জন্য। বিয়ের পরই বাচ্চা হল। বাচ্চা মানুষ করতে করতে এপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ডটা ল্যান্স হয়ে গেল।

ইস্ কার্ড থাকলেই যেন চাকরী হেঁটে হেঁটে বাড়িতে হাজির হোত।

হ্যাঁঁ  হত। স্কুল মাস্টারী অবশ্যই হত। আর শিক্ষকতা করব বলেই অনার্স পাশ করে বি.এড পাশ করেছিলাম।

রাখ রাখ তোমার মত বাংলায় অনার্স বি.এড রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কি বললে, রাস্তায় গড়াগড়ি। তার মানে আমি একটা রাস্তার মেয়ে। কথাটা বলে বিজয়া ঘ্যান ঘ্যান করে ওঠে।

হরিবল্। তুমি দেখছি পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করছ।

কী বললে, হরিবল তুমি আমাকে মরতে বলছ?

কী অসহ্য।

আমাকে অসহ্য লাগছে। কথাটা শেষ করেই বিজয়া হঠাৎ যেন আগুনের মতো ফুঁসে ওঠে।

আমি এক্ষুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাবো।–রইল তোমার মেয়ে।

কথা লতার মতো লতিয়ে লতিয়ে ধোয়ার কুণ্ডলী হয়ে শেষ পর্যন্ত চারদিক ঝাঁপসা করে দেয়। বিজয়া এখন কথা থামিয়ে ছুটে যায় ভেতরের ঘরের দিকে।

বসার ঘরে টেলিভিশন সেটটা তখনও চলছিল। এটা বোধ হয় দাম্পত্য কলহের সাথে নবীনতম সংযোজন। টেলিভিশনের শব্দে উঁচু গলায় কথা কাটাকাটি বা দাম্পত্য কলহের বিন্দু বিসর্গও বাইরের লোক শুনতে পাবে না। টেলিভিশনের শব্দ এই কলহে এক বিশেষ আবহ সংগীতের মাত্রা যোগ করে। বিচিত্র ধ্বনি সৃষ্টি হয়। ভেতরের সব টুকু ঢাকা দিয়ে দেয়।

অনিকেত কি করবে দিশা পায় না। ভাগ্যিস টেলিভিশন সেটটা চলছিল। নইলে মেয়েটা ঘুম থেকে জেগে উঠত। বাবা মায়ের ঝগড়া দেখলে মেয়েটা অসহায়ের মতো কাঁদতে থাকে। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে

অগ্নিসংযোগ করবে, এমন সময় বেশ জোরে একটা ভারি কিছু পতনের শব্দ হয়।

অনিকেত অতি দ্রুত ভেতরের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

ভেতরের ঘরে তখন গোদরেজের স্টিলাক্স আলমারিটা হাটখোলা। শাড়ি, জামা, কাপড় লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। আলমারির ছাদ থেকে তখন আঠাশ ইঞ্চি ফাইবারের বাক্সটা মেঝের ওপর ছড়িয়ে রাখা জামা কাপড়ের উপর চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে।

অনিকেত কতকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। মুখে সিগারেট হাতে লাইটার। স্তম্ভিত দৃষ্টিতে ফ্যালফ্যাল করে সে চারদিকে ঘুরে ঘুরে দেখে।

একটু আগেই বিজয়ার মুখ দিয়ে খই ফুটছিল। এখন মুখটা পাথরের মত কঠিন করে চারদিকে কী যেন খোঁজে। তারপর হঠাৎ কাপড়ের এক পাশে মাঝারী সাইজের একটা হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে বুকে চেপে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে। তারপর বোম টিপে ঢাউস ভি. আই. পি. লাগেজটা খুলে ফেলে। বাক্সটা উলের জামাকাপড়ে ঠাসা। শরীরটাকে ঈষৎ ঝুঁকিয়ে সে উলের জামা কাপড়গুলো মেঝের ওপর ছড়িয়ে সামনে এসে পড়েছে। অবিন্যস্ত বেশবাস। চোখদুটো স্থির মুখটা কঠিন।

অনিকেত বোকার মত তাকিয়ে দেখছে। সিগারেটটা হাতের আঙুলের ফাঁকে রয়েছে। লাইটারটা অন্যহাতে ধরা রয়েছে। হঠাৎ পাশের ঘর থেকে ঘুম থেকে জেগে উঠে মেয়ে শ্রীপর্ণা এই ঘরে উপস্থিত হয়। বিজয়া তখন ফুসছে। মেয়েকে দেখেই বিজয়া হঠাৎ অগ্নিমূর্তি ধারণ করে তার দিকে তেড়ে গিয়ে বলে, এ্যাই তুই-তোর

জন্য আমি মরতেও পারছি না। তোকে আজ খুন করে….

কথাটা শেষ করার আগেই মেয়ে শ্রীপর্ণা ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলে। সে কী আকুল কান্না। মেয়ের কান্নার সাথে সুর মিলিয়ে বিজয়াও হা-হুতাশ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, বাবা গো কী পাষণ্ডর সাথে আমায় বিয়ে দিলে গো…

বিজয়ার কান্নার হিক্কা ওঠে প্রথম। এখন ও কী বলছে বোঝা যায় না। একটু আগেই অনার্স গ্রাজুয়েট, বি. এড পাশ শিক্ষিকা হওয়ার প্রবল ইচ্ছা ফুৎকারে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।

মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বিজয়া কাঁদতে থাকে। এবার ওদের কলরোল কেবল টি.ভি’র শব্দকেও ছাপিয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়ায় অনিকেত দেখল, ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা বেজেছে। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে তখন মা-বিটিতে মিলে কান্নার রোল তুলেছে। বাইরে একদল কুকুর ডেকে ওঠে। অনিকেত মেয়ের মাথায় হাত রাখে। মেয়ে মাথাটা সরিয়ে নেয়। অনিকেত বোঝে মেয়ে তার দিকে আসতে ভয় পাচ্ছে। অনিকেত স্ত্রী বিজয়ার মাথায় হাত রাখে। সাথে সাথে কান্নার হিক্কা বাড়ে।

অনিকেত বলে, প্লিজ চুপ করবে। আচ্ছা বেশ সব দোষ আমার। আমি সংসার প্রতিপালনে অক্ষম এক অপদার্থ মানুষ।

কে কার কথা শোনে। কান্নার প্রবল হিক্কা এবার মেয়ে শ্রীপর্ণাকে সংক্রামিত করেছে। অনিকেত ওদের দুজনের মাঝখানে বসে দুজনকেই একসাথে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে।

বিজয়া বিজয়া কী হচ্ছে এত রাতে? বলছি তো সব দোষ আমার।—অনিকেত খানিকটা নার্ভাস হয়ে মেয়েকে বলে, মামনি তুমি কাঁদছ কেন? এই তো আমি তোমাকে আদর করছি।

মেয়ের কান্না থামে। ওর চোখের কোল দিয়ে জলের ধারা চিবুক অবদি নেমেছে। সে বাবাকে বলে, মাকেও আদর করো।

অনিকেত অসহায়ের মত বলে। সেই তো কতক্ষণ ধরে তোমাদের আদর করে চলেছি। এবার অনিকেত তার দুহাত দিয়ে বিজয়ার এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলগুলো গুছিয়ে দেয়। বলে, বিজয়া প্লিজ একটু আমার কথা শোনো। বিজয়ার কান্নার শব্দ থামে। সে তখনও হাফাচ্ছে। চোখের জল গালে মাখামাখি হয়ে চিবুক দিয়ে বক্ষদেশের দিকে এগিয়েছে। সে যেন চোখের জলে বুক ভাসিয়ে-মনের সমস্ত অভিমান ধুইয়ে নিয়েছে।

অনিকেত বসার ঘরে এসে টি.ভি. সেটটা বন্ধ করে মেয়ে বউকে নিয়ে ডিভানের ওপর বসে। ডানদিকে বিজয়া। বাম দিকে মেয়ে শ্রীপর্ণা। অনিকেত সমান স্নেহে দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

রাত বাড়ে বিজয়া ও কন্যাকে তখন দুই কাঁধে নিয়ে অনিকেত তখন ক্লান্ত শ্রান্ত। চোখে ঘুম জড়িয়ে এসেছে।

অনিকেত দুজনকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বলে। ঘুমুতে যাবে চল। রাত প্রায় ভোর হতে চলেছে।

অষুধ – শহীদ আখন্দ

কিছুদিন ধরে ঘটছিল কাণ্ডটা। রাতের খাবারটা কোনমতে গিলে কুলিটা মুখে নিয়েই সেই যে ঘর থেকে একলাফে নিচে নামে তারু মিয়া আর পাত্তা পাওয়া যায় না তারপর। ফেরে অনেক রাতে চোরের মতো। কপাটের উপরের ব্যাঙটা আর লাগায় না। সুরুয বানু, মানুষটা বাইরে আছে যখন কি জানি কত রাত হয় ফিরতে, নিচের ব্যাংটা বরং বাইরে থেকে খোলা যায়। চোরের মত কখন ফেরে রাতে, সুরুয বানু টের পায় মাঝে-মাঝে, টের পায়না কোনদিন। প্রথম দিকে পাত্তা দেয়নি সুরুয বানু, সারাদিন খাটে বন্ধে বাইরে, সন্ধ্যেবেলায় কোথাও একটু গিয়ে তামাক টানল, গপ্পো-টপ্লো মারল তাতে গা চুলকানোর কি আছে! কিন্তু আস্তে আস্তে ঘটনাটা কেমন চোখে ঠেকছে। মনে ঠেকছে। সন্ধ্যা থেকে এত রাত পর্যন্ত কোথায় কোন রসের এমন ভাণ্ডার আছে যে, খালি বিছানায় তাকে এমন খালি গড়াগড়ি খেতে হবে আর বার বার দরজার দিকে কোন পরিচিত শব্দের জন্য কান পেতে পেতে কাহিল হয়ে পড়ে ঘুমাতে হবে? সে জায়গাটা কোথায়? সুরুয বানু একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, খায়া কুলিটা ফালানির তর সয়না কই যাওয়ার জন্য এমুন পাগল হন, রুজ রুজ রাইতের বেলা?

উঠানে নেমে ডালিমতলায় চলে গেছে ততক্ষণে তারু মিয়া। ওখান থেকে কি রকম একটা মিনমিন করে চিবানো জবাব দিল টের পাওয়া গেল না। পরদিন সারাদিন সুরুয বানু তক্কে তকে থেকেছে ভাল করে কথাটা জিজ্ঞেস করার জন্যে ভাল করে। একটা জবাব পাওয়া পর্যন্ত বুকের ভিতরে একটা অচেনা দুপদাপকে কিছুতেই দূরে সরাতে পারছে না। কিন্তু সারাদিন তাকে একান্তে পাওয়া খুব কঠিন কাজ। শাশুড়ি আছে, দেবর ননদ আছে, আছে সারাদিন গুচ্ছের কাজ। হাঁড়ি ঠেলাঠেলি, ধান শুকানো, রকারি সাজানো। অথচ সারাটা দিন তার কিছু ভাল লাগেনি। মনে হয়েছে ডালিম গাছের পাতাগুলো হঠাৎ কবে-হলদেটে হয়ে গেছে। ধরতে ধরতে সেই রাতে খাবার সময়। ভাত দিয়েই প্রশ্নটা করল সুরুয বানু, কই যান কইলেন না?

কইলাম যে কালকে! অবাক হয় তারু মিয়া।

কি কইলেন, বুঝলাম না। ভাল কইরা কন।

আমার কথা তুমি বুঝ না?

তারুমিয়া তার বড় বড় চোখ মেলে এমন করে তাকাল, মুহূর্তে বিভ্রম হলো সুরুয বানুর। এবং তার ফলে একটু হেসে বিষয়টাকে হালকা করতে চায় সে, বলে, কথা পরিষ্কার কইরা না কইলে কেমনে বুঝব কন।

তারু মিয়া বলে, সব কথা পরিষ্কার কইরা কওয়া যায়?

ঘরে এসে আবার ঢোকে তারু মিয়া। ফিসফিস করে বলে, বাজারে নতুন এক বুড়া আইছে কবিরাজ। অনেক রকমের অষুধ জানে।

ব্যস এক কথায় সুরুয বানুর সমস্ত দ্বন্দ্ব কেটে ফর্সা হয়ে গেল। পেটের ভিতর কোন গুমর রাখতে নেই। রাখলে নিজেরও কষ্ট পবেরও কষ্ট।

কিন্তু প্রতিদিন যেতে হবে কেন? কিছু কিছু কথা কানে আসছে তার যার ফলে সমস্ত ব্যাপারটাকে আর হালকা করে দেখা যাচ্ছে না। সত্য, তাদের সাড়ে দশ বছরের বিবাহিত জীবনে কোন আনন্দ আসেনি কোলে-পিঠে। যখনই গরীব মানুষের কোন বউয়ের দিকে তাকায় সুরুয, মনটা খাঁ-খাঁ করে ওঠে। অভাগিদের এতো এতো তার একটাও নেই। পাড়ার কোন মেয়েকে বাচ্চা-কোলে দেখলে তার তলপেটে মোচড় দিয়ে ওঠে, হাত প্রসারিত হয় আপনা-আপনি। স্বামী আর শাশুড়ি বিশেষ করে এই দুজন মানুষ তাকে যত ভালবেসেছে এমন আর কেউ বাসেনি। এই দুজন মানুষ এখন যেন সমস্ত মায়া মহব্বত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। শিকেয় যত্ন করে সাজিয়েছিল যেন এক বিচিত্র সুন্দর বৈয়ম এখন কে যেন শিকে খালি করে ফেলেছে, বৈয়ম নেই। বয়সের ভারে, বাতাসের ভারে ঝুলছে ন্যাংটা শিকে।

তারু মিয়া চেষ্টা করছে করুক। কিন্তু রোজ রাতের বেলা এত রাত পর্যন্ত। কবিরাজ বাড়িতে কি করতে হয় তার?

সুরুয বানুর এখানে বিশ্বাসী মানুষ নেই। বাপের বাড়ি থেকে খবর দিয়ে একটা মানুষ আনতে হলো। মদন। বিশ একুশ বয়েস। বড় চটপটে। কাজের। বিশ্বাসী।

বাজার বেশি দূরে নয়। বাড়ি থেকে বাইরের উঠান পার হয়ে উত্তরদিকে মোড় নিলেই তো আব্বার কবর। যেখানে এলে দিন হোক রাত হোক গা ছমছম করে। তারপর বুড়ি আম গাছ। কতোকাল ওর আম খেয়েছে তারু, ওর গায়ে চড়ে, ঘাড়ে চড়ে বুকে বসে। অন্ধকারে গাছটাকে ভূত-ভূত লাগে। তারপরই জেলা বোর্ডের রাস্তা, পুবে-পশ্চিমে। না এই রাস্তায় রাত হোক বিরাত তোক কোন ভয় নেই এলাচিপুরের মানুষের। এখানে না আছে কোন গোপনীয়তা, না কোন ফাটাফাটি। দদিকের ধান ক্ষেত রোদের মতো ফর্সা। রাতে শীতল বাতাস। পশ্চিম দিকে ফার্লং খানেক হাঁটলেই হাট বাজার। শনি-মঙ্গল হাট বসে। রোজ সকালে বসে দধের হাট। আর সকাল সন্ধ্যা কয়েকটা চায়ের দোকান, একটা অষুধের দোকান হা করে থাকে। ইস্কুল কলেজের কিছু নতুন ছেলেছোঁকরা ওখানে গুলতানি মারে। অদূর যেতে হয় না তারু মিয়ার। বাজারে ঢুকতেই আগে যে একটা ঘর ছিল ছোট, হরদম মজত থাকতো নানান জাতের জিনিসপত্র। আর পঞ্চাননের হাসি মুখ, সেইটে। ঘরটা একটু বড় হয়েছে। এখন। ঘরটার সামনে দিয়ে গেলেই বিভিন্ন অদ্ভুত জিনিসের আনচান করা গন্ধ নাকে লাগে। সেই গন্ধের টানে ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করে। না, তারু মিয়া ওখানে নিজের ইচ্ছায় ঢোকেনি।

বাজার হইল বড় মানুষের পুত?

কথা শুরু করার কায়দা বটে।

হ-হ, চাচা।

তামুক খায়া যাবা একখান?

মন্দ কি? ঢুকল তারু মিয়া, ঘরটা ঠাণ্ডা। মেঝেয় খালি পা পড়তেই সমস্ত শরীর যে জুড়িয়ে গেল তা নয়, মেঝের ঠাণ্ডা পা দিয়ে ঢুকে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। এবং বিভিন্ন অষুধের মিশ্রিত গন্ধ নাকের ভিতর দিয়ে একেবারে বুকে এসে বসে গেল, মনে হলো, কোন মাতোয়ালীর নাঙ্গা বুকে তার বুক মিশল বুজি।

তারু মিয়া টুকেই বলে সরল মনে, ঘরটা ত আপনার খুব ঠাণ্ডা চাচা, মনে হয় শরীর জুড়াইল।

খিল-খিল করা বুকের পোকা-সাফ করা একটা হাসি ভিতর থেকে বের হয়ে এল তখন। কান গরম হয়ে উঠল তারু মিয়ার। একে শীতল মেঝে, তারপর কোবরেজি গন্ধের বাহার, তারপর সেই হাসি।

কন্ধেয় টিকে লাগিয়ে ফুঁ দেয় আরজান কবিরাজ। লম্বাটে মুখ, পাতলা দাড়ি, টানা-টানা তরল চোখ আর কেমন স্যাঁত-সেঁতে গলা। টানে খুব। কাটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আরজান কবিরাজ প্রশ্ন করেছিল, সুখ ও শান্তি কও, টাকা কও পয়সা কও; তদবির ছাড়া কিছু হয় না। ঘরে বইসা থাকলে কাম হয় না, তদবির করন লাগে। এই যে অত বড় সংসার, এত ধান চাউল, তুমি না থাকলে খাইবো কেডায়?

কি করুম চাচা, আল্লায় দেয় নাই।

তদবির না করলে আল্লায় কেমনে দিব? ভালা কইরা চাও তার কাছে।

অষুধ-টষুধ খাইছো কুনদিন?

অষুধ আছে? আপনার কাছে?

হাসলেন আরজান কবিরাজ। অষুধ নেই আবার! সব রোগের অষুধ আছে। সাপের বিষ আছে না? সাপের বিষ দিয়া অষুধ হয়। সেই অষুধে অমৃত পয়দা হয়। সেই অষুধে হয় না হেনো কাজ নেই। কতো মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছে তার অষুধ।

অষুধ, বিচিত্র গন্ধ এবং নেপথ্যের খিলখিল করা বুকে-তালা মারা হাসি তারু মিয়াকে বিদিশা করে ফেলেছিল। এবং আরেকদিন যখন হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় নদিনাকে দেখল আর হুঁশ রইল না তার। তার দীর্ঘ শক্ত সমর্থ ধ্বটা দেহ যেন সাপের বিষের ভারে অবশ হয়ে গিয়েছিল।

বাতাসে টিম টিম করে ঝিমানো হ্যারিকেনে কাঁপন লাগে, মাঝে-মধ্যে দপ করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু তাতে কোন সাহায্য হয় না। পর্দার আড়াল থেকে করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু তাতে কোন সাহায্য হয় না। পর্দার আড়াল থেকে মধ্যে মধ্যে নদিনা কথা বলে, মাঝে মধ্যে বলে ওর মা। কি একটা পান বানিয়ে দেয় নদিনা, নাকি তার মা, মুখে দিলে মিলিয়ে যায়। আর রাজ্যের গন্ধ; মুখের ভিতরে যেন একেবারে বেচায়েন অবস্থা। হুঁকোর গুড়ুক গুড়ুক শব্দ। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আসতে আসতে একদিন এসে দেখল কবিরাজ চাচা গেছে সদরে অষুধ আনতে। সেই কথা বলল নদিনা। দরমার দরজা ভেদ করে একেবারে দোকান ঘরে এসে হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় নদিনাকে দেখামাত্র বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে যেতে পারলে যেন শান্তি পেত তারু মিয়া, সন্তানহীন সুখি কৃষক; গরব্বিী সুরুয বানুর প্রাণের মানুষ তারু মিয়া।

কিয়ের অষুদ লাগবো কন।

কান লাল হয়ে গেল তারু মিয়ার। তাহলে জানে, কিসের অষুধের জন্য রোজ এখানে তামাক খায় এসে সে। কিন্তু চাষা-ভূষা মানুষ কি কথা কইবে সে! কথা তো কতো কিছুই বলতে চাইল, জমা রইল পেটে, কিন্তু মুখের আব্রু ভেদ করে কথাকে বাইরে আনা কী যে কষ্ট সে নদিন বুঝবে না।

–হর হর কইরা কথা কয় বাবার সাথে, আমার সাথে একটা কথাও কইতে পারে না-কি মানুষ।

ভিতর থেকে ওর মা সাহায্য করে, তুমি বইসো বাবা, নদি তামুক দে বাবারে।

তামাক নিয়ে আসে নদিনা। পান নিয়ে আসে। ওর বাবার গদিতে গিয়ে বসে। তারু মিয়া চোখ মুখ বন্ধ করে পান চিবোয় আর হুঁকোয় টান দেয়। যা একখানা শরীর কাঁপানো আরাম লাগছে না তার! তার মধ্যে কি কথা?

নদিনা আস্তে আস্তে সরল গলায় বলে, একটু বা ফিসফিসানির টান আছে গলায়, ফিসফিসানির বাতাস বুঝিবা মুখের পানের গন্ধের সঙ্গে কানে এসে লেগে যায়, বলে, অষুদে কোন কাজ হইলো?

লজ্জা নেই শরম নেই কিছুই আটকায় না তার মুখে। ওকি জানে কিসের অষুদের জন্য তারু মিয়া এখান আসে যায়?

জান? জিজ্ঞেস করবে তাকে? দূর, তাও কি সম্ভব?

নদিনাই, বলে, আবার দোষ কার, ঘরের না বাইরের সেইটা আগে বাইর করেন, বুঝছেন? তারপর জায়গা মতো অষুদ দেন। আতারে পাতারে খালি গুতাগুতি করলে লাভ হইবো না।

বলে কি! ছি ছি ছি। হুঁকো থেকে মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো যখন তারু মিয়া, দেখল অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে এক জোড়া চোখ, দেখল ঘাড় পেঁচানো শাড়ির আঁচল দুই হাতের আঙুলে কুটছে বটে, কিন্তু চোখ তার তারই দিকে ধরে কেমন রহস্যময় এলোমেলো বাউরি বাতাসের মতো উদাসকরা।

নদিনা বলে, ধরেন আরেকটা পান খান।

অনেক রাতে ও যখন ওদের ঘর থেকে বের হয়ে পথে নামল, জেলা বোর্ডের রাস্তার দুধারে ধান ক্ষেতে তখন মিঠে বাতাস। ওর লুঙ্গি উড়িয়ে নিচ্চে। পাঞ্জারি বুকে ওম দিচ্ছে কইর পাখি। একটা গান ধরল, তারু মিয়া ও জ্বালায়ে চান্দের বাতি, জেগে রব সারারাতি গো, কর কথা শিশিরের সনে ওর ভমরা; নিশিতে যাইয়া ফুলবনে। না, গলা ছেড়ে নয়, চাপা গলায়, এমন করে, যেন সে গান সে কেবল নদিনাকেই শোনাচ্ছে।

হঠাৎ ওর মনে হলো, কে যেন পেছন পেছন আসছে। পায়ের শব্দ। কে! নদিনা! অসম্ভব! মনের ভুল।

একটু পর আবার পষ্ট শব্দ। মনের ভুল নয়। দাঁড়িয়ে পড়ে, তাকায় পেছন দিকে। সাবধানে পরিষ্কার গলায় বলে, কেডায়?

একটা দলাদলা অন্ধকার কাছে এল। এসে একটা মানুষের আকৃতি নিল। চিনতে পারল না তারু মিয়া, প্রশ্ন করল একটু জোরে, কেডা?

আমি।

আমি-র নাম নাই?

আমি-র নাম মদন, আপনের শালা।

মদন!

বিস্ময়ের পার নেই। মদন, শ্বশুরবাড়ির লোক। কিছুদিন হলো তাদের বাড়িতে এসেছে। বাইরের ঘরে থাকে খায়। ড্যাবড্যাবে চোখ, উনিশ বিশ বছর বয়স কিন্তু গায়ে গতরে আছে বেশ।

তুমি মদন! কই গেছিলা?

বাজারে। বুজির লই অযুদ আনতে গেছিলাম।

এত রাত্রে? কিয়ের অষুদ?

মাথা ধরার।

এত রাত্রে?

মদন সে কথার জবাব দেয় না। পাল্টা প্রশ্ন করে সন্দেহবিহীন গলায়, আপনে কই গেছিলেন এত রাত্রে দুলা ভাই?

প্রশ্নটাকে বিশ্বাস করে না তারু মিয়া। প্রশ্নটা মিথ্যা। মাথা ধরা, অষুদ এবং এই প্রশ্ন সবগুলো ভুয়া। ফাঁকি। আসলে সুরুয বানু তার পেছনে চর লাগিয়েছে। ছোঁকরা চালাক চতুর বেশ। নিশ্চয়ই আড়ি পেতে সব শুনেছে। সুরুয বানুর কাছে গিয়ে বলবে, রিপোর্ট করবে সব। মনে মনে বিপদ গুনল তারু মিয়া। সুরুয বানুর কোন সন্তান হয়নি, এটিই তার একমাত্র দোষ, ওর আর সব গুণ। বড়লোক বাপ, অঢেল সম্পত্তি। একমাত্র মেয়ে। বাপ মরলে সব সম্পত্তি এই সুরুয বানুর। এটা খুব হাল্কা চিন্তার কথা নয়। অবশ্য সম্পত্তি তারু মিয়ারও আছে অনেক, তা থাকলেই বা। আছে বলে আরও হবে না কেন? আরও হবে, সঙ্গতভাবে যা পাবার সব পবে। তবে, কোন ওয়ারিশ যদি না থাকল তাহলে কার জন্যে করবে এত সম্পত্তি? আর এটা কি রকম কাজ হলো? সুরুয বানু তার পেছনে নোক লাগিয়েছে।

প্রশ্ন করে তারু মিয়া, আসল কথাটি কি মদন?

মদন চুপচাপ পেছ পেছ হাঁটতে লাগল। মদনকে তার পেছনে লাগানো হয়েছে, এটা সে টের পেয়েছে, এটা সে পছন্দ করছে না, এসব কথা এই মুহূর্তে মদনকে বলা হবে কিনা ভাবল খানিক তারু মিয়া। মদনকে সে সাবধান করে দিতে পারে, ভবিষ্যতে যদি তার পেছনে পেছনে আসতে দেখে তাহলে দুটো পার একটাও আস্ত থাকবে না, কিন্তু, এতো তাড়াহুড়ো করে কিছু করা ঠিক হবে না। বিষয়টা ঘোলাটে হোক তা সে চায় না। বরং ভালয় ভালয় এর শেষ দেখতে চায় সে।

মদন?

জি দুলাভাই?

আমাকে পাহারা দেওয়ার লাগি পাঠায় তোমার বুজি?

জে, রাইতে আন্ধাইরে কত কি হইতে পারে ত, তয় বুজি কয় থাকিস মদনা তানির লগে লগে।

২.

কোন ওজর-আপত্তি অশ্রুর মিনতি, চিৎকারের শাসানি টিকল না। নদিনা ভর বয়সী, মাছের মত শক্ত আর পিচ্ছিল শরীর, বেহায়া যৌবন আর আদরের রসে ভেজাগলা নিয়ে তারু মিয়ার সংসারে প্রবেশ করল, তারু মিয়ার কোন উপায় ছিল না। পৃথিবী একদিকে থাকলেও অন্যদিকে থাকতো নদিনা আর তারু মিয়া। আরে জীবনে সুখই না পেলাম তো কি দরকার সে জীবন দিয়ে। তাছাড়া, একটা অজুহাত যখন আছেই। অজুহাত, আবার ভয়। বাইরে সে যতই বলুক সে কাউকে পরোয়া করে না, সে নিজের বংশরক্ষার জন্য যা ভালো মনে করেছে তাই করেছে, ভিতরে ভিতরে ভয়টা ছিলই। সুরুয বানুর সঙ্গে তার অন্যরকম সম্পর্ক। অভ্যাসের সম্পর্ক, সংসারের সম্পর্ক, সুরুয বানু, এ সংসারে নেই একথা তার পক্ষে চিন্তা করা কঠিন।

ভাবনা ছিল, নদিনাকে সুরুয বানু গ্রহণ করবে না, কিংবা দু’জনে খুব লাগবে। বলে না দুষ্টলোকে কারো সঙ্গে দুশমনি থাকলে তাকে দুই বিয়ে করিয়ে দাও? সেরকম অশান্তি হবে ভেবেছিল। দু’জনের ঝগড়ার ঠেলায় বাড়িতে কোন কাক আসবে না, কুকুরগুলো ভেগে যাবে। এ গাছ লাগাবে তো সে গাছ কাটবে। এ শুকাবে তো সে ভিজাবে। এমনি।

কিন্তু না, সুরুয বানু সেদিন দিয়েও গেল না।

বরং ছোটবোনকে যেমন, তেমনি নদিনাকে বরণ করে নিল। ওক বলল, তুমার কি দোষ? তুমি তো তুমার সংসারে আসছে। দোষ আমার, আমার কপালের। লক্ষ্মী হইয়া আসছে, লক্ষ্মী হইয়া থাকবা।

কিন্তু তারু মিয়ার সঙ্গে কোন কথা নেই তার। তার দিকে ভুলেও তাকানো নেই। সংসারের কোন কথা নেই।

শাশুড়ি বানেছ। বিবি কেবল মাথা চাপড়ান, আমার সুখের সংসার আছিল, কি শাস্তি আছিল, সংসারে এখন শয়তান আসছে আমি টের পাইতাছি। কপালে শাস্তি না থাকলে জ্বর কইরা মানুষে শান্তি পায়?

তিনি কি যে দেখেছিলেন সংসারে, কিসের ছায়া তা তিনিই জানেন।

এমন করে আদর দিল নদিনাকে সুরুবানু সে গলে গেল। সবাই অবাক হলো, অবাক হওয়ার কথা। জিনিসটা অস্বাভাবিক, বড় সতীনের জান হয়ে গেল ছোট সতীন এটা কে কবে কোথায় শুনেছে। কিন্তু এই কথাটি কারো মনে ঢুকল না। বাইরের চেহারা দেখে মানুষ বিচার-আচার করে বটে।

৩.

আরজান কবিরাজ মদনকে পাত্তাই দিল না। তার মতো পোলাপানের আবার সাংসারিক সমস্যা কি? মদন বলল যে বিষয়টা তার নয়, তার বোনের। বোন তো পর্দানসীন, তায় অনেকদূরে বাড়ি। তার পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে অসুখ তার নয়, অসুখ তার বোনের। আরজান কবিরাজ বলল, যার অসুখ তাকে আসতে হবে, রোগী। না দেখে অযুদ কিসের?

মদন নাছোড়বান্দা, বলল, সকলেই বলে, আপনে বড় ভালো কব্রিজ। এখন বুঝতেছি কেন আপনের এত নামডাক।

হাসল আরজান কবিরাজ, বলল, বুঝতাছে?

হ।

তাহলে যাও, বইনরে লইয়া আস গিয়া।

মদন একটু ইতিউতি করে। বলে, আমার নিজের একটা অসুখ আছে।

কি অসুখ?

মদন লজ্জা পাওয়ার ভান করে। তারপর সঙ্কোচ করে। যেন কিছুতেই কথাটা মুখ দিয়ে রে হচ্ছে না। কব্রিজ উৎসাহ দেয়, বলে, কও কইয়া ফালাও।

শরম লাগে।

অসুখ নিয়া শরম কি? কও।

পকেট থেকে একটা একশ টাকার নোট বের করে দেয় মদন। সঙ্গে সঙ্গে প্রসন্ন হয়ে ওঠে কব্রিজের চেহারা। দ্বিগুণ উৎসাহে হুঁকোয় টান দেয় আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখ ছোঁকরাকে। নিশ্চয়ই ভালবাসার অসুখ। কাউকে সমস্তটা মন দিয়ে আছে কিন্তু তার মন পাচ্ছে না। এই বয়সে কবিরাজ প্রশ্ন করে, কাউকে ভালবাস?

মাথা দোলায় মদন।

সে তুমারে বাসে না?

বাসে।

তবে?

আরেকজন আছে। সে থাকতে আমার কোন আশা নাই।

তারে কি করতে চাও?

মদন বলে, সে জন্যই ত আপনার কাছে আসছি।

কবিরাজ অনেকক্ষণ চিন্তা করল। নতুন তামাক ভরল। টিকা লাগিয়ে ফু দিল। তামাকের ধোঁয়ার ভুরভুর গন্ধে ঘর ভরে গেল। আবার নতুন উদ্যমে বেশ কয়েকবার ঘন ঘন টান দিলে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যেন অনেক দূরের কি দেখলে।

বললে, তারে সুরাইয়া দিবা একেবারে?

জে?

কিন্তু–

গলার স্বর নামিয়ে আনল কবিরাজ আরজান, কিন্তু তাতে অনেক খরচ হবে, অনেক বিপদ।

মদন পকেট থেকে আরো একশ টাকার একটা নোট বের করে হাতে দেয়। কবিরাজের চোখ চকচক করে ওঠে।

বলে, ওর সাথে খারি দিবা। দাওয়াত কইরা খাওয়াইবা। প্যাঁচা আছে না? পাচার কলজা খাওয়াইবা।

খাওয়াইলে?

ব্যস। সাবধান, কেউরে কইবা না। কইলে তুমিই বিপদে পড়বা। আমি তুমারে চিনি-টিনি না। যাও।

৪.

কোনদিক দিয়ে যে সময় বয়ে যায়। আজকে কালকে করতে করতে কেমন করে একটি বছর পার হয়ে যায়, কেমন করে সহ্যের সীমা আর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়ে নিজেই দড়ি নিয়ে ঝুলে পড়বে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে বসে সুরুয বানু, নিজেই টের পায় না। নদিনার পেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকে অধৈর্য হয়ে যায় তারু মিয়া, বানেছা বিবি। প্যাচা ধরা সে যে কী ভীষণ কঠিন কাজ তা হাড়ে হাড়ে জানে মদন। এর মধ্যে ওকে আর ছেলেমানুষ লাগে না, পুরু গোঁফ প্রায় মুখ ঢেকে ফেলেছে। প্যাচার কলিজা খাইয়ে এমন একটা সোনার টুকরো মানুষকে মারবে, যতই সে ভাবে আর। নদিনাকে দেখে, নদিনার জন্যে একটা কাঁচা কচি মায়ার ভাব তার বুকে ভিতর কান্নাকাটি শুরু করে। একটা মানুষকে কেমন করে মারবে সে যেখানে নিজেই সে মরে আছে। নদিনার কথারও কোন ট্যাকসো নেই। সেদিন তাকিয়ে ছিল তার মুখের দিকে অনেকক্ষণ, ও যে কেমন করে ওর অমন বাণ-মারা চোখে বিদ্ধ করে, হু হু করে তখন বুক কেঁপে উঠল, ওকে প্যাচার কলজে সে খাওয়াতে পারবে না, তখনই নদিনা ওকে এক অসম্ভব লোমকাঁপানো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসল, অমন আর কতদিন খালি তাকাইয়া থাকবা? এবং তখন মদন একটু সাহস করে প্রশ্ন করল, আর কি করব? নদিনা মাথা সোহাগভরে মৃদু নাড়িয়ে চোখে ঢেউ তুলল এবং একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল ক্যান আর কিছু করার নেই? সব রোগের দাওয়াই আছে, খালি আমার রোগের নেই।

সুরুযবানু ওকে আবার পাঠাল কবিরাজের কাছে। প্যাচা যোগাঢ় করা খুব কঠিন কাজ। উনি পোকার (ছোট্ট অণুর মতো কালো পোকা বর্ষাকালে মশার মতো। কামড়ায়) নয় মণ দুধও হবে না রাধাও নাচবে না। মদন আবার যাক, সহজ কোন অযুদ আছে কিনা জিজ্ঞেস করে আসুক। টাকা যতো লাগে, সে দেবে—আর না হয় যদি এমন কোন দাওয়াই হারে কাছে থাকে খেলেই ঘুম আসে, আর ভাঙে না সে ঘুম সেই দাওআই যেন দিয়ে দেয়, সে নিজেই খেয়ে নেবে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গেছে সুরুয বানুর। বুজি তারা সারা রাত ঘুমায় না। কান্দে। সোনার শরীর কি হয়ে গেছে। না, আত্মীয় নয় পাড়ার ছেলে মদন কিন্তু সুরুয বানুদের সঙ্গে এমন একটা বংশানুক্রম সম্পর্ক সুরুবানুদের জন্য চিরকাল প্রাণ দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকেছে। মদনরা। সেই কথা বুজিয়ে দেখে মনে এল মদনের, নবীন যুবক মদন। সেদিন ভোরে যখন ওরা সবাই আবিষ্কার করল বাড়িতে তারু মিয়ার এক বছরের পুরনো নতুন বিছানায় নদিনা নেই, মদন নেই, তখন অনেকদিন পর স্বামীর সামনে এসে দাঁড়াল সুরুয বানু। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো সহজ সুরে বলল, একটা মানুষ পালাইয়া কই যাইবো। আপনে লোক পাঠান, যেখানে পায় ধইরা আনবো।

তারুমিয়া কথা শুনে চমকে উঠল। এই একটি বছর একবারও সুরুয বানুর কথা, সুরুব্বানুর মনের কথা ভাব্বার কথা মনেও আসে নি। সে যে ভিতরে অনেক নিদারুণ কষ্ট পেতে পারে সেকথা একবারও মনে আসেনি। সতীনকে ছোট বোনের মতো আদর করেছে তাতেও অসঙ্গতি দেখেনি। কিন্তু নদিনার চলে যাওয়ায় তার খুশি হওয়ার কথা নয়? কিন্তু ও কোন্ কথা বলছে সে?

তারু মিয়া বলল, যে চইলা গেছে তারে ধইয়া আনলে তুমি খুশি হইবা?

সুরুয বানু বলল, আমি অই বা না হই আপনে তো খুশি হইবেন। ব্যাস তাইলে হইলো। আপনের সুখ ছাড়া আমার আলাদা কুন সুখ নাই।

এর জবাব তারুমিয়া দিনের বেলা এত মানুষের ভিড়ে দিতে পারেনি কান্নার মতো যে মহব্বতের দলাটা সমস্ত শরীরে জমেছিল, তাকে নামিয়ে দিল রাত্রে দুজনে একসঙ্গে। নামাজের পরে অবসন্ন কন্ঠে তারু মিয়া বলল, আমরা দুজনেই শহরে যাব, ডাক্তার দেখাব, কতো জাতের অষুদ বাইর হইছে আজকাল। ডাক্তার পরীক্ষা কইরা কইতে পারবো, কার দোষ।

তখন সুরুয বানু ভাল একটা প্রশ্ন করল, যদি আপনের দোষ থাকে, তাহলে? তাহলে আমি অষুধ খাব।

অষুধ যদি না থাকে?

তারু মিয়া ওকে আবার জড়িয়ে ধরে। সত্যিই কিইবা আর করতে পারে সে।

অস্থির অশ্বক্ষুর – আবদুল মান্নান সৈয়দ

স্যার, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিলো। মেয়েলি কণ্ঠে থমকে দাঁড়াই। তাকিয়ে দেখি একটি ছাত্রী, আমারই। বুক কি একটু কেঁপে ওঠে না? এখনো ঠিক অজর অক্ষর অধ্যাপকে পরিণত হই নি তো, একটু হাওয়া দিলেই কোথায় বাঁশপাতায় কাঁপন ধরে। সেই কাঁপন যথাসম্ভব আড়াল করে, স্বাভাবিক গলায় বলি, কী, বলুন। ছেলেদের সঙ্গে ‘আপনি-তুমি’ এলোমেলো করে ফেলি, মেয়েদের সঙ্গে অদ্বিধ ‘আপনি’ ছাড়া আর কোনো সম্বোধন আসে না আমার। কোনো-কোনো সহকর্মী অধ্যাপকের মতো মেয়েদের সঙ্গে অনায়াসে তুমি বলতে পারি না।

আপনি তো, স্যার, নজরুলগীরি ভক্ত। আমি একটু-আধটু নজরুলগীতি গাই–কাল সকালে রেডিওতে আমার প্রোগ্রাম আছে একটা, আপনি যদি শোনেন—

বাহ–নিশ্চয় শুনবো বাহ, খুব ভালো তো–ততোক্ষণে আমার ভেতরের কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। মেয়েটিকে চিনি, বিবি ডাকনাম, তা-ও কবে যেন কীভাবে জেনেছিলাম; ভালো নাম আফরোজ জাহান। সকাল সাড়ে-আটটায় এদের সঙ্গে ছোট একটি ক্লাস ছিলো আমার। তারপর সারাদিন মুক্তি। তখনো কলেজের মাঠে ভোর বেলার সুঘ্রাণ লেগে আছে, কলেজের পুরনো বিশাল বিল্ডিংয়ের উপরে রোদ এখনো কাঁচা তাজা স্বচ্ছ স্নিগ্ধ রল সোনালি, বহুদিনের পুরনোর ওপরে নতুন সূর্য এসে পড়েছে।

২.

বুকের ভেতরে কবিতার ছেঁড়া উড়ো পঙক্তিমালা ঘোরে। আর কিছু নয়, ঘুরে-ঘুরে আজ মাত্রাবৃত্তে বাঁধবো তোমাকে, এই একটা লাইন ঘূর্ণিহাওয়ায় এক টুকরো কাগজের কুঁচির মতো কেবলি উড়ে-উড়ে ঘোরে। দিনরাত্রি রক্তের ক্ষরণ / এইখানে রাখো দেখি সিগ্ধ শাদা গভীর চরণ’— মেঘমেঘালির মধ্যে ওড়ে শাদা চাঁদ, অফুরন্ত মেঘমেঘালির মধ্যে এই ক্ষীণ শাদা চাঁদ। একা হতেই ক’একটি শব্দ মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে। মনে পড়ে বিবির চোখ যেন কলেজের কঠিন বিল্ডিং ও বাস্তবতার বাইরে অন্য কোনো দিগন্তের নীল আভাস দিচ্ছিলো; যেন তার কণ্ঠে লেগেছিলো না বলা বাণীর আভা।

৩.

আম্মা বললেন, মন্টু, দিলিনে এ মাসে?

দিচ্ছি শিগগিরই।

কবে আর দিবি। মাসের অর্ধেক হয়ে গেলো। সংসার কী করে চলে, তা তো বোঝে না। চালের দাম বেড়েছে আবার, তার খোঁজ রাখো? আমার হয়েছে যতো জ্বালা। দিনরাত কবিতা লিখলে কি আর সংসার চলে?

আমি হাসি, আম্মা, মনে আছে আপনার প্রথম যেদিন টেলিভিশনে কবিতা পড়লাম? বাড়িশুদ্ধ কী উৎসাহ আপনাদের সবার। আর এখন…।

আশ্চর্য, আম্মা হাসেন না তারপরও, কঠিন মুখ করে রাখেন। আমিও ভেতরে ভেতরে তিক্ত হতে থাকি। সময়, আমার সময়। বেলা হলে সমস্ত শিশির যায় শুকিয়ে। জীবন, ওগো জীবন।

৪.

বিবির মা বাপ সৌজন্য সাক্ষাৎকার সম্পন্ন করে চলে গেলে আমি ভেতরে-ভেতরে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। বিবির ছোট একটি কৌতূহলী ভাই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো, বিবি কোথায় তাকে সরিয়ে রেখে আসে। এতোক্ষণ পর আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠি। আমি সিগারেট খাই না, বু একটা খেতে ইচ্ছে হয় এখন। শাড়ি পরে নি আজ বিবি, লতাপাতায় আচ্ছন্ন পাজামা কামিজে ওকে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। সব মিলিয়েই ওকে আজ ‘তুমি’ বলে ফেলি।

আমি কিন্তু ভাবি নি, স্যার, আপনি শেষ পর্যন্ত আসবেন। বিবি বলে। তার মুখে এক ধরনের সুশাস্তি খেলে যায়।

চলে এলাম। আমি কিন্তু সহজে কোথাও যাই না। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে তো যাই-ই না, বন্ধুবান্ধবের বাড়িতেও খুব কম।

আমি জানি।

তবু তোমাদের বাড়ি কেন যে চলে এলাম হঠাৎ।

বিবির মুখে প্রত্যাশিত খুশির বদলে প্রশ্ন কীর্ণ হয়ে উঠলো। দ্রুত জিজ্ঞেস করলো, কেন, খারাপ লাগছে?

না—বাহ–খারাপ লাগবে কেন? বিবির মুখে লু কীরকম বিমর্ষ সৌন্দর্য। ভেবেছিলাম, ওকে হাসিখুশি দেখাবে খুব। তা না। তবু ওর ভেতরে যে একটা হিরে জ্বলছে, তা-ও বোঝা যায়।

বিবি দাঁড়িয়েই থাকে। সোফা ধরে একটু আলগা হয়ে। আমি বসে থাকি। কী বলবো, ভেবে পাই না। উঠে, একটা বুক-কেসে কিছু বই ছিলো, দেখি। একেবারে সাধারণ বই-টই। তারপর দু-চারটে মামুলি কথা হয়। পড়ার বইটই-এর ব্যাপারে একটু পরামর্শ দিই। জেনেও বিবি আবার জিজ্ঞেস করে নেয় কলেজ কবে খুলবে।

যাবার সময় সত্যিই বিবিকে বেশ বিমর্ষ লাগে। বলে, এর মধ্যে আবার একদিন আসবেন তো, স্যার, কলেজ বন্ধ থাকতে-থাকতে?

দেখি।

দেখি কেন, আসবেন স্যার। আসবেন। একটু কি কাকুতি ফুটলো বিবির গলায়? যেমনই দেখাক তাকে, একেবারে বাচ্চা মেয়ে সে না–কিন্তু আবদারে বোধহয় সব মেয়েই ছোটো খুকিটির মতো হয়ে যায়।

সরাসরি আর ‘না’ করতে পারলাম না, এমনকি নৈর্ব্যক্তিক সুরেও না। বললাম— হয়তো একটু ইতস্তত করেই, কিন্তু ভদ্রতা বাদ দিয়ে নয় বললাম, তুমি একদিন এসো। বিবি কি জানে না, ঘরে তরুণী স্ত্রী আছে আমার? বিবি কি জানে?

আমার কথা থাক। আপনি এর মধ্যে আর একদিন আসছে। সব মেয়ের মধ্যেই কীরকম একটা শান্তির সুর— অঙ্কের শাস্তির সুর লেগে থাকে। আমি তো কোনোদিন পারি না। মিনাকেও দেখি। আশ্চর্য শান্তি ও সুরসাম্য। সকাল থেকে রান্নাঘরে, দুপুরে যথারীতি যথাসময়ে স্নানাহার করে রেডিওর কমার্শিয়াল সার্ভিস শুনতে-শুনতে চুল এলিয়ে ফ্যানের হাওয়ায় ঘুমিয়ে পড়া। আমি পারি না। একটা সফল দিন যাপনের পরেও, দেখি, আমার চোখে ঘুম নেই, ঘন্টার পর ঘণ্টা নিদ্রাহীন চলে যায়, কবিতা লিখতে লিখতে ঠিক শব্দ খুঁজে না-পেয়ে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে হয়, আবার একটি কবিতা লিখে শেষ করে তৃপ্তিময় পড়তে-পড়তে দ্বিতীয় কবিতার কাঁটায় বিধে ভেতরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। এই সবই ভেবে নিলাম এক মুহূর্তে।

বেরিয়ে আসার সময়েও বিবি যখন বলে আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো, স্যার— তখন ধক করে ওঠে বুকের ভেতরে। অসম্ভব-বেদনায় আর অসম্ভব-আনন্দে বিহ্বল হয়ে ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে আসি।

৫.

ধবল অশ্বের মতো দিন। বছর ফুরিয়ে আসছে। চৈত্র শেষ হাড়ে হাড়ে সূচিত হয়ে গেছে। লাইব্রেরিতে গিয়ে ঠাণ্ডায় বসে থাকি। ম্যাগাজিনের পাতা পাল্টাই। বিদেশি কবিতার সুস্বাদ রঙিন শরবতের মতো পান করি। বিদেশি কাগজের ঘ্রাণ নিই সোফার আরামে ডুবে গিয়ে। আমার পাশে একটি কিশোর লুকিয়ে ম্যাগাজিনের পাতা থেকে ব্লেড দিয়ে এক নিতম্বিনীর ছবি কাটছে। আমি আড়চোখে দেখি। একটুও উত্তেজিত হই না। মুচকি হাসি। কবিতার শব্দে মৌমাছির মতো উড়ে-উড়ে বসে আমার চোখ। তিরিশ পেরিয়ে এসে আস্তে আস্তে জীবনের সবকিছু, নিরুত্তেজ শান্তিতে দেখতে পাই, অনেকটা মেয়েদের মতো নিরুত্তেজ শান্ত নির্মোহ দৃষ্টিতে, নিরাসক্ত নক্ষত্রের মতো। বয়সের দান? তবু পুরোপুরি সুস্থ ও শান্ত হতে পারছি কই। ভেতরে ছুটছে ঘোড়া, কবিতার শব্দ থেকে শব্দে তার খটাখট খটাখট শব্দ উঠছে, বুকের নক্ষত্র অব্দি ধুলো উড়ছে।

হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। পৃথিবীর আদিম আঁধার নেমে আসে সভ্যতার কেন্দ্রমণি এই গ্রন্থাগারে। নিউইয়র্কের হাজার-হাজার আলো-জ্বলা রাত্রিতে ব্রাজিলের গভীর অরণ্যের অন্ধকার। হঠাৎ সচেতন হয়ে উঠি, এতোক্ষণ তাহলে একটা ধ্বনিময়তার মধ্যে ছিলাম। আমি চলে যাবার পর এমনিভাবে কি জেগে উঠবে আমার লেখা? তারপরই নিহিত ঝিঝিদলের ঝংকার শুরু হয়ে যায়। আলো জ্বলে ওঠে। ওদের নিজস্ব জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তখন কোথায়?

৬.

পিকনিক করতে গেছি কোন্ দূর বনে। আমরা ক’জন। ডালিয়া একসময় চলে আসে ভিড়ের ভিক্স থেকে আমার পাশে। কলাগাছের দঙ্গলে অন্ধ চামচিকে ঘোরে। ওমা! ডালিয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে। কলাগাছের বনে ওড়ে অন্ধ চামচিকে।

৭.

চৈত্রমাস হা-হা করছে নগরীর পথে-পথে।

বিবি আর আমি গিয়ে বসি আইসক্রিমের ঠাণ্ডা দোকানে। মেয়েদের নিয়ে বসবার ভেতরের রুমটায় দুটি ছেলেমেয়ে এমন ভঙ্গিতে বসে যে, বাধ্য হয়ে বাইরে বসতে হয়। দুপুরবেলা এখন ভিড় নেই।

এখানে আবার কেউ দেখবে না তো? কেন তোমার ভয় লাগছে নাকি?

আমি সকৌতুকে জিজ্ঞেস করি।

না, আমার কী। আপনাকে নিয়েই তো ভয়। আপনি আবার, স্যার, অধ্যাপক মানুষ। কে কোথায় ছাত্র-টাত্র দেখে–।

ওরকম ভয় যে নেই, সত্যি কথা যদি বলতে হয় তাহলে তা আমি বলতে পারি না। ভেতরের রুমটায় বসতে পারলেই ভালো হতো। কিন্তু যা অবস্থা। আইসক্রিম খেতে-খেতে বারবার ভেতরে গিয়ে পড়ছে চোখ ভালো করে তাকাতে পারছি না। ছেলেটা বসে বসে কী করছে, কোথায় হাত দিচ্ছে জানি না, কিন্তু মেয়েটা বসেবসেও বারবার পা-টা লম্বা করে শুয়ে পড়ার মতো করছে। শীৎকারের ধ্বনি কি ভেসে এলো একবার? আমি তো ভাবতেই পারি না। ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়ে নাকি? প্রেমিক প্রেমিকা নাকি? আমরাও তো একসময় ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে শুধু বুকের ভেতর না, পা অব্দি কাঁপতো।

বিবির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ওরও চোখমুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। ওর সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক না, যে, এই নিয়ে একটু ঠাট্টা করতে পারি। কেমন অস্বস্তি বোধ করছিলো, আইসক্রিম খাওয়া হতে বললো, “চলেন, স্যার, যাই’। বাধ্য হয়ে উঠতে হলো আমাকে।

৮.

শুয়ে আছি। দেখি, রান্নাঘরের কাজের ফাঁকে ঘরে এলো মিনা, এরকম মাঝে-মাঝে আসে, আঁচল হলদে দাগ, আধ-ময়লা, মুখ ঘামে তেলতেলে, চুল রুখু। খুটখাট করে কী কাজ করে ঘরের মধ্যে। একবার দেখে আমি আবার বই-এর মধ্যে ডুবে যাই।

ও, এই শোনো, একদম ভুলে গিছলাম, গা ঘেঁষে বসলো খাটে, আমার পাশে। আচ্ছা, সত্যি করে একটা কথা বলবে?

বলো না।

ঠিক বলবে কি না, বলো–

আহা, তুমি দেখছি একেবারে প্রেমিকার মতো গা ঘেঁষে আদুরে গলায়–

সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে বেরিয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, আমার বলা উচিত হয় নি। সত্যি, আমিই না কতো মধুভাষী বিবির কাছে। কী যেন কেন, মিনার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, ভেতরের বিরক্তি আর অনীহা চেপে বসে কথায়, কথায় সুরে। অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ নেই? নিজেরই খারাপ লাগে শেষে, গ্লানি হয়। তখন বারবার খোশামোদ করি আবার। উঠে গিয়ে মিনাকে কাছে এনে বসাই।

শেষে নরম হয় মিনা, স্বাভাবিক হয়, হাসিখুশি মুখে বলে, আচ্ছা, ডালিয়া মেয়েটি কে সত্যি করে বলবে আমাকে? চোখেমুখে কৌতুক আর কৌতূহলের দ্যুতি ঠিকরে পড়ে মিনার।

বসন্তের ছুরি এসে পৃথিবীর মমতলে বিধলে তার যে চিৎকার জ্বলে ওঠে পলাশে আর কৃষ্ণচূড়ায় তেমনি আমূল রক্তিম চমকে উঠি। মুখে ঠিক হাসি টানতে পারি না, কে–কই আমি তো চিনি না!

নাহ, চেনে না— মেয়েলি ভঙ্গিতে হেসে ওঠে মিনা, ঘুমের মধ্যে ডালিয়া ডালিয়া বলে সে কী দীর্ঘশ্বাস!

যাহ! কী বলো! ভেতরে-ভেতরে অবাক হচ্ছিলাম, এখন বুঝলাম কী করে নাম জানলো মিনা, কিন্তু লজ্জায় আমার মুখ-চোখ লাল হয়ে যায়। হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে মিনা রক্তোচ্ছাসে সোনালি ফরসা মুখ ভরে যায় ওর, ওকে এমন হাসতে কোনোদিন দেখি নে, গভীর হাসতে হাসতে চোখে পানি এনে ফ্যালে। শল্যবিদ্ধ আমি মুগ্ধ তাকিয়ে থাকি।

৯.

ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে স্টাডি ট্যুরে গতবছর গিয়েছিলাম কক্সবাজারে। একদিন হুহু বাতাসে একজনের ডাকনাম রেখে দিয়েছিলাম। সবার অজ্ঞাতে একদিন বালির ওপর একজনের ডাকনাম লিখেছিলাম ওরই চোখের মতো বড় বড় হরফে। একদিন সারারাত সমুদ্রমেশিন শুধু একজনের ডাকনাম বুনে গিয়েছিলো— মোটেলে বিশাল কক্ষে নিদ্রাহীন নিশা ব্যেপে তার শব্দ শুনেছিলাম। একদিন বনঝাউ-এর বীজ-এর মতো আমার সমস্ত সৈকত ধরে উড়ে-উড়ে গিয়ে পড়েছিলো একটি নাম।

১০.

রাতে, কারফিউ শুরু হওয়ার আগে-আগে ফিরি আড্ডা দিয়ে। আমরা কজন কবিবন্ধু শক্রর অধিক বন্ধু শস্তা রেস্তোরাঁকে মাৎ করে, কাপের পর কাপ চা খেয়ে, ফিরি রোজ রাতে যতোটা রাত করা যায়। ঘুরেঘুরে আসে বিদেশি কটি নাম, বাঙালি কটি নাম, শব্দশাস্ত্র, ছন্দশাস্ত্র গভীর মন্থন করা চলে। ফিরি যখন, শেষ বসন্তের হাওয়া চলছে রাস্তায় রাস্তায়, ছেঁড়া পাতা:আর ঝরা পাতা আর ছেঁড়া কাগজ আর টুকরো চাঁদ ফাঁকা রাস্তায় রাস্তায় বেজে ওঠে নর্তকীর মতো। আমার কানে পাওয়ার হাউসের স্বর ময়ূরের পালকের মতো খুঁজে আছে। আমার কণ্ঠে কবিতার দুটি পঙক্তি বারবার আবৃত্ত হয় : তোমাকে আমার চাই ক্রমাগত অসিত কুকুর। ভিতরে কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায়।

সারা বাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে। দরোজা খুলে দ্যায় কাজের মেয়েটি। অকারণে হাসে কেন-যেন। যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি, মাঝে-মাঝে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরলে পা যেমন টলটল করে, সমস্ত চেনা যেমন টলমল করে, মাথায় ভিতরে যেমন ভূমিকম্প হয়, আস্তে-আস্তে কবিতার লাইন যেমন অনন্ত থেকে চলে আসে, মুঠোর মধ্যে সূর্য, কন্ঠে চাঁদ— তেমনি, আশ্চর্য, মদ না খেয়েই যেন কী একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যেন আবৃত্ত হতে-হতে তোমাকে আমার চাই ক্রমাগত অসিত কুকুর / ভিতরে আমার কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায়, এই লাইন দুটি পরিণত হয়েছিলো এক গভীর ইদারায়, যার ভিতরে লাফ দিয়ে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আমি। মেয়েটার হাসি যেন সেই ইদারার মুখ মুহূর্তে বুজিয়ে দ্যায়, মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে আসি। আশ্চর্য, মেয়েটাকে কোনোদিন ভালো করে দেখি নি। এখন আশ্চর্য হয়ে। দেখি ঈশ্বর-রচিত এক প্রাকৃতিক ভাস্কর্য : ফুলকপির মতো স্তন, বাঁধাকপির মতো পাছা। কবিতার শব্দগুলি যেন ঘাসের মধ্যে এদিক-ওদিক নিঃশব্দে লুকিয়ে পড়ে। আমি নিজের ঘরের উদ্দেশে চলে যাই।

১১.

রাত্রিবেলা জেগে ওঠে আমার ঘর— নিঃশব্দায়মান। টেবিল ল্যাম্পের আলোর বলয়ে এসে বসতে না বসতেই কোত্থেকে চলে আসে মায়াবীর মতো জাদুবলে চারটি নিবিড় পঙক্তি :

‘তোমাকে আমার চাই’ ক্রমাগত অসিত কুক্কুর
ভিতরে আমার কাঁদে রৌদ্রের অধিক পূর্ণিমায় :
‘তোমাকে আমার চাই’ এই কান্না রাত্রিনীলিমায়
স্বপ্নে চড়ে ঘুরে-ঘুরে উঠে যায় দূর–বহুদূরে।

লাইনগুলি লিখে ফেলতে দেরি হয় না আমার।

সব বদলে যায় রাত্রিবেলা। ফ্যান ঘুরছে না তো, যেন মনে হচ্ছে গলায় দড়ি বাঁধা হরিণের ক্রমচক্কর। ব্রা-খোলা মিনার স্তন দুটি বাল্বের মতো দীপ্যমান, তার আলো একটা নীলাভকালো গোলাপের পাপড়ির ওপর পড়ে থাকে। আমার ঘরের সবুজ ডিসটেম্পার করা দেয়াল দেখে মনে হয় যে আমি দোতলা অরণ্যশিবিরে আছি। যেন ওআর্ডরোব দুটি ডানা মেলে উড়ে যেতে চায় বিশাল প্রাচীনকালের পাখির মতো। ছাদের ওপর বাতাসে পাতা গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ বাজে নাচিয়ে মেয়ের পদসঞ্চালনের অতিদ্রুত বৃষ্টির মতো।

আহ, কতো টুকরো-টুকরো বিভক্ত হয়ে গেছি আমি। দিনের টুকরো, রাতের টুকরো, বাস্তবের টুকরো, স্বপ্নের টুকরো। টুকরো লাইন ছাড়া আমার দেবার আর কিছু নেই। এমন করে নিজেকে আত্মবিভক্ত আর কে করেছে? আমি তো ঈশ্বর নই, টুকরোগুলো জোড়া লাগাবো কী করে। নিজের জন্যে করুণার জল এসে যায় আমার

ওকে শাস্তি দাও— ওকে শাস্তি দাও ওকে শাস্তি দাও–
ওকে…
যে কাঁদে বিনিদ্র রাতে আমি ওকে করেছি আলাদা,
শিল্প রচা অন্য-আমি বিদেশী দূরত্বে আছি বাঁধা,
ওকে তুমি শাস্তি দাও, আমি ডুবে থাকি তীব্র শোকে।

অনন্তই হয়তো জীবনে–যদি একজনের কেন্দ্রে স্থিত হতো জীবন। নাকি এই আমাদের নিয়তি?

জানালা দিয়ে চোখে পড়ে, আকাশে চাঁদ উঠেছে একগুচ্ছ সাগরকলার মতো জ্বলজ্বলে সোনালি-হলুদ। তার দিকে তাকিয়ে থেকে চোখে একফোঁটা পানি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি একসময়।

১২.

মাঝরাতে কি গভীর বৃষ্টি নেমেছিলো? হরিণেরা জলপান করতে এসেছিলো মানুষের তৈরি লেকে? মনের মধ্যে একটি মুখের মতন সেই বৃষ্টিতে ভেসে যায়। ছাদের ওপর ঝিমিয়ে আসে জীবনের গহন নর্তকী। যেন নিশি-পাওয়া মানুষের মতো এসে বসি টেবিলে—

কখন প্রহর যায়, চন্দ্ররাত্রি ঘুমে ঢলে আসে,
দুই আমি জেগে ঘুমোবার সাধ ভালোবাসে;
ঘুমে-জাগরণে তারপর পরস্পরের সকাশে
এসে মেশে দু’জন আলাদা আমি— দুই পরস্পর;
ঘুম-চোখে দ্যাখে : এক চুল-চোখ-মন-কণ্ঠস্বর।
আধেক আমার জন্ম হয়ে ওঠে আধেক ঈশ্বর।

১৩.

আম্মা বললেন, এই ক’টা টাকা? এই ক’টা টাকায় আমি মাস চালাবো কী করে?

দেখি, আমি বলি, পরে আর-কিছু দেবোখন।

পেয়ে আর দিয়েছো তুমি। সে তো সব মাসেই শুনি। পর আর আসে না তোমার। তোমাদের সংসার তোমরাই নাও, বাবা আমাকে এই আজাব দেওয়া কেন?

১৪.

বিবি একদিন, রাত্রিবেলা অতিমৃদু অতিমধুর কণ্ঠে আমাকে শোনার ‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’। ফিরে-ফিরে অনেকক্ষণ ধরে এই একটি গান গায়। আমার মনে হয়, আমার শ্রবণে উদিত হলো এক অমূলক, যার ঝিরিঝিরি শিরিশিরি এ জীবনে থামবে না আর। আর, যতোক্ষণ গান চলতে লাগলো, আমি মনে-মনে ভাবলাম, এই গানের কথার মধ্যে বিবির আত্মতা মিশে গিয়েই কি একে এমন অপরূপ করে তোলে নি!

গান শেষ হতে বিবি আমার দিকে তাকালো। আমি স্পষ্ট বুঝলাম, আমার প্রিয় আরো কিছু গান গাইবার জন্যে সে আজ প্রস্তুত। বললাম, বিবি, এই গানের মাধুরী আমি নষ্ট হতে দেবো না। আজ আর কোনো গান না। কিন্তু, একটা কথা বলবে আমাকে বিবি? এই গানটা তুমি নির্বাচন করলে কেন?

বিবি মুখ নত করে রইলো। তারপর হঠাৎ মুখ তুলে বললো–আমি দেখলাম ওর চোখের হ্রদের চিকচিকে জলে সোনা রঙের চাঁদ উঠেছে–বললো স্যার!

মুহূর্তে আমি বুঝলাম, শব্দ কিছু নয়, এই যে কবিতার শব্দের জন্যে এতো প্রাণপাত শ্ৰম–সে কিছু নয়; বুঝলাম শব্দের লক্ষ্য হচ্ছে শব্দের অতীতে যাওয়া।

চোখ বুজে এলো বিবির, নত হয়ে এলো ওর আনন আমার মুখের দিকে, আমার ঠোঁটের ওপর ওর ঠোঁটের প্রথম কম্পন আমি যেন আত্মার ভিতর দিয়ে শুনতে পেলাম। বিহ্বল আমার ভিতর থেকে উচ্চারিত হলো, ডালিয়া!

মুহূর্তে সোজা হয়ে বসলো বিবি, এক মুহূর্তে নিজেকে ঠিক করে নিলো, কঠিন অবোধ্য পরিষ্কার গলায় বললো, আমি বাড়ি যাবো।

আমি কিছু বলতে পারলাম না, একবার জিজ্ঞেস করতে পারলাম না কী হলো, আমার অপরাধের জন্যে মুখ ফুটে একবার ক্ষমা চাইতে পারলাম না।

অনেকক্ষণ পরে শুধু বললাম, তোমার কাছে একটাই দাবি আমার। এতো রাতে তোমার একা বাড়ি যাওয়া ঠিক হবে না। আমি পৌঁছে দিয়ে আসবো।

বিবি শুধু বললো, ঠিক আছে। আর কোনদিন আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন না।

আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। সারা রাস্তা নীরব থাকলো বিবি। রিকশা থেকে নেমে নীরবে সোজা বাড়ির ভিতরে চলে গেলো।

১৫.

আমার শুধু টুকরো পঙক্তি আসে। আমি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ একটি কবিতা লিখে উঠতে পারি নি। সমস্ত টুকরোগুলো জুড়তে গেলে আমরা আঙুলের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। জীবনটাকেও বড়ো বেশি এলোমেলা করে ফেলেছি। বড়ো সাধ হয়, একটি সম্পূর্ণ শান্তিময় জীবন সৃষ্টি করবো নিজের জন্যে। আ, স্বপ্নই রয়ে যায়। আমার জীবন, আমার কবিতা সবই এলোমেলো হয়ে রইলো। সবই এক সন্ধ্যার ঘোরের মতো যে সন্ধ্যায় সূর্য অস্ত গেছে, কিন্তু চাঁদ তখনো ওঠে নি। সময় ছুটেছে দুরন্ত এক ঘোড়ার মতো। তার পায়ের নিচে আমার জীবনের শতশত টুকরো স্পন্দিত হল, শুধু গ্রথিত হয় নি একটি মালায়। মালা ছিঁড়ে পুঁতিগুলো ঝরে পড়েছে স্বপ্নে, বাস্তবে, খাটের নিচে, আলমারির তলায়, কাদায়, নক্ষত্রে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিধি নেই কি কোথাও? কোনো এক জায়গায় আমিও কি নই টান করে বাঁধা? সবই কি শেকড় ছেঁড়া? সবই কি ভেসে যাওয়া? নাকি আমাদের জন্মের আগেই সব সুগোল-নিটোল চিরতরে চূর্ণ হয়ে গেছে?

১৬.

বিবি, মাফ করো আমাকে। মিনা, মাফ করো আমাকে। কাজের মেয়ে, মাফ করো আমাকে। কবিতা, আমাকে মাফ করো। রাত্রি, আমাকে মাফ করো। তোমাদের সবার মধ্যে অন্য-এক কেন্দ্রীয় ধ্যানের প্রতিরূপ খুঁজে ফিরেছি আমি। তোমাদের সবার প্রতি অন্যায় করেছি।

১৭.

সন্ধ্যার মতো বিষণ্ণ, উন্মাতাল আর স্মৃতিসঞ্চারী আর কে আছে? সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে নেই কোনো দিন। হয় ফিরতে হয় অনেক বেলা থাকতে, না-হয় সন্ধ্যা পার করে দিয়ে। সেদিন সেই ভুলই করলাম। যানে যন্ত্রে উন্মথিত এক রাস্তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে সরু একটা গলিপথ, দেখে থমকে উঠলাম। এই-তো সাঁই পাড়ায় যাবার সেই বাঁকা রাস্তাখানি। মসজিদের পাশ দিয়ে, পুকুরের পাশ ঘেঁষে, ধুলো ওড়ানো এই পথটাই তো চলে গেছে আমাদের দেশগাঁয়ের বাড়িতে। সেই আটচালার সামনে দহলিজ-ঘর, দাদা হুঁকো হাতে, লোকজন সব বসে। ভেতরে ধানের গোলা। ঢেকির পাড় পড়ছে। সামনে বিশাল গোলাপখাশ আমগাছ। সেই গাছে এক পাগল কোকিল ডেকে চলেছে তো চলেছেই যতোবার সে ডাকছে ততোবার আনন্দের ঝলমলে মখমলের গা বেয়ে এক একটা হিরের আংটি গড়িয়ে পড়ছে শাদা বেদনার পাথরে। রিকশা থেকে লাফিয়ে নামছিলাম প্রায়, এমনিভাবে জায়গাটা পেরিয়ে গেলাম।

১৮.

দুটো পঙক্তি মনের মধ্যে বেজে উঠছে বারবার :

ভালোবাসা, বেজেছে ঘণ্টার মতো, সন্ধ্যার মন্দিরে।
তোমার যাবার পথ গিয়েছে আমাকে চিরে-চিরে।

১৯.

এক কবিতা-পাঠ ও আলোচনা সভায় প্রায় জবরদস্তি করে ধরে নিয়ে গেলো আমাকে। সেখানে ‘জটিল’, ‘দুর্বোধ্য’, ‘শূন্যসাধক’, ‘অর্থহীন’, ‘অভিব্যাক্তিক’ প্রভৃতি শব্দ-ছড়ানো যে রচনাটি পাঠ করা হলো বোঝা গেলো তার উদ্দিষ্ট আমি বা আমার কবিতা। আমাকে একটা ভাষণ দিতেও বলা হলো। নিজের সম্বন্ধে আমি একটা কথাও বলতে পারলাম না। আমি যুক্তি জানি না।

২০.

ফেরার সময় একটা ছুটন্ত প্রাইভেটকারের পিছনে উড়ন্ত অসম্ভব সুন্দর আমার চেনা যে-মেয়েটিকে দেখে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিলাম— এক মুহূর্ত পরেই খেয়াল হলো : আমি যাকে পনেরো বছর আগে হারিয়ে ফেলেছিলাম একদিন, তার বয়স এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকবে না। এই মেয়ে সেই মেয়ে না। অথচ কী বলবো, মনে হলো একদম এক, অবিকল এক। আমি যুক্তি জানি না।

২১.

রাতে কবিতার একটা শব্দের জন্যে ক্রমাগত মাথা খুঁড়ছি— খুঁজে বেড়াচ্ছি আকাশের নীলিমা থেকে পাতালের কালি অবধি। কিন্তু ঠিক শব্দটি কিছুতেই খুঁজে পাই না। সেই শব্দ, যা দিয়ে সেই শব্দের অতীত এক ক্ষমাহীন স্বর্গে পৌঁছানো যায়। মাথা গরম হয়ে ওঠে।

তখন দরোজায় টোকা পড়ে। তাকিয়ে দেখি, মিনা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি আলো জ্বেলে রেখে, দরোজা খুলে, বেরিয়ে আসি।

সিঁড়িতেই বসে আছে কাজের মেয়েটি। কিন্তু, একী সাজ-গোজ! চমকে উঠি আমি। গভীর করে কাজল-মাখা, আঁট করে শাড়ি পরা। হায়, অবোধ মেয়ে! প্রেম আর কামের তফাত জানে না। তফাত সত্যিই আছে কি? স্বজ্ঞার দৌলতে আমার চেয়ে প্রকৃত জেনেছে ও কি? কিন্তু আমাকে আবার ভালোবেসে ফেলে নি তো? অদ্ভুত মায়া লাগে। বুকের ভেতরে ছিঁড়ে যায় আমার। সমস্ত কাম মরে যায়। লু কীরকম অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে ওকে আলিঙ্গন করি। শরীর প্রবেশের সময় আমার কণ্ঠ থেকে আমার অজ্ঞাতে যেন বেরিয়ে আসে ‘ডালিয়া। ডা-লিয়া! ডা-লি-য়া!’

বাতাসে কোনো দূরের ঘ্রাণ, দোতলায় শাসিঁকাচে ক্রমাগত ডাল ঘষটানির শব্দ, ক্রমাগত চৈত্রের পাতা পড়ার শব্দ।

অস্পষ্ট মুখ – মঈনুল আহসান সাবের

একটা অবৈধ স্বপ্ন দেখে শেষরাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের মধ্যে এক জনের সঙ্গে ওটা তার হয়ে গেছে।

সে কিছুক্ষণ নিথর পড়ে থাকল বিছানায়। শরীরে কিছুটা অবসাদ, হয়ে যাওয়ার পর এমন হয়। সে ওটুকু অবসাদকে গুরুত্ব দিতে চাইল না। তার মাথার ভিতর তখন অন্য চিন্তা। কিছুটা আশ্চৰ্য্যও সে বোধ করছে। আচ্ছা, লোকটা কে? শামীমা একটু হাসল। সে ওই চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমোতে চাইল। কিছুক্ষণ সে চেষ্টা করল। তার ঘুম এলো না। শেষে সে উঠে বসল বিছানায়। কিছুক্ষণ বসে থাকল। তারপর এভাবে বসে থাকারও কোন মানে হয় না, এই ভেবে সে আবার শুয়ে পড়ল। কিন্তু এই শুয়ে থাকাটা তার অসহ্য লাগল। কী তাহলে সে করবে! শুয়ে থাকাটা অসহ্য, উঠে বসলেও কিছু করার নেই। সে একবার ভাবল বিছানা ছেড়ে নেমে টেলিভিশনটা অন করবে। তাদের টেলিভিশনে প্রায় ৩০/৩৫ টা চ্যানেল আসে। আসে, তবে কটা আর। দ্যাখা হয়। ৩/৪টা চ্যানেল মোটামুটি দ্যাখা হয়, বাকিগুলো হচ্ছে সময় কাটানোর জন্য তাকিয়ে থাকা। যখন হাতে কোনই কাজ থাকে না, যে ৩/৪ টি চ্যানেল মোটামুটি দ্যাখা হয়, সেগুলোতেও যখন দ্যাখার থাকে না কিছু, সে তখন শুয়ে বসে রিমোটের বোতাম টিপে চ্যানেল বদলায় শুধু। তবে কোন চ্যানেলই ২/৩ মিনিটের বেশি দ্যাখে না। আকর্ষণ বোধ করলে কোনটা হয়ত পাঁচ মিনিট। এভাবে অনেক সময় পার হয়ে যায়।

এখন এই ভোররাতে, যখন সে বুঝতে পারছে আর তার ঘুম আসবে না, তখন ওই কাজটি করা যায়—রিমোটের বাটন টিপেটিপে চ্যানেল বদলানো। কিন্তু এখন সম্ভবত ওই কাজটিও ভালো লাগবে না। ভিতরে ভিতরে সে অসম্ভব অস্থির বোধ করছে। আচ্ছা, লোকটা কে? ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর থেকে এই প্রশ্নটা ক্রমশই তার ভিতর তীব্র হয়ে উঠছে। হ্যাঁ সেই লোকটা। যে লোকটার সঙ্গে ব্যাপারটা ঘটে গেল, সে কে? শামীমা আবার একটু হাসল। লোকটা কে—এই প্রশ্নটা তীব্র হয়ে ওঠার কোন কারণ নেই। তবে সে আশ্চর্য হচ্ছে। হঠাৎ করে এতদিন পর কোন কারণ ছাড়া ওই মুখ!

তার অস্থির ওঠাবসায় রকিবের ঘুম হালকা হয়ে গেল। সে জড়ানো গলায় বলল, শামীমা? সে প্রথমবার জবাব দিল না কোন। সে ভাবল ঘুমের মধ্যে কথা বলেছে রকিব। সুতরাং সাড়া না দিলেও চলবে।

রকিব হাত তুলে একটা, চোখ খুলে তার দিকে তাকাল—ঘুম ভেঙে গেছে?

হুঁ। ছোট করে বলল শামীমা। সে একটা হাত রাখল রকিবের চুলে।

হ্যাঁ, মাথায় একটু হাত দিয়ে দাও তো….কখন ঘুম ভাঙল?

শামীমা রকিবের চুলে হাত বুলাতে আরম্ভ করল—এই তো একটু আগে আমারও সারা রাত ভাল ঘুম হয়নি। এপাশ-ওপাশ করলাম।

কাল সারা দিন জার্নি করে এসেছ। ঘুম তো ভাল হওয়া উচিত ছিল।

না। তুমি তো জানোই বেশি ধকল গেলে আমার ঘুমটা ভাল হয় না। আসলে রাতে একটা ঘুমের ওষুধ খাওয়া উচিত ছিল।

ঘুমোও, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

শামীমা রকিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল এবং রকিব সত্যিই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। তখন হাত সরিয়ে নিল শামীমা। মৃদু ভঙ্গিতে সে বিছানা ছেড়ে নামল। বাথরুমে গেল, বেরিয়ে রান্নাঘরে। চা বানাল এক কাপ। তারপর বারান্দায় এসে বসল। তাদের বাসার সামনে বেশ কিছুটা ভোলা জায়গা। এটা যে একটা কত বড় সুবিধা। সময়ে-অসময়ে তার যখন ভাল লাগে না, সে এই বারান্দায় এসে বসে। তাকিয়ে থাকে বহু দূরে। সে খেয়াল করে দেখেছে তখন তার মন ভাল হয়ে যায়। অবশ্য তার মন তেমন করে খারাপই বা হয় কখন! না, সে মনে করতে পারে না এমন কোন দিনের কথা যেদিন তার মন খুব খারাপ হয়েছিল। তার যেটুকু হয়, সেটুকুকে বলা যায়—মন ভারি হওয়া। সে তেমন কিছু নয়, অল্পতেই ঝেড়ে ফেলা যায়। আর মন আবার খারাপই বা হবে কেন, সে চায়ে ছোট একটা চুমুক দিয়ে দূরে তাকাল, মন খারাপ হওয়ার মতো কিছু তো ঘটে না। আচ্ছা, থাক ওসব মন খারাপ কিংবা ভাল হওয়ার কথা কথা হচ্ছে এতদিন পর ওই মুখ কেন?

২.

একবার খুব মজা হয়েছিল। রকিবদের অফিসে বিদেশ থেকে এক প্রতিনিধি এসেছিল, অ্যালেক্সি। অ্যালেক্সি খুব ফুর্তিবাজ, তাদের বাসায় এসে হইচই করে একাকার। প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত জমিয়ে আড্ডা। পরদিন অ্যালেক্সি চলে গেল ঢাকার বাইরে, রকিবও গেল। রকিবকে তো যেতেই হবে, অফিসের কাজে সে মাসের মধ্যে অনেক দিন ঢাকার বাইরে কাটায়। আর, শামীমা থাকে একা, একদম একা। থাক, এ প্রসঙ্গে সে এখন কিছু বলবে না। এখন অ্যালেক্সিকে নিয়ে কী মজাটা হয়েছিল, সেটা সে বলবে।

দিন ৪/৫ বাইরে কাটিয়ে অ্যালেক্সি আর রকিব ফিরে এল। আর একটা রাত তুমুল আড্ডা। এক সময় পরিশ্রান্ত তাদের আড্ডা ভেঙে গেল। অ্যালেক্সি বিদায় নিল আর তারাও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমোতে গেল। সে রাতে শামীমার স্বপ্নের মধ্যে ব্যাপারটা অ্যালেক্সির সঙ্গে ঘটে গেল। এটা সে লুকালো না। কারণ রকিবকে সে চেনে, এটা রকিবের কাছে লুকানোর কিছু নয়। সে নাস্তার টেবিলে বসে বলল, একটা মজার ব্যাপার হয়েছে জানো?

রকিব এক পলক তার দিকে তাকিয়ে খবরের কাগজে চোখ ফেরাল কী করে জানব, তুমি কি বলেছ?

আমার মনে হচ্ছে গত রাতে ও ওই কাজটা আমার অ্যালেক্সির সঙ্গে হয়েছে।

হুঁ। রকিব বলল। তারপর যেন খেয়াল হল তার, সে খবরের কাগজ সরাল–মানে!

মানে পরিষ্কার। মনে তো হলো—অ্যালেক্সিই।

রকিব হো হো করে হাসতে আরম্ভ করল-মনে হচ্ছে অ্যালেক্সিকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে তোমার।

ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত না? কীভাবে যে একেকটা মুখ চলে আসে।

রকিব হাসি থামাল না—এখন কথা ঘুরাচ্ছ?

অ্যাই বাজে কথা বলো না। এমনিতেই আমি খুব লজ্জা পেয়েছি।

রকিবের মুখে সামান্য হাসি থেকে গেল ব্যাপারটা আসলেও অদ্ভুত।

তুমি দ্যাখো, তুমি জানোই—অ্যালেক্সির কথা আমি একবারও ভাবিনি।

উঁহু কথাটা ঠিক না। অ্যালেক্সির কথা তুমি ভেবেছ।

শামীমা বলল, কখনও না।

ভেবেছ। কিন্তু যে স্বপ্ন দেখেছ রেকম কিছু ভাবোনি। কিন্তু হয়েছে কী—স্বপ্নের মধ্যে ওই ব্যাপারটা যখন ঘটে তখন একটা না একটা পরিচিত মুখ এসে যায়। অ্যালেক্সি এতক্ষণ ছিল আমাদের সঙ্গে—ওর মুখটা চলে এসেছে।

তুমি কাল রাতে ভোস করে না ঘুমিয়ে, ঘুমানোর আগে ওটা সারলেও তো পারতে। অ্যালেক্সি তাহলে স্বপ্নের মধ্যে তোক আর যেভাবে হোক, ওই কাজে আসার সুযোগ পেত না। আসলেও লজ্জা লাগে বাপু।

রকিব আড়মোড়া ভাঙল কীভাবে হবে ওটা! ৩/৪ দিনের এক্সটেনসিভ টুর, ফিরে অত রাত পর্যন্ত আড্ডা। তারপর কি শরীরে আর কোন ইচ্ছা থাকে।

ইচ্ছা না থাকলেও হতে হবে। কী লজ্জা স্বামী পাশে থাকতে।

লজ্জার কিছু নেই। গত মাসে আমার কী হয়েছিল সেটা শোনো। ওই যে টানা পাঁচ দিন বাইরে থাকলাম না?

এ আর ফলাও করে বলার কী! তুমি তো বাইরেই থাকো।

আহ্, শোননই না। ঢাকা ফেরার আগের রাতে স্বপ্ন আমাকে নিস্তেজ করে দিল। কিন্তু মেয়েটাকে আমি আর চিনতে পারি না। পারি না….।

একদম অচেনা?

ও রকমই। শেষে বুঝতে পারলাম—বিকালে যখন হোটেলে ফিরছি তখন রিসেপশনে মেয়েটাকে এক পলক দেখেছিলাম। বোর্ডার। স্বামীর সঙ্গে রিসেপশন

থেকে রুমের চাবি ফেরত নিচ্ছিল।

শামীমা আন্তরিক গলায় বলল, ওই একবার দেখেই মেয়েটাকে বুঝি তোমার খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল?

রকিবও খুব সহজ ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল হ্যাঁ, ততটা অবশ্যই, যতটা তোমার অ্যালেক্সিকে পছন্দ হয়েছিল।

তারপর তারা দুজন মিলে খুব হাসল।

রকিব বলল, ওই মেয়েটা আমাকে খুব ভুগিয়েছিল।

শামীমা বুঝতে পারল না। সে জিজ্ঞেশ করল–কোন্ মেয়েটা?

ওই যে, বললাম না, ঢাকা ফেরার আগের রাতে হোটেলে…। ওই মেয়েটাকে আমি চিনতেই পারছিলাম না। কখন পারলাম, জানো?

শামীমা মুচকি হাসল—ফিরে এসে আমার সঙ্গে হওয়ার পর?

রকিব অবাক চোখে তাকাল—তুমি বুঝলে কী করে?

শামীমাও অবাক হয়ে গেল—ওমা, সত্যি নাকি! আমি তো এমনি বললাম।

না, সত্যি। সে রাতে আমাদের হওয়ার পর সিগারেট ধরালাম না? দুটো টান দিতেই মনে পড়ে গেল-আরে, এটা তো ওই মেয়ে!

শামীমা গম্ভীর মুখে জানতে চাইল নিজেকে তখন তোমার আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল মনে হলো কিংবা মার্কোনি?

অ্যালেক্সি কিংবা ওই মেয়েটার এক ধরনের অস্তিত্ব থেকে গেছে তাদের মধ্যে। ট্যুরে রওনা দেওয়ার আগে রকিব গম্ভীর মুখে বলে, তোমার জন্য অ্যালেক্সিকে রেখে যাচ্ছি।

শামীমাও হাসতে হাসতে জানায় হ্যাঁ, আর তোমার জন্য ওই মেয়েটা তো থাকছেই।

কিংবা টুর থেকে ফিরে এসে রবি জিজ্ঞেস করে—অ্যালেক্সি এসেছিল?

শামীমা জানতে চায়—ওই মেয়েটাকে কোথায় রেখে এলে!

রকিব হাসিমুখে বলে, লুঙ্গির সঙ্গে।

৩.

চা শেষ করে কাপটা পায়ের কাছে নামিয়ে রাখল শামীমা। শরীরে ক্লান্তি নেই কোন, সে লু আড়মোড়া ভাঙল। সে দেখেছে—এটা একটা চমৎকার ব্যাপার, এই আড়মোড়া ভাঙা, এ অভ্যাসটা রকিবেরও আছে। প্রায়ই সে বিকট শব্দ করতে করতে আড়মোড়া ভাঙে।

কখনও টানটান করে দ্যায় শরীর, বলে—ধরো শামীমা, এই যে টানটান করে দিলাম শরীর, শরীর টানটানই থাকল, আর স্বাভাবিক হলো না, তখন? শামীমা বলে, মন্দ কী! অমন জবুথবু স্বাভাবিক হওয়ার চেয়ে টানটান হয়ে থাকাই ভাল। সে কথা মনে হলে শামীমা নিজে নিজে একটু হাসল। আরও একটা আড়মোড়া ভাঙল সে। তারপর উঠে দাঁড়াল। রকিবকে ওঠাতে হবে। সে কাল রাতে শোয়ার আগে বলে রেখেছে তাকে একটু সকাল সকাল উঠিয়ে দেয়ার জন্য। অফিরে কিছু কাজ সে গত রাতে বাসায় নিয়ে এসেছে। রাতে শেষ করতে পারেনি। বাকিটুকু সকালে অফিসে রনা হওয়ার আগে শেষ করতেই হবে। কারণ কাল এগারোটায় তার রিপোর্ট নিয়েই অফিসে জরুরী মিটিং।

দুবার ডাকতেই রকিব উঠে পড়ল। ঘুমটা তার গভীর ছিল না। সে বিছানায় উঠে বসলে শামীমা চলে গেল রান্নাঘরে। এখন এক কাপ চা লাগবে রকিবের। চা খেয়ে সে বাথরুমে যাবে, তারপর কাজ করতে বসবে। কাজ যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য হয় তবে তাকে আরও এক কাপ চা দিতে হবে। রকিবের এই অভ্যাসটা খুব বাজে। চায়ের নেশা তার অতিরিক্ত। এর কিছু ছোঁয়া শামীমারও লেগেছে। বিয়ের আগে সে। চা খেত দিনে দুকাপ, কদাচিৎ সেটা তিন কাপ হয়েছে। এখন দিনে ৫/৬ কাপ হয়ে যাওয়াটা কোন ব্যাপার নয়। এর বেশিও হয়। তবে এতে দেখুন অসুবিধা হয় না। আগে যেমন বিকালের পর চা খেলে সে জানত রাতের গুমটা নির্ঘাত হারাম। এখন। রাতে যদি নি কাপ চাও সে খায়, ঘুমের সমস্যা হয় না। রাতে চা খাওয়ার অভ্যাস অবশ্য একা থাকতে থাকতে। মাসের মধ্যে অনেক দিন রকিব ঢাকার বাইরেই থাকে। ওই দিনগুলোতে, দিনগুলোতে মানে রাতে, শামীমার কিছুই করার নেই। তার শ্বশুর থাকে তাদের সঙ্গে। খুব নিরিবিলি নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ একা থাকতেই পছন্দ করেন। শ্বশুরের বইপত্রর অনেক, তার ব্যস্ততা ও বইপত্রের সঙ্গেই। শামীমা মাঝে মাঝে তার সঙ্গে গিয়ে গল্প করে। বিশেষ করে রকিব ঢাকায় না থাকলে, সন্ধ্যায় কিংবা তার কিছু পর পর শামীমার খুব একা একা লাগে। সে তখন শ্বশুরের সঙ্গে গল্প করে কিছু সময় পার করতে চায়। কিন্তু ওর খুব কম কথা বলেন, খুবই ভাল মানুষ তিনি, শামীমাকে তিনি পছন্দও করেন খুব, কিন্তু বেশি কথা বলায় তিনি অভ্যস্ত নন। শামীমাও একা একা কত আর চালিয়ে যায়, সে এক সময় উঠে আসে। তারপর সময় অবশ্য কোন না কোনভাবে কেটেই যাবে। সে এটা-ওটা করে, বারান্দায় বসে থাকে, টেলিফোনে এর-ওর সঙ্গে কথা বলে, রান্নার লোক আছে, কাল ন’টার দিকে এসে বিকাল পাঁচটায় যায়, সুতরাং খাওয়ার সময় একটু গরম করে নেয়া ছাড়া ওই দায়িত্বও পালন করতে হয় না। রান্না করতে হলে সময় পার করায় কিছু সুবিধাই হতো বইকী, সে যাক, নানাভাবে সময় কেটেই যায়। বিয়ের পর থেকেই এ রকম, সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আর একেবারেই কিছু করার না থাকলে সে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে অনেক সময় নিয়ে চা খায়, চা খায় আর টেলিভিশনের চ্যানেল বদলায়। ঘুমের সমস্যা তার হয় বইকী। মাঝে মাঝে হয়, সে এক বিছানায় ছটফট করে। তবে সেটা বেশি বেশি চা খাওয়ার জন্য নয়, সেটা অন্য কারণে।

ঘণ্টা দুয়েক পর কাজ শেষ করে উঠল রকিব। বিকট একটা শব্দ করল। কতক্ষণ হাত-পা ছুড়ল, তারপর বলল, নাস্তা দাও।

নাস্তা রেডিই আছে, রান্নার মেয়েটাকে বললে সে টেবিলে নাস্তা এনে দিল পাঁচ মিনিটের মধ্যে। এখন তারা দু’জনই বসবে। শ্বশুর খেয়ে নেন বেশ আগেই। তারপর বেরিয়ে পড়েন, শামীমা জিজ্ঞেস করে জেনেছে তিনি একেক দিন একেক বন্ধুর বাসায় বা অফিসে যান। শামীমা একদিন জিজ্ঞেস করেছিল বাবা, বন্ধুর বাসায় গিয়ে আপনি কী করেন?

শশুর প্রথমে বুঝতে পারেননি কী করি মানে?

সেটাই আমি জানতে চাচ্ছি কী করেন?

কেন, গল্প করি!

আপনি গল্প করেন! আমার মনে হয় না।

শ্বশুর শামীমার কথার অর্থ বুঝতে পেরে হাসতে আরম্ভ করেছিলেন।

কাজের মেয়েটির টেবিলে নাস্তা সাজানো শেষ হলে শামীমা ডাকল রকিবকে—এসো।

রকিব এসে বসল, একবার তাকাল শামীমার দিকে মুচকি হাসল—তোমাকে এই সকালবেলা বেশ সেক্সি দ্যাখাচ্ছে!

শুনে খুশিতে আটখানা হয়ে গেলাম।…আবার কবে যাচ্ছ ট্যুরে?

কবে যাচ্ছি মানে? এই তো মাত্র ফিরলাম।

সে জন্যই তো জানতে চাচ্ছি। আগে থেকে এবার তবে একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকবে। রকিব হাসতে আরম্ভ করল।

হাসবে না। শামীমা গম্ভীর গলায় বলল। তোমার এ ধরনের হাসি দেখলে আমার মেজাজ গরম হয়ে যায়।

তাও ভালো শরীর গরম হয় না।

তা বটে, রকিব মাথা ঝাঁকাল। এটা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু কী করব বলো? আমার চাকরিটাই যে এ ধরনের। আমার নিজেরও কি খারাপ লাগে না, অসুবিধা হয় না!

কে জানে তোমার কি হয়।…আমার মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে।

কী রকম অসহ্য বলো তো? রকিব নিপাট ভদ্রলোকের মতো জানতে চাইল।

শামীমা মুখে কিছু বলল না, সে ভাবলকী রকিব অসহ্য তুমি কি সেটা জানো রকিব? তুমি যতই ইয়ার্কির ঢঙে কথা বলো না কেন, কী রকম অসহ্য সেটা তুমি জানো। আর বিয়ের দু’বছরের অধিকাংশ দিন যার একা কেটেছে, তার মাঝে মাঝে অসহ্য লাগবে না তো কী লাগবে! এ কথা অবশ্য তোমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এ রকম ভাবতে ভাবতে শামীমা রকিবের দিকে তাকাল।

রকিব বলল, তোমার তাকানোটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। তোমার দু’চোখে রাগ না ভালবাসা?

দূরে থাকতে থাকতে তোমার এমনই অবস্থা, আমার দুচোখে রাগ না ভালবাসা, এটাও তুমি আর বুঝতে পার না।

আচ্ছা আচ্ছা, তোমার দু’চোখে তা হলে রাগ কিংবা ভালোবাসা কিছুই নেই। তুমি বোধ হয় কিছু বলবে আমাকে। কী বলবে?

শামীমার একবার ইচ্ছা হলো, হত রাতের স্বপ্নের কথা বলবে সে। বলবে কাল রাতে স্বপ্নের ভিতর ওটা হয়ে গেছে। শুনে রকিব হয়তো অবাক হবে না, কিন্তু সে

অবাক হওয়ার ভান করবে—আবার?

শামীমা ভাবল, রকিব অবাক হলে সে তখন বলবে—অবাক হচ্ছে কেন! তুমিই তো বলেছ—এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

তা বটে। খুব স্বাভাবিক।…কিন্তু তুমি মনে হচ্ছে একটু লজ্জা পাচ্ছ।

পাচ্ছি না। তুমি বলেছ এতে লজ্জা পাওয়ারও কিছু নেই।

রকিব সত্যিই এ রকম বলেছে। বেশ আগে একদিন কথা প্রসঙ্গে রকিব বলল, এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। খুব সাধারণ একটা জৈবিক প্রক্রিয়া। নারী কিংবা পুরুষই, যার শরীরই ভারি হোক, একা অবস্থায় আপনা-আপনি ওভাবেই হালকা হবে—এটাই নিয়ম।

হোক নিয়ম। আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। কি একটা ব্যাপার বলো তো, ছিঃ।

উঁহু, লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।

আমার পা ঘিন ঘিন করে।

সেটা করাও অনুচিত।

বিশ্বাস করো, আমি এত বিব্রত হই, আমার এত অস্বস্তি লাগে। এভাবে আমি কখনও চাই না।

উপায় নেই।

রকিরে মুখে উপায় নেই শুনতে শুনতে ব্যাপারটা বেশ কিছুটাই সহজ তার কাছে হয়ে এসেছে বইকী। সুরাং রকিব যখন তাকে জিজ্ঞেস করল—কি বলবে—সে বলতে পারত গত রাতের স্বপ্নের কথা। তারপর কিছু হাসি-ঠাট্টা নিশ্চয় তাদের হতো। কিন্তু শামীমা বলল না। তার মনে হলো হাসি-ঠাট্টা হয়ত হবে ঠিকই, কিন্তু তার আগে সে আটকে যেতে পারে, যদি হাসতে হাসতেই রকিব জিজ্ঞেস করে—তা কার সঙ্গে ব্যাপারটা ঘটল? এ প্রশ্ন যদি করে রকিব, শামীমার মনে হলো, উত্তর দিতে তার সঙ্কোচ ও দ্বিধা হবে।

নাস্তা খেয়ে উঠে রকিব বলল, আসো, এক রাউন্ড ব্যায়াম করি। তারপর নিজেই সে মাথা নাড়লনা, ভরপেটে ব্যায়াম স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ফিরে এসে। বলে সে কতক্ষণ টেলিভিশন দেখল। পোষাক পাল্টে কতক্ষণ নিজেকে দেখল আয়নায়, জিজ্ঞেস করল—কেমন দ্যাখাচ্ছে আমাকে বলো তো? বড় অফিসার বড় অফিসার মনে হচ্ছে? শামীমা বলল, মাসের উনত্রিশ দিন যাকে অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে বাইরে থাকতে হয়, সে আবার কিসের বড় অফিসার?

রকিব একটা ভেংচি কাটল, তারপর অফিসে রওনা দিল।

বারান্দা থেকে রকিবের বেরিয়ে যাওয়া যতদূর সম্ভব দেখে নিয়ে শামীমা যখন ঘুরে দাঁড়াল, সে দেখল, তার আর কিছু করার নেই। সে শেষ রাতের স্বপ্নটা ভাবতে বসল। ওটা সজলের মুখ ছিল। কিন্তু এত বছর পর সজল কেন এল ওভাবে! সজলের সঙ্গে বেশ আগে, সে তখন ভার্সিটির প্রথম দিকে, তার একটা সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্ক প্রেমের, এমন নয়, আবার নিছক বন্ধুত্বের কিংবা সজল কেবলই বড় ভাইয়ের বন্ধু, এমনও নয়। সজলের সঙ্গে তার গভীর প্রেম হতে পারত, সেটা গড়াতে পারত। বিয়ে পর্যন্ত, কিন্ত ওসব ছিল হতে পারা কথা, হয়নি। হয়নি বলে সে দুঃখ পায়নি এ নিয়ে তার কোন ক্ষোভ নেই, কষ্ট নেই, হাহাকার নেই। তাছাড়া সজলের কথা তার মনেও পড়ে না।

কিন্তু, মনেও পড়ে না যখন, সজল ওরকম এক স্বপ্নে কেন এল? শামীমা কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা হাসিমুখে তাকিয়ে থাকল একদিকে।

অফিস থেকে যে সময় ফেরে রকিব, তার ঘন্টা দেড়েক আগে সে ফিরে এলে। বিটকেলে একটা হাসি দিল শামীমার সামনে দাঁড়িয়ে একা একা কার কথা ভাবছিলে?

শামীমা গম্ভীর গলায় বলল, তোমার কথা যে নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পার।…তুমি ও সময়ে ফিরলে যে, চাকরি চলে গেছে?

প্রায়। আমি বসকে বললাম এভাবে ঘন ঘন আমাকে বাইরে পাঠালে আমার সংসার টিকবে না। শুনে বস কি বলল জানো?

না।

বস বলল, সংসার গুলি মারেন, চাকরিই সব।…আমি অবশ্য বসকে বলিনি আমাদের ওই কাজটাও নিয়মিত হয় না। অথচ বিয়ের মাত্র দু’বছর।

বললে না কেন! বললেই পারতে।

কি দরকার। বাসায়ই তো চলে এসেছি। এখন ওটা আমরা করব। রেডি হও।

শামীমা হাসতে আরম্ভ করল—ফাজিল কোথাকার।

আমি কিন্তু রেডি হয়ে এসেছি। পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না।

শামীমার হাসি বেড়ে গেল—আমি তেমন করে দোষ দেই তোমাকে?

রকিব একটু গম্ভীর, একটু আনমনা হয়ে গেল, তা দাও না….শামীমা, তুমি আসলে খুব ভালো।

শামীমা তার ছড়িয়ে যাওয়া হাসি স্থির করল, রকিবের দিকে নরম চোখে তাকাল, বলল—বোঝো তাহলে?

রকিবের মুখে এবার হাসি ছড়াল—আমি যদি না বুঝি, কে বুঝবে বলো?

মৃদু মাথা কঁকাল শামীমা। সে খুব বুঝদারের ভঙ্গিতে বলল, তা-ও ঠিক, তা-ও ঠিক।

৪.

তারপর দিন পার হতে হতে রকিবের ঢাকার বাইরে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। এবার পাঁচ দিন তার থাকতে হবে বাইরে। সন্ধ্যার সময় তার বাস। সে বলল, যাচ্ছি তাহলে।

যাও। ভালোভাবে যাবে। আর ভালোভাবে ফিরে এসে চাকরিটা বদলানোর চেষ্টা করবে।

অবশ্যই। রকিব গম্ভীর ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। সে আর বলতে। ফিরে এসেই।…ফিরে এসেই। ফোন করব।

হুঁ। ফোনটা অন্তত নিয়মিত করো।

গেলাম।… অ্যালেক্সি থাকল।

শামীমা কতক্ষণ তাকিয়ে থাকল রকিবের দিকে। বলল, ওই মেয়েটাকেও, ওই যে হোটেলে দেখেছিলে এক পলক, ওই মেয়েটাও তো তোমার সঙ্গে যাচ্ছে, তাই না?

তারা দু’জন হাসতে আরম্ভ করল। হাসি থামিয়ে রকিব বলল, হ্যাঁ, আমি ওই মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি আর অ্যালেক্সি থাকছে তোমার কাছে।

শামীমা বলল, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? তোমার যাওয়ার সময় আমরা শুধু এ ধরনের ইয়ার্কি মারি। কিন্তু শুধু কি এটাই সমস্যা, বলো? দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকি বলে আমাদের কি মন খারাপ হয়ে থাকে না?

থাকে। রকিব শামীমার কাঁধে একটা হাত রাখল। খুব মন খারাপ হয়ে থাকে তোমার আর আমার। কিন্তু মন খারাপের কথা বলে যাত্রা সময়টা স্যাঁতসেঁতে করার কী দরকার আছে!….আর, ইয়ার্কি যদি মারতেই হয়, একটু রসালো ইয়ার্কি মারাই ভাল, কি বলল?

তা বটে। শামীমার এ রকম মনে হলো, তা বটে, ইয়ার্কিটা রসালো হলেই জমে ভাল আর বিদায়ের সময় মন খারাপের কথা বলে মন খারাপ করাটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। বেশ, মেনে তো নিচ্ছেই সে, কিন্তু মেনে নিয়ে সে এখন কি করবে? চা খাবে আর টেলিভিশনের চ্যানেল বদলাবে? তারপর, তারপর, তারপর?

শামীমা ভেবে দেখল তার কিছুই করার নেই। এ অবশ্য ভেবে দ্যাখার কিছু নয়। এ তো জানা কথা। তবু, রকিব ঢাকার বাইরে রওনা দিলে প্রতিবার সে এরকম ভেবে দ্যাখার ভান করে। পায় না কিছু, এবারও পেল না। অথচ সামনে পাঁচ-পাঁচটা রাত, পাঁচ-পাঁচটা দিন। রাতগুলো পার করতে হবে তার, দিনগুলোও। কি করে এতাট সময় পার করবে সে, ঠেলে ঠেলে? দু’হাতে ঠেলবে প্রাণপণ? আর মুখে বলবে—যা, যা, সর সর’?

শামীমা রান্নাঘরে গেল। চা বানাল। চায়ের কাপ হাতে বেডরুমে ফিরে সে টেলিভিশন ছাড়ল। মন খারাপ তার, হ্যাঁ মনই খারাপ তার। রকিব যতদিন থাকে না, ততদিন মন তার ভীষণ খারাপ হয়ে থাকে। রকিব না ফেরা পর্যন্ত তার মন ভাল হবে না। এটাও সে মেনে নিয়েছেনা হয় মন খারাপই থাকল তার, তবে তার শুধু একটাই কথা—এই দিন আর রাতগুলো পার করে দেয়ার কোন ব্যবস্থা যদি থাকত। কিন্তু এ রকম হবে না কখনও, কোন ব্যবস্থাই সে পাবে না। এটাও জানা আছে তার। সুতরাং একঘেয়ে এক নীরস সময় পার করতে করতে তাকে অপেক্ষা করতে হবে রকিবের ফেরার।

মন খারাপ থাকবে তার, পাশাপাশি—সে অস্বীকার করে না—শরীর, হ্যাঁ, এটাও একটা ব্যাপার বইকী। সে জানে রকিব ফিরে এসে জিজ্ঞেস করবে—এবার তোমার স্বপ্নে কে এল?

পাঁচ রাত থাকবে না রকিব, এর মধ্যে ও রকম এটা স্বপ্ন সে দেখবেই। এটা কেউ বলতে পারে না। নাও সে দেখতে পারে ওরকম কোন স্বপ্ন। একবার আরও অনেকদিন বাইরে ছিল রকিব, তখন কোন স্বপ্নই তাকে বিব্রত করেনি। হ্যাঁ, বিব্রতই বলবে সে। রেকম কোন স্বপ্ন সে সত্যিই দেখতে চায় না। নোংরা লাগে তার, সে অস্বস্তি বোধ করে এবং এ কথা শুনলে রকিব হয়ত হাসবে, কিন্তু এ কথা ঠিক এর রকম স্বপ্ন দ্যাখার পর তার ক্ষীণভাবে হলেও মনে হয় রকিবকে সে ফাঁকি দিয়েছে। তবে ওটা এড়ানোর উপায় তার জানা নেই। বরং এভাবে ব্যাপারটা মেনে নেয়া উচিত—ওটা নিছকই একটা শারীরিক প্রক্রিয়া, ওটা হবেই।

টেলিভিশনের চ্যানেল বদলাতে বদলাতে শামীমা একটু হাসল—এবারও কি হবে? খুব হেলাফেলায় কাঁধ ঝাঁকাল সে, সে চায় না থোক, তবে হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। যদি হয়, কার সঙ্গে হবে? মাঝে মাঝে শামীমার খুবই অবাক লাগে। কী যে একটা ব্যাপার—সে কত কেউই না চলে আসে ওরকম স্বপ্নে। অবাক হতে হয়—আরে এ কেন! এ কোত্থেকে ঢুকে পড়ল! কিন্তু ঢুকে পড়ে, ওই যে, যে সজলের কথ সে আর ভাবে না, সে সজল কী সহজেই চলে এল।

এবারও কি সজল আসবে? সজলের ব্যাপারটা, তার খুব লজ্জা লাগছে ভাবতে, তার ভিতর সেদিন এক অন্য রকম অনুভূতি তৈরি করেছিল। তবে না, সে চায় না সজল আসুক। ওরকম একটা স্বপ্ন আসবে কি না, তা-ই অবশ্য জানা নেই। তবে যদি আসেই ওরকম কোন স্বপ্ন, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে, শামীমার মনে হলো,—তাহলে এমন কেউ আসুক স্বপ্নে, যাকে সে চেনে না। হ্যাঁ, যাকে সে চেনে না, এমন কেউ—যাকে সে কখনও কোথাও দ্যাখেনি। ঘুম ভাঙার পর তাহলে সে খুব অবাক হয়ে যাবে। প্রচণ্ড এক অস্থিরতা তাহলে তাকে গ্রাস করে নেবে—কে, কে, কে! কিন্তু তাকে সে শনাক্তই করতে পারবে না।

আর এইভাবে, আশ্চর্য, কে এসেছিল, কে ছিল ওটা—এরকম ভাবতে ভাবতে অস্থির সে রকিবের না থাকা সময়টুকু পার করে দিতে পারবে না?

আঁধার ঘর – সঙ্কর্ষণ রায়

নীল-পর্দা-ঢাকা-জানলাগুলি-ভেদকরে-আসা পরিভুত ছায়াস্নিগ্ধ মৃদু আলোয় শোবার ঘরের ভেতরটা যেন স্বপ্নিল। খাটের পাশের জানলাটির গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আছে কুণাল। ছিপছিপে সুঠাম দেহের ঋজুতায় পৌরুষ আছে—আশ্চর্য রকম আত্মনির্ভর দাঁড়াবার ভঙ্গি।

তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে দুহাত দিয়ে তার ডান হাতটি সযত্নে তুলে ধরে কাজরী বলল, ঘুম ভাঙল বুঝি?

কুণালের চোখ দুটি কাজরীর মুখের ওপর এসে পড়ে। কাজরীকে দেখছে, অথচ দেখছে না, অর্থহীন শূন্য দৃষ্টি।

চিনতে পারছে না সে কাজরীকে।

কুণালকে খাটে এনে বসাল কাজরী। তার পর দুহাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে সে ডাকল, কুণাল! আমার কুণাল!

কুণাল শিউরে ওঠে। কাজরীর আলিঙ্গনে ওর যেন দম আটকে আসতে চায়।

কাজরী আকুল স্বরে বলে চলে, চেয়ে দেখ কুণাল, ভাল করে চেয়ে দেখ, এই আমি—তোমার কাজরী।

কুণাল শুনেও যেন শোনে না। কাজরীর আর্ত আকুল আহ্বানে সাড়া দেয় —গত পাঁচ বছর ধরে দেয় নি।

কুণালের নির্বাক মুখের দিকে চেয়ে পাঁচ বছর আগেকার তার অজস্র কথায় মুখর দিনগুলো যেন স্বপ্নের মত মনে হয়। সুদীর্ঘ নীরবতার ব্যবধান অতিক্রম করে কুণালের কথা বলা মুহূর্তগুলোকে যেন খুঁজে পাওয়া যায় না। কুণালের কথা ভাবতে গিয়ে মনে হয় বুঝি আর কারুর কথা ভাবছে সে।

.

মনে পড়ে পূর্বাচল-সঙেঘর পাঠচক্রের সেই সন্ধ্যা। বৈঠকে পৌঁছতে সেদিন দেরি হয়ে গিয়েছিল কাজরীর। সভাকক্ষের দরজার পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে—এমন সময় কানে এল, অপরিচিত কণ্ঠে কে যেন সেদিনকার আলোচ্য বিষয় জীবনে নেতিমূলক চিন্তা অস্তিত্বমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে কতখানি সাহায্য করে, সে সম্বন্ধে বলছে। স্পষ্ট সরল বলবার ভঙ্গী। বক্তব্য যাই হোক, বলবার ভঙ্গিমা শ্রুতিকে আকর্ষণ করে। কথার স্রোতে পৌরুষ যেন স্বতঃস্ফূর্ত। দেখবার মত মানুষের অভাব হয়নি কাজরীর জীবনে, কিন্তু শোনবার মত কথা বলতে পেরেছে কজন? পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে উৎকর্ণ হয়ে শুনল সে।

ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গিয়েছিল কাজরী। গলার স্বরে যাকে কল্পনা করেছে, চাক্ষুষ যেন অবিকল তাকেই দেখতে পেল। দেহের ঋজুতায় পৌরুষের অভিব্যক্তি, আত্মভোলা সুন্দর মুখ, আকাশের মায়া-জড়ানো টানা টানা চোখ দুটি যেন সুদুর স্বপ্নে সমাহিত।

কাজরী ঘরে ঢুকতেই দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হল। এক মুহূর্তে ওরা পরস্পরকে চিনে নিয়েছিল। কাজরীর স্মৃতিতে সেই প্রথম দৃষ্টির রোমাঞ্চ আজও শিউরে ওঠে। অনেক অন্বেষণের শেষে স্বপ্নসম্ভবাকে আবিষ্কারের বিস্ময় বুঝি ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল কুণালের চোখ দুটিতে।

কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারপর কুণাল আবার পূর্বকথার জের টেনে বলতে শুরু করে কাজরী লক্ষ্য করল যে তার কথার খেই সে হারিয়ে ফেলেনি।

দীপার পাশে বসে কাজরী তার কানে কানে জিজ্ঞাসা করেছিল, হ্যাঁ রে দীপু, ভদ্রলোকটি কে?

দীপা বলল, কে এক কুণাল সেন। পূর্বাচলের সভ্য হতে চান শুনলুম।

সভার শেষে কাজরীর কাছে এসে কুণাল বলল, নমস্কার কাজরী দেবী। আপনি বোধ হয় আমাকে চিনতে পারেননি?

বিব্রত মুখে কাজরী বলল, না তো।

কুণাল হেসে বলল, আট বছর আগেকার ইন্টারকলেজ ডিবেটে ধারালো তলোয়ারে মত ঝলসে উঠেছিলেন আপনি। বক্তব্য আপনার বেশী ছিল না, কিন্তু মনে স্থায়ী দাগ রাখার মত। সেদিনকার বিতর্কে আমারও সামান্য অংশ ছিল। কিন্তু আপনার সামনে আর সকলের মত আমিও নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিলুম।

মাথা নীচু করে কাজরী বলল, বড্ড খারাপ আমার স্মরণশক্তি! কিচ্ছু মনে থাকে লো।

কুণাল বলল, আমার স্মরণশক্তিও খুব সুবিধের নয়। কিন্তু—

পরক্ষণে গলার স্বর নামিয়ে সে বলে ফেলল, আপনাকে ভুলতে পারিনি।

নিমেষে আবীর রাঙা হয়ে ওঠে কাজরীর মুখখানা। মাথা নীচু করে ডান হারে অনামিকায় শাড়ির আঁচলের প্রান্ত জড়াতে থাকে সে।

গলার স্বর খাদে রেখে কুণাল বলতে থাকে, সেদিনকার বেস্ট ডিবেটার হিসেবে আপনিই মনোনীত হয়েছিলেন। কবে কথা বলতে শিখেছি স্মরণ নেই, সেদিন আপনার কথা শুনে কিন্তু আবিষ্কার করলুম যে আমরা শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে।

কাজরী লজ্জা-জড়ানো মৃদু কণ্ঠে বলল, আপনার কথা শুনে কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।

কুণাল হেসে বলে, এ আপনারই দান। সেদিনকার ডিবেটে আমার ব্যর্থতা আপনার সাফল্যের মধ্যে আশ্রয় খুঁজেছিল।

মনে মনে অস্বস্তি বোধ করছিল কাজরী। কথার মোড় ঘোরাবার জন্য সে বলল, সেদিন ডিবেটে কোন কলেজকে রেপ্রেজেন্ট করেছিলেন আপনি?

কুণাল বলল, সেন্ট জেভিয়ার্স। ওই কলেজের ফোর্থ ইয়ারের ছাত্র ছিলুম তখন। ইংরেজীতে অনার্স ছিল।

ও মা! আমারও তখন ফোর্থ ইয়ার। বেথুনে ইংরেজী অনার্স নিয়েই পড়তুম। কিন্তু য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে তো আপনাকে দেখি নি।

দেখবেন কী করে? বি. এ. পাস করে দিল্লী য়ুনিভার্সিটিতে গিয়ে ভর্তি হয়েছিলুম।

প্রথম আলাপেই কাজরীর মনের অনাহত তারে ঝঙ্কার উঠেছিল। কয়েক দিনের মধ্যেই তার মনের আগল আলগা করে দিয়ে অনায়াসে কুণাল তার পথ করে নিল।

তারপর কাজরী একদিন বলল, এ যে অকালবসন্ত কুণাল! বয়স তো আমার। কম হয়নি!

তুমি আমার চিরনবীনা-কাজরীর কানের কাছে মুখ এনে কুণাল বলল : তোমার বসন্তের সময়-অসময় নেই। চির বসন্তের রাণী তুমি।

ইডেন-গার্ডেনের নিভৃত ছায়ানিবিড় সন্ধ্যাগুলির পরিমিত অবকাশটুকু মন্থন করে অমৃত পান করে ওদের দুটি হৃদয়।

কাজরী বলল, দিনে মোটে দুটি ঘণ্টা আমাকে সঙ্গ দাও–আমার বাকি দিনের সমস্তটুকু জুড়ে থাকবার জন্য বুঝি! কাজে মন দিতে পারি নে, থসিস লেখা আর হয় না। এর চেয়ে আরও একটু সময় দাও না। আরও একটু অবসর দাও তোমাকে ভালবাসবার।

নিবিড়তম আলিঙ্গনের মধ্যে কাজরীকে বন্দী করে কুণাল বলল, আমার সমস্ত দিন রাত্রি জুড়ে থাকবে তুমি—এই তো আমি চাই। বল, কবে আমার ঘরে আসবে?

যেদিন তুমি চাও।–কুণালের বুকে মুখ গুঁজে কাজরী বলল।

বিয়ের কয়েক দিন আগে কুণাল বলেছিল, কাজরী, তোমার সাংসারিক বুদ্ধি একেবারেই পাকেনি। আমার সম্বন্ধে রীতিমত খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত ছিল তোমার।

কাজরী নিস্পলক দৃষ্টিতে কুণালের মুখের পানে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, তোমাকে তো জানি কী আর খোঁজ নেব?

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কুণাল বলল, তুমি জান, আমার আপনার বলতে কেউ নেই। তোমাকে পেয়ে আমার জীবনের শূন্যতা ভরে গেছে। তোমাকে নিয়ে আজ আমার জীবনের সত্যিকারের শুরু, তার আগেকার সৃষ্টিছাড়া দিনগুলোর কথা ভুলে যেতে চাই। আগে যেন জীবন্থত হয়ে ছিলুম—তোমাকে পেয়ে বেঁচে উঠেছি।

কুণালের গলা জড়িয়ে ধরে কাজরী বলল, থাক থাক, ও সব কথা নয়। আজকের এমনি সুন্দর সন্ধ্যাটিতে অন্য কথা বল।

কথায় তো কুলোবে না। তোমার ডিবেট শুনে মুগ্ধ হয়েছিলুম বটে, কিন্তু কথায় কি মন ভরে?বলে কুণাল কাজরীর তৃষিত ওষ্ঠাধরে গভীর চুম্বন এঁকে দিল।

কাজরীর বাবা-মা বিয়েতে রীতিমত আপত্তি জানিয়েছিলেন। জানা নেই, শোনা নেই—কোথাকার কে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, ভাল করে খোঁজ-খবর না নিয়ে বিয়েতে মত দিতে তারা সম্মত হননি।

কাজরী বলল, খোঁজ নেবার কোন দরকার নেই। ওর ওপর পুলিসের গোয়েন্দাগিরি তোমরা করতে পারবে না।

বিয়ের পর কুণালের ছোট্ট ফ্ল্যাটে কাজরীর নিরাড়ম্বর ঘরকন্না শুরু হল। পরিমিত উপকরণ, কিন্তু পরিমেয় ঐশ্বর্যের স্বাদ পেল কাজরী। দুটি স্বল্পায়ন ঘরে ঘরণী হলেও সে যেন ইন্দ্রলোকের ইন্দ্রাণী। একটি মানুষকে কেন্দ্র করে যেন একটা অনন্ত আনন্দলোক গড়ে ওঠে। হৃদয়মন্থন করা অমৃতসেচনে যে মূর্তিটি গড়ে ওঠে সে যেন কুণালকেও অতিক্রম করে যায়, সে যেন তার প্রেমের সাধনার সৃষ্টি।

অকস্মাৎ নিষ্ঠুর আঘাতে সে মূর্তি ভেঙে গিয়েছিল।

কাজরীর বাবাই খবরটা এনে গিয়েছিলেন। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে নাকি তাঁর ঘুম হচ্ছিল না। গোপনে কুণাল সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন তিনি।

কাজরীকে একদিন তিনি ডেকে পাঠালেন। তার কাছে উদঘাটিত করে দিলেন কুণালের প্রকৃত পরিচয়।

কাজরীর চোখের সামনে রূপেবর্ণে-গন্ধে-ভরা তিলেতিলে গড়ে-ওঠা আনন্দলোক মুহূর্তে বিবর্ণ বিরস হয়ে ওঠে। মনের কানায় কানায় ভরে-ওঠা অমৃত বিষে রূপান্তরিত হল।

কাজরীর বাবা রণদাবাবু ম্যাকনেইল অ্যান্ড বেরীতে খবর নিয়ে জেনেছিলেন যে, কুণাল সেখানে চাকরি করে না। তারপর হঠাৎ কুণালের মায়ের খোঁজ পেলেন; বাগবাজারের এক অখ্যাত গলিতে মাটির দুটো ঘর ভাড়া করে তিনি তার নাবালক ছেলেমেয়েদের নিয়ে থাকেন। কুণালের সামান্য রোজগারই তার একমাত্র অবলম্বন। কোনও এক মাড়োয়ারীর গদিতে কুণাল নাকি কাজ করে, বেতন তিন শো নয়, দেড় শো। বি.এ. পাস করেই সে নাকি চাকরিটি নিয়েছিল। দিল্লী য়ুনিভার্সিটিতে এম.এ. ক্লাসে ভর্তি সে কোন কালেও হয় নি। কাজরীর সঙ্গে কুণালের বিয়ের খবর কুণালের মা বিয়ের প্রায় এক মাস বাদে জানতে পারলেন। এতদিন কুণালের কোন খোঁজ ছিল না। বাড়ি ছেড়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছিল কুণাল। রণদাবাবুর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে কুণালের মা তার কাছে এসেছিলেন।

রণদাবাবুর কাছে তিনি তার ছেলেকে ফিরে পাবার জন্য ভিক্ষা জানিয়ে গেছেন।

রণদাবাবু কাজরীকে বললেন, বুদ্ধি-বিবেচনা তো তোর কম নয় মা, এখন ভেবে দেখ কী করব!

দু চোখে দুঃসহ জ্বালা ছিটিয়ে কাজরী বলল, কে তোমাকে অত খোঁজ খবর নিতে বলেছিল বাবা! তোমাকে আমি বলিনি আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি তুমি করো না?

দু চোখ কপালে তুলে রণদাবাবু বললেন, গোয়েন্দাগিরি কাকে বলছিস মা। কুণালের মা নিজেই খোঁজখবর নিয়ে এলেন, তাতেই জানলুম

রণদাবাবুর কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ঝড়ের বেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল কাজরী।

রোজকার মত সেদিন রাত্রে কুণাল দু ছড়া রজনীগন্ধার মালা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল। মালা দুটো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে মেঝেতে ছড়িয়ে দিল কাজরী।

এ কী করলে কাজরি!কুণাল আর্তস্বরে বলে ওঠে।

ঠিকই করেছি। কঠোর স্বরে কাজরী বলল ও আমার গলায় তোমার হারে ফুলের মালার চেয়ে দড়ি দেওয়াও ভাল। তোমার অসংখ্য মিথ্যার মত ও-মালাটিও তো ছল!

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কুণাল। কাজরীর কথাগুলো যেন গলিত ধাতুর মত তার কানে এসে ঢুকতে থাকে। অতি কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে নিয়ে সে বলল, সব শুনেছ মনে হচ্ছে, কিন্তু কী করে?

তোমার মা আমার বাবার কাছে এসেছিলেন। তা ছাড়া ম্যাকনেইল এ্যান্ড বেরীতে আমার বাবার যাতায়াত আছে। কঠিন জমাটবাঁধা গলায় বলল কাজরী।

পাংশু হয়ে ওঠে কুণালের মুখ। কিন্তু সে কয়েক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে কাজরীর প্রদীপ্ত চোখ দুটির দিকে চেয়ে সে বলল, নিজের দৈন্য ও তুচ্ছতা নিয়ে তোমরা কাছে এগুতে সাহস হয়নি, তাই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম। মিথ্যের দুঃসহ গ্লানির বোঝা মাথা পেতে নিয়েছিলুম তোমাকে পাবার জন্যে।

কিন্তু কেন?—দু চোখে অমানুষিক জ্বালা ছিটিয়ে কাজরী বলল। কী করে জানলে তোমার দারিদ্র্য আমি সহ্য করতে পারব না?

কুণাল গাঢ় কণ্ঠে বলল, আমার দেউলে-হওয়া জীবনে দাঁড়াবার জায়গা নেই। সেখানে তোমার যোগ্য ঠাই ছিল না। আমার দৈন্যের ফাঁকে ভালবাসার ফুল ফোঁটাতে পারতুম না। ভারবাহী পশুর পরিচয় নিয়ে কী করে বলতুম তোমায় যে, তোমাকে আমি ভালবাসি?

তাই বলে নিজের বিধবা মা, নাবালক ভাইবোনদের দায়িত্ব থেকে পালিয়ে এসে নিজের সুখ খুঁজেছ!

কুণাল ম্লান হেসে বলল, নিজের সুখ! সুখই শুধু দেখছ কাজরী! রম সুখের জন্যে রম দুঃখের মূল্য আমি দিয়েছি সে তো তুমি জান না।

খুব হয়েছে, থাম। কাজরীর সুন্দর মুখে নির্দয় কাঠিন্য ফুটে ওঠে : ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলতে খুব পার। মিথ্যে মিথ্যে—যা বলছ সবই মিথ্যে। এক ফোঁটা সত্য নেই তোমার মধ্যে। তোমার ভালবাসাও মিথ্যে।

মড়ার মত সাদা হয়ে ওঠে কুণালের মুখ। তার আহত দৃষ্টির মর্মান্তিক বেদনা কাজরীর নজরেও এল না।

খাটের একটি প্রান্ত দু হাত দিয়ে চেপে ধরে যেন প্রাণপণ আঘাত হজম করবার চেষ্টা করেছিল কুণাল। কোন কথাই বলতে পারেনি।

কাজরীর মনের আগুন আত্মবিস্মৃত চিৎকারে ফেটে পড়ে : আর এক মুহূর্তও তোমার সংস্রব আমি রাখতে চাই না। এই এক মাস তোমার ধ্ব মিথ্যেকে মাথা পেতে নিয়ে নিজেকে তোমার কাছে সঁপে দিয়েছি, এর জন্য নিজেকেও আমি ক্ষমা করব না। আমি চললুম।

না, যেয়ো না।–বলে খপ করে কাজরীর একটি হাত ধরে ফেলল কুণাল। হাতে যেন হাজারটা বিছে কামড়ে দিয়েছে, এমনি মনে হল কাজরীর। এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে বলল, ছুঁয়ো না আমাকে। ঠক, জোচ্চোর কোথাকার!

কুণাল শিউরে ওঠে। অস্বাভাবিক সে শিহরণ। অব্যক্ত যন্ত্রণায় তার সুন্দর মুখটা দুমড়ে মুচড়ে ওঠে। কাজরী দেখল।

অনতিবিলম্বে কুণালের ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেল কাজরী। কুণাল নিষ্প্রাণ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল, একটি কথাও বলল না।

হিন্দুস্থান রোডে দীপাদের হস্টেল। সেখানে গিয়ে উঠল কাজরী। রণদাবাবু খবর পেয়ে ছুটে এসে বললেন, এ কী, এখানে কেন? বাড়ি চল।

কাজরী বলল, না।

সে কি! নিজের বাড়িতে যাবি নে!

দোহাই তোমার বাবা, কিছুদিন একা থাকতে দাও আমাকে।

বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই সহানুভূতি জানাতে এগিয়ে আসে। কিন্তু কাজরী সযত্নে সবাইকে এড়িয়ে চলে। তার প্রতিটি দিন যেন ভারবাহী নৌকার মত স্বেচ্ছামত ভেসে যায়। অনুভূতিশক্তি যেন ভোতা হয়ে গেছে, দুঃখ-ক্লেশবোধও বুঝি নেই।

য়ুনিভার্সিটি-লাইব্রেরির এক কোণে সকাল থেকে সন্ধ্যা বইয়ের স্তুপের মধ্যে প্রাণপণ নিজেকে হারিয়ে ফেলবার চেষ্টা করে সে, তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা তার থিসিসের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করে সে যেন বিশ্বসংসারকে বিস্মৃত হতে চায়।

কিন্তু পারে না। আত্মশাসনের কঠোরতা সত্ত্বেও অবাধ্য পাগলা ঘোড়ার মত মন তার লাগামছাড়া হয়ে অতি-অবাঞ্ছিত চিন্তাগুলির অলিতে গলিতে ছুটোছুটি করতে থাকে। কঠোর বিস্মৃতির মধ্যে যাকে সে প্রাণপণে তলিয়ে রাখতে চায় মনের কঠিনতম আগল ভেঙ্গে বার বার সে আত্মপ্রকাশ করে। মনের সমস্ত ঘৃণা-জড়ো করা আগুনে ওর স্মৃতির শেষ কণাটিকেও পুড়িয়ে ছাই করে ফেলতে গিয়ে সে নিজেই দগ্ধ হয়। তার লজ্জাকর স্মৃতি তার সমস্ত সত্তাকে জড়িয়ে থাকে। এ যেন চরম লজ্জাকর রাহুগ্রাস, যার কবল থেকে মুক্তি নেই।

বাক্স ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ একদিন কুণালের একটি ছবি বেরিয়ে পড়ল। ছবিটি হাতে নিয়ে কাজরী প্রথমে ভাবল ছিঁড়ে নিশ্চিহ্ন করে। কিন্তু পরক্ষণে তার নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেকে সে যেন ছবির মধ্যে হারিয়ে ফেলল। দেবদুলভ অনিন্দ্য মুখকান্তি, আয়ত উজ্জ্বল চোখ-জোড়ায় কোথাও এক ফোঁটা পাপ নেই। কাজরীর বুকের ভেতরটা হঠাৎ যেন বেদনায় মুচড়ে ওঠে। ওর সেই বিদায়-মুহূর্তের বেদনাবিদ্ধ করুণ দৃষ্টি মনে পড়ে গেল তার। যত মিথ্যারই আশ্রয় নিক, ওর ভালবাসায় সত্যিই তো কোনও ফাঁকি ছিল না।

কাজরীর মনের পাহাড়প্রমাণ কঠোরতার বরফগুলি গলতে থাকে। তার শুষ্ক চোখের মরুদাহে মেঘের ছায়ার সঞ্চার হয়, অশ্রুধারায় বহু বিনিদ্র প্রহর কেটে যায়।

সে ভেবে পেল না কী করবে। ওকে ফিরিয়ে এনে অনুতপ্ত অশ্রুভরা আত্মসমর্পণের জন্য তার সমস্ত নারীহৃদয় আকুল হয়ে ওঠে, কিন্তু একবার যে মন সংশয়বিমুখ হয়েছে, সে যেন আর সহজ হতে চায় না। অকুণ্ঠ আত্মদান আর বুঝি সম্ভব নয়।

লাইব্রেরি-ঘরের কোণে সন্ধ্যাগুলি বড় নিঃসঙ্গ, বড় বিষণ্ণ মনে হয় কাজরীর। বাইরে ক্রমশ-ঘনিয়ে-আসা অন্ধকার যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তার সমস্ত ভবিষ্যৎ জীবনকে যেন এই অতলস্পর্শী অন্ধকারের মধ্যে সে প্রত্যক্ষ করল। পিছনে ফেলে-আসা দিনগুলির স্বপ্ন সৌরভের স্মৃতি লাইব্রেরি-ঘরের বন্ধ বাতাসকে উতলা করে তোলে। কাজরী ভয় পায়। যেন চিরদিনের মত তার জীবন থেকে সমস্ত রঙ-রস নিঃশেষে মুছে গেছে, এক সীমাহীন নৈঃসঙ্গ্য যেন তিলে তিলে তাকে গ্রাস করছে।

অসহ্য লাগে কাজরীর। এক-একদিন লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসে, রাস্তায় জনস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে লক্ষ্যহীনের মত ঘুরে বেড়ায় সে ইতস্ততঃ।

একদিন সে ইডেন গার্ডেনে এল। ছায়াচ্ছন্ন অস্ফুট আলোর কুহক-জড়ানো, কাকর-ছড়ানো পথে দাঁড়িয়ে থাকে সে আচ্ছন্নের মত। এ পথ যেন তার অতীতের করুণ রঙিন অধ্যায়—এপথে চলার অধিকার সে যেন চিরকালের মত হারিয়ে ফেলেছে।

প্যাগোডার অনতিদূরে অন্ধকারের সঙ্গে একাকার বেঞ্চিটার কাছে এসে দাঁড়াল সে দ্বিধাজড়িত পদক্ষেপে। অনেক মুধুর স্মৃতি সৌরভ যেন এখানকার বাতাসকে ভরে রেখেছে।

হঠাৎ যেন সেই বিস্মৃত প্রায় অতীতের স্বপ্নগুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে করুণ আবানে।

কাজরী!

কাজরী চমকে ওঠে। কাজরীর পাশে এসে দাঁড়াল স্বপ্ন নয়, কুণাল।

আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশী। তবু কাজরী দেখতে পেল শুষ্ক শীর্ণ চেহারা, সরল-সুন্দর চোখ দুটিতে নিবিড় করুণ কাতরতা।

কিন্তু এ কী হল তার! তার মনের সমস্ত আকুলতা নিমেষে নিথর হয়ে মনটাকে পাথরের মত শক্ত করে তোলে কেন?

রুদ্ধশ্বাসকম্পিত স্বরে কুণাল বলল, তুমি এসেছ কাজরী?

এমনি বেড়াতে এসেছিলাম। —নির্লিপ্ত, উদাসীন কণ্ঠে কাজরী বলল।

কুণালের মাথা নিমেষের জন্য নুয়ে আসে। পরক্ষণে মাথা তুলে সে বলে, শুধু বেড়াতে?

হ্যাঁ, তাই। কাজরী বলল।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে কুণাল ক্ষীণ আর্তকণ্ঠে বলল, আমার অপরাধের কি ক্ষমা নেই কাজরী?

কাজরীর বুক ফেটে যায়। ইচ্ছে করে সেই মুহূর্তে ওর বুকে আঁপিয়ে পড়ে বলে তুমি আমার জীবনকে পূর্ণ করেছ, তোমার অপরাধ নিয়ে আমি অপরাধী হতে চাই নে।

কিন্তু এ কী নিষ্ঠুর জ্বালা তার চোখে জ্বলে! যন্ত্রণা দেবার জন্যই যেন মরিয়া হয়ে ওঠে সে। বলে, না, নেই। মিথ্যে আমি সইতে পারি নে। মিথ্যের পাহাড় সাজিয়েছ, তুমি কি জানতে না যে মিথ্যে কখনও চাপা থাকে না?

জানতুম।—ওষ্ঠপ্রান্তে ম্লান হাসি ফুটিয়ে কুণাল বলল? কিন্তু সেই সঙ্গে এই বিশ্বাসও ছিল যে তুমি আমাকে ভালবাস। তোমার ভালবাসা তোমাকে ক্ষমা করবার শক্তি দেবে ভেবেছিলুম।

কাজরী চমকে ওঠে।

কুণাল বলে চলে, বুঝতে পারছি, তুমি আমাকে ভালবাসতে পারনি। হয়তো দু দিনের জন্যে নিজেকে ভুলেছিলে।

কুণাল!–কাজরী আর্তনাদ করে ওঠে।

কুণাল স্থির অবিচল, অদ্ভুত দৃষ্টিতে বহুক্ষণ ধরে কাজরীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। খানিকক্ষণ বাদে উত্তেজিত স্বরে সে বলে ওঠে, আমার ভালবাসা আমার প্রতিটি মুহূর্তের মধ্যে আগুনের মত জ্বলছে। আমি আর সইতে পারছি নে। প্রতিদান চাই না, শুধু ভালবাসতে চাই।

বলতে বলতে দু হাত বাড়িয়ে হঠাৎ কাজরীকে সে জড়িয়ে ধরে নিষ্ঠুর আলিঙ্গনের মধ্যে নিষ্পিষ্ট করতে করতে বলল, তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না কাজরী। আমার জীবনের আর সব চাওয়া-পাওয়া ফুরিয়েছে, শুধু তোমাকে চাই।

ছেড়ে দাও আমাকে।—অমানুষিক চিৎকার করে ওঠে কাজরী ও ছাড় আমাকে ছাড়।

কাজরীর চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে নিমেষের মধ্যে এক দল তোক ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হল।

কাজরীকে ছেড়ে দিল কুণাল। লোকগুলো প্রায় সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে : কী হয়েছে?

কাজরী হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ওই লোকটা আমার গায়ে হাত তুলেছিল।

মুহূর্তের মধ্যে ইডেন গার্ডেনের শান্ত স্তব্ধ সন্ধ্যার বুকে রক্তাক্ত বিভীষিকার সৃষ্টি হল। নিমেষে এতগুলো লোক এতখানি নৃশংস হয়ে উঠল কী করে, কাজরী ভেবে পেল না।

আত্মরক্ষার বিন্দুমাত্রও চেষ্টা করেনি কুণাল। তার ভয়লেশহীন ঋজুতা এক মুহূর্তের জন্যও নুয়ে যায়নি। একটি কথাও সে বলেনি, অস্ফুটতম চিৎকারও তার গলা থেকে বেরিয়ে আসেনি।

ছায়াভরা বিষাদ তার আয়ত চোখ দুটিতে আচ্ছন্ন করে ছিল, কাজরীর মুখের ওপর নিস্পলক নিবদ্ধ সরল সকরুণ অবিকৃত দৃষ্টি শূন্যতার মধ্যে মিলিয়ে যাবার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আকাশের তারাগুলির মতই প্রদীপ্ত হয়ে রইল। ওদের দুজনের সোহাগনিবিড় সব কটি সন্ধ্যার নিবিড় মায়া যেন সেই কটি মুহূর্তে তার চোখ দুটিতে ছাপিয়ে উঠেছিল।

কাজরীর পরবর্তী প্রতিটি বিনিদ্র রাত্রির বুকে ওই দৃষ্টির স্বাক্ষর থেকে গেছে।

অ্যাম্বুলেন্স এল। কুণালকে মেডিক্যাল কলেজের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হল।

কাজরীর বহু উৎকণ্ঠিত দিন ও রাত্রি জীবন-মৃত্যুর নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বের সাক্ষী হয়ে রইল। প্রথম একটি মাস জুড়ে শঙ্কা ও সংশয়, তারপর অতি ধীরে ধীরে সেরে উঠতে থাকে কুণাল। কাজরীর অনেক দিনের শঙ্কাভীরু প্রতীক্ষার শেষে কুণালের জ্ঞান ফিরে এল— সে চোখ মেলে তাকাল। তাকাল বটে, কিন্তু কোথায় সেই সুদূর স্বপ্নলীন দৃষ্টি, যাতে স্বর্গের হাতছানি প্রত্যক্ষ করেছিল কাজরী? এ কোন্ অপরিচিত আগন্তুক, যার শূন্য চোখে চাওয়া চির অপরিচিতের রাজ্যে ব্যর্থ অন্বেষণে দিশেহারা? চেতনা হারাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত প্রদীপ্ত স্বর্গের আলো কোথায় হারিয়ে গেল। কাজরীর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে।

রণদাবাবু বললেন, ওর পাওনা শাস্তিই ও পেয়েছ, তার জন্য দুঃখ করিস নে মা। ওকে অ্যাসাইলামে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে তুই ঘরে ফিরে আয়।

কাজরী বলল, সে হয় না বাবা।

কুণালের মায়ের শুকনো চোখে মর্মান্তিক জ্বালা প্রত্যক্ষ করেছিল কাজরী। তিনি বলেছিলেন, সর্বনাশী মেয়ে! আমার সোনার ছেলেকে ভুলিয়ে আমার কাছ থেকে। কেড়ে নিয়েছ, তারপর ওকে প্রাণে মারতে চেয়েছিলে। কিন্তু এ কী করেছ! প্রাণে না মেরে এ কী সাংঘাতিকভাবে মেরে রেখেছ ওকে! আমি মা—আমি বলছি আমি যেমন ভুগছি, তার হাজার গুণ তুমি প্রতি মুহূর্তে ভুগবে।

তাই হোক মা—অবরুদ্ধ কণ্ঠে কাজরী বলেছিল।

কুণাল হাসপাতাল থেকে খালাস পেল। তাকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে এল কাজরী।

কুণালের নিজের হাতে অতি যত্নে সাজানো ঘরগুলির মধ্যে কোথাও পূর্বস্মৃতির কোন সূত্র খুঁজে পেল না কুণাল। তার পরিচিত বস্তুগুলি তার আচ্ছন্ন চেতনায় লেশমাত্রও সাড়া জাগাল না।

সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্তর মুখার্জি কুণালকে পরীক্ষা করে বললেন, রীতিমত শক ট্রিটমেন্ট করতে হবে। বাড়িতে রেখে করতে অনেক হাঙ্গামা—অনেক খরচও। তার চেয়ে–

কাজরী বাধা দিয়ে বলে, যত হাঙ্গামা হোক খরচ হোক, বাড়িতেই ওঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন ডক্টর মুখার্জি। হাসপাতালে বা অ্যাসাইলামে ওঁকে ভর্তি করাতে পারব না আমি।

ডক্টর মুখার্জি বললেন, কেন মা? হাসপাতলে বা অ্যাসাইলামে ভর্তি করাতে হাঙ্গামা তো কিছু নেই।

কাজরী চুপ করে রইল। ডক্টর মুখার্জিকে সে কী করে বোঝাবে যে কুণালের প্রতিটি মুহূর্তকে সে আগলে রাখতে চায় অনুতপ্ত হৃদয়ের ব্যাকুলতা দিয়ে! যে চরম ভুল-বোঝার মধ্যে তার চেতনা ডুবে গেছে, চেতনার উন্মীলন-মুহূর্তে অনুতাপের অশ্রুধারায় তার পরিসমাপ্তি ঘটাবে সে! হাসপাতাল বা অ্যাসাইলামের বিরস রুগ্ন পরিবেশ নয়, সে চায় তার বুকভরা ভালবাসার স্নিগ্ধ ছায়ায় কুণাল জেগে উঠুক।

কাজরীর জেদে বাড়িতেই চিকিৎসার ব্যবস্থা হল। দিনের পর দিন মাসের পর মাস কুণালের বোধশক্তিহীন মস্তিষ্কে চেতনার সঞ্চারের ক্লান্তিকর প্রয়াস চলে।

কিন্তু কোন ফল হয় না। কুণালের শূন্য দৃষ্টিতে এক ফোঁটা বুদ্ধির স্ফুলিঙ্গও জাগে না। মুখে ভাষা ফোটে না। সমস্ত চিকিৎসার বিরুদ্ধে অনড় হয়ে থাকে তার নিঃসাড় নির্বোধ সত্তা।

মুখ ফুটে না বললেও বোঝা যায় যে, ডক্টর মুখার্জি আর তেমন আশান্বিত বোধ। করছেন না।

ইতিমধ্যে কাজরী তার রিসার্চ ছেড়ে একটি মহিলা কলেজে অধ্যাপনার চাকরি নিয়েছে। কলেজে চাকরি ছাড়াও প্রাইভেট টুইশান ও নোটবই লেখার কাজ নিয়ে বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করতে হয় তাকে। কুণালের চিকিৎসার খরচ আছে, তার মা ও ভাইবোনদের ভরণপোষণের যাবতীয় দায়িত্ব সে নিয়েছে, কেবলমাত্র অধ্যাপনার পরিমিত আয়ে সমস্ত ব্যয়সঙ্কুলান হওয়া শক্ত।

বাগবাজারের এঁদো গলি থেকে অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন পাড়ায় একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে কুণালের মা ও ভাইবোনদের স্থানান্তরিত করল কাজরী। নিজের ফ্ল্যাটে ওঁদের সে নিয়ে যেতে চেয়েছিল; কিন্তু কুণালের মা আপত্তি করেছিলেন।

রণদাবাবু দীপা মারফত কাজরীকে বলে পাঠালেন যে, কুণালকে অ্যাসাইলামে ভর্তি না করালে কাজরীর সঙ্গে কোন সম্পর্ক তিনি রাখবেন না।

কাজরী বলল, নাই রাখলেন।

শেষ পর্যন্ত রণদাবাবু একটি চিঠি লিখলেন কাজরীকে। তিনি লিখলেন, কলেজে চাকরি ছাড়াও বাড়তি রোজগারের জন্য দু বেলা অতিরিক্ত খাটুনি খেটে তোমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে শুনি। অবাঞ্ছিত কতকগুলো দায়িত্ব নিয়ে অনর্থক নিজেকে তুমি তিলে তিলে কেন ক্ষয় করছ জানি না। কুণাল ও তার মা-ভাইবোনদের দায়িত্ব নিয়ে তুমি আত্মনিগ্রহ করে যাচ্ছ। পত্রপাঠ তুমি ওদের ছেড়ে চলে এসে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন কর।

কাজরী এ চিঠির কোনও জবাব দেয়নি।

বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায় সকলেই কাজরীর ওপর বিরক্ত হল। কুণালকে ছেড়ে এসে আবার পুর্বের সহজ নির্ঞ্ঝাট জীবনের মধ্যে ফিরে আসতে পরামর্শ দিল ওরা সবাই। কাজরীর মনে হল, সমস্ত বিশ্বসংসার যেন তার বিরুদ্ধে এসে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে অতল নৈঃসঙ্গবোধের মধ্যে তার মনটা যেন দিশেহারা হয়ে যায়, কুণালের ভাবলেশহীন চোখের দৃষ্টিতে সে যেন কোন আশ্রয়ই খুঁজে পায় না।

এক-একদিন তার মনে হয়, কুণাল বুঝি আর সেরে উঠবে না। ডক্টর মুখার্জির বিধাগ্রস্ত কথাবার্তাগুলি তার মনের মধ্যে আশঙ্কা জাগায়। যে আঁধার কুণালের চেনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, সে যেন তার সমস্ত অস্তিত্ববোধকে ছেয়ে ফেলে।

কাজরীর সুমুখে তার সমস্ত ভবিষ্যৎ জুড়ে অবশ্যম্ভাবী আঁধারের ভয়। কুণালের আচ্ছন্ন চেতনায় এক নিমেষের জন্যও যদি একটু আলোর স্ফুলিঙ্গের সঞ্চার হত! একটি মুহূর্তের জন্যও যদি সে তাকে চিনতে পারত! এক নিমেষের জন্য যদি তার আঁধার মনে চাপা-পড়ে-থাকা বিপুল অভিমানকে ঘুচিয়ে দেবার সুযোগ পেত।

মাসের পর মাস, বছরের পর বছর যায়। যেন নিষ্ফল ভারবহনের ক্লান্তিকর সম্ভাবনা নিয়ে এক-একটি দিনের প্রভাত আসে, সারাদিনের কাজকর্মে একঘেয়ে পুনরাবৃত্তিগুলি মনে অবসাদ আনে। তার পর সুদীর্ঘ বিনিদ্র রাত্রি-জোড়া নৈঃসঙ্গবোধ। নিদ্রিত কুণালের মুখের দিকে চেয়ে মনের মধ্যে গুমরে ওঠে নিষ্ফল কান্না। কুণালের আধার মন যেন সমস্ত রাত্রিকে জুড়ে থাকে। তার সেই হারিয়ে-যাওয়া চোখের আলো আকাশের তারায় তারায় সুদূর স্বপ্নের স্মৃতির মত ঝিলিক দেয়। কুণালের চোখে আবার তা এসে মিশবে আর বুঝি তার কোন সম্ভাবনা নেই।

ব্যাকুলভাবে কুণালকে জড়িয়ে ধরে কাজরী বলে, সামান্য কয়েকটা মুহূর্তের জন্যও আমাকে দয়া করতে পার না? চিরদিনের মত আমাকে অপরাধী করে রাখবে? একটিবারও জানতে চাও না কী কঠিন প্রায়শ্চিত্ত আমি করে যাচ্ছি?

ডক্টর মুখার্জি বললেন, সেরে উঠতে বেশ কিছু সময় লাগবে মনে হচ্ছে।

কাজরী বলল, প্রায় পাঁচ বছর কেটে গেছে ডক্টর মুখার্জি। আর কতদিন?

আর কতদিন!—ডক্টর মুখার্জি যেন অস্বস্তি বোধ করেন? সে তো আমি বলতে পারি নে মা।

কাজরী আকুল হয়ে বলে, ডক্টর মুখার্জি, পুরোপুরি ও সেরে উঠবে—এ যেন আর আশা করতে পারছি না। এখন ভাবছি, সামান্য কিছুক্ষণের জন্যও যদি ওর চৈতন্য হত!

তা কেন মা! কুণাল পুরোপুরিই সেরে উঠবে—ডক্টর মুখার্জি ঈষৎ ইতস্ততঃ করে বললেন।

কাজরী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তার মুখের পানে তাকাল।

রণদাবাবু দীপাকে বললেন, আমি ভুলে যেতে চাই যে আমার মেয়ে বেঁচে আছে।

বান্ধবীদের মধ্যে একমাত্র দীপাই এসে মাঝে মাঝে খোঁজ নেয় কাজরীর।

দীপা একদিন বলল, বারো মাস—তিন শো পঁয়ষট্টি দিন একটা পাগলকে নিয়ে আছিস, অথচ সজ্ঞানে যারা তোর হিতাকাঙ্ক্ষী তাদের সংস্রব ছেড়েছিস! তোর জন্যে দুঃখ হয় কাজরী।

কাকে পাগল বলছিস তুই!—কাজরী প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

দীপা বলে, কুণালের রোগটাকে তো অস্বীকার করতে পারিস না। পাগলকে পাগল বললে দোষ কী হয় ভেবে পাই নে।

কাজরী বেদনার্ত চোখে দীপার দিকে চেয়ে থাকে, কিছু বলে না।

দীপা বলল, রোগের উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হয়। বাড়িতে রেখে কুণালের চিকিৎসার যত ভাল ব্যবস্থা কর না কেন, কোন ফল হবে না। তোর এই অহেতুক অন্ধ মমতা সব রকম চিকিৎসার প্রতিবন্ধক। ডক্টর মুখার্জির সঙ্গে আজ আমার দেখা হয়েছিল, তিনি বললেন, কুণালকে সারিয়ে তুলতে হলে প্রথমেই দরকার ওকে তোর কাছ থেকে সরিয়ে আনা।

সঙ্গে সঙ্গে কাজরীর বহু বিনিদ্র রাত্রির কালিমালিপ্ত চোখে বিদ্যুৎ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। রুদ্ধশ্বাস-চাপা উত্তেজিত স্বরে সে বলে ওঠে, ডক্টর মুখার্জির সঙ্গে তুই দেখা করতে গিয়েছিলি? কে বলেছিল তোকে যেতে?

দীপা হতভম্ব। আমতা আমতা করে বলে, কে আবার বলবে! কুণালের অবস্থাটা উনিই ভাল বলতে পারবেন বলে ওঁর কাছ গিয়েছিলুম।

কাজরী চিৎকার করে ওঠে, তোদের কী মতলব আমি বুঝি না ভেবেছিস! ওকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নেবার জন্যে সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে চলেছিস। তাই ডক্টর মুখার্জির কাছে গিয়েছিলি।

দীপা নির্বাক, একটি কথাও বলে না।

চলে যা তুই, আর আসিস না। তোর সংস্রব আর আমি রাখতে চাই না।

কাজরীর প্রায়-চেঁচিয়ে বলা কথাগুলোর পরতে পরতে কান্নার উচ্ছ্বাস।

দীপা চলে গেল।

কাজরীর খোঁজখবর নিতে সে আর আসে ন। কুণালের শূন্য চোখের দিকে চেয়ে কাজরীর বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। মনে হয়, কেবলমাত্র তার উপস্থিতি দিয়ে দীপা তার শূন্যতাবোধের যে বিপুল গহ্বরটার অনেকখানি আড়াল করে রেখেছিল তা যেন পুরোপুরি প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আঁধারলীন শূন্যতার গ্রাস তিলে তিলে তাকে আকর্ষণ করছে, ওখানে তলিয়ে যেতে আর বুঝি তার দেরি নেই।

কিন্তু এ তো সে চায়নি!

কুণালকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে ফিরে পেতে চেয়েছে, আঁধার নয়, আলোর দিকে যেতে সে চায়। কিন্তু দিনের পর দিন যাচ্ছে–সুমুখে নৈরাশ্য ছাড়া কিছু তো সে দেখতে পাচ্ছে না!

নিজের অবস্থার কথা ভেবে শিউরে ওঠে কাজরী। তিলে তিলে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তার দেহ-মন–কুণালের মৃত প্রায় চেতনার দিবারাত্রির সান্নিধ্য তার সমস্ত সত্তাকে যেন হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে।

অথচ সে তো বাঁচতে চায়।

সে দিন গভীর রাত্রে বিছানা থেকে উঠে এসে লেখবার টেবিলে আলো জ্বালিয়ে ডক্টর মুখার্জিকে চিঠি লিখতে বসল কাজরী।

ডক্টর মুখার্জিকে সে লিখল, কুণালকে উপযুক্ত ক্লিনিকে ভর্তি করবার ব্যবস্থা তিনি যেন করে দেন।

চিঠি লেখা শেষ হতেই মৃদু আহ্বান কাজরীর কানে এল।

কাজরী!

সুদীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সে কান পেতে আছে এ আহ্বানের জন্য। ভুল শোনেনি তো সে?

কাজরী!

আবার স্পষ্ট শুনতে পেল কাজরী। ভুল শোনেনি, কুণালই ডাকছে তাকে।

কাজরীর বুকের রক্তস্রোত উদ্দাম হয়ে ওঠে।

টেবিল-ল্যাম্পের স্বল্পায়তন আলোকবৃত্তের বাইরে গাঢ় ছায়ার মধ্যে বিছানার আদলটুকুই শুধু চোখে পড়ে। কুণালকে সে দেখতে পাচ্ছিল না।

তাড়াতাড়ি খাটের কাছে এগিয়ে এল কাজরী। তার হাত পা কাঁপছে। কোনমতে বেড-সুইচটা টিপে কুণালের শিয়রে এসে দাঁড়াল সে।

নীলাভ আলোয় কুণালের উন্মীলিত চোখ দুটি দেখতে পেল কাজরী। পাঁচ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আলো প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে তার চোখের তারায়।

কুণালের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কাজরী ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে, এই যে আমি, তোমার কাজরী। চেয়ে দেখ কুণাল!

কাজরীর চোখে চোখ রাখল কুণাল। কয়েক মুহূর্ত মাত্র। তারপর ধীরে ধীরে আবার তার চোখ দুটি থেকে সব আলো নিবে গেল। আবার অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সে।

দু হাত দিয়ে ব্যাকুলভাবে কুণালকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কাজরী। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে বলে, আমাকে চিনে যাও কুণাল। আর কিছু চাই নে—শুধু আমাকে চিনে যাও।

কুণাল ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কাজরীর বুকফাটা কান্না তার অসাড় চেনায় শুধু নিষ্ফল মাথা কোটে।

বেড সুইচ নিবিয়ে লেখবার টেবিলে আবার এল কাজরী। ডক্টর মুখার্জিকে লেখা চিঠিখানা তুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিল সে।

আজীবন দিন-রাত্রি – জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

রবিকে বাসায় নিয়ে আসার জন্যে আমি স্টেশনে যাচ্ছিলাম।

রীণা বললো, আর একবার ভেবে দেখলে হতো না?

.

তার স্বর এতে নিরুত্তাপ, নির্লিপ্ত যে জবাব দিতে সময় নিতে হলো। আর মুখেও কোনো রেখা নেই। আমি বললাম, ভেবে দেখার সময় নেই রীণা। ট্রেন আসবে ঘণ্টা খানেকের মধ্যে। আমার স্টেশনে যাওয়া উচিত। আর—। কথা শেষ করার আগে আবার ভেবে নিলাম, আর দেখো, রীণা, আরও অনেক দিন কাটাতে হবে, এমনি করে কেউ বাঁচে না।

ঘর ছেড়ে বেরুনোর মুখে বললাম, স্ব কিছু সহজ করে নাও।

আগের মতো গাঢ় আলিঙ্গনে আর তাকে ধরা যাবে না জানতাম। তবু প্রফু মুখে তার হাতে ঝাকুনী দিয়ে বললাম, কি রবি, কেমন আছো? গাড়ীতে ঘুম হয়েছিলো তো?

রবি অবাক হবার ভাণ করছিলো, আরে মনি, তুমি কি দারুণ ভদ্র হয়ে গেছে।

আমি চাইছিলাম, এই কষ্টকর ব্যাপারটা যাতে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। জোর দিয়ে বললাম, বিয়ে করলে বাই কিছুটা পালটায়। তুমিও তো কিছু কম পালটে যাওনি।

যদি সে আমার ইচ্ছা বুঝতো, যদি সে প্রশ্ন করতো, রীণা কেমন আছে, আমাকে ভালোবাসে কি না, তার কথা মনে রেখেছে কি না তাহলে কি হতো বলা যায় না, হয়তো সহজে বেড়াগুলো পার হয়ে আসা যেত। কিন্তু আমরা কেউ তা করি না। আমরা অনেককাল বাঁচতে চাই।

রবি আমার ইচ্ছেয় সাড়া দিলো না। খানিক ইতস্তত করে বললো, আমার চিঠি পেয়েছিলে তো। কোন হোটেলে।

তার দিকে তাকিয়ে বললাম, হোটেল এখনো কিছু ঠিক করিনি। এখন বাসায় চলো। আগে এলেও তো আমার বাসায়ই উঠতে। তার ঠোঁট একবার দু’বার নড়তে চাইলো দেখে আমি আর স্কুটার নিলাম না। শব্দে কারো কোনো কথা শোনা যাবে না।

রিক্সায় উঠে আমার চাকরির কথা, পুরনো বন্ধু, যারা এখানে আছে, তাদের কথা জিজ্ঞাসা করলো রবি।

বাড়ী তখনো কিছুদূরে। রবি আমার দিকে চাইলো, মনি, আমি তোমার মতো নই, তুমি জানো, কিছু ভেবো না, আমাকে নিয়ে যাবে, রীণার আপত্তি হবে না তো?

আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, প্রথমেই জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো। আমরা তিনজন লোক। আমি, তুমি, রীণা। কিছু কিছু জায়গা ছেড়ে দিলে বোধ হয় সকলেরই চলে যাবে। রীণা জানে তুমি আসছো, তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো তাকে বলেছি। তবু, রীণা স্ত্রীলোক, তুমি কিছু মনে করো না।

রবি হেসে বললো, পাগল।

.

হাত-মুখ ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে বসলে চাকরের হাতে চা-খাবার পাঠিয়ে দিলো রীণা। আমি জানতাম, সে সামনে আসবে না। সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করার ক্ষমতা আদৌ তাৎক্ষণিক নয়। ব্যক্তিবিশেষে তার পার্থক্যও স্বীকৃত।

আমি পারতাম আরো দ্রুত সব কিছু সহজ করার চেষ্টা করতে। কিন্তু সে সব ফিল্মী কায়দা স্থায়ী হয় না। আমি রীণার হাত ধরে টেনে এই ঘরে এনে বলতে পারতাম, রবি, এই যে রীণা, এতোকাল যাকে চিনেছো সেই রীণা নয়, আমার স্ত্রী রীণা, বলতে পারতাম, অনর্থক তোমরা অপরিচিতের ভাণ করো না। স্মৃতি যে মানুষের কি সম্পদ আমরা সবাই জানি।

অথবা রবিকেই সঙ্গে করে নিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে যেতে পারতাম, রীণা রবিকে দেখাও তুমি কি কি রান্না শিখেছে।

কিন্তু এই সবই ফিল্মী কায়দা। স্থায়ী হয় না।

তাহলে সহজ পথটা কি? আমি কি চাই যে আমার অন্যান্য বন্ধুর মতোই রবিকেও রীণা সৌজন্যে, আপ্যায়নে প্রীত করবে?

আমি ভেতরে গিয়ে রীণাকে বললাম, একটা নিঃশ্বাস চেপে রীণাকে বললাম, রবির সঙ্গে তোমার বোধ হয় একবার দেখা করা উচিত ছিলো।

মুখ না ফিরিয়ে মৃদু গলায় রীণা বললো, দেখা তো হবেই এক সময়। তাড়াতাড়ির কি আছে।

.

চাকরটাকে নিয়ে বাজারে বেরুবার মুখে রবি এসে দাঁড়ালো, চলো আমিও বাজারে যাই।

না, না, রাত জেগে এসেছে। তুমি বিশ্রাম করো।

আসলে আমার ভয় ছিলো, একসঙ্গে বাজারে বেরুলে পথে এতোক্ষণ কি কথা বলা যাবে। সে আসার আগে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা যেভাবে ভেবে রেখেছিলাম, সে ভাবে কিছুই ঘটছে না। এতো সহজে যে ঘটবে না, জানতাম। তবু যার সাথে কথা কোনো কালে শেষ হবে না বলে ভাবতাম, তাকে নিয়ে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়াও তো যায় না।

পথে প্রচুর ঘুম হয়েছে, বলে পায়ে জুতো গলিয়ে রবি তৈরী হয়ে দাঁড়ালো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললো, তোমার মতো মনের জোর তো সবার না-ও থাকতে পারে, এ কথা ভুলে যেও না মনি। আস্তে আস্তে সইয়ে নিতে দাও।

পথে নেমে বললাম, মনের জোর-টোর কিছু নয়। বাইকে বেঁচে থাকতে হবে। গৃহধর্ম সন্তান পালন যাই বলো, সবই এর অঙ্গ। কিছু বাড়তি ডালপালা ঘেঁটে এই জীবনবৃক্ষটিকে একটু সোজা করে নিতে আপত্তি কি?

রবি বললো, ও সব কথা থাক মনি। আপত্তি থাকলে আমিই কি আর তোমার কাছে আসতাম?

.

দুপুরে খাওয়ার সময়ে অন্তত রীণা কাছে থাকবে ভেবেছিলাম। সে রকম কোনো আভাস পেলাম না। ফলে, ক্রমেই শংকিত হয়ে উঠছিলাম। শংকা এই জন্যে যে, রবিকে যদি এমন অবস্থার মধ্যে পুরো দিন কাটাতে হয়, সে সত্যিই হোটেলে গিয়ে উঠবে। আর আমি যে জন্যে তাকে ডেকে এনেছি, সহজ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেবো বলে আমার যে উদ্যম, তারই বা কি হবে?

অথবা আমি যেভাবে মানুষের অনুভবগুলিকে ওজন করতে চাই, কেউ তা করে না। হয়তো আমি নিজেই যা করছি তার সাফল্যে বিশ্বাসী নই।

তবু এ-ভাবে ছেড়ে দেয়া যায় না। পৃথিবী বিশাল হয়তো। কিন্তু আমাদের এই চারপাশ বন্ধ, ছোটো দম-আটকানো দেশ, খোলা হাওয়া তার কোনো জানালা দিয়েই ঢুকতে চায় না। অতএব ছোটো ফাঁকগুলো বন্ধ করে লাভ কি?

আমি আরও ভেবেছিলাম, সবই এমন কিছু দু’য়ে দু’য়ে চার হয়ে যায় না। অংকের বাইরেও কিছু রয়ে গেছে সন্দেহ কি?

আরও ভেবেছিলাম, রবি এবং রীণা যদি তাদের অবস্থান মেনে নেয়, তাতে আমারই সুখ। পুরনো প্রথা, সংস্কার এমনকি পুরনো ধরনের অনুভূতিগুলোও কি কিছু পালটে দেয়া যায় না?

তারও চেয়ে বড়ো কথা, রবির সঙ্গে আমার হৃদ্যতা শেষ হয়ে যাক, আমি চাইনি। এমন ক্ষেত্রে যা হয় তেমন করে দূরে সরে যাওয়া এবং কদাচিৎ মুখোমুখি হলে না-দেখার ভাণ করা, অথবা কষ্টে মুখে হাসি ফোঁটানো, এর কোনোটাই আমি চাইনি।

রীণাকে এ কথাই বোঝাতে চেষ্টা করেছি। অতীতকে ভুলে যাও বলবো এত বড়ো মুখ নই, বু মানুষ তো পরিবর্তিত অবস্থার দাস।

সব বুঝেও রীণা বলেছে, কি জানি, বুঝি না, মানুষের দূর্বলতার ওপরে তুমি কি করে যাবে।

খাওয়ার টেবিলে বসার আগে রীণাকে বললাম, তুমি কি এখনও ওর সামনে। যাবে না ভাবছো?

রীণা স্থির চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলো, তুমি খুব স্পষ্টতা পছন্দ করো মনি, তোমার কাছে এসে আমিও করতে শিখছি। আচ্ছা ধরো রবিকে দেখে, তার কথা শুনে তোমরা যাকে সেলফ বলো, সেই পুরনো সেল যদি আবার মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। বিবর্ণ আমি হেসে বললাম, তাকে বাধা দেবো না— সেই শক্তি কারো থাকে না।

রীণা আমার মুখ থেকে চোখ নামালো না, তার দরকারও হবে না, তবু তোমার মতো অতে তাড়াতাড়ি এগুতে আমি পারি না।

রীণা কি ইচ্ছা করে আমায় ধুলোয় টেনে নামাতে চাইছে? আর শোনো, এখন আমাদের ব্যক্তিগত কথাবার্তা কিছু কমালে ভালো হতো।

আমি মলিন মুখে বললাম, আমিও তোমায় তাই বলবো ভাবছিলাম।

.

বিকেলে, বাইরে বেরুনোর আগে রবি বললো, মনি, হোটেলে একটা জায়গা করে নিলে হতো না?

আমি ভেবে বললাম, এত অল্পে ছেড়ে দেবো না রবি, আরও দেখা যাক। তুমি কি খুবই বিব্রত হচ্ছো?

রবি আগের দিনের মতো হেসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, পাগল। চিয়ার আপ ওল্ড বয়। উইশ ইউ সাসেস।

সারাদিনে একবার হাসতে পেরে আমি বেঁচে গেলাম।

.

পুরনো দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে রবি শহরের অন্য মাথায় চলে গেলে আমি একবার বাসায় ফেরার কথা ভেবেছিলাম। রীণার কথা ভেবে অন্য পথে নেমে গেলাম। অথচ হাতে কোন জরুরী কাজ ছিলো না, কারো সঙ্গে দেখা করার কথা ছিলো না। অন্যদিন এমন অবস্থায় হয়তো বাসায়ই ফিরে যেতাম। হয়তো রীণাকে নিয়ে বাইরে বেরুতাম।

লক্ষ্যহীন, একা একা সেই সব পথে ঘুরে বেড়ালাম যে পথে আমি, রবি, রীণা সকলেই পায়ের দাগ রেখে গেছি।

রীণার কথা ভাবছিলাম সে আমাকে কেননা ধূলোয় টেনে নামাতে চাইবে? যা স্বাভাবিক, যা ঘটে যায়, যা ঘটবে, যা আমরা সবাই জানি তাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে লাভ কি?

রবির ফিরতে রাত হবে, সে বলে গেছিলো। আমি আর কাঁহাতক একা একা পথে ঘুরবো?

রাস্তায় সেদিন আলো ছিল না। কেবল দু’পাশের বাড়ীর জানালায় পরদা দেখা যায়।

বাগানের দরজা খোলা ছিল, নিঃশব্দে ঢুকে গেলাম। দেখলাম রবির ঘরে আলো। সে তাহলে আমার আগেই পৌঁছে গেছে।

বাগানের ঠাণ্ডা হাওয়া অকস্মাৎ কয়েকটা ঝাঁপটা দিয়ে গেলো। সমস্ত শরীর ঠাণ্ডায় কুঁকড়ে আসতে চায়। অথচ বিকেলে বেরুনোর সময় শীত লাগছিলো না বলে গরম কাপড় বেশী নিইনি।

ওরা আসলে আমার অনুপস্থিতিই চাইছিলো। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে নেবার প্রয়োজন তো আমিও অস্বীকার করিনি, তাহলে আমার অনুপস্থিতি এতো কাম্য কেননা?

খোলা দরজা দিয়ে রীণার পেছন দিক দেখা যাচ্ছিলো কেবল। একবার ভাবলাম, ফিরে যাই। না, ফিরবো কেননা—যা ঘটে, যা ঘটবে, তাকে তুমি রোধ করতে পারো না, ঘুরে যাওয়া চাকাকে থামাবে কে? দরজার গোড়ায় শব্দ করে ঘরে ঢুকে গেলাম। রীণা চমকে ফিরে দাঁড়ালো। তার হাতের জিনিসপত্র দেখে বুঝলাম সে বিছানা গোছাতে এসেছে। ঘরে রবি নেই। সে তখনো ফেরেনি।

কপালে অল্প ঘাম ছিলো বোধ হয়। রীণা দ্রুত কাছে এসে, বুকের কাছে এসে, কপালে হাত রাখলো, এ রকম দেখাচ্ছে, শরীর খারাপ করলো না তো?

খাটের ওপরে বসলাম। বসে অনেকক্ষণ বসে, থেকে বললাম, না, রীণা, দুর্বলতা সহজে যায় না তো।

নিশ্চিন্ত হয়ে রীণা কি একটু ভাবলো, বললো, দেখো, ভাবছি, রবি যে ক’দিন আছে তোমরা দুজন এ ঘরেই শোবে।

আমি কৃতজ্ঞতায় তার হাত চেপে ধরে বললাম, আমিও তাই ভেবেছি।

রাতে খাওয়ার সময় রীণা আমাদের সঙ্গে ছিলো। শিষ্টাচার, কিছু হাল্কা কথা দিয়ে দ্রুতধাবী চাকাকে থামাতে চাইলাম আমরা। সু কিছুই সহজ হলো না সে-ও বোঝা গেলো।

শোয়ার সময় লেপ হাতে নিয়ে পাশের খাটে এলে রবি আদৌ বিস্মিত হয় না।

তার মুখে হাসির আভাস ছিলো।

বাতি নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। বললাম, রবি, আজ আর বেশী কথা নয়, ঘুমিয়ে পড়ো। রাতে তোমার ভালো ঘুম হওয়া দরকার। আমারও কাল ভোরে আপিসে ছুটতে হবে।

দেয়াল থেকে ঘড়ির আওয়াজ ভেসে আসছিলো।

অনেক পরে হঠাৎ রবি শব্দ করে হেসে উঠলো।

বিস্মিত আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আরে, কি ব্যাপার!

অন্ধকারে রবির গলা ভেসে এলো, আচ্ছা, আমরা আর কতোদিন বাঁচবো, মনি?

ভালো করে লেপ গায়ে জড়িয়ে চোখ বন্ধ করলাম। বললাম, আরো অনেক দিন রবি। এমনি সব দিন রাত্রি পা করে আরও অনেক দিন আমাদের বাঁচতে হবে।

আত্মজা – বিমল কর

হিমাংশু স্বামী; যুথিকা স্ত্রী। ওরা বছর পাঁচেকের ছোটবড়ো। দেখলে মনে হবে, ব্যবধান পাঁচের নয়, আট কিংবা দশের। মেয়ে পাশে থাকলে এহিসেবটাও গোলমাল হওয়া বিচিত্র নয়। পুতুল যদি পনরোয় পা দিয়ে থাকে, আর যুথিকা সত্যিসত্যিই গর্ভধারিণী হয় ও-মেয়ের, তাহলে বলতে হবে, রোগা খাটো চেহারায় মেয়েরা বেশ বয়স লুকতে পারে। যেমন যুথিকা। অবশ্য যুথিকা কখনও বয়স লুকোবার চেষ্টা করত না। বরং পুতুল যে তার মেয়ে—একথা হাবে-ভাবে সাজে-পাশাকে পরিস্ফুট করার ঝোকটা তার স্বভাব দাঁড়িয়েছিল। এই চেষ্টা সত্ত্বেও পুতুলের মা যুথিকাকে মোটেই পঞ্চদশী কন্যার জননী বলে মনে হত না। বরং এই ধরনের সাজ-পোশাকে ওর রোগা, খাটো চেহারার ওপর শালীনতা ও আভিজাত্যের একটা সুষমা ফুটিয়ে তুলত। যা দেখলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক, পনরো বছরের মেয়ের মা সাজার চেষ্টাটা ওর কৃত্রিম। আসলে, পরিচ্ছন্ন ও পরিমিত সজ্জার আশ্রয়ে একটি খাটো লঘু নারীদেহের মেদ-শুষ্ক দুর্বল অস্থিগুলো আশ্চর্যভাবে আত্মগোপন করত; এমন কি, পানপাতা ঢঙের ছোট একটি মুখে ব্যাধির যে-বিবর্ণ রেখাঙ্কন স্বভাবতই দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা—তাও ঢাকা পড়ে যেত। বলা মুশকিল, যুথিকার মনের সুগোপন কোণে; ওরই অজ্ঞাতে এই দ্বিতীয় বাসনা ছিল কিনা—যদিও আচরণে উলটোটাই প্রকাশ পেত।

স্ত্রীর তুলনায় স্বামী বিপরীত মেরু। যুথিকা একত্রিশ হলে হিমাংশুর ছত্রিশ হওয়ার কথা। স্বতন্ত্রভাবে ওকে দেখলে পরিণত যৌবনের দীপ্তিতে চোখ ঝলসে যায়। সুগঠিত অঙ্গ, স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ। সর্বাঙ্গে তার সেই প্রাণবন্ত যৌবনের খুশি, হাসি আর হিমাংশু ত ব সময়েই হাসছে। সকাল-দুপুর-সন্ধে-সব সময়; সর্বত্রই। একটা মানুষ যে এত হাসতে পারে, ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমনিতেই গলার স্বরটা রাট। জোরে হাসলে বাতাসের ঢেউ এমনভাবে গলা দিয়ে বাইরের হাওয়ায় এসে শব্দ তুলত যা শুনলে মনে হবে—এক জোড়া পায়রা আগল-দেওয়া ঘরে ডানার শব্দ তুলে উড়ছে। এমন হাসি দিনে অসংখ্যবার শোনা যায় হিমাংশুর পাশে থাকলে; যদিও সব সময়ের হাসিটা তার ঠোঁটে গালে লেগে থাকে, চোখেও কিছুটা। অনেকের এ হাসি পছন্দ; অনেকের নয়। যেমন, পুতুলের খুবই ভালো লাগে; যুথিকার লাগে না। বরং দেখা গেছে—মাঝে মাঝে রীতিমত বিরক্ত হয় যুথিকা, কড়া সুরে ধমক দেয়; বলে, “ইস্ অমন বিকট শব্দ করে কি হাস?…” অফিস যাবার মুখে হিমাংশু তখন হয়ত রুমালটা ট্রাউজারের পকেটে পুরছে, খুবই ব্যস্তভাব; তবু এক লহমা স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চোখে বিস্ময় তুলে বলে, “বল কি–যে হাসি এককালে বাঁশির চেয়ে মধুর মনে হত তোমার, আজ তা বিকট হয়ে গেল!” একটু হয়ত অপ্রতিভ হয় যুথিকা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সামলে জবাব দেয়, “এককালে রঙ্গ করার বয়স ছিল-করতুম। তা বলে আজও কি তোমার মতন ছেলেমানুষি করতে হবে?” স্ত্রীর কথায় আর একদফা হেসে দমকা হওয়ার মতন বাইরে এসে দাঁড়ায় হিমাংশু, পাশের ঘরের দিকে মুখ বাড়িয়ে ডাকে, পুতুল, রেডি? আমি নীচে নামলাম। তাড়াতাড়ি আয়।” কথা শেষ হতে না-হতে দেখা যায় ব্রতর করে সিঁড়ি বেয়ে হিমাংশু নীচে গেছে। পুতুল সবে বারান্দায়। মা-মেয়েতে চোখাচোখি হয়। যুথিকা পাশ কাটিয়ে নীচে নামতে থাকে হঠাৎ তারপর সিঁড়ির মাঝবাঁকে দাঁড়িয়ে পড়ে। হিমাংশু পায়ে ক্লিপ লাগিয়ে সাইকেলের হ্যান্ডেলে হাত রেখে অপেক্ষা করছে চোখ সিঁড়িতে। যুথিকা বিরস চোখে তাকিয়ে শুরু করে, “তুমি যাও, পুতুল যাবে না।”… “যাবে না! কেন?” হিমাংশু বুঝেও না-বোঝার ভান করে। অসহ্য বিরক্তি মেশানো গলায় যুথিকা এবার জবাব দেয়, “এক কথা একশো বার বলতে আমার ভালো লাগে না! কার না বলেছি, ওকে তুমি সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাবে না!” হিমাংশু চকিতে একবার স্ত্রীর মাথা টপকে দেখে নেয় : পুতুল এক সিঁড়ি এক সিঁড়ি করে নিঃশব্দে মার প্রায় পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে-মুখে চট করে একটু অপরাধের ভাব ফুটোয় হিমাংশু, “আজ কিভাবে যে একটু দেরি হয়ে গেল গো বুঝতেই পারলাম না! পুতুলের স্কুলের বাসটাও ফিরে গেল। কিন্তু অযথা স্কুল কামাই করা কি ভালো হবে? ওর আবার আজ অঙ্কের ক্লাস। কি রে, আজ না হয় নাই গেলি, পুতুল!” বাপের কথায় মা ঘাড় ফিরিয়ে মেয়ের দিকে তাকায়। কান্না কান্না মুখ করতে তিলমাত্র দেরী হয় না মেয়ের। আস্তে অথচ শব্দটা যাতে বাবার কানে যায় ততটুকু চড়িয়ে পুতুল বলে, “অঙ্কের ক্লাস কামাই গেলে বড্ড যা-তা করে বলে মিস্ প্রকার।” যুথিকা চূড়ান্ত শাসরে সুরে জবাব দেয়, “সেকথা আগে মনে থাকে না; হেলাফেলা করে কেন তুমি স্কুলের বাস ফেল কর? শুনবে কুনি, শোনাই উচিত।” একটু থেকে যুথিকা এবার স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে, “ট্রামবাসে পৌঁছে দিতে বললে এক্ষুনি ত বলবে তোমার অফিসের লেট হয়ে গেছে। বুড়োধাড়ী মেয়েকে সঙ সাজিয়ে সাইকেলের পেছনে করে রাস্তা দিয়ে না নিয়ে গেলে তোমার বাহার হয় না। যাও, যা খুশি করগে।” কথা শেষ করেই ঘূথিকা ওপরে উঠতে থাকে—মেয়ে, স্বামী কারুর দিকে ফিরে তাকায় না। না তাকাক যুথিকা। পুতুল হরিণগতিতে নীচে নেমে এসে বাবার পাশটিতে দাঁড়ায়। হিমাংশু মুচকি হেসে মেয়েকে সদরের দিকে পা বাড়াতে ইঙ্গিত করে।

মেয়ে শাসনের রাসটা ইদানিং যুথিকা শক্ত করেই ধরেছে। ফলে, সাইকেলের পেছনে চেপে স্কুল যাওয়াই শুধু নয়, আরো অনেক খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে নিত্যই স্বামীকে ভর্ৎসনা করছে যুথিকা। মেয়েকেও। তবু যেমন বাপ, তেমনি মেয়ে। গায়ে মেখেও মাখে না। শতেক রকম ফন্দি করে এড়িয়ে যায় সমস্ত শাসন। কাজেই যুধিকার রফ থেকে প্রায়ই কথা ওঠে।

মেয়েদের সাঁতারে ফার্স্ট হয়েছিল পুতুল। কাপ পেল, মেডেল পেল; সুইমিং কষ্টিউম পরা ছবি উঠল তার। কাপ-মেডেল দেখে যুথিকা অখুশি হয়নি। কিন্তু যেদিন পুতুলের সেই বিজয়িনী ছবিটা নিয়ে এল হিমাংশু, যূথিকার সারা মুখ কুঁচকে উঠল। মেয়ের অসাক্ষাতে ছবিটা বাক্সের অন্ধকারে চালান করে দিয়ে বলল যুথিকা স্বামীকে, “আচ্ছা, মেয়ের তোমার বয়স বাড়ছে না কমছে?”

“কেন?” হিমাংশু অবাক হয়ে চোখ তোলে।

“কেন কি, ওই নেংটিটা পরিয়ে কেউ ছবি তোলে ডাগর মেয়ের? ছি-ছি।”

“নেংটি? নেংটি আবার কোথায় পেলে তুমি? ওটা ত সাঁতারের জামা। বাঃ, আমারও ত অমন জামা আছে, ছবিও আছে, দেখ নি নাকি তুমি?”

“তোমার থাকে থাক, মেয়ের থাকবে না।” যূথিকার গলায় এবার স্পষ্ট আদেশ, “হেদোর জলে সাঁতার কেটে মেয়ের তোমার জীবন কাটবে না; তাকে ঘর-সংসার করতে হবে।–-ছি ছি, কি জঘন্য ছবি! পাঁচজনে ত চোখ দিয়ে তাই গিলে খাবে।”

“কি যে বল?” হিমাংশু স্ত্রীর কথায় হেসে ফেলে, “রসগোল্লা না পান্তুয়া যে গিলে ফেলবে! তবে হ্যাঁ, দেখবে। দেখানর জন্যেই ত ওই ছবি; ওতে তোমার মেয়ের গর্ব। আর যদি অন্য কথা বল, তবে বাপু, সত্যি কথাই ত, ভালো চেহারা দেখবার জন্যই।” একটু থেমে আবার, “এই ধরনা তোমার-আমার কথা। বিয়ের আগে দাদু, মা—দুজনই তোমায় দেখেছিলেন; লুকিয়ে চুরিয়ে আমিও। আর দিব্যি করে বল তুমি, আমাকেও তুমি দেখেছিলে কিনা?–হুঁ, বাব্বা-এত দেখাদেখি, ভালোলাগা তবেই না বিয়ে?”

স্বামীর বাকবিন্যাসের তরলতায় যুথিকার গাম্ভীর্য ক্ষুণ্ণ হতে চলেছিল। তাড়াতাড়ি অন্তিম উম্মাটুকু প্রকাশ করে ও বলল, “সব কথা নিয়ে হ্যালহেলে ভাব আমার ভালো লাগে না। ওসবের বয়স পেরিয়ে গেছে, এখনো তোমার এই ছেলেমানুষি কি ভালো লাগে, না মানায়?” কথা শেষ করে যূথিকা আর দাঁড়ায় না; চলে যায়।

স্ত্রীর কথায় মুচকি হাসে হিমাংশু। ও লক্ষ করেছে–যূথিকা দিনে অন্তত দু’পাঁচবার চেষ্টা করে, হিমাংশু যে ছেলেমানুষির বয়স কাটিয়ে প্রায় প্রবীণত্বের সীমানায় এসে পৌঁছেছে, সেটা স্মরণ করিয়ে দেবার। অথচ হিমাংশু জানে, এটা বাড়াবাড়ি যুথিকার। জোর করে বয়স পাকাবার চেষ্টা। বাস্তবিক, কি এমন বয়স ওর বা যুথিকার! নেহাত এক সেকেলে দাদুর পাল্লায় পড়ে গোঁফ ঘন হওয়ার বয়সে, সেই কুড়িতে কলেজে পড়ার সময়ই তাকে বিয়ে করতে হয়েছিল পনরো বছরের ঘূথিকাকে। নয়ত আজ তার বা যূথিকার এমন একটা বয়স হয়নি, যাতে বুড়োটে মেরে যেতে হবে। বরং আজকাল ছেলেরা কে-ই বা ত্রিশ-বত্রিশের আগে, আর মেয়েরা তেইশ-চব্বিশের আগে বিয়ে করে? একটু বয়সে বিয়ে হওয়াই ভালো—হিমাংশুর আজকাল এই ধারণা। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় তার বা যুথিকার কিছু ক্ষতি হয়েছে বই কি? একটা আশ্চর্য সিরসিরে তারুণ্যের আনন্দ যদিও বিয়ের সময় ওদের ঘিরে ছিলে, বিয়ের পরেও, তবু যোত বছরে মা হয়ে যুথিকা মরতে বসেছিল। কি কষ্ট তার, কি ভয় হিমাংশুর! ভেবে ভেবে ভয়ে দুশ্চিন্তায় হিমাংশুর চেহারা শুকিয়ে গিয়েছিল, এমন সাঁতারু বুকের ফুসফুসটাও দুর্বল হয়ে পড়েছিল, কালি ধরেছিল চোখের নীচে। যাক, ঈশ্বরের কৃপায় প্রচুর অর্থ-সামর্থ ব্যয় করার পর যূথিকা বেঁচে উঠল। আবার সে ফিরে এল এই আলোয়, হিমাংশুর স্পর্শানুভূতির গণ্ডির মধ্যেই। কিন্তু সে-যূথিকা আর নয়। মিষ্টি, মোলায়েম চেহারা আর নেই; বিবর্ণ, শুষ্ক, অস্থিসার, দীপ্তিহীন। তার শরীরে একটা গোলমেলে অঙ্গই চিরকালের জন্যে বিকল করে দিলে ডাক্তাররা। দ্বিতীয় কোনো পুতুলের সম্ভাবনা থাকল না আর ওর জীবনে। না থাকুক; এক পুতুলই যথেষ্ট। যাকে হারাবার আশঙ্কায় প্রতি মুহূর্ত দুঃসহ হয়ে উঠেছিল, সেই যখন ফিরে এল তখন হৃতস্বাস্থ্য, বাঁ-পা টেনে টেনে হাঁটা নির্জীব স্ত্রীই এক মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের আনন্দস্বাদ বয়ে এনেছে হিমাংশুর জীবনে। খুঁত নিয়ে কে তখন মাথা ঘামায়? হিমাংশু ঘামায়নি; আজও ঘামায় না বোধ হয়। খালি এইটুকুই মনে হয়, দুর্বল স্বাস্থ্যের আর সম্ভবত শারীরিক গোলমালের জন্য যুথিকার স্বভাবেও কেমন একটা নির্জীবত্ব এসে পড়েছে দিনে দিনে।

সে-তুলনায় হিমাংশু অবশ্য ছেলেমানুষই, অন্তত ছেলেমানুষের মতন চঞ্চল, চপল, দুরন্ত স্বভাবের। এর জন্যে যদি দোষারোপ করতে হয়, তবে তার স্বতঃস্ফূর্ত জীবনীশক্তিকেই করা উচিত। প্রখর যৌবনের অমিত তাপে তার প্রাণশক্তি উথলে উঠছে, উপড়ে পড়ছে। তা নিয়ে কি করবে হিমাংশু তাই যেন ভেবে পায় না। অফিস শেষে সাইকেলটাকে হাওয়ার গতিতে রাস্তার পাশ ছুঁয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়; র‍্যাকেট হাতে খেলতে নামলে হার্ড সার্ভিসে অপর পক্ষকে নাস্তানাবুদ করে তোলে, প্রতিটি অঙ্গ মত্ত হয়ে ওঠে টেনিস বলের চকিত বিচরণে। এতেই সে শেষ নয়, বা এতটুকুতেই। সুইমিং ক্লাবে আজও সে ট্রেনার; ব্যাকস্ট্রোকে সাঁতারু যুবকদের ভীতিস্থল। ছোটদের দল হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় চাঁদা উঠোতে, পুজোর প্যান্ডেল সাজাতে। বন্ধুরা ধরে নিয়ে যায় তাসের আড্ডায়, চৌরঙ্গী পাড়ায় পানীয় কক্ষে কখন হয়ত। শেষের জিনিসটা সম্পর্কে তার আকর্ষণ বা অনুৎসাহ কোনোটাই নেই। কেমন একটা ঝোঁকের মাথায় চলে যায়। আর দেখা যায়, এমন দিনে বেশ রাত্রিতেও কার্জন পার্কে চক্কর মারছে হিমাংশু। মনে মনে হিসাব কষে যতক্ষণ না স্থির ধারণা জন্মাচ্ছে। পুতুল ঘুমিয়ে পড়েছে, ততক্ষণ ট্রামে উঠবে না ও। রাগ করলেও যুথিকার কাছে ক্কচিৎ-কদাচিৎ এ-অপরাধের মার্জনা আছে। ভয় পুতুলকে। পাছে পুতুল বুঝতে পারে, বাবা তার মদ খেয়েছে—সেই ভয়ে অনেক রাত করে অসাড় পায়ে হিমাংশু বাড়ি ঢোকে; উঁকি দিয়ে দেখে, মেয়েটা ঘুমিয়েছে কিনা। বিছানায় শুয়ে সেদিন নিজের ওপর যত রাগ, তত ঘৃণা হিমাংশুর। ছি ছি এমন নেশার দরকার কি, যাতে মেয়ের কাছে যেতে লজ্জা, মেয়েকে পাশে ডাকতে ভয়। সারা সন্ধ্যে মেয়েটা নিশ্চয় কান পেতে বসে থেকেছে, পড়ার টেবিলে বসে বই খুলে রেখেছে অযথাই, একটা অক্ষরও চোখে দেখেনি। খেতে বসে খুঁতখুঁত করেছে। শেষ পর্যন্ত অভিমানভরেই হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছে। মনটা ভয়ঙ্কর রকম মুষড়ে পড়ে হিমাংশুর। শুয়ে শুয়ে প্রতিজ্ঞা করে, আর নয়–বন্ধুদের এই বাজে ফুর্তির পাল্লায় পড়ে নেশা-টেশা আর করছে না সে।

পরের দিন ভোর হতে না-হতেই মেয়েকে নিয়ে আদরের আতিশয্য শুরু হয়ে যায়। যেন প্রায়শ্চিত্ত করছে হিমাংশু। সকাল-দুপুরটুকু কোনোরকমে কাটল, বিকেল থেকে বাপ-মেয়ে পাশাপাশি, ছায়ার ছায়ায় জোড়া। দোতলার খোলা বারান্দায় ফুলের টবে জল দিচ্ছে হিমাংশু, একদমে দুশো-আড়াইশো ক্রস স্কিপ করে পুতুল ঘন ঘন খাস টানছে, মুখ লালচে। তারপর মুখ-হাত ধুয়ে সেজেগুঁজে বেড়াতে বেরোয়। মেয়েকে নিয়ে হিমাংশু। ট্যাক্সি চড়, টফি কেন, গল্পের বই চাও ত তাই : রিবন, পেনসিল গ্রামোফোনের রেকর্ড— যা চাও।

এমনি এক প্রায়শ্চিত্তের দিনে সকাল থেকে যা শুরু হয়, যুথিকা তা মোটেই সহ্য করতে পারে না। মুখ ফুটে স্পষ্ট করে বলাও যাচ্ছে না কিছু। এক পিসতুতো বোন এসেছে ওর দিল্লী থেকে আজ সকালেই। বিকেল পর্যন্ত থাকবে; তারপর যাবে তার ভাইয়ের বাসায়। সেই বোন, শিপ্রা যার নাম দিল্লীর কোন এক মেয়ে কলেজের পড়ায়, এখনো কুমারী। যূথিকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রয়েছে শিপ্রা। ওর সংসারের খুঁটিনাটি দেখছে আর গল্প করছে দিল্লীর, আত্মীয়স্বজনের। আর বলতে কি, এরই ফাঁকে তার রোল্ডগোল্ডের চশমার ফাঁক দিয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে বাপ আর মেয়েকে। যুথিকাও সেটা লক্ষ করছে। কিন্তু অবস্থাটা এমন, কিছুই বলা যায় না। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় যুথিকার ক্যালেন্ডারের লাল তারিখের ওপর। এত ছুটি যে কেন থাকে অফিস আর স্কুলের, যুথিকা বুঝতে পারে না। না থাকত ছুটি আজ, মেয়ে নিয়ে অত ঘটাপটা করে আদিখ্যেতা করার অবসর জুটত না হিমাংশুর। ছি, ছি, শিপ্রাদি দেখছে ত! কি ভাবছে, কে জানে। নিশ্চয় ভালো কিছু নয়। আভাসে, যেন শিপ্রাদি বুঝতে না পারে, তেমন ইঙ্গিতে, হু কয়েকবার চেষ্টা করল যুথিকা হিমাংশুকে সরিয়ে নেবার—কিন্তু কেউ গায়ে মাখল না সে কথা। প্রকাশ্যে কিছু বলতেও সঙ্কোচ-হয়। কে জানে শিপ্রাদি যদি তেমন একটা খারাপ চোখে না নিয়েও থাকে, যুথিকার কথায় হয়ত অন্যরকম একটা ধারণা হবে। অগত্যা রুষ্ট হলেও ভয়ঙ্কর একটা অস্বস্তি চেপে রেখে যুথিকাকে সহজভাবেই সব দেখতে হয়, সহ্য করতে হয়! ওদিকে, ফঁকা উঠোনে শীতের রোদ্দুরে, বালতিতে ঠাণ্ডা গরম জল মিশিয়ে হিমাংশু তরল সাবানের ফেনা দিয়ে পুতুলের চুল ঘষে দেয়, পা-হাত রবারের স্পঞ্জ দিয়ে রগড়ে তেল উঠিয়ে ধবধবে করে, অলিভ অয়েল মাখায়।

বেলা গেল, দুপুরও। বিকেলের দিকে শিপ্রাদির ভাইপো গাড়ি নিয়ে হাজির। জোর তাগিদ তার। তাড়াতাড়ি চলে গেল শিদিও।

খানিক পরে দেখা যায়, বাপ-মেয়ের সাজগোজও শেষ হয়েছে। এবার তারা বেরুবেন। যুথিকা থমথমে মুখে সব দেখে যাচ্ছে, একটাও কথা বলেনি। বলবে না, এই তার প্রতিজ্ঞা বোধ হয়। শেষ পর্যন্ত দেখবে এবং তারপর। আজ যেন সেও মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে, ধূমায়িত হচ্ছে ভেতরে ভেতরে।

যাবার আগে হিমাংশু স্বভাবমতন কিছু টাকা চাইল। চাবিটাই দিয়ে দিল যুথিকা। তারপর কাপড় কাচতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। ফিরে এসে দেখে, হিমাংশুরা চলে গেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে এরই মধ্যে। বেশ অন্ধকার।

একটু রাত করেই ফেরে হিমাংশুরা। পায়ের শব্দ শোনে ঘরে বসে যুথিকা। হাসিখুশি মুখ আর একটা অয়েলপেপারে মোড়া প্যাকেট হাতে ঘরে ঢোকে হিমাংশু একাই। চেয়ারে বসতে বসতে প্যাকেটটা যুথিকার দিকে এগিয়ে দেয়, “নাও, দেখ ত কেমন হল তোমারটা।”

হাত বাড়াবার আগ্রহ দেখা যায় না যুথিকার। নিস্পৃহভাবে ও বসে থাকে, নির্বিকার মুখে। ধৈর্য ধরতে পারে না হিমাংশু। অয়েলপেপারের আচ্ছাদন খুলে ফেলে পশমের জামাটা এবার এগিয়ে দেয়। যুথিকা দেখে অল্প একটু সময়, তারপর কেমন একটা অভ্যাসবশে হাত বাড়িয়ে জামাটা টেনে নেয়।

জামা দেখছে না মনে মনে কিছু ভাবছে যুথিকা, ঠাওর করা মুশকিল। হয়ত ভাবছে এবং ভাবনাটাই ওর আড়ষ্ট হাতকে অল্প একটু চঞ্চল করেছে, যার ফলে পাট খুলে গেছে পশমের জামার। নরুন-সরু হাসির ছোঁয়া যুথিকার ঠোঁটে ফুটি-ফুটি করছে। যেন। …এমন সময়টিতে দেখা গেল পুতুলকে, দরজার গোড়ায়, একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যুথিকার। চোখাচোখি হল মা আর মেয়েতে। মার চোখ মেয়ের সর্বাঙ্গ লেহন করল। আর পরমুহূর্তেই যুথিকার সারা মুখ থমথমে হয়ে আসে, একটু রোদের আভাস ফুটতে-না-ফুটতেই আকাশ যেন আবার কালো মেঘে ছেয়ে যায়। থমথমে মুখটা অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয় যুথিকা। ভুরুর ওপর আঁচড় কেটে অদ্ভুত একটা বিরক্তি চোখের পাতায় এসে জমছে। দৃষ্টিটা এখন তার দেওয়ালে; তীরের ফলার মত ছুঁচলো হিংস্র একটা টিকটিকির মুখের ওপর। হাতের আঙ্গুলগুলোও যে জ্বালা করছে, এতক্ষণে স্পষ্ট যেন অনুভব করতে পারে যুথিকা। তবে তাই হবে, মোলায়েম পশমে নয়, তুষের আগুনেই অজান্তে হাত রেখেছিল ও।

ছুঁড়েই দিয়েছে, নাকি হাতে থেকে খসে পড়েছে ঠিক বোঝা যায় না, দেখা গেল পশমের জামাটা যুথিকার পায়ের তলায় মেঝেতে পড়ে! এক পলক মার দিকে তাকিয়ে, এগিয়ে এল পুতুল, টুপ করে জামাটা কুড়িয়ে নিল। চোখেমুখে তার অনেক বিস্ময়, কিছু কারতা। কী হল মার? পছন্দ হয়নি? এমন আকাশ নীল রঙ জামাটার, গলার কাছে দু-সুতোয় ভোলা সাদা ফুল আর লতার কাজ, দামও প্রায় বাইশ, বাস্তবিক যা সুন্দর, খুবই পছন্দ হয়েছে ওদের—ওর আর ওর বাবার; তাই কিনা অপছন্দ মার? মনটা মুষড়ে পড়ে পুতুলের। লু চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে থাকে, মোলায়েম পশম মুঠোয় ভরে, বোকার মতন, বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে।

হিমাংশু মেয়েকেই দেখছে, সেই মেয়েকে যার নাম পুতুল, দেখতেও পুতুলের মতনই—অমনই নধর গঠন, সুডৌল, সুশ্রী। টিয়াপাখি রঙের নিউ স্টাইল সোয়েটারে পুতুলকে যেন আরো সুন্দর দেখাচ্ছে, এতই অপরূপ যে, হিমাংশু মেয়ের দিকে তাকিয়ে তন্ময়, তৰ্গত। ওই যে পুরু জমাট রক্তগোলাপ—পুতুলের সোয়েটারের বুকের ওপর নকশা ভোলা—ওই গোলাপের লাল আভা যেন পুতুলকে আলো করে তুলেছে তার গায়ের সবুজ, মুখ-চোখ হাত-পা’র লালচে সাদায় সেই আলোর ঢেউ ফেনার মতন ছড়ান-ছিটনো।

খুশিতে উপচে উঠে হিংশু ডাক দেয়, “গ্র্যান্ড! কাছে আয়, কাছে আয় ত পুতুল দেখি—”

হিমাংশুর উচ্ছ্বাস আর ঘরের আলো দুই যেন বেশ তীব্র। কাজেই যূথিকা চোখ ফিরিয়ে পারে না। আর আশ্চর্য, হিমাংশু কাছ ঘেষে দাঁড়াবার আগেই যুথিকা

মেয়ের চোখে চোখ রেখে তাকিয়েছে বিষাক্ত দৃষ্টিতে।

পুতুল মার কুঞ্চিত চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। সামনে বাড়ানো পা আস্তে আস্তে টেনে নেয় পিছনে। হঠাৎ সব যেন আড়ষ্ট হয়ে এসেছে ওর।

মেয়ের মুখ থেকে দৃষ্টিটা সরিয়ে নিয়ে স্ত্রীর ওপরই রাখতে হয় হিমাংশুকে। আর সেদিকে তাকিয়ে চট করে ফিরিয়ে নেওয়াও সম্ভব হয় না। সহাস্য, উজ্জ্বল, মুগ্ধ একটি মুখ ধীরে ধীরে মলিন হয়ে আসে।

যুথিকা একপাও সরে আসে নি, একটুও নড়ে নি—শুধু ঘাড় ফিরিয়েছিল যতটুকু ততটুকুই ফিরিয়ে রেখেছে এবং মেয়েকেই দেখছে এখনো, ঠিক তেমনি ভাবেই, অসহ্য একটা বিরক্তিতে। বোঝা যায়নি যুথিকা এবার কথা বলবে, ঠোঁট নড়তেই বোঝা গেল। একটা চিকন স্বর থেমে থেমে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল, ঘরের সুপ্তি নিষ্করুণ একটি আদেশের কাঠিন্যে থমথমে হয়ে ভেঙে পড়ল।

“ও ঘরে গিয়ে জামা ছেড়ে চুপচাপ বসগে যাও। শালটা গায়ে জড়িয়ে নিও।”

চোখ নামিয়ে নিয়েছে পুতুল অনেক আগেই। মার আকাশ নীল রঙের পশমের নামার বোতামটাই অনর্থক খুঁটে চলেছে ও। বড্ড শক্ত, নখ বসে না। দাঁত দিয়ে কামড়াতে পারলেই যেন বেশ হত!

পুতুল ফিরেই যাচ্ছে, হিমাংশুর কথায় দাঁড়াল।

“তোমার শাসনের ঠেলায় বাপু অস্থির! তোর মার জামাটা দে ত, পুতুল।” হিমাংশু হাত বাড়ায়। পুতুলকে বাবার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে কয়েক পা এগিয়ে আসতে হয় আবার। আসতে আসতেই বাবার কথা আবার কানে যায়, “পুতুলের গায়ে কেমন মানিয়েছে সোয়েটারটা বললে না? এবারে এই ডিজাইনটাই নতুন এসেছে।”

মার দিকে না তাকিয়েও পুতুল বুঝতে পারে, ভালো লাগেনি মার; কিছুতেই ভালো লাগতে পারে না।

“টাকাগুলোকে ভোলামকুচির মতন ভাব তুমি!”—যূথিকা বলছে, পুতুলও শুনে যাচ্ছে, “ছাইভস্ম কিনে আনছ, যা-তা ভাবে খরচ করছ। বলার কিছু নেই, ভালো লাগে না বলতে আমার।”

জানা কথাই,মা এই ধরনের কিছু বলবে। পুতুল তাড়াতাড়ি বাবার হাতে মার জামাটা কোনোরকমে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যায়।

পুতুল চলে যেতে হিমাংশু যূথিকার দিকে তাকাল! যূথিকাও স্বামীর দিকে। দুতিন পা সরে এসে বিছানায় বসে পড়ে ও।

“কি হল তোমার আবার?” হিমাংশু জানতে চায়, “অযথা মেয়েটাকে ধমকালে কেন?”

“ধমকালেই বা কি–!”যুথিকা হাত বাড়িয়ে হিমাংশুর হাত থেকে জামাটা টেনে নেয়। বিছানার এক পাশে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, “তোমার মেয়ের এসব ধিঙ্গিপনা আমার ভালো লাগে না! তুমি ওকে দিন দিন কী করে তুলছ? আমি ভেবেই পাই না—এরপর কী হবে?”

“ও, এই! সেই পুরনো কাসুন্দী;” খানিকটা স্বস্তি পায় হিমাংশু। মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে! কোলের ওপর থেকে গরম শালটা তুলে বিছানার ওপর রেখে দেয়।

আরাম করে সিগারেট ধরায় একটা।

যুথিকা তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখে। স্বামীর ভাবভঙ্গী থেকে মনের কথাটাও বোঝা যায়। অর্থাৎ হিমাংশু যে তার কথাগুলো পরম অবহেলায় সরিয়ে রাখল, যূথিকা তা বুঝতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে রাগটা দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে ওর।

“এসব তোমায় ছাড়তে হবে।” যূথিকা আদেশের সুরে বলে।

“কি?”

“মেয়ে নিয়ে এই ন্যাকামো!”

হিমাংশু স্ত্রীর দিকে চেয়ে এবার হেসে ফেলে; বলে, “মুশকিলে ফেললে। মেয়ের মাকে নিয়ে ন্যাকামি করতে চাইলেই কি তুমি রাজী হবে?”

যূথিকা ধমক দিয়ে ওঠে, “সব সময় তোমার এই তাচ্ছিল্যভাব আমার ভালো লাগে না।”

“কি-ই বা আমার ভালো লাগে তোমার?” হিমাংশু উঠতে উঠতে বলল “ওই তো জামাটা আনলাম তোমার-ওটাই কি ভালো লেগেছে?”

“উঠো না; বসো।” যুথিকা হাত বাড়িয়ে স্বামীর পাঞ্জাবির হাতা ধরল, “আমার জন্য তোমায় জামা কিনে আনতে বলিনি।”

“না বললেই কি আনতে নেই?” হিমাংশু আবার বসে পড়েছে, ‘ইচ্ছে করে, আদর করেও ত মানুষ কিনে আনে।”

“আমার বেলায় ইচ্ছেও নয়, আদরও নয়”যুথিকা কুটিল সুরে বলছে, নিষ্ঠুরের মতন, ধারাল গলায়, “নেহাতই না আনলে নয়, বাধ্য হয়ে, মন রাখতে এনেছ!”

হিমাংশু চুপ। যূথিকার মুখ থেকে দৃষ্টিটা তুলে নিয়েছে। এখন দেওয়ালের টিকটিকিটা তার লক্ষ্যে।

যূথিকার গলায় একটা শিরা নীল হয়ে ফুটেছে, কাঁপছে দপদপ। একটু থেমে কথাগুলো যেন গুছিয়ে নিল ও।

“এভাবৈ আমায় তুমি ভোলাতে চাও কেন? আমি কি ছেলেমানুষ?”

“বোধ হয় তাই।” হিমাংশু আবার একবার চেষ্টা করল সহজ হবার। ফিকে একটু হাসি টেনে বলল, “তুমি আজকাল অল্পতেই বড় চটে ওঠ! তোমাদের মা মেয়ের দুটো জামা কিনে এনে কি এমন অপরাধ করেছি, বুঝছি না;”।

“বুঝবে না, বুঝবে না–।” যুথিকা অধৈর্য হয়ে উঠেছে, “মেয়ের তোমার গরম জামার অভাব আছে কিনা তাই একটা আঁটবুক, আধ কোমরে মেমজামা কিনে আনলে? ছি ছি,– চোখেরও একটা ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে মানুষের!”

“ফ্রকের সঙ্গে অমন জামাই ত পরে; মানানসই বলেই না কিনেছি।”

“যে পরে পরুক, আমার মেয়েকে আমি পরতে দেব না। বেহায়াপনার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছ তোমরা বাপবেটিতে। কী ভাবে লোকে—ছি ছি–! পনরো বছরের আইবুড়ো মেয়েকে তুমি-তুমি-” যূথিকা ঠোঁটের কথাটা যেন চেপে নিয়ে অনেক কষ্টে অন্য কথা টানল, “তুমি ফ্রক পরিয়ে রাস্তা-ঘাট ঘুরিয়ে আনছ!” ঘৃণায় নাক, চোখ, মুখ কুঁচকে ওঠে যুথিকার।

“বয়সটা এমন কি বেশি?” হিমাংশুকেও যেন আজ তর্কের নেশায় পেয়েছে, “শাড়ি সামলাতে পারবে কেন পুতুল?”

“আমরা কিন্তু পেরেছি।” যুথিকার গলায়, ঠোঁটে শ্লেষ ফুটেছে তীক্ষ্ণতর হয়ে, “পনরো বছরেই আমার বিয়ে হয়েছে; যোত বছরে মা হয়েছি। শুধু শাড়ি নয়, মেয়েও সামলেছি।”

বলার কথা আর খুঁজে পায় না হিমাংশু। তর্কের নেশাটাও হঠাৎ থিতিয়ে যায়। স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে যেন ও পনরো বছরের সেই কিশোরী যুথিকাকে খেজবার চেষ্টা করছে এবং তুলনা করবার চেষ্টা করছে এই একত্রিশ বছরের যুথিকার সঙ্গে।

যুথিকাও উঠে পড়েছে। স্বামীর পাশে বসে থাকার মতন ধৈর্য নেই আর তার। অদ্ভুত একটা রিরি সারা গায়ে-মনে। অস্বস্তিকর, অসহ্য জ্বালা। বাইরে শীত; তবু সেই শীতের হাওয়ায় গিয়ে না দাঁড়ালে ঘামের মতন লেপটে থাকা এই অস্বস্তিকর জ্বালা থেকে যেন মুক্তি নেই।

বাঁ পা-টা টেনে টেনে যুথিকা চলে যায়। হিমাংশু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।

তারপর দুটো দিন যূথিকা গুম হয়ে থাকে। যতদূর সম্ভব কম কথা বলে, গলার স্বর খাদে নামিয়ে সংসারে তার উপস্থিতিটাকে নিরাসক্ত রাখতে চায়। তিন দিনের দিন গুমট ভাবটা কাটতে শুরু করে, প্রদা চড়ে যুথিকার স্বরের। আড়ালে বাপ আর মেয়ে মজা পাওয়ার হাসি হাসে। ওরা জানে, যুথিকার রাগের বহর কতখানি, তার পরিণতি কোথায়। এবার জেরটা একটু বেশীক্ষণ স্থায়ী হল, এই যা। তা হোক, গুমট ভাবটা কাটার সঙ্গে সঙ্গে হিমাংশু আর পুতুল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল। এখন কিছুদিন শাসনের রাসটা একটু আলগাই থাকবে। যূথিকার স্বভাবই তাই। মেয়ে বাপ-দুজনাই তা জানে। আর সেই কথা ভেবে দুজনাই পরম খুশি।

চারদিনের দিন পড়ল শব্বির। জানা গেল দুপুরে যুথিকা যাবে শিপ্রাদিদের বাসায়। ফিরবে সন্ধ্যেবেলায়। পুতুল স্কুল থেকে ফিরে এসে বাড়িতে একাই থাকবে, হিমাংশু যেন অফিসের ছুটির পর আড্ডা মারতে না গিয়ে সকাল সকাল বাড়ি ফিরে আসে।

স্কুলের বাসে ওঠার আগে পুতুল চুপি চুপি হিমাংশুকে তারিখটা স্মরণ করিয়ে দেয়, “আজই কিন্তু থারটিন্থ বাবা; ভুলো না! সেই রসিদটা আমি তোমার শার্টের বুকপকেটে রেখে দিয়ে গেলাম।”

রসিদের কথা ভোলেনি হিমাংশু, কিন্তু অফিসের পর অন্য এক ঝামেলায় পড়ে তার দেরি হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে বেশ বিকেল। পুতুল তখন ঝি রাসমণির সাহায্যে পিঠের ওপর সাপের মত দুই বেণী ঝুলিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে।

বাবার হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে খুশির দাপটে পুতুল বললে, “আমি ভাবছিলাম তৈরিই হয়নি বোধ হয়; দর্জিদের কাণ্ড ত! তুমি এত দেরি করলে কেন, বাবা?”

মেয়ের কাছে কৈফিয়ত দিতে দিতে হিমাংশু চেয়ারে বসল পা ছড়িয়ে। টানটান হয়ে। ঝুপ করে বাবার পায়ের কাছটিতে বসে পড়ল পুতুল। তড়িৎ হাতে জুতোর ফিতে খুলে, মোজা খুলে—জুতো জোড়া হাতে করে উঠে দাঁড়াল। ঘরের এক কোণে রাখল। বলল, “আমি তোমার চা করে আনি, হাতুমি একটু জিরও।”

“তা না হয় জিরচ্ছি! কেমন করল ওটা দেখলি না?”

“দেখব দেখব। দাঁড়াও না। তোমায় চা দিয়ে নিই আগে। হাত-মুখ ধুয়েই একবারে পরব।” সাপের মত দুই লিকলিকে বেণী নাচিয়ে পুতুল ছুটল চা তৈরি করতে।

চা শেষ করে হিমাংশু আরাম করে সিগারেট ফুঁকল। উঠে ট্রাউজার ছেড়ে ধুতিটা জড়িয়ে নিল। বাইরের কঁকা দালানে অন্ধকার নেমেছে ততক্ষণে। তাতে কী? বেশ একটা আমেজ আর আরাম লাগছে। হিমাংশু চেয়ারের ওপর এলিয়ে চোখ বুজে পড়ে থাকল। টুক করে আলো জ্বলে উঠল ঘরের। চোখ খুলে হিমাংশু দেখে, পুতুল একেবারে ঘরের মাঝটিতে দাঁড়িয়ে, আলোর তলায়। সদ্যপরিচ্ছন্ন ধবধবে মুখটিতে ফুটফুটে হাসি। চোখের তারায় ফুলঝুরির দীপ্তি। গায়ে তার সদ্য-আনা ক্রিমসন রঙের সেই লুজ ফ্রক। চুলের একটা বিনুনি গলার পাশ দিয়ে বেঁকা হয়ে বুকের মাঝটিতে এসে পড়ছে আগায় যার সাদা জরির রিবন তৈরি ফুল। ঝিমিক করছে আলোয়। ঠিক যেন একটি লতান ডাটার ওপর এক থোকা ফুল ফুটে রয়েছে। আশ্চর্য, আশ্চর্য সুন্দর এই পুতুল। কি নিখুঁত অঙ্গ! কপাল, মুখ, চোখ, ঠোঁট, গলা—সব যেন সামঞ্জস্য করে কেউ এঁকেছে নিপুণ তুলিতে। দুটি হাত যত নিটোল তত কোমল; দুটি পা তাও যেন লালচে মোমের ছাঁচে গড়া, মসৃণ, মোলয়েম, মধুর।

“মন্দ করে নি, না বাবা?” পুতুল লাজুক হাসি হাসে।

মেয়ের গলার স্বরে তন্ময়তা ফিকে হয় হিমাংশুর।

“ওয়ান্ডারফুল! রঙটা তোকে বিউটিফুল মানিয়েছে।”

“একটু কিন্তু বেশি ঢিলে করে ফেলেছে, যাই বল–।” মেয়ে খুঁত ধরছে এবার। “নাম যখন লুজ ফ্রক তখন ত একটু ঢিলে-ঢালা হবেই, বোকা–!”

“বই-কি, তা বলে এত! এই দেখ না; হাঁটুর কাছটা ঘাগরা মতন হয়ে গেছে, আর পিঠের কাছটায় বড্ড বেশি কাপড় রেখেছে, বুকের কাছে একটা কুঁচি দিয়ে দিতে হবে নিজেকেই!” পুতুল একে একে টুকটাক খুঁত ধরিয়ে দিচ্ছে।

হিমাংশুকে উঠতে হয়। এত খুঁত যখন, তখন একবার ভালো করে দেখতে হয় অবশ্য। মেয়ের কাছটিতে এসে দাঁড়ায় ও। মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। ফ্রকের। কাপড়ের ঝুলের অংশটা একবার উঁচু করে একটু। মেয়ে বলে, “হ্যাঁ–ওই পর্যন্ত হলে ভালো হত।” হিমাংশু মাথা নাড়ে, “ঠিক।” তারপর বুক। হিমাংশু বুকের দু পাশের কাপড় দু-হাতের আঙুলে আলতো করে ধরে কাপড়ের বিস্তৃতিটা পরখ করে, সঙ্কুচিত করে বুকের বস্ত্রাংশটা।—”কুঁচি দিয়ে নিলে কি ভালো দেখাবে রে–বরং একটু ছোট করতে দিয়ে এলে হয়।”—”না না, দরকার কি,” পুতুলের আপত্তি, “আমি হাতেই এমন সুন্দর করে একটা হনিকম্বের কাজ করে নেবে। দেখো-।” এরপর কোমর। সত্যি বেঢপ বড়ো করেছে, কাপড় রেখেছে একরাশ। হিমাংশুর দুই বিঘতের মধ্যে পুতুলের কোমরটা আঁট হয়ে থাকে। কি সরু, সুন্দর কোমর পুতুলের হিমাংশু পরখ করে, ভাবছে, “তুই এবার একটু আধটু নাচ শিখলেই ত পারিস, পুতুল—যা সরু কোমর তোর”…পুতুল আনন্দে আত্মহারা : “সত্যি নাচ শিখতে ভীষণ ইচ্ছে আমার। আমাদের ক্লাসের রেখা, ছন্দা ওরা ত শেখে, কোথায় যেন। কিন্তু আমি যেন একটু ভারী বাবা; ওরা বেশ হাল্কা।”… “ভারী?” হিমাংশু হো হো করে হেসে ওঠে, টপ করে কোমরে বিঘত জড়িয়ে শূন্যে তুলে নেয় মেয়েকে। আচমকা মাটি থেকে পা উঠে যেতেই পুতুল ভয়ে হিমাংশুকে আঁকড়ে ধরে—তার হাত হিমাংশুর মাথার চুলে ঘাড়ে-টলে পড়ে। ক্রিমসন রঙের লুজ ফ্রকের আড়ালে হিমাংশুর নাক, চোখ, মুখ সব ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু একটা অট্টহাসির অনেকখানি শব্দ ঘরের বাতাসে।

পুতুলকে নামিয়ে দিতেই সে গা মুখ ঘুরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে গিয়ে হঠাৎ কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল। অধস্ফুট শব্দ বেরুল, “মা!”

তাকাল হিমাংশু। দরজার গোড়ায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুথিকা আর শিপ্রা। মনে হল, ওরা অনেকক্ষণই এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে।

‘কখন এলেন আপনারা?” হিমাংশু শিপ্রার মুখে চোখ ফেলে হাসল,“আসুন–”

“এসেছি অনেকক্ষণ, মেয়ে নিয়ে যা মত্ত ছিলেন, বুঝবেন কি করে?” শিপ্রার ঠোঁটের পাশে একটু বাঁকা হাসি খেলে গেল।

আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই যুথিকা শিপ্রাকে টেনে পাশের ঘরে চলে যায়।

আগের দিন কিছু না বললেও আজ শিপ্রা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কথা তুলল, “তোর মেয়ের বয়স কত হল রে যুথি?”

“পনরো।” বিরস, গম্ভীর মুখ যুথিকার।

“দেখলে যেন আরো একটু বেশি মনে হয়। তা বড়-সড় হয়েছে; ওকে ফ্রক পরিয়ে রাখিস কেন? চোখে কটকট করে লাগে।”

“সাধ করে কি পরিয়ে রাখি?” যুথিকা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে তিক্তস্বরে বলছে, “ওর বাবার শখ, মেয়েকে শাড়ি পরতে দেবে না।”

“বাবার শখ?” ঠোঁট উলটে শিপ্রা একটা বিশ্রী শব্দ করল, “হিমাংশুর এই শখ নিজের চোখেই দুদিন দেখলাম।” আবার একটু থামল শিপ্রা তারপর গলার স্বর নীচু করে যেন উপদেশ দিচ্ছে এমনভাবে বলল, “জিনিসটা মোটেই ভালো নয়, যুথি। এসব আসকারা তুই দিবিনে। এ এক ধরনের কমপ্লেক্স!”

যুথিকা শেষ কথাটা বুঝল না। শিদির চোখের দিকে তাকাল।

“মানে?”

“মানে–? ও, সে তুই বুঝবি না।” শিপ্রা যুথিকার অজ্ঞতাকে উপেক্ষা জানিয়ে অনুকম্পার হাসি টেনে আনল, ঠোঁটে, “আসলে যুথি…এই—এই–ধরনের রুচি কি বলব যেন একে হ্যাঁ, এই ধরনের রুচি খুব খারাপ, নোংরা।”

যুথিকা কয়েক মুহূর্ত ফ্যাকাশে, অর্থহীন চোখে তাকিয়ে থাকে শিদির মুখের দিকে। তারপর উঠে দাঁড়ায় আস্তে আস্তে। আলমারি খুলে টাকা বের করে। খান পাঁচেক দশটাকার নোট এনে শিপ্রার মুঠোর মধ্যে গুঁজে দেয়।

“এতে হবে তোমার?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ; যথেষ্ট। আমি তাহলে উঠি যুথি। বেশি রাত হলে বাড়ি খুঁজতে বিপদ। হবে। টাকাটা তোকে দিল্লী ফিরে গিয়ে পাঠাব কিন্তু।”

“সঙ্গে কাউকে নিয়ে যাও না!”

“না, না, দরকার নেই। একাই বেশ যেতে পারব। চলি, হা—।” শিপ্রা চলে যায়। নীচে নেমে বিদায় দিয়ে আসে যূথিকা।

ওপরে উঠে শাড়িটা বদলে নিয়ে কোনোরকমে বাথরুমে গিয়ে তপ্ত চোখেমুখে, হাতে-পায়ে অনেকখানি জল ঢালে, তারপর সেই সপসপে ভিজে অবস্থাতেই বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। বাতি নিভিয়েই।

যুথিকা যে সেই শুয়ে পড়ল আর উঠল না, কথা বলল না। রাত বাড়ল। পুতুল এসে ডাকল মাকে। কেমন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে ভাঙা চাপা গলায় যুথিকা বলল, “তোমরা খেয়ে-দেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়। রাসমণিকে বল, সব গোছগাছ করে নীচের চাবি রেখে দিয়ে যাবে।”

রাত বেড়ে চলেছে। ঘড়িতে দশটা বেজে গেল। পুতুল এসে শুয়ে পড়ল মার পাশে। ধোয়া-মোছা সেরে রাসমণি ওপরে এসে চাবি রেখে গেল। বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিল দরজা। হিমাংশু অনেকক্ষণ হল পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে। ও-ঘর এ ঘরের মধ্যে যে দরজা তাতে কপাট থাকলেও সে কপাট বন্ধ হয় না; একটা পর্দা শুধু ঝোলে। ও-ঘরেই হিমাংশু শোয়, তার নিজস্ব কাজকর্ম করে। স্বামীর শোয়া বসার জন্য, পুতুল বড়ো হবার পর, যুথিকা নিজের হাতেই এব্যবস্থা করেছে।

হিমাংশুর ঘরে আলো জ্বলছে। নিশ্চয়ই সে ঘুমোয়নি। হয় কোনো বইয়ে, না হয় ক্রসওয়ার্ড পাজলে ডুব দিয়েছে।

ঘড়ির কাঁটায় শব্দ ঠেলে রাত গভীর হয়ে আসে। সব নিস্তব্ধ। শীতের রাত। সমস্ত পাড়াটাই এতক্ষণে যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। এ বাড়িটাও। একটা বেড়াল সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে গেলে তার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়, কেউ খিল খুললে, জানলার ছিটকিনি দিলেও খুট করে আওয়াজ ওঠে। এমন কি, পুতুল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কেশে। উঠছে—সেই খসখসে ভাঙ্গা আওয়াজ নিবিড় নিস্তব্ধতার মধ্যে কানে লাগে। অনেকখানি ঠাণ্ডা খড়খড়ির ফাঁক দিয়েও যেন যুথিকাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। বারোটা বেজে গেল। ঘড়ির সেই ঘণ্টা পেটার শব্দটা যেন বারোটা মুগুর পিটে গেল ঘরের অন্ধকারে। ধকধক করে যাচ্ছে যূথিকার বুক, খসখসে একঘেয়ে কাশি কেশে চলেছে পুতুল। ফট করে বাতি জ্বলে উঠল। যুথিকার বিছানার পাশে হিমাংশু।

দেখছে বই-কি হিমাংশু—পাশাপাশি মা আর মেয়েকে। যূথিকা ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে, বালিশের ভাজের তলায় মুখ চাপা, ডান হাতটাও গালের ওপর দিয়ে কপাল বেয়ে, বালিশের প্রান্তে এলিয়ে রয়েছে। কিছু ভালো করে দেখা যায় না। চোখের পাতা বোজা।

মার দিকে মুখ করে কাত হয়ে ঘুমচ্ছে পুতুলও! ক্রিমসন রঙের সেই লুজ ফ্রক এখনো তার অঙ্গে। গায়ের লেপটা সরে গেছে—অর্ধেক দেহটাই তার খোলা। হিমাংশু আরো একবার মুগ্ধ চোখে মেয়েকে দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। সাদা চাদর আর বালিশের ফেনার মধ্যে সূর্যাস্তের রঙ চোপান একটি ঢেউ যেন। হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখে ঠোঁট খুলে কেমন একটু ককিয়ে উঠে থেমে গেল পুতুল, আবার কাশল খুকখুক করে। নড়ে চড়ে উঠে ফের শান্ত। রাত্রে কাশিটা আবার বেড়েছে মেয়েটার। যেভাবে শোয়, রোজই হয়ত ঠাণ্ডা লাগে। গলার কাছটায় অত ভোলা না রাখলেই কি নয়। হিমাংশু হাত বাড়িয়ে গলার কাছটায় জামার টিপকলটা এঁটে দেয় পুতুলের, লেপটা টেনে দেয় গলা পর্যন্ত। কতকগুলো চুল কপালের পাশ দিয়ে চোখে এসে পড়ছিল। আস্তে আস্তে সরিয়ে দেয়। গভীর সোহাগে গালে মুখে কপালে হাত বুলিয়ে সরে আসে। বারান্দার দিকের দরজাটা ফাঁকা হয়েছিল। বন্ধ করে দেয় হিমাংশু। ছিটকিনি তুলে দেয়। বাতি। নেয়। তারপর পরদা সরিয়ে যায় নিজের ঘরে।

বিছানার দিকে এগোতে যাচ্ছে হিমাংশু, হঠাৎ কে যেন পিছ থেকে টান দিল চাদরে।

মুখ ফেরাতেই দেখে যূথিকা।

“তুমি ঘুমওনি?” হিমাংশু অবাক।

“না।” ঘুম থেকে ত নয়ই যেন খুব জ্বর থেকেও উঠে এসেছে, তেমনি শুকনো টকটকে ওর চোখ-মুখ, তেমনি বিশ্রী ঝঝ আর তিক্ততা তার গলায়!

“কি করছিলে তবে এতক্ষণ?” হিমাংশু আবার এগুতে চায়।

“তোমার কীর্তি দেখছিলাম।” যুথিকা আবার বাধা দেয়।

“কীর্তি!” অবাক চোখে চায় হিমাংশু।

“তাই।” ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে ধরেছে যূথিকা।

“স্পষ্ট করে বল যা বলতে চাও, হেঁয়ালি করো না। আমার ঘুম পাচ্ছে।” হিমাংশু এই প্রথম বিরক্ত হল।

“বলবই ত।” যূথিকা স্বামীর চাদর ছেড়ে দিল, অপ্রকৃতিস্থ দৃষ্টিতে তাকাল ঘরে এদিক-ওদিক। তারপর হঠাৎ, যে-কপাট এতকাল খোলাই থাকত রাত্রে, সেইপাশে কপাটটা পরদা সরিয়ে বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্ত থামল। কি ভাবল সে, কে জানে। দু-পা এগিয়ে সুইচটা অফ করে দিল। মুহূর্তে সারা ঘর অন্ধকারে ভরে গেল। খালি একপাশের এক খোলা জানালা দিয়ে বাইরের একটু আলোর আভাস জেগে থাকল।

‘বাতি নেবালে কেন?” অন্ধকারেই বিছানার পাশে এগিয়ে গিয়ে বসলে হিমাংশু।

“অন্ধকারই ভালো। আলোয় তোমার মুখের দিকে তাকালে কথা বলতেও আমার ঘেন্না হয়।”

হিমাংশু কতদূর বিস্মিত হয়েছে অন্ধকারে ঠাওর করা যায় না।

“রাত দুপুরে কি পাগলামি শুরু করলে, যূথি? কি যা তা বলছ?”

“পাগলামি নয়, যা বলছি তা তোমায় শুনতেই হবে। আমি আর পারছি না—আমার সহ্যশক্তি আর নেই—নেই।” যুথিকা সত্যিই বুঝি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে, “তোমরা দুজনে—মেয়ে আর বাপে মিলে আমায় শেষ করে ফেলছ। কি চাও তুমি, আমি চলে যাই, আমি মরে যাই?”

“এ কি বলছ!”

“ঠিক কথাই বলছি। তুমি কি বল ত, মানুষ না পশু? পুতুল না তোমার মেয়ে?”

অন্ধকারেও হিমাংশু একবার চমকে উঠে স্ত্রীকে দেখবার চেষ্টা করল।

“রাত দুপুরে তুমি এই কথা বলতে এসেছ?”

“হ্যাঁ-হ্যাঁ। রাত দুপুরে তুমি যেমন লুকিয়ে পনেরো বছরের মেয়ের ঘুমন্ত চেহারা দেখতে যাও।”

“যুথি”–হিমাংশু কি যেন বলতে চায়। কিন্তু তার গলায় স্বর চাপা দিয়ে যুথিকার তীক্ষ্ণ, অসম্ভব তিক্ত, একরাশ অভিযোগ স্রোতের মতন বেরিয়ে আসে।

“তুমি বাপ হতে পার, কিন্তু সে মেয়ে; তার রূপ আছে, বয়স আছে, তার কী নেই, কী হয়নি। জান না তুমি? তবু, এই মেয়ে নিয়ে তোমার বেহায়াপনা রোজ রোজ আমি দেখে যাচ্ছি। বাইরের লোক এসেও আজ দেখে গেল। ছি, ছি ছি। কোন্ আকেলে তুমি ওর বুকে মুখ গুঁজে থাক, কোমর জড়িয়ে ধর।” যুথিকার হাঁফ ধরে যায়। বু অনেককষ্টে দম নিয়ে আবার সে বলে, “এতদিন বুঝিনি, আজ বুঝাতে পেরেছি, মেয়েকে ফ্রক পরাবার বায়না তোমার কেন।”

“চুপ কর, চুপ কর, যুথি!” অন্ধকারেই হিমাংশু দাঁড়িয়ে উঠেছে। কাপছে তার গা, গলা।।

“করব বইকি, চুপ ত করবই, চিরকালের মনই। এত পাপ তোমার মনে বু আমি থাকব ভেবেছ! আমি”—

যুথিকা আর পারে না, কান্নায় তার গলা একেবারেই বুজে এসেছে। অনেকটা ফেঁপানো আবেগের অদ্ভুত একটা ছমছমে শব্দ উঠিয়ে, আশ্চর্য করুণভাবে ডুকরে উঠে অন্ধকারেই ও চলে যায়। একটা শব্দ শুধু ওঠে। পাশের কপাট খুলে আবার বন্ধ হাওয়ার শব্দ। সেই শব্দটা যেন হিমাংশুর বুকের হৃৎপিণ্ডে এসে আঘাত করে।

ক’টি তো মুহূর্ত। কিন্তু এই অল্প একটু সময়ের ব্যবধানে হিমাংশু এই ঘর, পরিবেশ, সংসার, স্ত্রী কন্যা সমস্ত থেকে ছিটকে এক বীভৎস অন্ধকারে গিয়ে পড়ে। সেখানে কিছু কী আছে? বাতাস, আলো? কিছু না। শুধু সাপের কুণ্ডলীর একটা হিমস্পর্শ, আর প্রতি পলকে শত সহস্র বিষাক্ত দংশন। যার বিষে এখনো সে অসাড়, যার ক্রিয়ায় এখনো সে অচেন এবং যে-দংশনে তার স্নায়ু মৃত।

নিছক একটা মানসিক প্রাণ এখনো আশ্চর্যভাবে গিরি-গোপন শীর্ণ জলপ্রবাহের মত ক্ষীণ স্রোতে বয়ে যাচ্ছে। শুধু এইটুকু মাত্র অনুভূতিতেই হিমাংশু এখনো কানের। কাছে যুথিকার সেই তীক্ষ্ণ নির্মম নিষ্ঠুরের মত শানিত কথাগুলো শুনতে পাচ্ছে। আর শুধু শোনা নয়, যুথিকার প্রত্যেকটি অভিযোগ অদ্ভুতভাবে একটি একটি করে অসংখ্য ছবি ফুটিয়ে তুলছে। জীবন্ত করছে বহু ঘটনা, বহু মুহূর্ত, বহু অবচেতন অভীপ্সা। পুতুলের বুকে মুখ গুঁজে হিমাংশু হাসছিল বটে, কিন্তু কোথায় একটা সুধার স্পর্শ যেন ছিল। ঠিক, ঠিক—পুতুলের হাঁটুর ওপর থেকে বস্ত্র সরিয়েছে, কিন্তু চোখে পড়ছে—একটি অন্য আকাশ, কি ফুল, সুডৌল রক্তশ্বেত একটি মেঘ, কি পাপড়ি। অস্বীকার করবে কি হিমাংশু, পুতুলের চুল, চোখ, সর্বাঙ্গের ঘ্রাণ ওর চিত্তে যে শিহরণ জাগিয়েছে তার মধ্যে কোন আনন্দের স্বাদ ছিল না?

কোন কিছুই অস্বীকার করবে না হিমাংশু; করতে চায় না আজ। এই নিষ্ঠুর সত্যের মুখখামুখি দাঁড়িয়ে কার কাছে কি গোপন রাখতে পারে সে? নিজেকে? তারই ত অংশ পুতুল। নিজেকে গোপন করার অর্থই ত পুতুলের কাছে নিজেকে গোপন করা। হিমাংশু তা পারে না। যদি মনের সঙ্গোপনে জট পাকিয়ে গিয়ে থাকে অজ্ঞাতে, অদ্ভুত কোন কামনার আবর্ত সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সব আজ প্রকাশ হোক।

জানলাটা হাট করে খুলে দেয় হিমাংশু। শীতের কুয়াশায় সমস্ত আচ্ছন্ন; পাশের বাড়িটাও হারিয়ে গেছে। হয়ত অমনিই হবে-স্নেহের আর পিতৃত্বের কুয়াশায় হিমাংশুর সত্য পরিচয় ঢাকা ছিল। আবার যেন একটা বিষাক্ত ছোবল খেয়ে ওর চিস্তাটাই অসাড় হয়ে এল।

বাতি জ্বালবে নাকি হিমাংশু? এত অন্ধকার! যেন একরাশ অশরীর প্রেতস্পর্শ ওকে ঘিরে রয়েছে। একটু আলো আসুক। হিমাংশু অস্থিরভাবে অন্ধকারে হাত বাড়ায়। হঠাৎ চমকে উঠে হাত সরিয়ে নেয়। না, না, অন্ধকারই ভালো। আলো নয়। আলো এসে হিমাংশুকে প্রকাশ করে দেবে, নিজেকেই নিজে দেখতে পাবে, স্পর্শ করতে পারবে। কুৎসিত একটা গলিত কুষ্ঠকে কি স্পর্শ করা যায়না, প্রকাশ করা যায়! ফিঘিন করে ওঠে হিমাংশুর গা, মন, হাত পা। থাক, অন্ধকারেই থাক। আর যেন আলো না ফোটে। হা ঈশ্বর।

পলে পলে পলাতক সময় এসে রাত চুরি করে নিয়ে যায়। কখন যেন হিমাংশুর খেয়াল হয় তার চোখ, মুখ, মাথা সব পুড়ে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা, জ্বালা। একরাশ ছুঁচ ফুটে চলেছে মাথায়। কোথায় যেন, কোথায় যেন? হিমাংশু শক্ত মুঠিতে চুল চেপে ধরে টানে! টানে। আঃ কি আরাম!

জলের জন্য আকুলি-বিকুলি করছে প্রত্যেকটি শিরা, প্রতিটি স্নায়ু। একটু জল।

হিমাংশু কেমন করে যেন বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসে। হুট করে ছুটে পালায় বেড়ালটা। ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া এসে গায়ে মাথায় চোট দিয়ে যায়। আরো একটু সম্বিত ফিরে পায় হিমাংশু। বুক টেনে টেনে নিশ্বাস নেয়। দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে একবার আকাশ দেখে, কয়েকটা তারা। তারপর টুক করে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে যায়। আবার একটু মৃদু শব্দ। ভেতর ছেকে ছিটকিনি তুলে দেয় হিমাংশু।

বাথরুমে এসে দাঁড়াতেই হিমাংশুর খেয়াল হয় কাঁচের উঁচু জানালা দিয়ে একটু ফরসা এসে ঢুকছে। পা পা করে এগিয়ে যায়; জল নয়, আয়নার দিকে। আয়নায় অস্পষ্ট, খুব অস্পষ্টভাবে মুখ দেখা যাচ্ছে তার। একেবারে কাছটিতে এসে পাড়ায় হিমাংশু। আয়নার বুকে একটা জল ধোওয়া শ্লেট-রঙের ছবি ফুটেছে। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হিমাংশু সেই ছবির মধ্যে কাকে বুঝি খুঁজছে।

গালে হাত তুলতেই ছবির মধ্যে থেকে সেই ছায়াকৃতি লোকটাও নড়ে ওঠে–হিমাংশু সে নয়, কারণ হিমাংশু পিতা, কিন্তু ও অন্য লোক, যে পিতা নয়, পশু। যার দৃষ্টি—ঈশ্বর, যার দৃষ্টি সুস্থ মানুষের নয়, জানোয়ারের।

হিমাংশুরই অসম্ভব ঘৃণা হয় তার ওপর–। শুধু ঘৃণাই নয়; তাকে ধিক্কার দেয় হিমাংশু, ইচ্ছে হয় ওর টুটি চেপে ধরে, ওর রক্তের পঙ্কিল গন্ধে…

আশ্চর্য, আরো কি ফরসা হয়েছে আকাশ–নাকি একটু আলো আসছে কোথাও থেকে। আয়নার ছবিটা আরো স্পষ্ট, আয়নার নীচের একটি সরু ব্র্যাকেটে সাজান দাড়ি কামানার সাবন, ডেটল, ক্ষুর, সেই রবারের হ্যান্ডেল, ব্রাশ সব ফুটে উঠেছে।

জানোয়ারটার চোখে চোখ রাখতেই আর ইচ্ছে হচ্ছে না হিমাংশুর। ওর রক্তের পঙ্কিল গন্ধ যেন ভেসে আসছে। বিকৃত মুখভঙ্গী করে হিমাংশু ব্র্যাকেটের ওপর থেকে ক্ষুরটা তুলে নেয়।

রক্তের স্বাদ আছে, কিন্তু গন্ধ আছে নাকি? নেই? কিন্তু ভ্যাপসা পচা ঘার মতন গন্ধ আসছে কোথা থেকে? পঙ্কিল রক্তের, কলুষ নিশ্বাসেরও হতে পারে। হতে পারে ওই পশুটার।

হিমাংশু আর সহ্য করতে পারছে না। ঘিনিঘিনে গন্ধটা তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এমন কি বুঝি রক্ততেও মিশে গেছে।

মণিবন্ধের একটি শিরায় ক্ষুরটা জোর করে চেপে ধরল হিমাংশু। তারপর ছোট্ট একটু টান। ছত্রিশ বছরের অমিত তাপে তপ্ত একটি যৌবনের উষ্ণ শোণিত ফিনকি দিয়ে ছুটে এল। আঃ, কি টনটনে আরাম! কি আরাম, কি শান্তি; যেন হু হু করে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে। আরো একটু দ্রুত মুক্তি চাই, দ্রুত। এবার ডান হাতের মণিবন্ধে গভীরভাবে ক্ষুরটা টেনে দেয় হিমাংশু।

টুপ টুপ…জল কি পড়ছে নাকি? সিরসির করছে নাকি গা? ঘুম কি আসছে এতক্ষণে? হয়ত কিছুই না, সব ভুল—সব ভুল। লু এ আশ্চর্য আরাম। যেন অনেক কলুষ রক্ত বিশুদ্ধ হাওয়ায় এসে শুদ্ধ হচ্ছে, তারই আরাম; একটা পুঁজ রক্ত ফোড়া থেকে আশ্চর্য যাদুবলে যেন সব কষ্ট কেউ শুষে নিচ্ছে, তারই স্বস্তি।

আরো একটু আলো এসেছে না ঘরে! হিমাংশু চমকে চায়। ইস্, এ যে অনেক রক্ত। কোথাও তা কালো রঙ নেই, সেই কুৎসিত কালো, যাতে পাপের বীজ লুকিয়ে থাকে। নেই, নেই—? হিমাংশু তবু খোঁজে, সতর্ক চোখে। যদিও কেমন যেন আচ্ছন্নতা আসছে। এবং কান্নাও।

তবে কি নিষ্ঠুর সত্যটাও ফাঁকি দিয়ে গেল? হিমাংশুর দুর্বল শরীরটা আর একবার যেন মরিয়া হয়ে ওঠে। আর এবার ক্ষুরের আগা দিয়ে শিথিল, কম্পিত, স্বলিত হাতে গলায় একটা টান দেয়।

ধীরে ধীরে এতক্ষণে গভীর তন্দ্রা নেমেছে হিমাংশুর মনে, একটা অব্যক্ত যন্ত্রণাও ছড়িয়ে পড়েছে, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তৃষ্ণাটা তালুর কাছে এসে ঠেলে ওঠে।

বেসিনের কাছে হাত বাড়াবার চেষ্টা করে হিমাংশু, পারে না। মাথা ঢুলে আসে, মেঝেতেই লুটিয়ে পড়ে।

অব্যক্ত একটা যন্ত্রণা পুরু ভারী লেপের মন পা-মাথা সব ঢেকে ফেলেছে। বুক চুইয়ে যেন একটি প্রশ্বাস আসে; একটি নিশ্বাস যায়। অদ্ভুত একটা আবেগ গলার কাছে পুঁটলির মত পাকিয়ে গেছে।—আর ঘুম—গভীর, গভীরত্র আচ্ছন্নতা। এই আচ্ছন্নতার মধ্যেই আকাশ যেন দেখতে পেল হিমাংশু, খানিকটা আকাশ এবং ক্রিমসন রঙের একটি মেঘ।—মেঘ-মেঘ। না, মেঘ নয়; মেয়ে। হিমাংশুর মেয়ে যার নাম পুতুল, বয়স পনেরো বছর নয়, পনেরো দিন। অসহায়, উলঙ্গ, নির্বোধ একটি রক্তপিণ্ড। কে? মেয়ে। …পনেরোটি পাপড়ি যেন আরও খুলে যায়, একে একে একটি একটি করে—আর এক-একটি পাপড়িতে একটি করে বছর বিকশিত হয়ে ওঠে। পুতুল শুধু তিলে তিলে গড়ে উঠেছে হিমাংশুর হাতে হাতে। কল্পনায়, বাস্তবে। যা শুধু শীর্ণ শাখা তাকে শাখায় শাখায় প্রসারিত করে, পত্রপল্লবে সাজিয়ে, পুষ্প সম্ভারে ছেয়ে দিতে—হিমাংশু তার জীবনের সমস্ত সুষমা, শ্রম, স্নেহ অকৃপণভাবে ব্যয় করে চলেছে। কেন? এ কে? তার মেয়ে? এ কি ভিন্ন? হ্যাঁ, দেহ থেকে ভিন্ন। কিন্তু তবু ভিন্ন নয়, রক্তের সেই আশ্চর্য লীলার কাছে ওরা এক, সেই আত্মায় ওরা অভিন্ন। ওর আত্মায় এর জন্ম, এর জীবন, এর লীলা। আর হিমাংশু জানে এই অভিন্নতাকেও একদিন ভিন্ন করতে হবে; এই আত্মাকেও। কী নিষ্ঠুর! এস্থিমোচনের আশঙ্কায় হিমাংশু ভয় পায়। ভয় পায় কেন? পাবে না—? পাবে বইকি কারণ পুতুলও শেষে একদিন যূথিকা হয়েই সংসারে ফুটে উঠবে—যোল বছরে যার জীবন যৌবন, প্রেম, উদ্দিপনা, আনন্দব অন্ধকার করে নেমে আসবে একটি চিরাচরিত অভ্যাস— যা কুটিল, জটিল, সতত সন্ত্রস্ত। আর তখন? তখন হিমাংশু শূন্য; যেমন আজ, জীবনের সেই ছেলেবেলার সুখ, স্বপ্ন মুক্তি সমস্ত থেকে সে শূন্য—যেমন বিতাড়িত যুথিকার উত্তপ্ত অনুরাগ থেকে। হিমাংশুর হৃৎপিণ্ডে এতক্ষণে একটা সাহস এল, ভাসমান মনে একটি আশ্রয়। না, তবে এই ত কারণ, যা পনরো বছরের পুতুলকে ছোট দেখেছে, ছোটই ভেবেছে। প্রার্থনা করেছে নিঃশব্দে, নিত্যদিন? পুতুল, আমার পুতুল, আমার কাছে ছোটটি থাক চিরকাল-ঈশ্বর, তুমি ওর যৌবন দিয়ো না, প্রজাপতির রঙ ছুঁড়ো না ওর মনে। ও যে আমার সেই ছেলেবেলা, আমার সেই সুখ, সেই মন আর আনন্দ। সেই আত্মা, একটি শুধু অক্ষয় স্মৃতি। পনেরো বছরে যুথিকাকে নিয়ে আমি যা হারিয়েছি, যুথিকা যা হারিয়েছে তার স্পর্শ কেন দেবে নিকুবের মতন ওকেও?

হিমাংশু শেষে ঘুমের ঢেউয়ে ভেসে যাবার আগে চেষ্টা করল উঠে দাঁড়াবার, বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ছুটে গিয়ে পুতুলকে বুকে জড়িয়ে ধরবার। কিন্তু তাই কি সে পারে? পারে না। মন দিয়ে স্মৃতিকে জীবন্ত করা যায়, আত্মাকেও কিন্তু দেহকে। হিমাংশু একবার চোখের পাতা খুলেছিল একটু আর সেই একটু জুড়ে বাইরের রসার মধ্যে একটি বিনুনি ঝোলানো ক্রিমসন রঙের মুখ ছিল, একটি মুখ, যা হিমাংশুর আত্মার। যে-ছবি ও নিজেই দেখেছে আর কেউ নয়। কেউ না।

আমি একটা মানুষ নই – আশাপূর্ণা দেবী

একটা মাঝারি সাইজের সুটকেসের মধ্যে নেহাৎ দরকারি, বলতে গেলে অপরিহার্যই কয়েকটা জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল স্বাতী। একটু যেন বিপদেই পড়ে যাচ্ছে। অপরিহার্যর সংখ্যাও যে এত তা তো আগে খেয়াল হয়নি।

কিন্তু কী নেবে, কী নেবে না?

অরিন্দমের দেওয়া নয়, অথবা অরিন্দমের পয়সায় কেনা নয়, এমন জিনিস কটা আছে স্বাতীর? কোথায় আছে? মাঝে মাঝে মা বাবার উপহার কিছু দামী দামী শাড়ি। আর কী?

হঠাৎ মনটাকে ঝেড়ে ফেলে। ঠিক আছে, এতদিন ওর সংসারে আমি যে সার্ভিস দিয়েছি, তার জন্যে আমার কিছু পারিশ্রমিকও প্রাপ্য নেই কি?

মনে এই জোর নিয়ে আরো দুচারটি জিনিস টেনে বার করল আলমারি খুলে। এই সময় অরিন্দম এসে ঘরে ঢুকল। হৃত চেহারা, মুখের রংটায় যেন কালির পোঁচ।।

টাইটা খুলে মাটিতে ফেলে দিয়ে বিছানার ধারে বসে পড়ে ভাবশূন্য গলায় যেন প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, তবু এতদিন আমরা প্রেস্টিজের ওপরই ছিলাম। এবার সকলের সামনে উলঙ্গ হয়ে গেলাম।

স্বাতী আলমারির পাল্লাটা দুম করে বন্ধ করে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলল, হ্যাঁ, কুষ্ঠগ্রস্ত শরীরটাকে শাটিনের পোশাকে ঢেকে রাখা হচ্ছিল। সেটা আর কতদিন চলতে পারে?

কুষ্ঠগ্রস্ত! কী অনায়াসে উচ্চারণ করল স্বাতী!

অরিন্দম উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।

রাস্তায় আলোর সমারোহ। আশেপাশে সামনে পিছনে কাছেদূরে অজস্র বাড়ি, অজস্র ফ্ল্যাট। সব জানলা দিয়েই আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে।

অরিন্দম মনে মনে বলল, ওরা সবাই সুখী। ওদের কারো শরীর কুষ্ঠগ্রস্ত নয়। আবার হঠাৎ হাসি পেল। আমারও সব ঘরের জনলায় জনলায় তো আলোর জোয়ার। ওরা কি বুঝতে পারছে এখানে কী গভীর অন্ধকার নেমে এসেছে।

অরিন্দম আবার জানলা থেকে সরে এসে খাটের ওপর বসে পড়ে। আস্তে বলে, আচ্ছা, স্বাতী!

স্বাতী কোনো উত্তর দেয় না। অরিন্দম একটু হাসির মতো গলায় বলে, ভাবছিলাম, হঠাৎ মনের জোর করে ভাবতে পারা যায় না, আমরা ঠিক আছি। আমাদের কোথাও কোনো ব্যাধির ছাপ পড়েনি।

স্বাতী মুখটা বাঁকায়। তেতো গলায় বলে, অনেক কাল সে মনের জোর দেখাবার চেষ্টা করেছিল। এখন সেই ঠাট অসহ্য হয়ে উঠেছে। ওসব তো অনেক হয়ে গেছে। সবেরই একটা সীমা আছে।

অরিন্দম স্বাতীর কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়।

বলে, বলার আমার মুখ নেই স্বাতী। তবু খুব বেহায়া বলেই বলছি, আর একটি বারের জন্যে কি আমায় একটু চান্স দিতে পারা যায় না?

দোহাই তোমার।

স্বাতী তীব্র তীক্ষ্ণ গলায় বলে ওঠে, আর এইসব নাটক করতে এসো না। রেহাই দাও আমায়। মনে রেখো আমি একটা রক্তমাংসের মানুষ!

অরিন্দম চুপ করে গেল।

স্নানের ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। আর ঢুকেই একটা অদ্ভুত কাজ করে বসল। ঠাস ঠাস করে নিজের গালে গোটাকতক চড় মেরে চাপা আর্তনাদের গলায় বলে চলল, কেন? কেন? ইডিয়ট রাস্কেল, হতভাগা বাঁদর, কেন? কেন?

অরিন্দম স্নানের ঘর থেকে ফিরে এসে দেখল সুটকেসের ডালাটা ভোলা। স্বাতী জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাতীও হয়তো অন্য সবাইয়ের আলোয় ভাসা জানলাগুলো দেখছে।

অরিন্দমের ফিরে আসাটা অনুভব করে স্বাতী ফিরে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গের গলায় বলল, ইচ্ছে হলে সুটকেসটা সার্চ করতে পারো। খোলা আছে।

স্বাতী! ছিঃ!

এর মধ্যে ছিঃ-র কিছু নেই। ভাবতে পারো বেশ কিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছি। ব্যাঙ্কের পাশবইটই সব যেখানে থাকবার রইল। আর–

থাক স্বাতী। এসব কথা থাক এখন।

ক্লান্ত ক্লিষ্ট গলায় বলল অরিন্দম, ঝিলিক কোথায়?

এসময় কোথায় থাকে? মাস্টারমশাইয়ের এখনো যাবার টাইম হয়নি।

ওঃ। টাইম?

তারপর স্বগোতোক্তির মতো বলল অরিন্দম, কাল থেকে?

স্বাতী নিষ্ঠুর গলায় বললল, সে নিয়ে না ভাবলেও চলবে তোমার।

স্বাতী কি এই নিষ্ঠুরতার জোরে নিজেকে শক্ত রাখতে চায়? নাকি নিজের দিকের পাল্লাটা হঠাৎ হালকা হয়ে যাবার ভয়ে বাড়তি বাটখারা চাপাতে চায়? তা নইলে অরিন্দম যখন বলে ফেলে, ওর সম্পর্কেও কিছু ভাববার অধিকার নেই আর আমার?

তখন স্বাতী মুখটা এত বিকৃত করে বলে ওঠে কেন, না, নেই। একটা বেহেড মাতাল লুজ ক্যারেক্টার জুয়াড়ি বাপের সে অধিকার থাকে না।

অরিন্দম আর কিছু বলে না। ঘর থেকে বেরিয়ে সরু ব্যালকনিটায় গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক নিচে রাস্তা। এ ফ্ল্যাটটা পাঁচতলায়।

একদিন মাঝরাত্তিরে স্বাতী এখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেষ্টা করেছিল। অনেক চেষ্টায় নিবৃত্ত করা গিয়েছিল সেদিন।

অরিন্দম যেন নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে। আমি কি একটা জানোয়ার? বকলস বাঁধা কুকুর একটা? তাই ‘অজন্তা’ নামের সেই মোহিনী নারীর সামনে গেলেই অনায়াসে সে বকলসটায় শেকল পরিয়ে আমায় যথেচ্ছ চালিয়ে নিয়ে বেড়াতে পারে?

হঠাৎ সীতেশের ওপর অসম্ভব একটা রাগে থরথরিয়ে উঠল অরিন্দম। সীতেশকে ও খুন করবে। সীতেশকে ও-হা, সবটাই সীতেশের বদমাইশি। বৌকে দিয়ে ফাঁদ পাতিয়ে জুয়ার আড্ডা বসিয়ে বন্ধুদের সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে।

উঃ। স্বাতী যদি আর একবারের জন্যে অরিন্দমকে চান্স দিত।

দেবে না। স্বাতী এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে।

তবু চেষ্টা করা যায় না?

স্বাতী।

স্বাতী কি বলতো কে জানে? আদৌ কিছু বলতো কিনা! হঠাৎ এই সময় প্রায় আছাড় খেতে খেতে ছুটে এল ঝিলিক মা-মণি।! মা-মণি! বিন্দুমাসি না কী অসভ্য জানো? বলছে, আমরা আর কক্ষণো এখানে আসব না। মামার বাড়িই থাকব। এখানে। বাপী শুধু একা থাকবে।

অরিন্দম তার এই রুষ্ট ক্ষুব্ধ উত্তেজিত বছর পাঁচেকের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে প্রবল শক্তিতে গলার কাছে ঠেলে ওঠা হাহাকারটাকে গলার মধ্যে আটকে রেখে বলল, তোমার বিন্দুমাসি একটা বোকা।

হি হি হি। ঠিক বলেছ বাপী। বোকার ঢিপি একেবারে। বলে কিনা, দেখিস আমার কথা সত্যি হয় কিনা?

আশ্চর্য! এই যখন তখন বেহেড হয়ে যাওয়া মাতাল আর শিথিল চরিত্র জুয়াড়ি বাপের প্রতি লেশমাত্রও ঘৃণা অবজ্ঞা বিতৃষ্ণা দেখা যায় না ঝিলিকের। বাপের গালে গালটা নিবিড় করে চেপে ধরে আদুরে গলায় বলে, থাকলেই হলো! আমার যেন

ও অঙ্ক পরীক্ষা নয়। আমরা তো শুধু দিদিভাইয়ের অসুখ দেখে কালই চলে আঘ, তাই না মামণি?

হ্যাঁ, মেয়ের কাছে এই কথাটাই বলা হয়েছিল। বাড়ির কাজ করা লোকেদের কাছেও। স্বাতীই বলেছিল। শাটিনের যে জামাটা ফেঁসেই গিয়েছে, সেটাকেই কোনোমতে ব্যাধিগ্রস্ত দেহটায় ঢাকা চাপা দিয়ে এখানের মঞ্চে যবনিকা টেনে বিদায় নিতে চাইছিল।

কিন্তু দেখা গেল, স্বাতীর সে চেষ্টা সফল হয়নি। বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল স্বাতী। যে ব্যাপারটাকে সে ঘুণাক্ষরেও ওদের কাছে প্রকাশ করেনি, যার জন্যে আজ পর্যন্ত সংসার মঞ্চের সমস্ত খুঁটিনাটি অনিয়টিও নির্ভুল ভাবে করেছে; শঙ্কুকে বলে রেখেছে মাছের খানিকটা যেন আগামীকালের জন্য ফ্রীজে ঢুকিয়ে রাখে, রান্না করা কড়াটা যেন তুলে না রেখে মাজতে দেয়। বিন্দুকে বলেছে, চায়ের বাসনগুলো আর একটু সাফ করে ধুয়ো বিন্দু। দেখ কী রকম দাগ ধরে রয়েছে। এমন কি বেরোতে দেরি হবে বুঝেও ঝিলিকের মাস্টারমশাইকে আসতে বারণ করে দেয়নি।

হ্যাঁ, রাতের দিকেই চলে যেতে চায় স্বাতী। সেখানে গিয়েই যাতে শুয়ে পড়তে পারে। সদ্য সদ্য কারো সঙ্গে কথা বলতে না হয়। আর এখান থেকেও শত চক্ষুর সামনে দিয়ে–। যদিও মেয়ে নিয়ে আর মাঝারি একটা সুটকেস নিয়ে বেরিয়ে পড়ার। মধ্যে কারো কোনো সন্দেহ উদ্রেকের কারণ থাকার নয়। তবু চোরের মন ভাঙা বেড়ায়।

কিন্তু এত সতর্কতা সত্ত্বেও ওই বিন্দু কোম্পানী রহস্যভেদ করে বসে আছে। রাগে মাথা জ্বলে গেল স্বাতীর।

আর কী দরকার ছেঁড়া পোশাক টেনেটুনে গা ঢাকার চেষ্টায়?

তাই স্বাতী রূঢ় গলায় বলে ওঠে, না! চলে আসব না। আমরা ওখানেই থাকব। ওখান থেকেই পরীক্ষা দেবো। এখানে আর আসব না।

আঁ আঁ অ্যাঁ। কক্ষণো না। ও বাপী। দেখো না—

বাপীর শরণ নিলেও, তার কোল থেকে সড়াৎ করে নেমে পড়ে ঝিলিক। ঘরের মধ্যে দাপাদাপি করে বেড়ায়, মায়ের শাড়ি ধরে টান মারে। নিজের ক্লিপ-আঁটা পরিপাটি আঁচড়ানো চুলগুলোকে দুহাতে টেনে খামচে ক্লিপ খুলে ফেলে নুড়ো নুড়ো করে বলতে থাকে, কেন আমরা ওখানেই থাকব? ওটা তো টিনাদি আর বাপ্পাদার বাড়ি। আমরা কেন সবদিন থাকব? আমাদের বুঝি নিজেদের বাড়ি নেই?

না, নেই।

নিষ্ঠুরতার হিংস্র খেলায় মেতে উঠতেই বুঝি স্বাতীর গলা থেকে একটা অমোঘ স্বর বেরিয়ে আসে, মেয়েদের নিজেদের কোনো বাড়ি থাকে না। চিরকাল তাদের পরের বাড়িই থাকতে হয়।

ছোট্ট মেয়েটার ওপর এই রূঢ় আঘাত হয়তো স্বাতীর এই ছেড়ে চলে যাওয়া বাড়িটার মালিকের প্রতি একটা কুদ্ধ ঈর্ষা থেকে জমে ওঠা।।

ওর সব ঠিকঠাক রইল। এই সাজানো ঘরবাড়ি জানলায় জানলায় রঙিন পর্দা, দেওয়াল ধারে রঙিন টিভি, দেওয়ালে দেওয়ালে ছবি, টেবিলে ফুলদানী, ওয়ার্ডরোবের মাথায় তিব্বতী বুদ্ধমূর্তি, কাশ্মীরী আখরোট কাঠের আঙুরগুচ্ছ, ঝকঝকে স্টীলের ফ্রেমে আটকানো ঝিলিক-এর প্রথম স্কুলে যাওয়ার স্কুল-ড্রেস-পরা ছবিটি।..খাবার টেবিলে নুন মরিচের শৌখিন কৌটো, ফ্রীজে মাছ, কী নয়?

সব, সব। যেখানে যা কিছু সাজিয়েছিল স্বাতী এই আটটা বছর ধরে, তার একচুল এদিক ওদিক হবে না। শুধু স্বাতীই এখান থেকে পিছনে সরে গিয়ে আবার সেখানে গিয়ে পড়বে, যেখানে স্বাতীর জন্যে এখন আর কোনো জায়গা নেই। অনধিকারিণীর ভূমিকা নিয়ে কয়েকটা বোদা মুখের সামনে ঘুরে ফিরে বেড়াতে হবে। আর বাইরে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হবে পায়ের তলার জন্যে একটু মাটি খুঁজে বেড়াবার জন্যে। যে বাড়িতে সেই তার জন্মাগারে মাটির প্রশ্ন নেই স্বাতীর। তার বাবা দুহাতে রোজগার করেছেন দুহাতে খরচ করে গেছে, চিরকাল ভাড়া বাড়িতেই কাটিয়ে গেছে। আজো সেটাই ঝিলিকের মামার বাড়ি।

সে বাড়িতে একদা স্বাতীর নিজস্ব একখানা ঘর ছিল। পড়ার টেবিল পাতা ছিল। এখন সেটা টিনা আর বাপ্পার পড়ার ঘর।

স্বাতী জানে এসব। স্বাতীর চোখে ভেসে ভেসে উঠছে তার মায়ের ঘরের অর্ধাংশটুকু। লু স্বাতীর চলে যাওয়া ছাড়া পথ নেই। আগুন থেকে তো ছুটে পালাতে হবে। তারপর জলে তলিয়ে যাবে, না চোরাবালিতে পা ফেলে ধসে বসে যাবে, কে জানে!

তবে কেন স্বাতী রূঢ় থেকে রূঢ়তর হবে না, ওই ছোট্ট মেয়েটার ওপর? এটাই তো অরিন্দমকে ঘায়েল করবার একটা প্রকৃষ্ট হাতিয়ার।

অসভ্যতা কোরো না বলছি ঝিলিক। চলো খেয়ে নেবে চলো।

যদিও ও বাড়িতে বেশি রাতেই চলে যেতে চেয়েছিল। আগে বলেছিল, মার কাছে গিয়েই খেয়ে নেব। তবু অরিন্দম বলেছিল, শেষ সন্ধ্যেটা আমায় দাও স্বাতী? খাবার টেবিলে ঝিলিককে নিয়ে আমরা দুজন–

হ্যাঁ, এই পরম সৌভাগ্যসুখটুকু ভিক্ষা চেয়েছিল অরিন্দম। যেটা নাকি সে দিনের পর দিন মাসের পর মাস অবহেলায় পরিত্যাগ করে এসেছে।

অরিন্দম রাতে যখন ফেরে, ঝিলিকের তো তখন অর্ধেক রাত। ‘বাপীর সঙ্গে’ খাব বলে জেগে বসে থেকে থেকে মায়ের তাড়নায় খেয়ে নিয়ে হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

আজ অরিন্দম কাতর প্রার্থনা জানিয়েছে ঝিলিককে সঙ্গে নিয়ে খাবার টেবিলে বসবে।

কিন্তু এখন সেই পরম মুহূর্তে—

স্বাতী যখন বলে উঠল, অসভ্যতা কোরো না ঝিলিকি। খেয়ে নেবে চলো।

আর অরিন্দম ‘আয়’ বলে আবার তাকে কোলে তুলে নিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল তখন ঝিলিক অসভ্যতার চূড়ান্ত করে বাপকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, যাব না। খাব না তোমাদের সঙ্গে। থাকব না তোমাদের বাড়ি। আমি রাস্তায় চলে যাব। ‘রাস্তার মেয়ে’ হয়ে যাব। ফুটপাথে ঘুমোব, খাবারের দোকান থেকে বাসি খাবার চেয়ে চেয়ে খাব-ছেঁড়া জামা পরে—গায়ো ধুলো মেখে–

ঝিলিক!

স্বাতী প্রায় বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বলে, বড় বাড় বাড়িয়েছ দেখছি। এসব অসভ্য কথা শিখছ কোথা থেকে, অ্যাঁ! যা মুখে আসছে বলে যাচ্ছ। মানেটা কী? কোথা থেকে শিখছ এসব বিচ্ছিরি কথা?

অরিন্দম একটু ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, আশা করি ও ব্যাপারে আমায় সন্দেহ করছ না!

থামো। তোমার প্রশ্রয়েই এরকম হয়েছে। সন্তান সম্পর্কে দায়িত্ববোধ নেই, কর্তব্যের বালাই নেই, আছে শুধু আদিখ্যেতা দেওয়া আদর। …ঝিলিক! ও কী! ওটা কী হচ্ছে?

কী হচ্ছে। দেখে চীৎকার করে ওঠবারই কথা।

ঝিলিক তার গায়ে পরে থাকা হালকা সুন্দর রেশমি ফ্রকটার ঝালর তুলে দাঁত দিয়ে টেনে টেনে ছিড়ছে।

ধৈর্য রাখা সত্যিই সম্ভব নয়।

নিজের জীবনের সমস্ত ছন্দ, সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য সম্পদ আরাম আয়েস জৌলুস ব ভেঙেচুরে ছিঁড়ে তছনছ করে চলে যেতে হচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর মানসিক যন্ত্রণার সময় ওই ক্ষুদে মেয়েটা এইভাবে শত্রুতা করতে বসল।

জামা ছিঁড়ছিস যে?

ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল স্বাতী ছোট্ট মেয়েটার ফুলের মতো গালে।

কিন্তু মেয়েও আজ নির্ভীক, অনমনীয়।

ছিঁড়বই তো জামা। কাদা মাখাব। এই এমনি চুল করব—

বলে দুহাতে চুলগুলো নুড়ো নুড়ো করে মুখ চোখে ছড়িয়ে দেয়।

হাঁফাতে হাঁফাতে বলে, রাস্তার মেয়েছেলেরা বুঝি ভাল জামা পরে? ভাল করে চুল আঁচড়ায়?

অরিন্দম তাকিয়ে দেখে। মেয়েটার গালে ‘ঠাস’-এর চিহ্নটা দেদীপ্যমান হয়ে উঠেছে। ওর কাছে গিয়ে কোলে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু এখন আর ঝিলিক বাবারও নয়।

হাত পা ছুঁড়ে কোলে ভোলা আটকে বলে, না! কোলে নেবে না। রাস্তার ছেলে-মেয়েদের বাবা থাকে না, মা থাকে না, কেউ থাকে না। তারা কারুর কোলে চাপে না।

এই শোন লক্ষ্মী মেয়ে। হঠাৎ রাস্তার ছেলেমেয়ের মতন হতে যাবার খেয়াল চাপল কেন?

ঝিলিক সতেজে বলে, চাপবেই তো। কেন চাপবে না? যাদের বাড়ি-টাড়ি কিছু থাকে না, তারা তো রাস্তারই।

ঝিলিক! এবার আরো একটা চড় খেতে চাও? হঠাৎ এত সাহস এল কোথা থেকে? অ্যাঁ। কেন, মামার বাড়িতে যাও না কখনো? থাকো না সেখানে?

ঝিলিক একমনে চুলের পাট ভেঙে নুড়ো নুড়ো করতে করতে বলে, সে তো বেড়াতে! রোজ রোজ থাকতে যাই?

অরিন্দম একবার স্বাতীর দিকে তাকায়। স্বাতীর চোখ অন্যদিকে। অরিন্দম গাঢ়গম্ভীর গলায় বলে, রোজ রোজ থাকতে যাচ্ছিস এ কথা তোকে কে বলেছে রে? তুই তো এমনিই যাচ্ছিস! আবার কাল পরশু মিথ্যে কথা। সব মিথ্যে কথা।

ঝিলিক দাঁড়িয়ে উঠে জামাটা ফালি ফালি করে ছিঁড়ে গা থেকে খোসা ছাড়ানোর মতো ছাড়াতে ছাড়াতে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে বলে, আমি যেন কিছু বুঝতে পারি না। নিজেরা কেবল ঝগড়া করবে, মা ঝগড়া করে এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে দিদাদের বাড়ি থাকতে যাবে আর আমায় সেইখানে নিয়ে গিয়ে আর আসতে দেবে না! ভারী মজা পেয়েছে। নিজেরা ঝগড়া করবে আর আমায় যত ইচ্ছে কষ্ট দেবে! আমি যেন একটা মানুষ নই? নিজেরাই শুধু মানুষ। নিজেদের যা খুশি তাই চালাবে। না?… ঠিক আছে। যেও তুমি দিদার বাড়ি। আমি তো রাস্তার লোক হয়ে যাব। রাস্তায় পড়ে পড়ে মরে যাব। বেশ হবে। ঠিক হবে। তখন ভ্যা ভ্যা করে কেঁদো।

বলেই এতক্ষণের সমস্ত তেজ গৌরব ধূলিসাৎ করে নিজেই ভ্যা করে কেঁদে ফেলে উপুড় হয়ে পড়ে মাটিতে মুখ ঘষতে থাকে।

আর দু’জোড়া পাথরের চোখ স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে সেই দিকে।

কিন্তু ওই পাথরে চোখ দুটো কি একটা শিশুর এই দুরন্ত যন্ত্রণা দেখে মমতায় কোমল হয়ে আসবে? সেই কোমলতায় ওই যন্ত্রণার কাছে নিজেদের অসহিষ্ণুতার যন্ত্রণা খাটো করে দেখবে?

হুঁ। অত সোজা নয়।

যেই একজোড়া চোখ কোমল হয়ে মিনতি দৃষ্টিতে অপর জোড়ার দিকে তাকাবে, সেই অপর জোড়ায় জ্বলে উঠবে আগুনের ফুলকি। বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়বে ওই শিশুটার ওপর। হিঁচড়ে টেনে তুলে নিয়ে মারতে মারতে গাড়িতে নিয়ে গিয়ে ওঠাবে।

দাঁতে দাঁত পিষে বলবে, বদমাশ মেয়ে, তোমার থিয়েটার করা বার করছি। আদর পেয়ে পেয়ে বাঁদর হয়ে উঠেছ। দেখবে চলো এবার কী করে শায়েস্তা করতে হয় দেখাচ্ছি। আমায় এখনো চেনো না তুমি।

আসলে হয়তো কথাগুলোর লক্ষ্য অন্যজন। এই শিশুটা উপলক্ষমাত্র। তবে কিছুতেই ভাববে না সত্যি এটা একটা মানুষ। একটা অসহায় শিশুর যন্ত্রণা বেদনা কাতরতা মস্ত একটা সমস্যার সমাধান করে ফেলবে, পৃথিবীটা এত সহজ জায়গা নয়।

আর একবার – প্রফুল্ল রায়

এই সতেরো তলা হাইরাইজ বিল্ডিংটার টপ ফ্লোরে সুশোভনের ফ্ল্যাট। এখানে যে কোনও জানালায় দাঁড়ালে বিশাল আকাশ চোখে পড়ে। কলকাতার মাথার ওপর যে এত বড় একটা আকাশ ছড়িয়ে আছে, এখানে না এলে টের পাওয়া যায় না।

বেশ কিছুক্ষণ আগেই সকাল হয়েছে। শীতের মায়াবী রোদে মেঘশূন্য আকাশটাকে অলৌকিক মনে হচ্ছে।

কটা শঙ্খচিল অনেক উঁচুতে, আকাশের নীলের কাছাকাছি, ডানা মেলে অলস ভঙ্গিতে হাওয়ার ভেসে বেড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে কোনও জাপানি চিত্রকরের আঁকা একটি ছবি যেন।

বেডরুমে সিঙ্গল-বেড খাটে হেলান দিয়ে দুরনস্কর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সুশোভন। হাতের কাছে একটা টি-পয় টেবিলে সাজানো রয়েছে আজকের মর্নিং এডিশরে বগুলো খবরের কাগজ, অ্যাশ-ট্রে, সিগারেটের প্যাকেট, এইটার আর এক কাপ চা।

কুক-কাম-বেয়ারা সতীশ ঘন্টাখানেক আগে খবরের কাগজ-কাগজ দিয়ে গেছে কিন্তু একটা কাগজেরও ভাজ খুলে এখন পর্যন্ত দেখেনি সুশোন। মেটালের অ্যাশ ট্রেটা ঝকঝকে পরিষ্কার, পোড়া সিগারেটের টুকরো বা ছাই কিছুই তাতে নেই। এমন কি, সতীশ যেভাবে চা দিয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই পড়ে আছে। কাপে একটা চুমুকও দেয়নি সুশোভন। চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। ক’দিন ধরে এভাবেই তার সকালটা কাটছে।

অনেকটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে চোখ নামায় সুশোন। একটানা একভাবে বসে থাকার কারণে কোমরে খিচ ধরার মতো একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। অর্থাৎ ব্লড সার্কুলেশনটা ঠিকভাবে হচ্ছে না। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে হাত-পা টান টান করে বাঁ দিকে সামান্য কাত হল সুশোভন। আর তখনই ওধারের বেডরুমে মণিকাকে দেখতে পেল। তার আর মণিকার শোবার ঘরের মাঝখানে যে দরজাটা রয়েছে সেটা আধাআধি খোলা। সুশোভন দেখল, মণিকা তারই মতো সিঙ্গল-বেড খাটে হেলান দিয়ে আকাশ দেখছে। তার পাশের টি-পয় টেবিলেও চা জুড়িয়ে ওপরে পড়ে গেছে।

মাসখানেক ধরে রোজ সকালে সুশোভন এবং মণিকার ঘরে এই একই দৃশ্য চোখে পড়ে।

সপ্তাহের অন্য ঘ দিন অবশ্য এভাবে সুশোভনকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয়। কাটায় কাটায় সাড়ে নটায় অফিসের গাড়ি এসে যায়। তার আগেই শেভ করে, আন এবং ব্রেকফাস্ট চুকিয়ে রেডি হয়ে থাকতে হয়। লাঞ্চের সময় সে ফ্ল্যাটে ফেরে না। ওটা অফিসেই সেরে নেয়।

আজ রবিবার। সপ্তাহের কাজের দিনগুলো প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। কিন্তু ছুটির দিন নিয়েই যত সমস্যা। সময় আর কাটতে চায় না তখন। রেল স্টেশনের

প্ল্যাটফর্মে অপরিচিত যাত্রীদের মতো পাশাপাশি ঘরে তারা চুপচাপ বসে থাকে।

অবশ্য এরকম অস্বাভাবিক গুমোট আবহাওয়া খুব বেশিদিন থাকবে না। এ সপ্তাহেই যে কোনও সময় এলাহাবাদ থেকে মণিকার দাদা অমলের আসার কথা আছে। সে তার বোনকে নিয়ে যেতে আসছে। মণিকা সেই যে চলে যাবে, তার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। সেটাই হবে সুশোভনের জীবন থেকে তার চিরবিদায়। তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের জন্য দরখাস্ত করবে। ঝগড়াঝাঁটি, হই চই বা পরস্পরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে দু’জনের চার। বছরের ক্ষণস্থায়ী দাম্পত্য জীবন।

অথচ সুশোভন এবং মণিকা, দু’জনেই ভদ্র, শিক্ষিত। তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ডও চমৎকার। লুও তাদের মধ্যে বনিবনা বা অ্যাডজাস্টমেন্ট ঘটেনি। অমিলের কারণ বা বীজটি রয়েছে তাদের চরিত্রের মধ্যে।

মণিকা খুবই শান্ত, স্বল্পভাষী এবং ইনট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে। সে কথা বললে দশ ফুট দূরের লোক শুনতে পায় না। জোরে টিভি বা রেডিও চালায় না সে। চলাফেরার সময় এত আস্তে পা ফেলে যে শব্দই হয় না। চা খায় আলতো চুমুকে— নিঃশব্দে।

বিয়ের পর এই চারটে বছর বাদ দিলে আজন্ম এলাহাবাদেই কেটেছে মণিকার। কলকাতার বাইরে বাইরে নানা প্রভিন্সের নানা জাতের মানুষের কসমোপলিটান পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও সে রীতিমত রক্ষণশীল ধরনের মেয়ে। তাদের বাড়ির আবহাওয়াতেও এই রক্ষণশীলতার ব্যাপারটা রয়েছে। তার মা বাবা বা ভাই-বোনের কেউ পুরনো ধাঁচের পারিবারিক কাঠামো ভেঙে বৈপ্লবিক কিছু ঘটাবার কথা ভাবতে পারে না। তার বাপের বাড়িতে মদ ঢোকে না। ড্রিংক করাটা সেখানে ট্যাবু। উনিশ শতকের সুখী যৌথ পরিবার যেভাবে চলত সেই চালেই তাদের বাড়ি চলছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো ছাড়া সেখানে বিশেষ কোনও পরিবর্তনের ছাপ পড়েনি।

সুশোভনদের ফ্যামিলি একেবারে উলটো। হই চই, পার্টি, ড্রিংক, ওয়েস্টার্ন পপ মিউজিক, কেরিয়ারের জন্য যতদূর দরকার নামা— এসব নিয়ে তারা মেতে আছে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তাদের আস্থা নেই। ছেলেরা চাকরি-বাকরিতে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে সুশোভনের বাবা তাদের আলাদা করে দিয়েছে। নিজের নিজের সংসার বুঝে নাও এবং সুখে থাকো। অন্যের দায় বা সাহায্য, কিছুই নেবার প্রয়োজন নেই। এতে সম্পর্ক ভাল থাকবে। মোটামুটি এটাই হল তাঁর জীবনদর্শন এবং ছেলেদের প্রতি অমূল্য উপদেশ।

এই ফ্যামিলির ছেলে হবার ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পারিবারিক ট্রাডিশানের সব কিছুই পেয়েছে সুশোভন। সে একটা নামকার অ্যাড কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ। বড় বড় ফার্মের হয়ে তারা বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা তো করেই, তাছাড়া প্রচুর অ্যাড-ফিল্মও তুলতে হয়।

আজকাল অগুনতি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। কমপিটিশন প্রচণ্ড। বড় বড় ক্লায়েন্টদের হাতে রাখতে হলে প্রায়ই পার্টি দিতে হয়। শুধু হোটেল বা ‘বার’-এ নয়, বাড়িতে ডেকেও মাঝে মাঝে ড্রিংকের আসর বসাতে হয়। এমন কি বড় কোম্পানি ধরে রাখতে হলে অনেক সময় জায়গামতো টাকাপয়সাও দিতে হয়। কারও কারও যুবতী সুন্দরী মেয়ে সম্পর্কে দুর্বলতা রয়েছে। কাজেই দরকারমতো। তারও ব্যবস্থা করতে হয়। যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অ্যাড-ফিল্ম ভোলা হয়, তারা তো প্রায়ই সুশোভনদের ফ্ল্যাটে এসে হানা দেয়। যতক্ষণ তারা থাকে চড়া সুরের ওয়েস্টার্ন মিউজিকের সঙ্গে হুল্লোড় চলে।

জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা, রুচি, কালচার, কোনও কিছুতেই সুশোভন আর মণিকার মধ্যে এতটুকু মিল নেই। তু তাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। প্রেমের বিয়ে নয়। দুপক্ষেরই এক আত্মীয় যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিয়েছিল।

বিয়ের পর কলকাতায় এসে দু-চারদিন কাটাতে না কাটাতেই চমকে উঠেছিল মণিকা। সুশোভনের বন্ধুবান্ধব বা বড় বড় কোম্পানির একজিকিউটিভ এবং তাদের স্ত্রীরা প্রায়ই আসত। সতীশ হুইস্কি-টুইস্কি বার করে দিত। যে মহিলারা আসত তারাও পাড় মাতাল। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা রাম কি হুইস্কি খেত।

এমন দৃশ্য আগে আর কখনও দেখেনি মণিকা। সে শিউরে উঠত। অন্য একটা ঘরে ঢুকে দম বন্ধ করে সিঁটিয়ে বসে থাকত। সুশো এসে ডাকাডাকি করত, কী। হল? ওঁরা তোমার জন্যে ওয়েট করছে— এস। মণিকা জানাতো, মদের আসরে সে যাবে না। কাকুতি-মিনতি করেও ফল কিছুই হত না। সুশোভন বলত, ‘ওঁরা কী ভাবছেন বল তো?’ মণিকা বলত, ‘যা খুশি ভাবুক। বাড়িতে ‘বার’ না বসালেই কি হয় না?’ সুশোভন কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলত, কী করব বল। দিস ইজ আ পার্ট অফ মাই জব। আমার কেরিয়ার, আমার ফিউচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্লিজ এস, ফর মাই সেক।

প্রথম প্রথম কিছুতেই মদের আসরে যেত না মণিকা। পরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খানিকটা অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছিল। সুশোভনের বন্ধুবান্ধব এবং তাদের স্ত্রীরা এলে সে ওদের সামনে যেত ঠিকই, তবে হুইস্কির ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলত। অবশ্য সঙ্গ দেবার জন্য হাতে একটা সফট ড্রিঙ্কের গেলাস রাখত।

সুশোভনের বন্ধুরা বলত, একটু হুইস্কি টেস্ট করুন ম্যাডাম। পুরাকালে ঋষিটিষিরাও সোমরস পান করতেন। জিনিসটা খুব অস্পৃশ্য নয়।

মণিকা উত্তর দিত না।

বন্ধুরা আবার বলত, আফটার ডেথ যখন ওপারে যাবেন তখন ব্রহ্মা বিষ্ণুরা এক্সপ্লেনেশন চাইবে— মা জননী, ওয়ার্ল্ডে যে তোমাকে পাঠালাম, হুইস্কিটা টেস্ট করে এসেছ তো? তখন কী উত্তর দেবেন? মানব জীটা এভাবে নষ্ট হতে দেবেন না ম্যাডাম।

মণিকা আবারও চুপ।

বন্ধুদের স্ত্রীরা বলত, ‘তোমার মতো পিউরিটান মেয়ে লাইফে দেখিনি। ড্রিংক করলে ক্যারেক্টার নষ্ট হয় না।’

এসব কথারও উত্তর দেওয়া দরকার মনে করত না মণিকা। মনের দিক থেকে সায় না থাকলেও দাম্পত্য জীবনের খাতিরে দাঁতে দাঁত চেপে এসব মেনে নিতে হত তাকে। তবে কম বয়সের ছেলেমেয়েদের লেভেলে নেমে তাদের সঙ্গে সমান তালে সুশোভন যখন হুল্লোড় করত তখন অসহ্য লাগত।

ভেতরে ভেতরে বারুদ একটু একটু করে জমছিলই। কিন্তু বিস্ফোরণটা ঘটল দেড়-দুই বছর আগে। মণিকা যেদিন জানতে পারলে, কাজটাজ বাগাবার জন্য সুশোভন কাউকে ঘুষ দেয়, কাউকে কাউকে সঙ্গ দেবার জন্য সুন্দরী যুবতী যোগাড় করে তখন তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। যা কখনও সে করে না, যা তার স্বভাবের বাইরে, ঠিক তাই করে বসেছিল। উত্তেজিত মুখে চিৎকার করে বলেছিল, তুমি ঘুষ দাও?

স্থির চোখে অনেকক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকেছে সুশোভন। বলেছে, ‘ঘুষ না, গিফট।

‘একই বস্তু। আর ওই মেয়েদের ব্যাপারটা?’

‘নাথিং নাথিং’ টোকা দিয়ে গা থেকে পোকা ঝাড়ার মতো ভঙ্গি করে বলেছিল সুশোন।

দাঁতে দাঁত চেপে মণিকা বলেছিল, ‘নাথিং বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না।’

কাঁধ ঝাঁকিয়ে, দুই হাত উলটে সুশোভন হালকা গলায় বলেছিল, ‘এ নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। খুব সিম্পল ব্যাপার। কেউ কেউ মেয়েদের কোম্পানি পছন্দ করে। এই একটু গল্প-টল্প করতে চায়। জাস্ট আ টেণ্ডার ফেমিনিন টাচ।’

সোজাসুজি সুশোভনের চোখের দিকে তাকিয়ে মণিকা চাপা অথচ কঠিন গলায় বলেছে, ‘এ তোমাকে ছাড়তে হবে।‘

হাসির একটা পলকা ভঙ্গি করে সুশো বলেছে, কী যে বল, তার কোনও মানে হয় না।

‘নিশ্চয়ই হয়। আমি চাই না আমার স্বামী কেরিয়ারের জন্য এত নিচে নামুক।‘

‘নিচে নামানামির কী আছে! দিস ইজ আ পার্ট অফ আওয়ার লাইফ।‘

‘এ ধ্বনের লাইফের দরকার নেই আমার। তোমার সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা নষ্ট হতে দিও না।‘

মণিকার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে সুশোভন চমকে উঠেছে। বলেছে, ‘একটা তুচ্ছ বাজে ব্যাপার দেখছি তোমার মাথায় ফিক্সেশানের মতো আটকে গেছে। আজকাল র‍্যাট রেসে টিকে থাকতে হলে, জীবনে ওপরে উঠতে হলে, মানুষকে অনেক কিছু করতে হয়।‘

‘খুব বেশি রাইজ আর অনেক টাকার দরকার কী? ভদ্রভাবে চলে গেলেই হল।‘

সুশোভন বোঝাতে চেষ্টা করেছে, তার বন্ধুবান্ধবরা টাকা পয়সার জন্য, প্রোমোশনের জন্য কত কী করে বেড়াচ্ছে। তাদের স্ত্রীরা এই নিয়ে মণিকার মতো খিটিমিটির তো করেই না, বরং রীতিমত উৎসাহই দেয়।

মণিকা বলেছে, তোমার দুর্ভাগ্য, আমি তোমার বন্ধুর স্ত্রীদের মতো উপযুক্ত সহধর্মিণী হতে পারিনি।

মাথার ভেতরটা এবার গরম হয়ে উঠেছে সুশোভনের। বলেছে, ‘দেখ, মস্তিষ্কে নাইনটিনথ সেঞ্চুরির কিছু ভ্যালুজ ঢুকিয়ে বসে আছ। ও আজকাল একেবারে অচল, টোটালি মিনিংলেস। তোমার বাপু কোনও সাধু-টাধু টাইপের লোককে বিয়ে করা উচিত ছিল। আমি তোমার লাইফে মিসফিট।’

হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো মণিকা তৎক্ষণাৎ বলেছে, ‘বোধহয়। এই বিয়েটা তোমার আমার কারও পক্ষেই হয়তো ভাল হয়নি।’

এরপর আর কিছু বলার ছিল না সুশোভনের। স্তব্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো সে তাকিয়ে ছিল।

ক্রমশ যত দিন গেছে, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিশ্বাস বা মমতা বলতে কিছুই প্রায় আর অবশিষ্ট ছিল না। রাত্তিরে এক ঘরে তারা থাকে না। তাদের বিছানা আলাদা হয়ে গেছে। কথাবার্তাও একরকম বন্ধ। সুশোভন ফ্ল্যাটে থাকলে পাশাপাশি দুই ঘরে তারা চুপচাপ বসে থাকে। ইদানীং বেশ কিছুদিন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে ডাকে না সে। ওদের কারও কিছু দরকার হলে সতীশকে দিয়ে বলায়। সমস্ত ফ্ল্যাট জুড়ে এখন দম বন্ধ করা আবহাওয়া।

এভাবে মন এবং স্নায়ুর ওপর মারাত্মক চাপ নিয়ে জীবন কাটানো অসম্ভব। এর মধ্যে একদিন মণিকা সোজা তার ঘরে এসে বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।’

প্রায় দেড়মাস পর সুশোভনের ঘরে এসেছিল মণিকা। রীতিমত অবাকই হয়ে গিয়েছিল সুশোভন। বলেছিল, কী কথা?

‘আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি তাতে নিশ্চয়ই তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।‘

‘আমার কথা থাক। অসুবিধাটা বোধহয় তোমারই বেশি। তা কী করতে চাও তুমি?’

‘এলাহাবাদ যেতে যাই। দাদাকে চিঠি লিখেছি। কয়েকদিনের ভেতরেই আমাকে নিতে আসবে।‘

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সুশোভন। তারপর বলেছিল, একেবারে নিয়ে যাবার জন্যে চিঠি লিখে ফেললে! একটু থেমে বলেছিল, ঠিক আছে।

তারপর থেকে শুধু অমলের জন্য অপেক্ষা করে থাকা। আজ কাল পরশু, যে কোনওদিন সে এসে পড়তে পারে। সুশোভনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, অমলের সঙ্গে সেই যে মণিকা চলে যাবে, আর কোনওদিনই ফিরবে না।

কতক্ষণ আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে মণিকার দিকে তাকিয়েছিল, খেয়াল নেই। আচমকা কলিং বেল বেজে উঠল।

আজকাল তাদের ফ্ল্যাটে বিশেষ কেউ আসে না। বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগ, অ্যাড-ফিল্মের মডেলরা—কেউ না। মণিকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে। পৌঁছেছে, মোটামুটি সবাই তারা জেনে গেছে। তাই পারতপক্ষে এধার মাড়ায় না। একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার ভেতরে গিয়ে কী লাভ?

সুশোভন প্রথমটা ভেবেছিল, জমাদার বাথরুম সাফ করতে এসেছে। কিংবা যে ছেলেটা মিল্ক বুথ থেকে দুধ এনে দেয় সে-ও হতে পারে। যে-ই আসুক বিশেষ, কৌতূহল নেই সুশোভনের। ওরা এলে সতীশ দুধ নিয়ে ফ্রিজে রেখে দেবে বা বাথরুম পরিষ্কার করাবে। কাজকর্মে লোকটা দারুণ চৌখস।

একটু পরেই দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। পরক্ষণেই ফ্ল্যাট কাঁপানো চিৎকার, সুশোভন কোথায় রে?

গলার আওয়াজেই টের পাওয়া গেল পরিমল। আস্তে, গলার স্বর নিচু পর্দায় নামিয়ে কথা বলতে পারে না সে। কলেজে সুশোভনের সঙ্গে পড়ত। পরে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরি যোগাড় করে ক’বছর আগে মিডল ইস্টে চলে গিয়েছিল। ওখানে তাদের কোম্পানি কী একটা প্ল্যান্ট বসাচ্ছে। সেখানে পরিমল টপ একজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার।

ব্যস্তভাবে খাট থেকে নেমে বাইরে আসতেই সুশোভনের চোখে পড়ে, লিভিং কাম-ড্রইং রুমে পরিমল আর তার স্ত্রী সুজাতা দাঁড়িয়ে আছে। পরিমলের হাতে একটা মাঝারি সাইজের দামি সুটকেস। তাকে দেখেই সুটকেসটা নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড়ে এসে দু’হাত জড়িয়ে ধরল, ‘কেমন আছিস রে শালা?’

সেই কলেজ লাইফ থেকেই পরিমলটা দারুণ হুল্লোড়বাজ আর আমুদে। তার মধ্যে কোনওরকম প্যাঁচ বা নোংরামি নেই। ওর স্বভাব অনেকটা দমকা বাতাসের মতো-ও এলেই মনে হয় ঘরের সব বন্ধ দরজা-জানলা খুলে গেল।

পরিমলকে দেখে মনটা খুশি হয়ে গেল সুশোভনের। বলল, এই চলে যাচ্ছে। তোরা কেমন আছিস বল।

‘আমরা কখনও খারাপ থাকি না। অলওয়েজ ইন আ জলি গুড মুড। আমাদের মতো স্বামী-স্ত্রী হোল ওয়ার্ল্ডে খুব বেশি খুঁজে পাবি না।‘ বলে ঘাড় ফিরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে স্ত্রীকে দেখতে দেখতে পরিমল বলল, ‘না কি বল?’

সুজাতা হাসল, অর্থাৎ পরিমল এবং সুজাতা দাম্পত্য জীবনে খুবই সুখী। পারফেক্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং বলতে যা বোঝায় তা তাদের রয়েছে। হঠাৎ নিজের আর মণিকার কথা মনে পড়তে অদ্ভুত বিষাদে বুকের ভেতরটা ভরে যেতে লাগল সুশোভনের।

বন্ধুকে ছেড়ে দিয়ে একটা সোফায় বসতে বসতে পরিমল বলল, অনেকদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হল। কী ভাল যে লাগছে!

সুশোভন দাঁড়িয়েই ছিল। একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ, প্রায় বছর পাঁচেক পর তোকে দেখলাম। এখন যেন তুই মিডল-ইস্টে কোথায় পোস্টেড?’

‘কুয়েতে। আমাদের কোম্পানি ওখানে একটা বিরাট এয়ারপোর্ট তৈরি করছে।‘

সুশোভন জানত, যাদবপুর থেকে ডিগ্রি নিয়ে বেরুবার পর পরিমল বছর দুই তিন কলকাতার একটা ফার্মে কাজ করেছে। তারপর চলে যায় বম্বে অন্য একটা কোম্পানিতে। সেই কোম্পানি মিডল-ইস্ট আর আফ্রিকার নানা দেশে বিরাট বিরাট প্রোজেক্ট করেছে। ক’বছর ধরে পরিমল এই সব প্রোজেক্টের কাজে কখনও আবুধাবি, কখনও বাগদাদ, কখনও ত্রিপোলিতে রকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে দিনরাত তার এত ব্যস্ততা যে দেশে ফেরার সময়ই পায় না। আগে তবু দেড় দু’বছর পর পর। আসতে পারত। ক’বছর আগে একবার সুজাতাকে বিয়ে করতে এসেছিল। এবার তো এল পাঁচ বছর বাদে।

পরিমল বলল, এবার একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। লাস্ট উইকে বম্বে পৌঁছেছি। হেড অফিসে দুটো জরুরি কনফারেন্স ছিল। সেসব সেরে পরশু মর্নিং ফ্লাইটে এসেছি কলকাতায়। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে ফোন-টোন না করেই চলে এলাম। কতকাল একসঙ্গে থাকি না। এবার তোর এখানে তিন-চার দিন থেকে যাব। সুটকেসটা দেখিয়ে বলল, এই দ্যাখ, একেবারে জামাকাপড় নিয়ে রেডি হয়ে এসেছি।

সুশোভন চমকে উঠল। পরিমল তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সেই স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে যতদিন পরিমল কলকাতায় ছিল, রোজ দু’জনের একবার করে

দেখা না হতে চলত না। কতদিন পরিমল তাদের বাড়ি এসে থেকে গেছে, সে-ও গিয়ে থাকত পরিমলদের বাড়ি। কোনওদিন যে তাদের ছাড়াছাড়ি হবে, এ যেন ভাবাই যেত না।

পরিমল তার কাছে ক’দিন থাকবে। সোনার সুতো দিয়ে বোনা যৌবনের সেই দিনগুলো নতুন করে ফিরে আসবে, এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কী হতে পারে। কিন্তু কয়েক দিন না, কয়েকটা মিনিট থাকলেই তার আর মণিকার এখনকার সম্পর্কটা ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে। ভেতরে ভেতরে দারুণ গুটিয়ে গেল সুশোভন। ফ্যাকাসে একটু হেসে কোনওরকমের বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

সুজাতা ওধারের একটা সোফায় এর মধ্যে বসে পড়েছিল। সে এবার বলে উঠল, ‘আপনার মিসেস কোথায়? তার তো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাড়িতে নেই?’

সুজাতার দিকে তাকাল সুশোভন। গোলগাল আদুরে চেহারা। চোখে মুখে হাসির আভা মাখানো। সে যে সুখী, তৃপ্ত সেটা যেন তার সর্বাঙ্গে হালকা লাবণ্যের মতো মাখানো রয়েছে।

সুজাতাকে আগে খুব বেশি দেখেনি সুশোভন। পরিমলের বিয়েটা প্রেম-ফ্রেম করে বিয়ে নয়। পুরনো স্টাইলে বাড়ি থেকে মেয়ে দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করা। হয়েছিল। মেয়ে দেখার সময় একবার সুজাতাকে দেখেছে সুশোভন। তারপর বিয়ে এবং বৌভাতের দিন। পরে খুব সম্ভব বারদুয়েক। সুজাতার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ বেশি পাওয়া যায়নি। যাই হোক, হৃৎপিণ্ড পলকের জন্য থমকে যায় সুশোভনের। কাঁপা দুর্বল গলায় সে বলে, বাড়িতেই আছে।

ওধারের সোফা থেকে প্রায় চেঁচিয়েই ওঠে পরিমল, তুই আশ্চর্য ছেলে তো বৌকে কোথায় গায়েব করে রেখেছিস? ডাক, এক্ষুনি ডেকে আন।

অগত্যা প্রায় মাসখানেক-মাসদেড়েক বাদে মণিকার বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল সুশোভন। দূরমনস্কের মতো এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মণিকা। পরিমলরা যে এসেছে, সে কি টের পায়নি?

কয়েক মুহূর্ত দ্বিধান্বিতের মতো তাকিয়ে থাকে সুশোভন। তারপর আস্তে করে ডাকল, মণিকা–

চমকে মুখ ফেরায় মণিকা। রীতিমত অবাকই হয়ে যায়। কতদিন পর সুশোভন তাকে ডাকল, মনে করতে পারল না। জিজ্ঞাসু চোখে সে তাকিয়ে থাকে।

সুশোভন এবার বলল, ‘পরিমলকে তো তুমি চেন।‘

মণিকা মাথা নাড়ল—চেনে। যদিও তার বিয়ের পর দু-একবার মাত্র পরিমলকে দেখেছে। অবশ্য সে যে সুশোভনের প্রাণের বন্ধু, এ খবর তার অজানা নয়।

সুশোভন বলল, ‘পরিমল ওর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। ড্রইং রুমে বসে আছ। ওরা ক’দিন আমাদের এখানে থাকবে।‘

মণিকার চোখে মুখে চাঞ্চল্য ফুটে উঠল কিন্তু এবারও কিছু বলল না সে।

সুশোভন গলার ভেতর একটু শব্দ করল। তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘আমার একটা অনুরোধ রাখবে?’

মণিকা আবছা গলায় বলল, ‘কী?

‘আমাদের মধ্যে যা-ই হয়ে থাক না, পরিমলরা যেন বুঝতে না পারে। ওরা যে কদিন থাকে একটু অ্যাডজাস্ট করে নিও। আই মীন–’ বলতে বলতে থেমে যায় সুশোভন। তার দু’চোখে অনুনয়ের ভঙ্গি ফুটে ওঠে। অর্থাৎ বাইরের লোকজনের সামনে পরস্পরের তিক্ত সম্পর্কটা যাতে বিস্ফোরণের মতো ফেটে না পড়ে সেই জন্যই সুশোভনের এই কাকুতি-মিনতি।

মণিকা এক পলক ভেবে নিল। আর কদিন বাদেই দাদা এলে সে তো এলাহাবাদ চলে যাচ্ছেই। তার আগে দু-চারটে দিন সুখী দম্পতির রোলে অভিনয় করলই না হয়। যে সম্পর্ক চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাচ্ছে, যার আর জোড়া লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, খুশি মুখে পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে কয়েকটা দিনের জন্য তার জের টেনে চলতে হবে। এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ডিভোর্স হয়নি, আইনের চোখে এখনও তারা স্বামী-স্ত্রী। এ সবই ঠিক, তবু মনে মনে তারা বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত হয়েই আছে। এই সময় আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করাটা একটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা বৈকি।

মণিকা বলল, ‘ঠিক আছে। তোমার সম্মান যাতে নষ্ট না হয়, যাতে কোনও রকম অস্বস্তিতে না পড় সেটা আমি দেখব।‘

মারাত্মক একটা টেনশান কেটে যায় সুশোভনের। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একটু হাসে সে। বলে, পরিমলরা ড্রইং রুমে বসে আছ। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বলে গভীর আগ্রহে মণিকার দিকে তাকাল।

সুশোভনের ইচ্ছেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না মণিকার। খাট থেকে নামতে নামতে সে বলে, চল, আমি যাচ্ছি। একটু পরে সুশোভনের সঙ্গে ড্রইং রুমে এসে স্নিগ্ধ হেসে মণিকা পরিমলকে বলে, কতদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। কী ভাল যে লাগছে। আমাদের এখানে কিন্তু কদিন থেকে যেতে হবে। পরিমলরা যে এখানে থাকতেই এসেছে সে খবর সুশোভনের কাছে কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে মণিকা। তবু কথাটা যে বলল, সেটা নিতান্তই আন্তরিকতা বোঝাবার জন্য।

পরিমল বলল, ‘থ্যাংক ইউ। আমরা তো সেইরকম প্ল্যান করেই এসেছি। ক’টা দিন হই-হই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।‘

মণিকা হেসে হেসে বলল, আপনারা দুই বন্ধু গল্প করুন। আমি এঁর সঙ্গে একটু কথাটথা বলি। আপনাদের বিয়ের সময় সেই একবার মোটে দেখেছিলাম। তারপর যে দু’বার কলকাতায় এসেছিলেন তখন আমি এলাহাবাদে, বাপের বাড়িতে। বলতে বলতে সুজাতার পাশে গিয়ে বসল মণিকা। বলল, ‘প্রথমেই বলে রাখছি, আমি কিন্তু আপনি-টাপনি করে বলতে পারব না।

সুজাতা হাসল।

‘তুমি করে বললে রাগ করবে না তো?’ মণিকা ফের বলে।

‘আরে না না, তুমি করেই তো বলবে।’ মণিকা যে এত দ্রুত আপন করে নেবে সুজাতা ভাবতে পারেনি। তাকে খুবই খুশি দেখাল।

বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখের কোণ দিয়ে মণিকাকে লক্ষ করতে লাগল সুশোভন। হেসে হেসে সুজাতার সঙ্গে গল্প করছে মণিকা। খুবই ইনট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে সে। কোনওদিন তাকে এত উচ্ছ্বসিত হতে দেখেনি সুশোভন। যেভাবে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সুজাতার সঙ্গে সে কথা বলছে তাতে মনে হয় সুজাতা যেন তার কতকালের চেনা। মণিকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এই মুহূর্তে তাকে দেখলে কে তা বুঝবে!

কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে সতীশকে দিয়ে প্রচুর কেক, প্যাস্ট্রি, সন্দেশ আর চা নিয়ে নিজের হাতে সাজিয়ে সবার সামনে ধরে দিল মণিকা। তারপর বাজার থেকে কী কী আনতে হবে, তার একটা লিস্ট করে তাকে পাঠিয়ে দিল। প্রায় দেড়মাস বাদে এভাবে তাকে বাজারে পাঠাল মণিকা। এই ক’সপ্তাহ সতীশ নিজের থেকেই যা ইচ্ছে কিনে এনেছে বা বেঁধেছে। কিভাবে কি হচ্ছে, সে সম্পর্ক একটা কথাও বলেনি মণিকা। এমন কি রান্নাঘরে উঁকি পর্যন্ত দেয়নি। গভীর উদাসীনতায় সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থেকেছে। সতীশও সুশোভনের মতোই অবাক হয়ে গেছে। বিমূঢ়ের মতো মণিকাকে দেখতে দেখতে সে চলে গেল।

এদিকে আচমকা কিছু মনে পড়ে যেতে পরিমল স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, ওদের জন্যে কী সব এনেছ, সেগুলো বার করে দাও।

‘আরে তাই তো—’ ব্যক্তভাবে নিজেদের সুটকেসটা খুলে সুশোভনের জন্য দামি প্যান্টের পিস, টাই-পিন, টেপ-রেকর্ডার এবং মণিকার জন্য ফরেন কসমেটিকস, হাউস কোট ইত্যাদি ইত্যাদি কত রকমের জিনিস যে বার করে দিল সুজাতা!

সুশোভন বলল, ‘এত সব কী এনেছিস! তোদের কি মাথা-টাথা খারাপ!’

সুজাতা এবং পরিমল একসঙ্গে জানালো, এমন কিছুই তারা আনেনি। খুবই সামান্য জিনিস।

হাত পেতে হাউস কোট-টোট নিতে নিতে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল মণিকা। এসব তাকে নিতে হচ্ছে সুশোভনের স্ত্রী হিসেবে, যার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই তার সম্পর্ক চিরদিনের মতে ছিন্ন হয়ে যাবে। এই উপহারগুলিতে তার এতটুকু অধিকার নেই। এক ধরনের ক্লেশ এবং অস্বস্তি মণিকাকে খুবই কষ্ট দিতে থাকে। মনে মনে সে স্থির করে ফেলে, এলাহাবাদ যাবার সময় এর একটি জিনিসও নিয়ে যাবে না, সব এখানে রেখে যাবে।

মণিকা নিজের মনোভাবটা মুখে চোখে ফুটে উঠতে দেয় না। শুধু বলে, এর কোনও মানে হয়!

ওদের কথাবার্তার মধ্যেই একসময় বাজার করে ফিরে আসে সতীশ। কী কী রান্না হবে, ভাল করে তা বুঝিয়ে দেয় মণিকা। শুধু তা-ই নয়, মাঝে মাঝে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে রান্না দেখিয়ে আসে, কখনও বা চা করে আনে।

অতিথিদের যে এত যত্ন করতে পারে, যে এমন নিপুণ সুগৃহিণী, কদিন পরেই তার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না, ভাবতেই বুকের ভেতর অদৃশ্য কোনও শিরা ছিঁড়ে যায় সুশোভনের।

.

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে যায়। টেবিলের এক দিকে পাশাপাশি বসেছে পরিমল এবং সুজাতা। তাদের মুখোমুখি মণিকা আর সুশোভন। মণিকা অবশ্য একসঙ্গে বসতে চায়নি। সবাইকে খাইয়ে, পরে খাবে বলে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু সুজাতা রাজি হয়নি, একরকম জোরজার করে তাকেও সঙ্গে বসিয়ে দিয়েছে।

মণিকার ইঙ্গিতে এবং নির্দেশে সতীশ সবার প্লেটে খাবার দিয়ে যাচ্ছিল। একটা বড় মাছের মাথা সে যখন পরিমলের প্লেটে দিল তক্ষুনি পরিমল সেটা সুজাতার পাতে তুলে দিল। লজ্জায় এবং সুখে মুখটা আরক্ত দেখাচ্ছে সুজাতার।

ওদিকে সতীশ আর একটা মাছের মুড়ো সুশোভনের পাতে দিয়েছে। দ্রুত সুশোভন এবং মণিকা পরস্পরের দিকে একবার তাকায়। আগে হলে মুড়োটা কিছুতেই নিত না সুশোভন। মাছের মুড়ো মণিকার খুব পছন্দ। কিন্তু এখন তাদের যা সম্পর্ক তাতে হুট করে মুড়োটা তুলে দেওয়া যায় না। ভেতরে ভেতরে ভয়ানক

অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগল সুশোভন।

এদিকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল পরিমল, ‘কি রে শালা, তুই তো টেরিফিক সেলফিশ দেখছি।‘

সুশোভন চমকে ওঠে, ‘কেন, কী করলাম?’

‘নিজে এত বড় মাছের মুড়োটা সাবড়ে দেবার তাল করছিস। আর তোর বউ মুখ চুন করে বসে আছে। বৌকে কী করে ভালোবাসতে হয় আমার একজাম্পল দেখেও শিখলি না। মুড়োটা মণিকার পাতে তুলে দে এক্ষুণি।‘

সুশোভন অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল, বোঝা গেল না। মণিকাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মাছের মুড়ো-টুড়ো আমার ভাল লাগে না। ভীষণ কাটা।

এরপর যান্ত্রিক নিয়মে খেতে লাগল মণিকা আর সুশোভন। পরিমল অবশ্য প্রচুর কথা বলছিল। আর করছিল বিদেশবাসের সময়কার মজার মজার সব গল্প। একটু আধটু হাসছিল সুশোভন। মাঝে-মধ্যে হুঁ হাঁ করে যাচ্ছিল।

.

খাওয়া-দাওয়ার পর সুশোভন বলল, সতীশকে বিছানা করে দিতে বলি। তোরা একটু রেস্ট নে।

পরিমল জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়, দিবানিদ্রা দেবার জন্যে কুয়েত থেকে তোর এখানে এসেছি নাকি? কদিন এখন শুধু আড্ডা, বাংলা সিনেমা, তাস, বাংলা থিয়েটার, এটসেট্রা, এটসেট্রা।

দু’মিনিটের ভেতর কদিনের একটা প্রোগ্রামও ছকে ফেলে পরিমল। আজ এই দুপুরবেলায় তাসের আসর বসবে। বিকেলে চা-টা খেয়ে একটা বাংলা নাটক কি সিনেমা। রাত্রে ফিরে এসে আবার আচ্ছা, তারপর ডিনার, অবশেষে ঘুম। কাল সকাল থেকে আড্ডা-নাটক ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর সঙ্গে ছেলেবেলার বন্ধুদের বাড়িতেও হানা দেবে। ক’টা দিন কলকাতাকে জমিয়ে মাতিয়ে পরিমলরা আবার কুয়েতে ফিরে যাবে। ঠিক হয়, কাল থেকে দিন চারেক সুশোভন ছুটি নেবে।

কাজেই ড্রইং রুমে আবার সবাই চলে আসে। হালকা মেজাজে নতুন করে গল্পটল্পর ফাঁকে একসময় সুশোভনকে ডেকে দক্ষিণ দিকের ব্যালকনিতে নিয়ে যায় মণিকা। বেশ অবাকই হয়েছিল সুশোভন। জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?

হ্যাঁ। আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয় মণিকা, তোমার বন্ধুরা আমাদের জন্যে এত জিনিস এনেছে। ওদেরও আমাদের দিক থেকে কিছু প্রেজেন্টেশন দেওয়া দরকার। নইলে খারাপ দেখাবে।

এই ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি, অথচ আসা উচিত ছিল। সংসারের সব দিকে মণিকার চোখ কান খোলা। বরাবরই সুশোভন লক্ষ করেছে, তার কর্তব্যবোধের তুলনা হয় না। মণিকা সম্বন্ধে রীতিমত কৃতজ্ঞতাই বোধ করল সে। খুব আন্তরিকভাবে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দেওয়া তো নিশ্চয়ই দরকার। ওদের জন্যে তোমার পছন্দমতো কিছু কিনে এনো।

তুমিই নিয়ে এস না।

দোকানের ভিড়ভাট্টায় আমার যেতে ইচ্ছে করে না। সাফোকেটিং মনে হয়। তুমিই একসময় চলে যেও।

ওরা যেরকম প্রোগ্রাম-ট্রোগ্রাম করেছে তাতে পরে যাবার সময় পাওয়া যাবে। গেলে এখনই যেতে হয়।

‘বেশ তো, গাড়িটা নিয়ে চলে যাও।‘

মণিকা নিজে ড্রাইভ করতে জানে। সুশোভন বলা সত্ত্বেও মণিকা কিন্তু গেল না, দাঁড়িয়েই রইল।

সুশোভন জিজ্ঞেস করল, আর কিছু বলবে? মুখ নামিয়ে দ্বিধান্বিতের মতো মণিকা বলে, ‘মানে—’ বলেই থেমে যায়।

হঠাৎ সুশোভনের মনে পড়ে, ডিডোর্স সম্পর্কে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকেই আলমারির চাবি নিজের কাছে আর রাখে না মণিকা, সতীশকে দিয়ে সুশোভনের কাছে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।

দ্রুত নিজের বেডরুমে গিয়ে বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা এনে মণিকাকে দিতে দিতে সুশোভন বলে, আলমারি থেকে টাকা নিয়ে যাও—

কুণ্ঠিত মুখে মণিকা বলে, ‘কিন্তু—’

বিষণ্ণ হাসে সুশোভন, ‘স্বামী-স্ত্রীর নকল রোলে যখন অভিনয় করতে রাজিই হয়েছ তখন সামান্য খুঁতটা আর রাখছ কেন? ফিউচারে আমাদের যা-ই ঘটুক না, আমি কি তোমাকে কোনওদিন অবিশ্বাস করতে পারব?’ তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত এক কষ্টে বুজে আসে।

মণিকা উত্তর দেয় না। চাবি নিয়ে সোজা সুশোভনের ঘরে গিয়ে আলমারি খোলে। কতকাল বাদে সে এই ঘরে ঢুকল।

একটু পর টাকা নিয়ে একাই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল মণিকা। যাবার আগে পরিমলদের বলল, একটা দরকারি কাজে সে বেরুচ্ছে। ঘন্টাখানেকের ভেতর ফিরে আসবে। ইচ্ছে হলে পরিমলরা একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে।

পরিমল জানালো, দুপুরে ঘুমোবার অভ্যাস তার বা সুজাতার কারও নেই। মণিকা যতক্ষণ না ফিরছে তারা সুশোভনের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দেবে। সে ফিরে। এলে চারজনে জমিয়ে তাসের আসর বসাবে।

.

এক ঘন্টা না, প্রায় ঘন্টাদুয়েক বাদে সুজাতার জন্য দামি মাইশোর সিল্কের শাড়ি, নামকরা গায়কদের লং-প্লেয়িং রেকর্ড, কিছু ইন্ডিয়ান পারফিউম আর পরিমলের জন্য দামি প্যান্ট এবং শার্টের পীস ইত্যাদি নিয়ে ফিরে এল মণিকা।

পরিমল প্রায় চেঁচামেচিই জুড়ে দিল, এই জন্যে বেরুনো হয়েছিল! কোনও মানে হয়?

সুজাতা মজা করে বলল, ‘ওই যে আমরা কি একটু দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তার রিটার্ন দেওয়া হল।

মণিকা বলল, রিটার্ন আবার কী! সামান্য উপহার। এগুলো দেখলে আমাদের কথা মনে পড়বে।

পরিমল বলল, এগুলো না দিলেও মনে পড়বে।

‘জানি। তবু—’

এরপর এ নিয়ে আর কথা হয় না। পরিমল বলে, এবার তা হলে তাস নিয়ে বসা যাক।

মণিকা বলে, আমার আপত্তি নেই। পুরুষ ভার্সান মহিলা খেলা হোক। সুজাতা আর আমি একদিকে, আপনার ফ্রেণ্ড আর আপনি আরেক দিকে।

‘ও, নো নো—’ জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নাড়ল পরিমল, ওটা হবে না। ওই ইভস ভার্সান আদমস-এর কারবারে আমি নেই। সুজাতা আমার লাইফ পার্টনার। সুখে-দুঃখে ভালয়-মন্দয়, চেস্ট বেঙ্গলিতে কী যেন বলে শ্মশানে রাজদ্বারে সব সময় ও আমার পার্টনারই থাকবে। এই তাস খেলাতেও ওকে আর কারও পার্টনার হতে দেব না বলে রগড়ের ভঙ্গিতে চোখ টিপল।

পরিমল এবং সুজাতার মধ্যে সম্পর্কটা কতটা গভীর, নতুন করে আরেক বার টের পাওয়া গেল। সুশোভন একধারে এতক্ষণ চুপচাপ সিগারেট হাতে বসে ছিল। কোনও এক যান্ত্রিক নিয়মেই যেন তার চোখ চলে যায় মণিকার দিকে। মণিকাও তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয় মণিকা। সুশোভন টের পায়, বুকের অতল থেকে ঢেউয়ের মতো কিছু একটা উঠে আসছে।

একসময় খেলা শুরু হয়। পরিমলের ইচ্ছে মতোই সুজাতা তার পার্টনার হয়েছে। অগত্যা সুশোভনের পার্টনার হয়েছে মণিকা।

সুজাতা ভুল তাস ফেললেই হই চই করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে দিচ্ছে পরিমল, তুমিই আমাকে ডোবাবে।

মণিকা খুব ভাল তাস খেলতে জানে না। সে এনতার বাজে তাস ফেলে যাচ্ছে। আগেকার সম্পর্ক থাকলে পরিমলের মতোই সুশোভনও চেঁচামেচি করত। কিন্তু হারজিত্রে ব্যাপারে এখন তার মনোভাব একেবারেই নিস্পৃহ। প্রতি দানেই তারা পরিমলদের কাছে হেরে যাচ্ছে। কিন্তু কী আর করা যাবে। জয় পরাজয়, দুইই তার কাছে এখন সমান। নিঃশব্দে অন্যমনস্কর মতো সে খেলে যেতে লাগল।

প্রতি দানে জিতে জিতে দারুণ মেজাজে আছে পরিমল। সে বলল, কি রে, তোর বউ তোকে ফিনিশ করে দিলে!

চমকে মণিকার দিকে তাকায় সুশোভন। চমকানো ভাবটা তার একার নয়, মণিকারও। দ্রুত মণিকা তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।

এক পলক কিছু ভাবল সুশোভন। তারপর বলল, ‘আরে বাবা, খেলাটা খেলাই। এটা তো আর লাইফ অ্যান্ড ডেধের ব্যাপার নয়। তাসের খেলায় তোরা না হয় জিতলিই। এই তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বউকে বকাবকি করতে যাওয়াটা মিনিংলেস।’ বলে চিন্তাটিস্তা না করেই হাতের তাসগুলো থেকে একটা বেছে টেবিলের ওপর ফেলল।

একটানা ঘন্টা দুয়েক খেলা চলল। তারপর সন্ধের আগে আগে পরিমল বলল, অনেকক্ষণ তাস হল। এবার চল, একটু বাইরে ঘুরে আসা যাক।

সুশোভন বলল, ফাইন। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে থেকে কোমর ধরে গেছে।

দশ মিনিটের ভেতর চারজন টপ ফ্লোর থেকে নিচে নেমে সুশোভনের গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ল। ময়দানের চারপাশে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ পরিমল বলল, ‘অনেকদিন বাংলা নাটক দেখিনি। কলকাতায় এখন ভাল ড্রামা কী চলছে?

সুশোভন বলল, ঠিক বলতে পারব না। আমরাও অনেক দিন নাটক-টাটক দেখিনি। অ্যাকাডেমিতে গ্রুপ থিয়েটারগুলো রোজই নাটক করে। ওদের ড্রামায় একটা ফ্রেশ ব্যাপার থাকে। দেখবি নাকি?

পরিমল বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠল। বলল, চল না, দেখাই যাক।’

আহামরিও না, আবার খুব খারাপও না, একটা নাটক দেখে ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা বেজে গেল।

.

রাত্তিরে খাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ আড্ডা-টাজ্ঞা দিতে দিতে পরিমলের হাই উঠতে লাগল। সে বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে রে। এবার শুতে হবে। আমি আবার রাতটা বেশি জাগতে পারি না।

শোওয়ার কথায় চমকে উঠল সুশোভন। কেননা তার এই ফ্ল্যাটে মোটে দুটো বেডরুম। পরিমলদের যদি একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়, অন্য ঘরটায় তাকে আর মণিকাকে থাকতে হবে। অনেকদিন মণিকা এবং সে এক ঘরে রাত কাটায় না।

একটু ভেবে সুশোভন বলল, এক্ষুনি শোবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এক কাজ করা যাক—’

‘কী?’

‘তুই আর আমি এক ঘরে শোব। আমাদের বউরা অন্য ঘরে। সেই কলেজ লাইফে তুই আর আমি কতদিন এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি। এতদিন পর যখন একটা চান্স—’

সুশোভনের কথা শেষ হতে না হতেই প্রবল বেগে দুই হাত এবং মাথা নাড়তে নাড়তে পরিমল বলল, ‘নো নো, নেভার। কলেজ লাইফে যা হয়েছে, হয়েছে। এখন আমাদের ম্যারেজ লাইফ। বউকে ছাড়া আমি ভাই ঘুমোতে পারব না। পরক্ষণেই গলার স্বরটা ঝপ করে অনেকখানি নামিয়ে বলল, তুই কী রে, বউকে ফেলে আমার মতো একটা দুম্বো পুরুষের সঙ্গে শুতে চাইছিস! তোদের মধ্যে কোনওরকম গোলমাল টোলমাল হয়েছে নাকি?’ বলে রগড়ের ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।

নেহাত মজা করার জন্যই কথাটা বলেছে পরিমল, কিন্তু সুশোভন এবং মণিকার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু খেলে গেল। তাদের সম্পর্কটা কি বাইরের একজন মানুষের চোখে ধরা পড়ে গেছে? দ্রুত পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নিল তারা। তারপর সুশোভনই আবহাওয়াটাকে সহজ করে নেবার জন্য। হেসে বলল, ঠিক আছে বাবা, তুই তোর বউয়ের কাছেই শুবি। ম্যারেজ লাইফের হ্যাবিট তোকে নষ্ট করতে হবে না।

সতীশকে দিয়ে একটা ঘরে পরিমল এবং সুজাতার বিছানা করে দেওয়া হল। এবং নিতান্ত নিরুপায় হয়েই অন্য ঘরটায় গিয়ে ঢুকল সুশোভন আর মণিকা। দরজায় তারা খিল দেয়নি। পান্না দুটো ভেজিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল দু’জনে। তারপর মণিকা আস্তে আস্তে ডান দিকে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

জানালার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে যে আকাশ দেখা যায় সেখানে হাজার হাজার তারা জরির ফুলের মতো আটকে আছে। রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে কলকাতা।

শহর এখনও ঘুমোয়নি। নিচে অবিরত গাড়ি চলার শব্দ। অবশ্য হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের এই টপ ফ্লোরে বাতাসের ছাঁকনির ভেতর দিয়ে সেই আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে উঠে আসছে।

সুশোভন খুবই অস্বস্তি বোধ করছিল। দ্বিধান্বিতের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে করে বলল, ‘পরিমলটা ভীষণ ঝামেলায় ফেলে দিল।’

মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকায় মণিকা। সুশোভন কী বলতে চায়, সে বুঝেছে। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল সে।

সুশোভন এবার বলল, ‘আমি বরং এক কাজ করি।‘

আবার চোখ তুলে তাকায় মণিকা। তবে কিছু বলে না।

সুশোভন বলল, ‘আমি বাইরের ড্রইং রুমে গিয়ে শুই। তুমি এখানেই থাক। আধফোঁটা গলার মণিকা বলল, কিন্তু—’

‘কী?’

‘ড্রইং রুমে তো সতীশ শোয়। ওখানে—’

ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কাজের লোকের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়ির কর্তা গিয়ে শোবে, দৃশ্যটা একেবারেই মনোরম নয়। তাছাড়া সতীশ ভাববেই বা কী!

সুশোভন বলল, ‘তা হলে?’

ঘরের চারপাশ একবার দেখে নেয় মণিকা। তারপর বলে, তুমি শুয়ে পড়। আমি ওই জানালাটার ধারে সোফায় বসে থাকি। একটা তো রাত।

‘আজকের রাতটা না হয় না ঘুমিয়ে কাটাবে। কিন্তু পরিমলরা তো কয়েক দিন থাকছে। বাকি রাতগুলো?’

মণিকা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ পাশের ঘর থেকে টুকরো টুকরো হাসি, জড়ানো গাঢ় গলার আবছা আবছা কথা, চুমুর শব্দ, খুনসুটির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে।

চমকে মণিকা সুশোভনের দিকে একবার তাকাল। পরক্ষণেই মুখ নামিয়ে নেয়। আর সুশোভনের সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে তীব্র স্রোতের মতো অনেকক্ষণ, একটানা কী যেন বয়ে যেতে থাকে। নিজের অজান্তেই কখন যে সে মণিকার কাছে চলে এসেছে, জানে না। কোনও এক অভ্রান্ত নিয়মে তার হাত মণিকার কাঁধে উঠে। আসে। সঙ্গে সঙ্গে কী এক অলৌকিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে যায়। হঠাৎ সুশোভন টের পায় মণিকার মুখ তার বুকের ওপর আটকে আছে এবং মণিকার শরীরটাও ক্রমশ তার শরীরের ভেতর মিশে যাচ্ছে।

অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তারা। তারপর কাঁপা গম্ভীর গলায় সুশোভন। বলে, তোমার দাদা অমল এলে বলব, তুমি এলাহাবাদ যাবে না। আরেক বার আমরা চেষ্টা করে দেখি না। তুমি কী বল?

মণিকা উত্তর দেয় না। অনবরত তার মুখটা সুশোভনের বুকে ঘষতে থাকে।

একটু পর সুশোভন বুঝতে পারে, তার বুক চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। মণিকার কান্না তার মধ্যেও বুঝিবা ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙা ভাঙা, ঝাঁপসা গলায় বলে, ‘কেঁদো না, কেঁদো না।‘

আলট্রা মডার্ণ – অসীমানন্দ মহারাজ

হর্ষ চিন্তা করছিল, কী সে পেল আর কী সে হারাল। যা হারাল, তার চেয়ে যা পেল, তা-ই কি জীবনের পরম পাওয়া? হর্ষ কিন্তু তা মেনে নিতে পারছিল না। তাই তার মধ্যে প্রফুল্লতার অভাব ছিল।

হর্ষের স্ত্রী বীথি যে তা টের পেত না, এমন নয়। তাদের পাঁচ বছর বয়সের মেয়ে মৌলির আলাদা ঘরে শোয়ার বন্দোবস্ত করেও হর্ষের আদরের মাত্রা বাড়াতে সে অপারগ হল।

শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বদ্ধঘরে শোভন শয্যায় দেহবাস আরও শিথিল করে স্বামীর দিকে আরও এগিয়ে এসে বীথি বলল, তুমি তো সজাগই আছ, দেখছি। তোমার ভেতরের পশুটা কি এখনও ঘুমাচ্ছে?

তাই হবে হয়তো। হর্ষের কণ্ঠস্বর বড়ই উদাস।

বীথি বলে উঠল, তাকে জাগাও। পশুটা বুঝুক, তাকে সে অনেক সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে, যা সে আগে কখনও পায়নি।

বীথির সে কথা মিথ্যে নয়। হর্ষ ইচ্ছে করলে তার ভেতরের পশুকে আজকাল অনেক বেশি পরিতৃপ্ত করতে পারে।

কয়েকদিন আগেও তা পারত না, যখন সে স্ত্রী কন্যা সহ বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকত নিজেদের বাড়িতে।

মৌলির বয়স তখন সাড়ে চার। শিশু হলেও যথেষ্ট বুদ্ধিমতী সে। মুখখানা যেন কথার ফোয়ারা। তাকে একই ঘরে রেখে স্বামী স্ত্রী নিশ্চিন্তে খেলা করে কি করে? তবু তাকে আলাদা ঘরে শোয়াবার বন্দোবস্ত করার কথাটা গুরুজনদের কাছে তুলতে পারেনি কেউ।

তার ওপর ছিল ভোর হতে না হতে বদ্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বুড়ো বাপের বিরক্তিকর কাশির আওয়াজ, যার একটা অর্থও বুঝি ছিল, ওঠ, ওঠ, এত ঘুম ভাল নয়। সূর্য ওঠার আগে উঠতে হয়। Early to bed and Early to rise makes a man healthy, wealthy and fine. কথাটা কি ভুলে গেলে?

না, ভুলে যায় নি কেউ। সু সুখের শয্যা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করত না কারও। ঘুমাতও অবশ্য অনেক দেরিতে। গভীর রাতে আওয়াজ বন্ধ করে উত্তেজক ছবি দেখতে দেখতে নিজেরাও উন্মত্তের মত আচরণ করত। শরীরের ক্লান্তি তাই সহজে কাটতে চাইত না। সে কথা বলাও যেত না গুরুজনদের কাছে। অথচ বদ্ধ দরজার ওপারে গুরুজনের সশব্দ উপস্থিতি এপারে কামচরিতার্থতায় বাধা সৃষ্টি করত।

কিছুক্ষণ বাদে হর্ষের মা এসে দরজার কড়া নাড়াতেন, যার অর্থ, মৌলিকে তুলে দিতে হবে। সে স্কুলে যাবে। সাড়ে ছটার মধ্যে তার বেরিয়ে পড়া চাই।

মৌলিকে যথাসময়ে স্কুলে পাঠাবার দায়িত্বভার যদিও নিজ হাতে তুলে নিয়েছিলেন ঠাকুর মা, তু মেয়েকে ঘরের বার করে দিয়েই আবার দরজা বন্ধ করে দিতে উভয়েই সংকোচ বোধ করত।

সেসব অসুবিধে আজ আর নেই। যতক্ষণই তারা ঘুমিয়ে থাক বা সম্ভোগে লিপ্ত থাক না কেন, কেউ এসে বিঘ্ন সৃষ্টি করে না। হর্ষকে বলে বলে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে কোম্পানির দেওয়া ফ্ল্যাটেতে উঠে আসা হয়েছে, অন্তত বীথি তা ভালই মনে করে।

সে এখন অনেক স্বাধীন। শ্বশুর শাশুড়ির উপদেশ মেনে চলার প্রয়োজন নেই। স্বামীকে তুষ্ট রাখতে পারলে কোনও সমস্যাই তার থাকে না। শ্বশুর বাড়ি থাকতে যাদের সে কখনও ফোন করতেই সাহস পেত না, স্বামীর ফ্ল্যাটে আজ সে তাদের যখন খুশি চলে আসারও আমন্ত্রণ জানায়। দু চারজন মদ্যপ বন্ধুর কথা ভেবে ফ্রিজে সে মদের বোতল পর্যন্ত এনে রাখে।

ফ্রিজে মদের বোতল দেখে হর্ষ অবশ্য বলেছে, এ কাজটা তুমি ঠিক কর নি, বীথি। মৌলি না বুঝলেও আমার বাবা মার চোখে যদি পড়ে যায় কখনও, তাদের কি ধারণা হবে, ভাবতে পার?

বীথি হেসে উত্তর দিয়েছে, গোপন জায়গা যা সংরক্ষিত থাকে, অতিথিদের তা চোখে পড়ার কথা নয়। তারা বড় জোর ডাইনিংরুমে বসে, কিচেনে ঘোরাফেরা করে না।

হর্ষ বলে উঠেছে, আমার বাবা মাও কি—

বীথি বলেছে, আমার সংসারে অতিথি বই কী। সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার অধিকার তাদের আমি দেব না। এতকাল মুক্তির স্বাদ পেতে যারা দেয় নি, তাদের এবার শাস্তি তো পেতেই হবে।

হর্ষ জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে, আমার বাবা মা কিন্তু শাস্তিযোগ্য অন্যায় কখনও করে নি। তারা আমাদের যত ভালবাসে, নিজেদেরও তত ভালবাসে না।

বীথি বলে উঠেছে, তুমি তা টের পাও কি করে? তোমার রক্তপ্রবাহের মধ্যে নাকি? তা-ই যদি হয়, আমাকে তুমি দোষ দিতে পার না। তাদের রক্ত তো আর আমার ধমনীতে বইছে না। সে কারণে তাদের দোষও আমি দেখতে পাই, তুমি যা। দেখতে পাও না। পুত্রস্নেহে অন্ধ পিতামাতার মত তুমিও তোমার পিতামাতার প্রতি ভক্তিতে অন্ধ।

বীথির কথাগুলির খুব একটা প্রবািদ করতে না পারলেও হর্ষের শুনতে মোটই ভাল লাগেনি। বুঝতে তার ভু হয়নি, বীথি নিজের খুশিমত জীবন যাপন করতে চায় বলেই গুরুজনেরা তার কাছে অসহ্য।

পতিও তো পরম গুরু। কিন্তু হর্ষকে গুরু বলে কখনও কি মনে করে বীথি? একেবারেই না। নাম ধরে তো ডাকেই, তাছাড়া তাচ্ছিল্যও কম করে না। পাঁঠা ও কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে কথাও শোনায় কখনও কখনও। হর্ষ ভাবে, হায়, দিন কালের এ কী পরিবর্তন!

.

২.

শীতের সকাল। ঘুম ভেঙে গেলেও ওঠার ইচ্ছে হয় না সহজে। তবু হর্ষ উঠেই পড়ল। মেয়ে মৌলিকে তৈরি করে কাজের বৌটি যখন তাকে স্কুলে নিয়ে যায়, সে সময়টার মৌলির মনের অবস্থা কেমন থাকে, অনেকদিন তা লক্ষই করা হয় নি যে।

হর্ষ চলে এল সে-ঘরে, যে ঘরে মৌলিকে নিয়ে কাজের বৌটি ঘুমায়।

আয়নার সামনে মৌলিকে সে একাই দেখল। অপটু হাতে নিজের সাজ নিজেই করছে।

হর্ষ জিজ্ঞেস করল, তোর পারুল মাসি কোথায়?

মৌলি বলল, আমিও অনেকক্ষণ দেখছি না। ও আমাকে ঠিকমত সাজাতে পারে, বাপি, তুমি ঠাকুরমাকে এখানে নিয়ে এস।

তোর মা যদি সাজিয়ে দেয়, রাজি তো? হর্ষ মেয়ের চোখে চোখে তাকাল।

মৌলি বলল, না, বাপি। মা কোনও দিন আমার চুলও আঁচড়ে দেয়নি। আমার ব্যাপারে মাকে তুমি কিছু বোলো না। ঠাকুরমার হাতে সাজতেই আমার সবচেয়ে ভাল লাগত। তারপর ঠাকুরদা যখন আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে যেত, মনেই হত না, আমি পথে হাঁটছি। সুন্দর সুন্দর গল্প শুনতে শুনতেই সময় কেটে যেত। বাপি, তোমরা যখন আমাকে তোমাদের কাছে নিচ্ছ না, আমাকেই রং ঠাকুরমা ঠাকুরদার কাছে পাঠিয়ে দাও। সেখানেই আমি ভাল থাকব।

মেয়ের কথা শুনতে শুনতে হর্ষের বুক ব্যথায় যেন ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল। কোনও রকমে চোখের জল সামাল নিয়ে সে বলল, মৌলি, সবুর কর। আমিই তোকে সাজিয়ে দেব। তারপর স্কুলেও পৌঁছে দিয়ে আসব। তোকে বলার জন্য কত গল্পই না আমার মনে জমা হয়ে আছে রে।

মৌলি তার বাপির মুখের দিকে তাকাল একবার। তারপর হঠাৎই বলে উঠল,, বাপি, তুমি কখনও ঠাকুরদার মত গল্প বলতে পারবে না। তোমাকে দেখলেই আমার মনে হয়, তুমি শুধু হিসেব কষছ। তুমি কি করে আমাকে আনন্দ দেবে? ঠাকুরদা ঠাকুরমাকে রেখে যখনই এখানে চলে এলে, তখন থেকেই আমার মুখে আর হাসি আসে না, গলাতেও গান আসে না, বাপি। শুধু মাকে বড় হাসিখুশি দেখি। দুপুরে যখন মামা কাকারা আসে, মায়ের সে কী হাসি!

হর্ষ যেন তড়িতাহত হল। তার অনুপস্থিতিতে নির্জন দুপুরে নিজেদের শয়নকক্ষে বীথি তাহলে পুরুষ সঙ্গ করে!

মেয়েকে সে প্রশ্ন করল, মামা কাকারা তোকে আদর করে তো, মৌলি?

মৌলি বলল, আমি তাদের কাছে কখনও যাই না, বাপি। স্কুল থেকে ফিরেও আমাকে এইঘরেই থাকতে হয়। উঁকি ঝুঁকি দেওয়াও মা পছন্দ করে না। জোর ধমক দেয়। আজকাল দরজাই বন্ধ করে রাখে। আমি শুধু আওয়াজ শুনে বুঝি, কত আনন্দই না করছে। আমার কেবলই কান্না আসে, বাপি।

হুম। অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়া হর্ষের মুখ থেকে আর কোনও শব্দ বের হল না।

সেসময়ে কাজের বৌটি এসে বলল, আপনি সরুন, দাদা। মৌলিকে আমি ঠিক সময়েই স্কুলে পৌঁছে দিতে পারব। ও আজকাল বেশ জোরেই হাঁটতে পারে।

হর্ষ গম্ভীর স্বরে বলল, তুমি দেরি করবে আর মৌলিকে জোরে হাঁটাবে, এটা ঠিক নয়, পারুল। এ সময়ে গিয়েছিলে কোথায়!

পারুল মৌলির চুল আঁচড়ে দিতে দিতে বলল, একজন কাজে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে গেল। সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।

কে সে? তোমার স্বামী?

না, দাদা। সে আমার স্বামীর বন্ধু। যতবলি, এখন ব্যস্ত আছি, সে তবু ছাড়তে চায় না। পর পুরুষগুলি একেবারে জোঁকের মত। বিরক্তি ধরে গেলে সে কথাই ভাবতে হয়। তা না হলে অবশ্য আনন্দের সঙ্গীও হয়ে ওঠে। যেমন ধরুন, বৌদির বন্ধুরা তার আনন্দের সঙ্গী। সেঁক নয়। তাই তো অমন হাসিঠাট্টা চলে। আমি কিন্তু আমার স্বামীর বন্ধুকে ঝামটা মেরে চলে এসেছি।

তাই তো আসবে। তুমি পরের বাড়িতে কাজ কর, লোকটা তা চিন্তা করবে না কেন? হর্ষ তার বক্তব্য ব্যক্ত করে পুনরায় বলল, পারুলের কি দুপুরে ঘুম হয় না?

পারুল বলল, দুপুরে ঘুমের অভ্যাস আমার নেই, দাদা। বৌদি তাই মাঝে মাঝেই দুপুরে আমাকে সিনেমা দেখতে পাঠায়। যতবলি, আজকাল টিভির সামনে এত বসি যে, হলে বসতে আর ইচ্ছে হয় না, বৌদি সেকথা শুনতেই চায় না। তবে আমি বেরিয়ে গিয়ে সব সময়েই যে হলে বসি, তা নয়। আমার স্বামীর কাজের জায়গায় গিয়ে মাঝে মাঝেই তাকে সাহায্য করি।

আর মৌলি তার ঘরে একা পড়ে থাকে! হর্ষের কণ্ঠস্বরে যেন মেঘের মৃদু গর্জন।

পারুল বলল, একা পড়ে থাকলেও লেখাপড়াই করে, দাদা। আপনার মেয়েটি কিন্তু খুবই ভাল।

কথা বলতে বলতেই পারুল মৌলির যাবতীয় কাজ শেষ করে তাকে নিয়ে দ্রুত পা বাড়াল। হর্ষ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে দেখল, পারুল সে ভাবে মৌলিকে নিয়ে। স্কুলের দিকে ছুটছে, তাতে মৌলির নরম পায়ের যথেষ্টই ক্ষতি হতে পারে।

শরীরের আলস্য ঝাড়তে ঝাড়তে বীথি এসে দাঁড়াল হর্ষের পাশে। কি এত কথা বলছিল পারুল তোমাকে?

হর্ষ বলল, সে অনেক কথা। তারপর থেকে ভাবছি, এ ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে আবার বাবা মায়ের কাছে গিয়েই থাকব। মৌলিও তাতে ভাল থাকবে। আমাকে সে বলেছে।

বীথি যেন জ্বলে উঠে বলল, আমারও তা ভাল লাগবে কিনা, তা জিজ্ঞেস করারও বুঝি প্রয়োজন বোধ করছ না?

হর্ষ বলল, তিনজনের মধ্যে দুজন মত দিলে তা অনুমোদিত হয়ে যায়, বীথি। তোমার ভাল না লাগলেও ভাল লাগাতে হবে। এছাড়া আর কোনও উপায় নেই।

বীথি হঠাৎ রুক্ষস্বরেই বলল, বাপ মেয়ে থাক গিয়ে সেখানে। আমি কিন্তু এখান থেকে নড়ছি না।

বীথির চোখে চোখে তাকিয়ে হর্ষ বলল, এতই তোমার এখানে থাকার ইচ্ছে?

বীথি বলল, হ্যাঁ। জীবন বড় ছোট। স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নিলে এ জীবনে নিজের খুশিমত ব্যয় করার জন্য আর সময় পাওয়া যাবে না। নিজের জন্য যে সময় আমি কেড়ে নিতে চাই, তাতে আর কারও বাধা আমার সহ্য হবে না, এমন কী মৌলির বাধাও না। আমি এ-ও ভেবে নিয়েছি। মৌলি এখানে থাকলে আগামী শিক্ষা বর্ষে সে দুপুরের স্কুলেই পড়বে। পারুলকেও সব সময়ের জন্য রাখার প্রয়োজন হবে না।

হর্ষ না বলে পারল না, কিন্তু নির্জন দুপুরে অভাগেদের যে বড় আনাগোনা বাড়ে, বীথি। আমার সম্পত্তি যে লুট হয়ে যাবে। বীথি বলল, তোমার লুঠ করার মত সম্পত্তি কীই বা থাকে ঘরে সবই তো থাকে লকারে। হর্ষ খোলা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু লকারে যাকে রাখা যায় না, সেই যে আমার সেরা সম্পদ। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে আসায় হর্ষের কথাগুলি বীথি স্পষ্ট শুনতে পেল না।

কি বললে? চড়া গলাতেই প্রশ্ন করল বীথি।

হর্ষ বলল, সে কথা আর একদিন শুনো। আজ শুনে কাজ নেই।

.

৩.

একটি নির্জন দুপুর বীথি বড় সুখে কাটাচ্ছিল। অবশ্য একা নয়, আর একজনের সঙ্গে। সেই আর একজন হর্ষের কাছে অভাগার হলেও বীথির কাছে বড়ই বাঞ্ছিত জন।

সেই দুপুরে হর্ষ অফিসের কাজে মন বসাতে পারছিল না। অর্ধদিবস ছুটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাস ধরে ফিরছিল নিজের আস্তানার দিকে। নামার স্টপ ক্রমে এগিয়ে আসছিল। সিট ছেড়ে উঠবে উঠবে ভাবছে, এমন সময়ে বাসের জানালা দিয়ে সহসা তার চোখে পড়ল, একটি মঞ্চের দিকে মৌলিকে নিয়ে পারুল এগোচ্ছে। সেখানে ম্যাজিক দেখানো হবে।

হর্ষের বুকটা দ্যাৎ করে উঠল। মৌলি ম্যাজিক দেখবে, পারুলও ম্যাজিক দেখবে, সেকথা ঠিক। কিন্তু নিজের আস্তানায় গিয়ে সে কি দেখবে? যা দেখবে, তারপর নিজেকে স্থির রাখতে পারবে তো?

হর্ষ বাস থেকে নামল। ততক্ষণে মৌলিকে নিয়ে পারুল মঞ্চে ঢুকে গেছে। হর্ষ তাদের পিছু না নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটের দিকেই এগিয়ে চলল।

কোলাপসিবেল গেটে তালা ঝুলছিল ভেত্র থেকে। তার অর্থ, ভেতরে কেউ আছে। হর্ষ লু কলিং বেল না বাজিয়ে গেটের তালাটা ঘুরিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাখা ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে খুলে ফেলল। তারপর গেটটা দুদিকে সরিয়ে দিয়ে দরজার হাতলে চাপ দিল। দরজা তালাবদ্ধ না থাকা খুলে গেল। হর্ষ নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকল। জুতো মোজা খুলে যথাস্থানে রেখে সে নিজের শয়নকক্ষের দিকে এগিয়ে চলল।

বীথির হাসি যেন গলিত লাভার মত তাকে স্পর্শ করল। শয়নকক্ষও অর্গল বদ্ধ ছিল না। তাই হাতের সামান্য ঠেলাতেই দরজা উন্মুক্ত হল।

সেখানে হর্ষ থাক দেখুক, বীথি কিন্তু ভূত দেখার মত চমকে উঠল না।

আর বীথির বান্ধবটিও চোরের মত নিঃশব্দে পলায়ন করল না।

সে তার পোশাক আশাক নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

বীথি তার স্বামীর সামনেই বেশ বাস পরে নিল, যা তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। হর্ষের দুই চোখে ক্রোধ বহ্নি জ্বলে উঠলেও তা স্থায়ী হল না। তাতে বর্ষার সজলতাই পরিস্ফুট হয়ে উঠল।

বীথির বান্ধবটি বাথরুম থেকে পোশাক পরে বেরিয়ে এসে বলল, তোমার হাজব্যান্ড যখন চলেই এসেছেন, আমি তাহলে আজ চলি।

হ্যাঁ, এস।

সে চলে যেতেই বীথি হর্ষকে বলল, খুব ব্যথা দিলাম, মনে হচ্ছে? কিন্তু তোমার মত আধুনিক যুবক এ ব্যাপারে কেন ব্যথা পাবে, সেটাই তো বুঝি না। তুমি কি জানো না, প্রতি মানুষই পৃথিবীতে একবার জন্মায়? সেই একবারের জন্মকে সার্থক করতে হয় পরিতৃপ্তির মাধ্যমে? আমি পরিতৃপ্ত। তাই আমার জন্ম সার্থক।

হর্ষ গম্ভীর স্বরে বলল, এবার বুঝলাম, কেন তোমার এমন একটি আশ্রয়ের প্রয়োজন ছিল।

বীথি বলল, ঠিকই বুঝেছ। এর জন্য আমি লজ্জিতও নই। পরাক্রান্ত পুরুষেরাই কেবল বসুন্ধরাকে ভোগ করবে কেন? নারীরাও যে পারে, আজ তা দেখিয়ে দেওয়ার দিন এসেছে।

এইভাবে? সংসারের ইজ্জৎ লুণ্ঠিত হতে দিয়ে? আমি তা মানতে পারছি না, বীথি। তাই ঠিক করে ফেললাম, আজই আমি মৌলিকে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের কাছে চলে যাব। তবে তোমাকে আমি নিরাশ্রয় করে যাব না। আমাকে দেওয়া কোম্পানির ফ্ল্যাট তোমারই থাকবে। বিয়ের মন্ত্র তুমিও উচ্চারণ করেছিলে, বীথি। তবু তুমি তার মূল্য দাও নি।

অগ্নিকে সাক্ষী রেখে শালগ্রাম শিলার সামনে আমি তোমার খাওয়া, পরা ও থাকার ভার নেওয়ার শপথ নিয়ে ছিলাম, সে-শপথ আমি ভাঙি কি করে, বল?

কথাগুলো বলতে বলতে হর্ষ তাদের শয়নকক্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল।

বীথি বলে উঠল, শোনো। তোমার গার্লফ্রেন্ড যদি না থাকে তো কলগার্লদের নিয়েও ফুর্তি করতে পার। আমি আপত্তি করব না।

তবু হর্ষ আর ফিরে তাকাল না।

হয়তো পরে ফিরবে মৌলিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

আশ্রয় – নীলাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

সাততলা বিল্ডিং-এর জানলা দিয়ে ডালহৌসি এলাকার স্কাইলাইন দেখছিল মনোজ। দিনটা মেঘলা। ঘোলা জলের মতো আকাশের রঙ। এত উঁচু থেকে রাস্তাঘাট, চলন্ত যানবাহন, হেঁটে যাওয়া মানুষজন সব মনে হচ্ছে কবিতার প্রতীক।…অস্পষ্ট…।

আজ সকাল থেকে মননজের মাথাটাও ভার মনে হচ্ছে। যন্ত্রণা নেই। তবে মাথা নীচের দিকে ঝোকালে কেমন ভারী লাগছে। আর যেন তাই অফিসে এসে কাজ করতেও ভাল লাগছে না। কয়েকটা ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করেই আবার সরিয়ে রাখল। হয়তো মাথা ধরার ফল গতকাল বেশ রাত অব্দি আড্ডা আর গুরুপাক খাওয়াদাওয়া। স্টেটস থেকে মাসখানেকের ছুটি নিয়ে কয়েকদিন আগে কলকাতায় ল্যাণ্ড করেছে অরণি। আর এসেই মনোজের অফিসে ফোন। প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিল মনোজ। গলাটা চিনতে পারেনি। বছর পাঁচ হ’ল অরণি কাছাকাছি নেই। প্রথম দিকে ঘনঘন চিঠিপত্রের আদান-প্রদান থাকলেও ক্রমশঃ দূরত্ব সম্পর্কের গিটকে আলগা করে দিয়েছে। মধ্যিখানে,—তাও প্রায় বছর দুই আগে, অরণি কয়েকদিনের জন্যে এখানে এসেছিল বিয়ে করতে। মনোজের অফিসে নিমন্ত্রণও করতে এসেছিল। কিন্তু মনোজের সঙ্গে দেখা হয়নি। সে তখন অফিরে কাজে দিল্লী। ফিরে এসে টেবিলে কার্ড দেখে ব্যাপারটা বুঝেছিল।

গতকাল অপ্রত্যাশিতভাবেই ফোনটা পাবার পর মনোজ বুঝতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ছিল। কে কথা বলেছেন জিজ্ঞেস করতেও হয়েছিল তাকে।

—আরে আমি রে আমি। অরণি! ইট সিমস ইউ হ্যাভ ম্যানেজড টু ফরগেট মি—।

—অরণি? আরে কি আশ্চর্য! কোথা থেকে?

–ডোভার লেন থেকে।

–মানে?

–মাসখানেকের ছুটি নিয়ে তোরা কে কেমন আছিস দেখতে এলাম। আজ সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে আয়। মণিকার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। আমার বউ রে! শালা চিঠি দিলে তো উত্তর দিস না।

–চিঠি আমাকে?

–আবার কাকে? তোর বউকে?

বুকের মধ্যে আচমকাই একটা ধাক্কা খেল মনোজ।….

সামলে নিয়ে বলল—একটা চিঠিও পাইনি। মাইরি বলছি। এখানকার পোস্টাল সার্ভিস ভেরি পুওর। এ দেশটা তো আর তোর স্টেটস নয়–।

–যাই হোক। আজ চলে আয়। সাতটা নাগাদ। আই উইল এক্সপেক্ট ইউ ও. কে?

–ও. কে.। যাব।

গিয়েছিল মনোজ। অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরী হলেও ঠিক সময়মতোই পৌঁছে গেল। ডোভার লেনে অরণিদের বাড়িতে শেষ এসেছিল ঐ বছর পাঁচ আগেই। এতদিন পর হলেও বাড়িটা চিনতে অসুবিধে হ’ল না। গোলাপী রঙ। দোতলা বাড়ি। জানলার কাচ নীল। কলিং বেল টিপতেই যিনি দরজা খুলে দিলেন তিনি অরণির বাবা।

—আরে-এসো-এসো। অরণি সেই কখন থেকে তোমার জন্যে বসে আছে। সিঁড়ির চাতালের কাছে পৌঁছে অনিশ্চিত ভাবে দাঁড়াতেই বললেন—যাও। দোতলায় আছে। মনোজ লক্ষ্য করল পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হলেও সময়ের থাবা তেমনভাবে ভদ্রলোকের চেহারায় পড়েনি। সেই আগের মতোই দীর্ঘ, টানটান, সুন্দর চেহারা। শুধু মাথার চুলগুলো সব পেকে গেছে।

—কেমন আছেন মেশোমশাই? সিঁড়িতে উঠতে উঠতে মনোজ জিজ্ঞেস করে।

—ঐ আছি আর কি! রিটায়ার্ড ম্যান! আমাদের আর থাকা।

—মাসিমা?

—ঐ একরকম। ওনার তো আবার আথ্রাইটিসের কষ্ট!

-তাই নাকি? বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে অরণির মাকে দেখতে পেল। কথাবার্তা শুনে মনোজের গলার আওয়াজ বোধহয় চিনতে পেরেই দালানের শেষে একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলন। মনোজকে দেখে, ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন যে চিনতে পেরেছেন। দোতলায় উঠেই সামনের ঘরে সোফায় কাত হয়ে অরণি বসেছিল। দেখেই লাফিয়ে উঠল—আয় আয়। মণিকা দেখো কে এসেছে। আজ দুপুরে যাকে ফোন করেছিলাম।

বেশ ভালই দেখতে অরণির বৌকে। লম্বা উজ্জ্বল ফর্শা। তীক্ষ্ণ নাক। স্বপ্নালু চোখ। মাথার চুল, সচরাচর হয় না, অদ্ভুত কোঁকড়ানো। বয়কাট। সব মিলিয়ে একটা আধা-দেশী, আধা বিদেশী ছাপ। মনোজকে দেখে বেশ আন্তরিকভাবে হাসল।

–বসুন। আপনার গল্প প্রায়ই শুনি ওর কাছে। একা এলেন? মিসেসকে আনলেন না।

বুকের মধ্যে আচমকা আবার ধাক্কা খায় মনোজ। চকিতে সামলে নিয়ে, প্রশ্নটা এড়িয়ে অল্প হেসে নাটকীয়ভাবে সে নিজেকে বলতে শোনে—কিরে অরণি? বউটাকে দেখছি ভালই বাগিয়েছিস। ইউ আর এ লাকি চ্যাপ। স্পষ্টতই খুশীতে আরও উজ্জ্বল হয়ে মণিকা হেসে ওঠে। অরণিও হাসে। তারপর বলে শালা—অন্যের বউ তোর কাছে তো বরাবরই সুন্দরী রে! তোকে আর আমি চিনি না? কিন্তু নিজের বউটাকে ঘরের মধ্যে চাবি দিয়ে এলি কেন? সঙ্গে আনতে পারলি না? বেশ একসঙ্গে চারজনে আড্ডা দেওয়া যেত। তুই তো বিয়ে করলি আমি স্টেটসে যাওয়ার পর। আমি তবু একটা ইনভিটেশন কার্ড তোর অফিসের টেবিলে রেখে আসতে পেরেছিলাম। তুই তো তাও পাঠাসনি! বিয়ে করে, হনিমুন-টুন করে, বউটাকে বাসি করে তারপর একটা চিঠি পাঠালি যে তুই বিয়ে করেছিস। বল—এটা কি বন্ধুর মতো কাজ হ’ল?

মণিকা একটু চাপা গলায় বলল—আঃ অরণি। কি আজেবাজে ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজ করছ?

মনোজ তাড়াতাড়ি হেসে বলল—ঠিক আছে। ঠিক আছে। অরণিটা বরাবরই কিন্তু এরকম। কাকে কি বলতে হয় জানে না। দেখছি এতকাল স্টেটসে থেকেও কথা

বলতে শেখেনি। সেইসব সাত-পাঁচ ভেবেই তো বউকে আনিনি। কি উল্টোপাল্টা বলে দেবে! রসিকতাটা ধরতে পেরে ওরা দুজনেই গলা ফাটিয়ে হেসে উঠল। খানিক বাদেই বিদেশী সিগারেট অফার করল অরণি। তারপর মণিকার দিকে তাকিয়ে বলল—যাও। টী-এর অ্যারেঞ্জমেন্ট করো। আমরা ইন দি মিনটাইম দুজনে সুখ-দুঃখের গল্প করে নি।

—নিশ্চয়ই। মণিকা চলে গেল।

গল্প-সল্প বেশ অনেকক্ষণই—চলল। ফস করে অরণি একবার জিজ্ঞেস করে বসল—আমাদের বয়স-টয়স কতো হলে রে মনোজ? ঠিক খেয়ালও থাকে না।

–কম হল না রে!

–কতো?

—তুই আমার থেকে এক বছরের ছোট। আমার আটত্রিশ চলছে। তুই নিশ্চয়ই সাঁইত্রিশ। আমাদের দুজনেরই বেশ লেট ম্যারেজ।

–সাঁইত্রিশ-আটত্রিশ বছরকে তুই বেশী বয়স বলছিস? দূর! এখন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করা যায়।

-সত্যি? মনোজ খানিক্ষণ চুপ করে সিগারেট টানল। অরণির এই কথার মধ্যে সে যেন এক গভীর অর্থ খুঁজে পেয়েছে। অরণি এবার বলল-স্টেটসে একবার চলে আয় মনোজ। দেখে যা কতো আরামে আছি! বডোসড়ো চাকরি তো অনেকদিন করছিস। মাইনেও মনে হয় খারাপ পাস না। দু-সপ্তার ছুটি নিয়ে চলে আয়। শুধু প্লেনভাড়া তোর। ওখানকার থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য জায়গায় বেড়ানো খরচ আমার। কিরে যাবি?

-আচ্ছা তুই তো এখনও বেশ কয়েকদিন আছিস। ভেবে দেখবখন। মণিকা বেশ কিছুক্ষণ চা আর স্যাণ্ডউইচ রেখে গেছে। একটা স্যাণ্ডউইচ ভেঙে মুখে দেয় মনোজ। অরণি চা-এর কাপে চুমুক দিয়ে বলে—চলে আয়। কলকাতায় কি করে যে তোরা ডে-টু-ডে লাইফ চালাস! এই কবছরে রাস্তাঘাটের যা হাল দেখছি। সেদিন দমদম এয়ারপোর্টে নেমে জানিস তো একঘন্টার ওপর দুজনে দাঁড়িয়ে আছি। একটা ট্যাক্সি পাই না! সবাই বলে—এখন রাস্তা জ্যাম। সাউথের দিকে যাব না। শেষ অব্দি একজন রাজী হ’ল। তাও আবার তাকে এক্সট্রা কুড়ি টাকা দিতে হ’ল! ক্যান ইউ ইমাজিন? একজন ট্রাফিক পুলিশকে বললাম। গ্রাহ্যই করল না?

চায়ের কাপে ধীরে ধীরে চুমুক দিয়ে মনোজ অল্প হেসে বলল—আমার কাছে। এসব নতুন কিছু নয়। যা—ওসব সাহেব-মার্কা কথাবার্তা ছাড়তো। কলকাতা যে এরকম সে ত’ বিশ্বশুদ্ধ সবাই জানে। তুই যখন এখানে রোজ থাকতি—তখনও কি খুব ভাল ছিল?

প্রায় ঘন্টা-তিনেক গল্প করা আর ঘন ঘন সিগারেট টানার পর উঠতে যাবে। মণিকা এসে বলল—খেয়ে যেতে হবে। অরণির মা বাবাও নাকি তাই বলছেন। অগত্যা আরও খানিকটা সময় গেল। খাওয়া-দাওয়া সেরে রাস্তায় নেমে যখন ট্যাক্সি নিল মনোজ তখন রাত সাড়ে-দশটা বেজে গেছে। মণিকা দোতলার ব্যালকনি থেকে বলল—এবার এলে-মিসেসকে নিয়ে আসবেন।…

জানলার ধার থেকে সরে এসে টেবিলের সামনে দাঁড়াল মনোজ। কিছু ফাইল আগে থেকেই ছিল। আবার সকাল থেকে কিছু ফাইল এসে জমেছে। ময়লা, ছেঁড়া, স্মৃতির মতো ধূসর ফাইল সব। খুললেই পড়তে হবে প্রতারক ভাষা। নিজেকে লিখতেও হবে প্রতারক ভাষা। এভাবেই কতদিন? …অনেকদিন…। গতকালই তো অরণির সঙ্গে বয়স হিসেব হচ্ছিল। আটত্রিশ চলছে তার। কম করে এখনও বছর কুড়ি এই চাকরি করে যেতে হবে তাকে। কোনো পরিত্রাণ নেই। অবশ্য এই চাকরিটা আছে বলেই সমাজে তার যাকে বলে একটা পজিশন আছে। এই চাকরিই তাকে দিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত পাড়ায় একটা ছিমছাম ফ্লাট। গাড়ি। কিন্তু এসব পেয়েও কি সে সুখী? শাস্তি এলো কি জীবনে? কোনদিন আসবে? দিনের শেষে বাইরের কাজের পর ক্লান্ত মানুষেরা তাড়াহুড়ো করে তোড়জোড় চালায় বাড়ি ফেরার। প্রত্যেকেরই বাড়ি আছে। সংসার আছে। সন্তানের উষ্ণ সান্নিধ্য আছে। কিন্তু তার কি আছে! বিয়ে করেও, সংসার শুরু করেও বিবাগী সে। কার জন্য বাড়ি ফিরবে? গতকাল প্রসঙ্গটা অনেকবার উঠেছে অরণির কথাবার্তায়। আর বরাবরই অস্বস্তি হয়েছে তার। ব্যক্তিগত সমস্যার কথা কাউকে বলে লাভ কি? চেম্বারের দরজা খুলে পিয়ন এসে দাঁড়াল। ভুরু কুঁচকে তাকাল মনোজ।

–কিছু বলবে?

—একজন ভিজিটর এসেছেন স্যার–।

—আজ আর কারুর সঙ্গে দেখাটেখা করা যাবে না। ভীষণ ব্যস্ত আমি। এখনই বেরিয়ে যাব। সত্যিসত্যিই অ্যাটাচিটা নিয়ে প্রস্তুত হয় মনোজ।

—আচ্ছা স্যার।

লিফটে নেমে এসে এদিক ওদিক তাকায়। সামনেই আছে গাড়িটা। এখন বিকেল চারটে। গাড়িতে উঠে বসে সে। ড্রাইভার ঠিক বুঝতে পারে না কোথায় যেতে হবে। তাই জিজ্ঞেস করে।

-পার্কস্ট্রীটের মোড়ে নামিয়ে দাও।

–ভীষণ জ্যাম স্যার। কি একটা মিছিল বেরিয়েছে। সত্যিই ভীষণ জ্যাম। সারি সারি গাড়ি সামনে। আবহাওয়া সত্যিই বিশ্রী আজ। সারা দিন আকাশের মুখ ঝুলে আছে। রোদের লেশমাত্র নেই। বিকেল বেলাতেও শহরের কোথাও কোন ঔজ্জ্বল্য নেই। পথচারীদের মুখেও যেন বিষণ্ণতা লেগে আছে। সবাই যেন রিমোট কন্ট্রোলে চালিত হয়ে যন্ত্রের মতো হাঁটছে, হাত-মুখ নাড়ছে, ফিসফাস কথা বলছে সবাই। কারুরই যেন কোন প্রাণ নেই, সজীবতা নেই। কি যেন বলছিল অরণি! আমেরিকায় যেতে? ওখানে জীবনকে জীবনের মতো উপভোগ করা যায়। মেদিনী কাপিয়ে বেঁচে থাকা যায়। তাই যাবে কি? সঞ্চয়ের টাকা যা আছে প্লেনভাড়া কোন ব্যাপার নয়। এখন সে একেবারে প্রায় মুক্ত, স্বাধীন। পিছুটান নেই। তিনশো বছরের এই প্রাচীন শহরে আহত ইঁদুরের মতো মুখে রক্ত তুলে বেঁচে থেকে কি হবে? যদি এখনই চাকরি থেকে ইচ্ছাকৃত অবসর নেয় তাহলে সরকারী তহবিল থেকে প্রায় লাখ দেড়েক টাকা। তারপর যদি ভিসা ম্যানেজ করা যায় তাহলে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা আমেরিকা যে। কোন জায়গাতেই যেতে অসুবিধা কোথায়। চাকরি নাকি বিদেশে পেতে অসুবিধে হয় না। কিন্তু সত্যিই কি সে যেতে পারবে? সত্যিই কি তার কোন পিছুটান নেই? এই কয়েক মাসের নিঃসঙ্গতায় সে কি একবারও মনে মনে চায়নি বনশ্রী ফিরে আসুক…।

সমস্যাটা নিয়ে অনেক ভেবেছে মনোজ। যখন প্রচণ্ড অশান্তির মধ্যে দিয়ে, মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিনগুলো কাটছে, বিনিদ্র রাতগুলো কাটছে তখন প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত সে নিজের জীবনের বিশ্রী অভিজ্ঞতাগুলো চিরে চিরে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে। এরকমও তো হতে পারে যে সে তার মতো করে সমস্ত কিছু দেখছে। ফলে নিজের দোষ-ত্রুটিগুলো হয়তো তার নিজের কাছে ধরা পড়ছে না। এবং কিছুটা সেকারণেই সে অনেক ভেবেছে। নিজেকে দর্শকের আসনে বসিয়ে, নিরপেক্ষভাবে সবকিছু বিচার করতে চেয়েছে। কিন্তু না; বারবার তার মনে হয়েছে বনশ্রীর সঙ্গে এই যে তার মতের অমিল,দৈনন্দিন জীবনের খুব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়েও তর্কাতর্কি; এসব্বে কারণ বনশ্রীর অদ্ভুত, অপরিণত মানসিকতা। ব্যাপারটা সে প্রথম উপলব্ধি করে বিয়ের মাস ছয় পরে—পুজোর সময়। বোনাসের টাকাটা হাতে পেয়ে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর সে। অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই বৌকে প্রস্তাব দিল চলো আজ মার্কেটিংএ বেরোব। একটা খুব দামী শাড়ি কিনে দেব তোমাকে।

–সত্যি? উত্যু বনশ্রী বলল।

—হ্যাঁ। চলো।

—তাহলে মাকে একটা ফোন করে দি?

–মাকে? কেন?

—মা সঙ্গে থাকলে খুব সুবিধে হবে। ওনার মতো শাড়ি পছন্দ করতে আমি পারব না। আর তাছাড়া আমার শাড়ি এ যাবতকাল সবই পছন্দ করে এসেছে মা। আমার নিজের পছন্দে কোনদিন কিছু কিনতেই পারি না!

গম্ভীর হয়ে যায় মনোজ। একটু আগেকার আবেগ, উচ্ছাস-সব যেন লোডশেডিং হওয়ার মতো নিভে যায় দপ করে! নিজেকে সামলে নেবার জন্যে একটা সিগারেট ধরিয়ে সে বলে বিয়ের আগে না-হয় তোমার মা সব পছন্দ করে দিতেন। কিন্তু বিয়ের পরে তো আর সেরকম হওয়া উচিত নয়। এবার থেকে আমিই না-হয় পছন্দ করে দেব তোমায় সবকিছু।

–ধ্যাৎ। ছেলেরা আবার শাড়ি কিনতে পারে নাকি? আমার বাবা বলেন এরকম। চেষ্টা যে ছেলে করবে সে বোকা। এরকম কথার পর আর সেদিন মার্কেটিং করা হয়নি মনোজের। অফিসের কি একটা জরুরী কাজ মনে পড়ে গিয়েছিল তার। বনশ্রীকে সে পুজোর বাজারের টাকা ধরে দেয় পরে।

বনশ্রীর এই অদ্ভুত মাতৃ-নির্ভরতা ক্রমশঃ তার কাছে বিশেষভাবে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। প্রায় প্রতিদিনই দুপুরবেলা বনশ্রী নিজের বাড়িতে মা-এর কাছে চলে যেত। মনোজ অফিস বেরিয়ে যাবার পর তার নাকি খুবই ফাঁকা ফাঁকা, একা লাগে। বাপের বাড়ি তো আর বেশী দূর নয়। পার্ক সার্কাস। অনেক বোঝাতে চেয়েছে সে। হোক না দূরত্ব কম, তবুও বিয়ের পর নিজের ঘরবাড়ি ফাঁকা রেখে কেন প্রায়ই প্রতিদিনই মায়ের কাছে যেতে হবে তাকে? তার থেকে দুপুরে কিছু পড়াশোনা করো। হাতের কাজ করো। কিংবা নতুন নতুন রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করো। আর যদি কোন স্কুলে চাকরি করতে চাও—তাও করতে পারো। চেষ্টা করো সে ব্যাপারে। কিন্তু কোন পরামর্শই মনঃপূত হয় না বনশ্রীর। তার পড়তে ভাল লাগে না। হাতের কাজ করতে ভাল লাগে না। একা একা কিছুই ভাল লাগে না। সুতরাং নিঃসঙ্গ দুপুর ও বিকেলগুলো সে মায়ের কাছে কাটিয়ে আসে। যদি সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকত ব্যাপারটা তাও না হয় হ’ত। কিন্তু এর থেকেও বাড়াবাড়ি শুরু হল। প্রায় দিনই অফিস থেকে সন্ধ্যের পর কোয়ার্টারে ফিরে মনোজকে দেখতে হয় দরজায় তালা ঝুলছে। তখনও ফেরেনি বনশ্রী। ডুপ্লিকেটে চাবির ব্যবস্থা করতেই হয় মনোজকে। এবং একদিন ব্যাপারটা চূড়ান্ত পর্যায়ে গেল। নিজেই দরজা খুলে, প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সে নিজেই এক কাপ কফি করার কথা ভাবছে,—ঠিক তখনই ফোন।

—তুমি বলছ? ওধার থেকে বনশ্রীর বেশ উচ্ছ্বসিত গলা।

—হ্যাঁ।

—খুব রাগ করেছে মনে হচ্ছে। প্লীজ রাগ কোরো না। শোনো, সেই আমাদের ফুলদিকে মনে আছে?

—কে?

ফুলদি গোয় আমাদের বিয়ের দিন রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে তোমার সঙ্গে খুব ইয়ার্কি মারছিল। আমার মাসিমার মেয়ে। ফুলদি আর ওর হাজব্যান্ড আজ বিকেলেই পুনে থেকে কলকাতায় এসেছে। আমাদের বাড়ি উঠেছে। তো আজ সবাই মিলে ডিনার সারব। তুমিও চলে এসো। ওয়েট করছে সবাই।

—আমার শরীর খারাপ লাগছে। যেতে পারব না।

—যাঃ। সকালে তো সেরকম কিছু মনে হ’ল না। প্লীজ এসো, না এলে কি ভাববে বলো তো সবাই?

—তুমি যেতে পার। আমি যাব না।

-আচ্ছা। মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। বিরক্তির সঙ্গে ফোনটা ধরে থাকতে হয় তাকে।

—কে? মনোজ বলছ?

–হ্যাঁ। উত্তরটা দিয়েই প্রশ্নটা অবাস্তর মনে হয় তার।

–বনু কি বলছে তোমার শরীর খারাপ? আসতে পারবে না!

–না।

-ঠিক আছে। শরীর খারাপ থাকলে এসো না। কিন্তু বনু আজ একটু আমাদের সঙ্গে বেরোবে। বুঝেছো? আজ রাতে আর ফিরতে পারবে না। আগামীকাল ফিরবে। আর কথা বাড়ায়নি মনোজ। রিসিভার নামিয়ে রেখেছিল। রাগটা তার বনশ্রী আজ ফিরবে না বলে নয়। অনেকদিন পর আত্মীয়দের দেখা পেয়েছে। আজ একটু বাই মিলে থাকতেই পারে। কিন্তু সে তার শরীর খারাপ বলা সত্ত্বেও বনশ্রী তেমন কোন কৌতূহল বা উদ্বেগ প্রকাশ করল না ব্যাপারটাতে। অবিশ্বাসই করল। এতটা ঠিক নয়। মনোজের হঠাৎ মনে হল স্বাধীনতার সুযোগ যেন খুব বেশীই নিচ্ছে বনশ্রী। যৌথ জীবনের ন্যূনতম এটিকেটগুলোও মানছে না!

পরের দিন বনশ্রী ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই মনোজ প্রসঙ্গটা তুলতে চাইল।

—শোন, একটা কথা তোমায় অনেকদিন ধরে বলব ভাবছিলাম।

—কি কথা? ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে বনশ্রীর জিজ্ঞাসা।

—অফিস থেকে খেটেখুটে বাড়ি ফেরার পর কোন হাজব্যান্ডেরই কিন্তু তালা খুলে বাড়ি ঢুকতে ভাল লাগে না।

—ওরকম বেঁকিয়ে বলছ কেন? মাঝে মাঝে একটু অসুবিধে তো হতেই পারে।

–না। প্রায়ই দুপুরে তোমার বেরিয়ে যাওয়া চলবে না। একা লাগলেও থাকা অভ্যাস করতে হবে। অনেককেই ওরকম থাকতে হয়। তা বলে তুমি রোজ রোজ বাপের বাড়ি গিয়ে বসে থাকবে এটা আমার একেবারে মনঃপূত নয়।

তোমার মন রেখে যে সবসময়ে চলতে হবে এরকম কোন মানে নেই। আমার যখন যেখানে খুশী যাবো। তুমি আমার ওপরে কোন ফরমান জারি করতে পার না।

-আমি সব পারি। আমি তোমার হাজব্যান্ড…।

–তাই নাকি? হাজব্যান্ড হলেই বুঝি যা ইচ্ছে শাসন করা যায়? আসলে তুমি ভীষণ গোঁড়া। প্রেজুডিসড! বাইরে যতই আধুনিকতা দেখাও…।

—আমি গোঁড়া? …প্রেজুডিসড? আর তুমি কি? বিয়ে করার পরও মায়ের কথায় ওঠো বসো? কচি খুকী নাকি? শাড়ি চয়েস করতেও এখনও তোমার মাকে দরকার হয়! কেন তোমার নিজের কোন ব্যক্তিত্ব নেই? তাহলে বিয়ে করেছিলে। কেন? মায়ের কোলে দুধের বোতল নিয়ে শুয়ে থাকতে পারতে।

–ইনসালটিং কথাবার্তা বলবে না।

—শেষ কথা আমি বলে দিলাম। কাল থেকে দুপুরে বেরোনো বন্ধ।

—আচ্ছা দেখা যাবে। বলে মেজেয় দুমদাম শব্দ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল বনশ্রী। শুধু তাই নয়। সেদিন রাতে কিছু খেল না। এবং এক বিছানায় না শুয়ে পাশের ঘরে শুল। খাটটাকে সেদিন বিশাল এক প্রান্ত মনে হয়েছিল মনোজের। বনশ্রীর ব্যবহারে সে স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সারারাত তারও ঘুম এলো না। পরের দিন। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে চান সেরেই মনোজ অফিসের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ল। একটা রেস্তোরাঁতে চা খেতে খেতে তার মনে হ’ল সকাল থেকে বনশ্রী এক কাপ চা করে দেওয়া দূরে থাক একটা কথা অব্দি বলেনি। সন্ধেবেলা মনের মধ্যে একটা চাপা টেনশন নিয়ে বাড়ি ফিরে সে দেখল দরজায় তালা। তার মানে বনশ্রী তার নিষেধকে কোন পাত্তাই দিল না। উপরন্তু তার দিকে ছুঁড়ে দিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কোন খবর নেবার চেষ্টা করেনি সে বনশ্রীর। নিজের গোঁ নিয়ে সে বসে থাকল বাপের বাড়ী। একদিন বিকেলে মনোজের অফিসে ফোন বেজে উঠল…।

-হ্যালো?

—আমি বলছি। আজ আমাকে নিতে আসবে একটু? ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ ভেবে নিল মনোজ। তারপর গম্ভীর গলায় বলল

—কেন? হঠাৎ! খুব একটা খারাপ আছ নাকি?

—নিতে আসবে একটু? প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি।

—সময় নেই। দরকার মনে করলে তুমি নিজেই আসবে। ডুপ্লিকেট চাবি তো তোমার ব্যাগেই থাকে। ফোনটা রেখে দিয়েছিল। চুম্বক-টানেই যেন মনোজ সেদিন বাড়ি ফিরল বেশ তাড়াতাড়ি। দরজার দিকে তাকিয়েই তার বুকটা ধড়াস করে উঠল। তালা খোলা। ভেতর থেকে বন্ধ দরজা। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলে দিল বনশ্রী। একটু যেন লাজুক ভঙ্গীতে তাকালোও। খানিক পরেই নিয়ে এল চা। প্লেটে ভাল বিস্কুট। সেই বিয়ের পর প্রথম কয়েকটা দিনের মতো। চায়ের কাপ টেবিলে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই মনোজ এক হ্যাচকা টানে বনশ্রীকে টেনে নিল নিজের দিকে। তারপর চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিতে লাগল তার ঘাড়, গলা, বুক…। পরপর কয়েকদিন খারাপ কাটল না। একদিন ছুটি নিয়ে মনোজ বউকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখল। তারপর ফেরার মুখে খানদানী হোটেলে ডিনার। যেন পল বেয়ে গড়িয়ে নামছিল স্রোত। গল গল করে কথা বলছিল দুজনে। যেন অতীতের তেতো, বিস্বাদ দিনগুলোকে ভুলে আবার ওরা দুজনে দুজনকে ঘিরে বাঁচতে চাইছে। একদিন রাতে ঘনিষ্ঠ হবার মুহূর্তে মনোজ বনশ্রীকে জানাল তার ইচ্ছার কথা। আর অপেক্ষা করা ঠিক নয়। বয়স বেড়ে যাচ্ছে দুজনেরই। এবার মনোজ বাবা হতে চায়। তার নিবিড় আলিঙ্গন থেকে যেন চাবুকের মতো ছিটকে বেরিয়ে এল বনশ্রী। না এত তাড়াতাড়ি নয়। বিবাহিত জীবনের স্বাদ আরও কিছুদিন নির্ভেজাল, নির্ঝঞ্ঝাট উপভোগ করতে চায় সে। এটা মনোজকে মেনে নিতেই হবে। এত তাড়াতাড়ি ঐসব ঝক্কি? অসম্ভব…।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় মনোজ জিজ্ঞেস করে—এটা কি বলছো তুমি? সন্তান মানে ঝামেলা? বহুক্ষণ যুক্তি দিয়ে বোঝালেও বনশ্রী বুঝতে চায় না। শেষকালে ফস্ করে বলে বসে—ঠিক আছে। আমাকে একটু মায়ের সঙ্গে আলোচনা করতে দাও। কথাটা শুনেই মনোজের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। সন্তান তারা আনবে কি আনবে না এ ব্যাপারে তাদের যৌথ সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। এ ব্যাপারে আবার অন্য কারোর সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এরকম অদ্ভুত কথা কে কবে শুনেছে! এসব কি বলছে বনশ্রী? সত্যিই বুঝতে পারে না মনোজ। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলে—তোমার মা যদি এখনও তোমার অভিভাবক থাকেন তাহলে আমার সঙ্গে থাকার কোন প্রয়োজন আমি দেখি না। কাল ভোরবেলাই তুমি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। তোমার মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে। আর কোনদিন এ-মুখো হবে না।

-কি? আমাকে এভাবে অপমান করলে? নিজের স্ত্রীকে এখনও সম্মান দিতে শেখোনি? রাষ্টিক! ব্রুট কোথাকার! এবার সত্যি সত্যিই মেজাজ হারিয়ে ফেলে। মনোজ। যেনবা প্রকৃত ব্রুটের মতোই সে বনশ্রীর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার কোমল গালে পরপর দুটো চড় কষায় সাপটে! ফর্সা গাল রক্তিম আকার নেয়। যেন নিজের অজাইে ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেলে মনোজ। বনশ্রী বোধহয় এতটা কল্পনাও করতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত পাথরের মতো নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার দুগাল বেয়ে নিঃশব্দে জল বিছে মতো এঁকেবেঁকে গড়ায়।

—তুমি…তুমি আমাকে মারলে? অস্ফুটে বলে বনশ্রী।

—এতোবড়ো সাহস তোমার আমাকে রাষ্টিক বলো? আমার স্ট্যাটাস জানো?

—এই মুহূর্তে আমি বেরিয়ে যাব বাড়ি থেকে। আমি থাকব না তোমার সঙ্গে। একটা অসভ্য, ইতর লোকের সঙ্গে কিছুতেই থাকব না!

কাঁদতে কাঁদতে পাশের ঘরে গিয়ে সুটকেশ গোছাতে থাকে সে। আলমারী এবং আলনা থেকে শাড়ি, জামা, অন্যান্য টুকিটাকি তীব্র রাগে এলোমেলো ছুঁড়ে ফেলতে। থাকে। মনোজ বুঝতে পারে তাদের এই এতোল-বেতোল সম্পর্কের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে তারা। খাদের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। একটু পরেই সুটকেশ হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় বনশ্রী। তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে দশটা। মনোজ কোন রকম বাধা দেবার চেষ্টা করে না। বিছানায় চোখ বুজিয়ে শুয়ে শুয়েই সে নিশ্চিত হয় যে, একটা ট্যাক্সি বনশ্রী ঠিক পেয়ে যাবে। এবং কোনরকম রিস্ক ছাড়াই বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠবে…।

নির্দেশমতোই ড্রাইভার অনেকক্ষণ মনোজকে নামিয়ে দিয়ে গেছে পার্কস্ট্রীটের মোড়ে। আনমনা মনোজ নিজেকে একটা বুক-স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাতে দেখল। কোথায় যেন সে পড়েছিল আবহাওয়ার সঙ্গে মেজাজের একটা অদৃশ্য যোগাযোগ আছে। সারাদিন আকাশ গুম হয়ে থাকায় তার মনও যেন ভার হয়ে আছে। অতীতের তিক্ত স্মৃতিসব বুড়বুড়ি কাটছে। ভীষণ একা আর অসহায় লাগছে। একটা সাজানো জীবন সে চেয়েছিল। পরিবর্তে পেয়েছে একটা ফাটা, ভাঙা, বিশৃঙ্খল জীবন। এই মুহূর্তে সে কি করবে জানে না। অরণির বাড়ি যাবে? কাটিয়ে আসবে কিছুক্ষণ? কিন্তু মনে পড়ে গেল। আজ থাকবে না অরণিরা। কোথায় যেন বেরোবে। আবহাওয়ার মালিন্য থাকলেও পার্কস্ট্রীট কিন্তু প্রতিদিনকার মতো নিজস্ব বিভায় উজ্জ্বল। দোকানপাট, অভিজাত রেস্তোরাঁ ও বারগুলি ঝলমল করছে আলোয়। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সামনের এক বারের দরজা সামান্য খুলে গেল। বাইরে বেরিয়ে এলো মার্কিনী উপন্যাসের চরিত্রের মতো এক উজ্জ্বল যুবক আর যুবতী। সপ্রতিভ ভঙ্গীতে ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠে গেল। বারের ভেতরকার ঠাণ্ডা হাওয়া এক ঝলক ছুঁয়ে গেল মনোজকে। হঠাৎই মদ্যপান করার করার ইচ্ছে জাগল তার। লম্বা পা ফেলে সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। তার দীপ্ত হাঁটার ভঙ্গীতে উর্দি পরা বেয়ারা সচমকে উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল। ভেতর চাপা গুঞ্জন, তবে এখন মজলিশ তেমনভাবে জমে ওঠেনি। অধিকাংশ টেবিলই ফাঁকা। সিগারেটের ধোঁয়া কুয়াশার মতো জমে আছে আলোগুলোর নীচে। ডিম লাইটের মৃদু আলোয় অলৌকিক লাগছে অভ্যর। মননজের মনে হয়, হঠাই যেন সে সমুদ্রের ভাসমান কোন জাহাজের কেবিনে ঢুকে পড়েছে কোণের দিকে একটা ফাঁকা টেবিল দেখে সে বসে পড়ে। খানিক পরেই সুবেশ অ্যাটেনড্যান্ট নোটবুক নিয়ে এগিয়ে আসে অর্ডার নেবার জন্য। কিছু খাবার আর হুইস্কির অর্ডার দেয় সে। বেয়ারা এসে দিয়ে গেলে কয়েকটা কাজু তুলে নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে মনোজ চারপাশে তাকায়। কিছু কিছু টেবিলে নারী-পুরুষেরা একসঙ্গেই বসে মদ্যপান আর গল্প করছে। নিজেদের নিয়েই মশগুল তারা। কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। শুধু,ভাল করে তাকায় সে। বিপরীত দিতে একটা টেবিলে একজন বসে আছে একা। মহিলা। কারুর কি অপেক্ষায় এরকম পরিবেশে একা একজন মেয়ে। একটু অবাকই লাগে তার। বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকায় মনোজ। মেয়েটিও তাকায়। সেই তাকানোর মধ্যে যেন কিসের ইঙ্গিত। সাজটা বেশ উগ্র। স্লিভলেস ব্লাউজে কাধ আর হারে অনাবৃত অংশ চকচক করছে। একটা আলগা চটকও যেন ছড়িয়ে আছে মেয়েটির মুখে। যেন মনোজের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনেই মেয়েটি অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসল। গুছিয়ে নিতে চাইল শাড়ির আঁচল। আর সেই মুহূর্তে পাশ থেকে ওর নিটোল স্তনের ঘনত্ব বুঝে নিতে অসুবিধে হ’লনা মনোজের। হুইস্কির ধীর প্রভাব কি কাজ করতে শুরু করেছে? মাথা যেন আরও ভারী হয়ে আসছে। দৃষ্টিও ঝাঁপসা! শরীরের মধ্যে যেন কিসের টান অনুভব করে সে। হঠাৎই মনে পড়ে, বনশ্রীর চলে যাওয়ার পর থেকে আজ চার মাস তার। শরীর উপবাসে আছে। একটা নারীশরীর নিজের মতো করে নাড়াচাড়া করার ইচ্ছেটা। যেন হঠাই চাড়া দিয়ে ওঠে তার ভেতর। বিল মিটিয়ে দিয়ে সে মেয়েটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কথা বলছে না মেয়েটি। কিন্তু ওর ঠোঁটের কোণে প্রচ্ছন্ন হাসি। আর কথা বলছে চোখদুটি!

–ইয়েস? চাপা গলায় বলে মনোজ।—উড ইউ লাইক টু গো? অদ্ভুত ভঙ্গী করে হাসে মেয়েটি। তারপর শরীরে ঢেউ তুলে নির্বাক উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে মনোজের পেছন পেছন বেরিয়ে আসে।

—কোনদিকে যাওয়া যায়?

—যেদিকে নিয়ে যাবেন। গাঢ় লিপষ্টিক ঠোঁটে। মনে হ’ল রক্ত জমাট বেঁধে ফুলে আছে। কোথায় তোলা যায় একে? ফাঁকা বাড়িতে? কিন্তু পাড়ার কেউ যদি দেখে ফেলে? গলির মোড়ে যে ক্লাবটা আছে সেখানকার বোম্বেটে-মার্কা ছোঁকরাগুলো কিন্তু তাকে দেখেই সিগারেট লুকোয়। সম্মান দেয় তাকে। অসম্ভব…।

–কোন পার্কে-টার্কে গিয়ে বসা যাক! অনিশ্চিতভাবে প্রস্তাব দেয় সে।

–যা করার তাড়াতাড়ি করুন। গঙ্গার ঘাটে চলুন না।… নৌকোয়…। চাপা হাই তোলে মেয়েটি। মনোজ তার মুখের গহ্বর স্পষ্ট দেখতে পায়। দাঁতগুলোর ভেত্রদিক কি নোংরা! কালো ছোপ! তীব্র বিতৃষ্ণায় কুঁকড়ে যায় মনোজ।

–ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি যাহয় একটা ডাকুন না। কথাটা বলেই তার অপেক্ষা না করে মেয়েটি নিজেই হাত তুলে একটা চলন্ত ট্যাক্সিকে দাঁড় করায়। উঠে বসে। সুতরাং মনোজকেও উঠতে হয়। ট্যাক্সি-ড্রাইভারের জিজ্ঞাসায় মনোজ নিজেকে অস্পষ্টভাবে বলতে শোনে—আউটরাম ঘাট। সন্ধ্যে পুরোপুরি নেমে এসেছে। রাস্তার এবং দোকানের আলোর সারি চোখের সামনে দিয়ে সরে যাচ্ছে দ্রুত। কুয়াশা আর ধোঁয়ায় বিধুর হয়ে আছে চারদিক। কিছুই স্পষ্ট করে চোখে পড়ে না। ট্যাক্সির অন্ধকারে মেয়েটি ঘন হয়ে সরে আসে তার দিকে। একটা হাত হঠাৎ তুলে দেয় মনোজের উরুর ওপরে। চমকে ওঠে মনোজ। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হাতটাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। বুঝতে পারে মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মনোজ হঠাৎই অনুভব করে বার-এ মেয়েটিকে দেখে সেই উত্তেজনা যেন আর নেই। ব্রং সে যেন এই মুহূর্তে পালিয়ে যেতে চাইছে ওর কাছ থেকে। আবার মেয়েটির হাত এঁকেবেঁকে উঠে আসছে তার বুকে! ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে তার নাভির দিকে! মননজের মনে হয়। একটা সাপ কিলবিল করছে তার শরীরে! গঙ্গার কাছাকাছি ট্যাক্সি প্রায় পৌঁছে গেছে। এক ঝটকায় মনোজ হাতটা সরিয়ে দেয়। তারপর ট্যাক্সি থামিয়ে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে। ট্যাক্সি-ভাড়া মিটিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে—কত দিতে হবে? স্পষ্টতই এবার অবাক হয় মেয়েটি।–নৌকায় যাবেন না?

–কত দিতে হবে? কঠিন গলায় আবার জিজ্ঞাসা মনোজের।

–কুড়িই দিন তাহলে। হতাশ গলায় বলে মেয়েটি। পার্সটা হাতে ধরাই ছিল। একটা কুড়ি টাকার নোট বাড়িয়ে দেয়….

শরীরটা হঠাৎই যেন খারাপ লাগছে। একটু বমি হয়ে গেলে ভাল হ’ত কি? ফুটপাত ধরে এলোমেলো পা চালায় সে। রেলিং-এর ওপারে একটু এগোলেই বিশাল, ঘোলা জলরাশির বিস্তার। জাহাজের আলোগুলোকে তার কোনও নগরীর আলো মনে হয়। ঠাণ্ডা, মৃদু হাওয়া। সেই হাওয়ায় শরীরটা একটু যেন হাল্কা লাগে। ফুটপাতে একটা বেলুনওলাকে ঘিরে অনেক বাচ্চা আর মায়েদের ভীড়। বেলুনের কুমড়ো পটাশ বিক্রি করছে লোকটা। এক একটা কুমড়ো পটাশ শূন্যে ছুঁড়ে দিচ্ছে। ঘুরপাক খেতে খেতে তা আবার নেমে আসছে নীচে। মনোজ কি ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে। বেলুনগুলোকে ঘিরে বাচ্চাদের এই চাঞ্চল্য, উল্লাস তার দেখতে ভাল লাগে।

—মাম্মি, আমাকে একটা কিনে দাও। দেবদূতের মতো একটা বাচ্চা তার মায়ের কাছে আবদার ধরে।

রোজই তো কিনে দিই। পেলেই তো এখুনি ফাটিয়ে ফেলবে। আজ থাক।

–না—আজও একটা কিনব। বায়না করতে থাকে বাচ্চাটা। মনোজ এগিয়ে যায়। পকেট থেকে খুচরো পয়সা বের করে একটা বেলুন কিনে বাচ্চাটার দিকে। বাড়িয়ে ধরে। একবার বেলুনটার দিকে আর একবার মনোজের মুখের দিকে তাকায় বাচ্চাটা। তারপর মায়ের দিকে তাকায়। মিষ্টি চেহারার একজন যুবতী। বেশ অস্বস্তিতে পড়েছে ভদ্রমহিলা। মনোজের দিকে তাকিয়ে অল্প হেসে বাচ্চাটাকে বলে—আচ্ছা, উনি যখন দিচ্ছেন, নাও। থ্যাঙ্ক ইউ বলো।

–থ্যাঙ্ক ইউ। বেলুনটা নিয়ে কাঁপা কাঁপা স্বরে বাচ্চাটা বলে। মনোজ হাঁটতে থাকে। হাঁটতেই থাকে। হঠাৎ আবার খুব হালকা লাগছে। মাথার ভারবোধও কম মনে হচ্ছে। সে ভাবে…। অরণি বলছিল স্টেটসে চলে যেতে। না,সে কোথাও যাবে না। সে এখানেই পড়ে থাকবে। তার এই অতি চেনা শহরে। হঠাৎ তার উপলব্ধি হয় যে একটা সুখী, উপদ্রবহীন সংসারের জন্য সে ভেতরে ভেতরে তৃষাতুর হয়ে আছে। সংসার ছাড়া তার পরিত্রাণ নেই। সংসারে ধরাবাঁধা ঘেরাটোপই তার একমাত্র আশ্রয়। হাঁটতে হাঁটতে মনোজ ঠিক করে ফেলে সে বনশ্রীর কাছে ফিরে যাবে। একবার চেষ্টা করে দেখবে। তার সামনে নতজানু হয়ে বলবে—যা হবার হয়েছে। এসো, আমরা সবকিছু ভুলে যাই। …এসো, আমরা আবার নতুন করে শুরু করি…।

কালার টি.ভি. – সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

‘পই পই করে বলেছিলাম ভাড়া দিও না। নিজেদেরই জায়গা কুলোয় না। নাঃ ভাড়া না দিলে আর চলছিল না। যদিও বা দিলে তা সেখানে ছুতোয় নাতায় যাবার কি হয়েছে। মনে রেখো জামাই ছেলে হয় না, বউ মেয়ে হয় না আর ভাড়াটে কোনদিন আপন হয় না। বলি তোমাকে কি তুকতা করল নাকি! তুমিতো এমনটি ছিলে না। আজকাল বাবুর আবার কালার টি.ভি.র ব্যামো হয়েছে। ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট নাকি মানুষের দেখার নয়। কালে কালে দেখব কত রাধার গায়ে থতমত! হুঁ:।

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে অমলা কাঁধের গামছায় হাত মুছতে থাকল। আর যাকে উদ্দেশ্য করে এই কথার বৃষ্টিপাত সে কিন্তু ভিজেছে বলে মনে হ’ল না। বক্স জানালায় বসে উদাস হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখছে। আর এই ঔদাসীন্য অমলাকে যেন আরও তাতিয়ে তুলল।

কে বলবে কথা কানে যাচ্ছে। বধির না কি! বিয়ে হয়ে ইস্তক এই এক জ্বালায় আমি জ্বলছি। বাবা যে কি দেখেছিল এই পাথরে! কালা হলেও নয় বুঝতুম। ও বাঃ এ তো শেয়ান পাগল রে। ভাড়াটের ঘরে যেতে বলতে হয় না। দাঁড়াও আমি দেখাচ্ছি মজা। উঠুক একবার। আর ভাড়া দেয় কোন হারামজাদা। পয়সা আমার দরকার নেই। হায় ভগবান দুটো পয়সার মুখ দেখতে গিয়ে শেষে কি মানুষটাই বেহাত হয়ে যাবে নাকি! বলছি অফিস থেকে তো অনেকক্ষণ এসেছ এবারে চা করি? নাকি সেটাও ভাড়াটের ঘরে সারবে?

বক্স জানালা থেকে অর্ণব নামতে নামতে শুধু বলল, ‘অমলা! এবার রেকর্ডটা বদলাও। ব্যাস তেতে ওঠা কড়াতে তেল পড়ল যেন। ছাত্ করে উঠল অমলা। হ্যাঁ তা তো বলবেই তোমার পিন যে ঐ ফাটা রেকর্ডেই আটকেছে।

অর্ণব প্রসঙ্গ বদলে জানতে চায়, অম্বলের ওষুধটা খেয়েছিলে তো? এত বলি জল খাও বেশী করে কে কার কথা শোনে। সাধে কি মেয়েদের কোলাইটিস হয়।

চা দিতে দিতে বলল, অমলা, হলে তো বাঁচতাম। রেকর্ড বন্ধ হয়ে যেত। তোমারও মুক্তি হত। আমি কি আর বুঝি না সেই সকালে বেরোও আর রাতে ফের। এসব কচকচানি কি কারো ভাল লাগে। নাও চা খেয়ে হাত-পা-মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নাও।

চা খাওয়া সেরে অর্ণব বলল, যাই একটু খবরটা—

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অমলা ঝামরে উঠল, দেখে আসি তাই তো? আমি তো জানতাম। বলি ঘেন্না পিত্তির মাথা খেয়েছ নাকি!

অর্ণব জামাটা গলাতে গলাতে বলল, কেন তোমার গুরুদেবই তো বলেছে–লজ্জা-ঘেন্না-ভয়, তিন থাকতে নয়। আমি কি তোমার গুরুদেবের কথা কক্ষনো অমান্য করতে পারি?

জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। চুপসে গেল অমলার হম্বিতম্বি। ফ্যা ফ্যা করে তাকিয়ে রইল পায়ে পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে যাওয়া অর্ণবের দিকে।

সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে অর্ণব চেঁচিয়ে বলল, তুমি আবার খেয়ে দেয়ে শুয়ে পোড় না। আমি এই যাব আর আব।

অমলা উত্তর দেয় না। কটমট করে তাকিয়ে থাকে।

আবার পিছনে এসে অমলাকে চেঁচিয়ে অর্ণব বলে, বনে বনে জলে জঙ্গলে আমাকে স্মরণ করিও আমিই রক্ষা করিব।’ বলে আর দাঁড়ায়নি। কি জানে আবার কি বলে।

অমলা রাগে গজগজ করতে করতে ফ্রিজ খুলে অবাক! মাছভাজার বাটিটাই হাওয়া। মনে মনে ভাবে নির্ঘাৎ অর্ণব নিয়ে গেছে তলায়। তলার বউটিও হয়েছে বড্ড গায় পড়া। দাদা দাদা করে আর রাখছে না। এবার যদি ফোঁটার ঘটা কেউ দেখত। যত সব আদিখ্যেতা। আমারটি বোধহয় রূপদেখে গলে জল। উঃ উঠলে বাঁচি। কি সাংঘাতিক! শেষ পর্যন্ত স্বামী টপকে হেঁসেলে ঢুকে পড়েছে দেখছি! রান্নাঘরে ফিরে এসে খুব লজ্জায় পড়ল অমলা। একদম ভুলেই গেছে গ্যাসে মাছ বসিয়ে সে। পাগলের মত খুঁজছে।

.

২.

সকাল থেকেই আকাশের মুখ গোমড়া। যে কোন সময়তেই তুমুল বৃষ্টি নামবে। বেলা তখন এগারোটা। ভাড়াটে গিন্নি অনিতা এসে হাজির।

–কি করছেন দিদি? রান্না বান্না হ’ল? দাদা বেরোয়নি বুঝি আজ?

-না ভাই। ও ছেলেকে আনতে গেছে। তা তুমি এ সময়ে কি মনে করে?

-এলুম। কত্তা বেরিয়ে গেছে। সে বেরিয়ে গেলে তো ঝাড়া হাত পা। কোন্ ছেলেকে আনতে গেছে?

-আমার দেওরের ছেলে। আমার তো কপাল পোড়া তা তো তুমি জান ভাই। ছেলেপুলে তো হ’লই না।

-তাতে কি হয়েছে। দাদার মত স্বামী পেয়েছে।

—দেখ অনিতা ঘরে একটা ছেলেপুলে না থাকলে সংসার শূন্য মনে হয় বুঝলে।

-হবে হবে অত ভাববেন না। মা ষষ্ঠি ঠিক দয়া করবে।

-তা তুমি কিছু বলবে?

-না বলছিলুম দাদা যখন আজ বেরোয়নি। আমি একটু বাপের বাড়ি যাব—

—তা যাও না। দাদা কি করবে?

-না বলছিলাম যদি একটু ধর্মতলা থেকে দীঘার বাসে তুলে দিয়ে আসে।

—কেন তোমার কতা এটুকু পারল না।

–তাহলে তো হয়েইছিল। যে যাকে নিয়ে ঘর করে সে বোঝে হাড়ে হাড়ে।

—দেখ অনিতা! পরের বউ পরের স্বামী চিরকালই ভাল হয় বুঝলে।

–একি বলছেন দিদি! আমি দাদাকে—

—ফোঁটা দিয়ে ভাই বানিয়ে তিন মাসের ভাড়া বাকি রেখেছ তাইতো?

—সে টাকা আপনাদের দিয়ে দেব। আপনি এসব কি বলছেন?

—যা বলছি ঠিকই বলছি। স্পষ্ট বলে দিচ্ছি সামনের মাসের মধ্যে ভাড়া না দিলে অন্যত্র উঠে যাও। আমার তো হরিহর ছত্রের মেলা নয়। তোমার দাদার আর কি, সে তো সংসারে হর্ষবর্ধন সেজে বসে আছে।

—ছিঃ আপনার মন এত নীচ।

—আর তোমার মন উঁচু।

–লজ্জা করে না পরের স্বামীকে বশ করতে চাও।

—দিদি ভুল বুঝছেন। দাদা টি.ভি.টা একটু দেখতে যায়।

—ঐ কালার টি.ভি. টাই তো আমার সংসার ডিকালার করে দিচ্ছে। এত টি.ভি. খারাপ হয়, ওটা কি খারাপও হয় না। তবে বাঁচতুম।

—আমি ভাবতেই পারছি না। আপনি দাদাকে সন্দেহ করেন?

—মুখ সামলে কথা বল। আমি কি করি তোমায় বলতে হবে আঁ! বিকেল হলেই সাজুগুজু। খোঁপায় মাছে দাঁতের মত ক্লিপ, কপালে টিপ, নখে রঙ, ঠোঁটে রঙ। কই তোমার কত্তাকে দেখেতো আমি অমন হ্যাংলাপনা করি না।

—আমি হ্যাংলা? আপনি অনেক কথাই বললেন। তা আপনিও তো পারেন আপনার স্বামীটিকে বশ মানাতে!

—যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা। তুমি যাও, যাও বলছি। একটি কথাও আর বলবে না। আজ আসুক। ভগবান! কপালে এও ছিল। শেষপর্যন্ত কিনা ভাড়াটে এসে বাড়িওয়ালাকে স্বামী মানুষ করা শেখাচ্ছে।

অনিতা নেমে যেতে যেতে শুধু বলল বিড় বিড় করে, দাদার মত মানুষ হয় না। দাদা যদি শিব হয় তো আপনি নন্দীভূঙ্গি। বাব্বাঃ এমন বউ নিয়ে মানুষে ঘর করে!

.

৩.

অর্ণব ইলিশ মাছ এনে বলল, আজ যখন বেরোলামই না। তিন কিসিম ইলিশ কর। তোমার হাতের ভাপা কি যে স্বাদ হয়! আহা অপূর্ব।

অমলা পাশে এসে দাঁড়ায়। গামছা এগিয়ে দিয়ে বলে, ঘামটা মোছ। মুছে মুখ হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হও দেখবে ভাল লাগবে। একটু চা দেবো?

না চাইতে চা, গামছা, মিষ্টি মিষ্টি সোহাগ মাখা কথা শুনে অর্ণবের তো ভিরমি খাবার জোগাড়। মনে মনে ভাবে চোরা অম্বল নয় তো! আজ হ’ল কি! তাহলে নির্ঘাৎ তলার সঙ্গে উপরের একটা জবরদস্ত পাঞ্জা কষাকষি হয়েছে।

চা এনে অমলা পাশে এসে গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আব্দারের সুরে বলে, চল না গো আজ কোথাও বেড়াতে যাই।

অর্ণব তো অবাক! বলল, বেশ তো কোথায় যাবে? তুমিই বল।

অমলা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, গঙ্গাস্নান ছাড়া তো যাইনি কখনো, চল আজ গঙ্গার পাড়ে ঘুরে আসি। যাবে গো!

অর্ণব বলল, এ আর এমন কি যাব।

অমলা গুন গুন করে গাইতে গাইতে রান্না ঘরের দিকে হেঁটে গেল, লাজবতী। নূপুরের রিনিঝিনি রিনি, ভাল যদি লাগে তবে দাম দিয়ে কিনি, বেশী তো নেব না…। বেশ গায় অমলা। একান্নবর্তী পরিবারের হ্যাপা সামলাতে গিয়ে কত সাধ আহ্লাদ যে গলা টিপে মেরেছে সে।

অমলা হঠাৎ সরষে বাটা থামিয়ে রান্না ঘর থেকে চেঁচাল, তার চেয়ে ভিক্টোরিয়ায় চল। দারুণ মজা হবে।

অর্ণব ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে, ধ্যস্‌ ছেলে ছোঁকড়ারা প্রেম করে ওখানে একটু নিরিবিলি। জানতে এই কাজে যে বাধা দেয় সে সুখী হয় না।

কাটা ঘায়ে নুনের ছিট পড়ল। বিষম খেল জোর অমলা। অর্ণব দৌড়ে এসে মাথা চাবড়াতে লাগাল। অমলা মনে মনে ভাবে এ কথা তাকেই বলল, ঝি মেরে বৌ শেখানো আর কি। তার মানে ভাড়াটে বউয়ের সঙ্গে ফস্টিনস্টিতে আমি বাঁধা না দিই। ভাবতে ভাবতে সাধের ইলিশ পুড়ে ছাই। অর্ণব দৌড়ে এসে দেখে আঁচলে চোখ মুছছে অমলা। ইলিশ, বালিশ ফাটা তুলোর মত ছত্রাখান।

অর্ণব চেঁচাল, কি হ’ল কি আবার? সব যে পুড়ে গেল!

অমলা ঝাঁঝিয়ে উঠল, যাক সব ছাই হয়ে যাক। কপাল পোড়ার আর পুড়তে কি বাকি আছে!

অর্ণব পিঠে হাত দিয়ে বলে, একটু শান্ত হও অমলা।

তোমার ঐ নীচের ঘরের টাইফুনটাকে শান্ত হতে বল গে যাও। বেশ ছিলুম। সংসারটা তছনছ করে দিল আমার। বলে আবার কাঁদতে থাকে।

অর্ণব অপ্রস্তুত হয়ে বলে, আরে বাবা এই তো গঙ্গার ঘাটে যাব। আবার কি এমন হল?

তুমি ঐ অনিতা কে নিয়ে যাও ঘুরে এসো গিয়ে খুশী হবে। ভেবেছিলুম বয়স বাড়লে স্বস্তি হবে ও ব্বাবাঃ কোথায় কি রস একদম গইড়ে পড়ছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ। সাধে কি আর কেউ ভাড়া দিতে চায় না। বলেই খস খস করে শিলের উপর নোড়াটাকে ঘসে ব্যাপ করে একদলা সরষে মাছের উপর ছুঁড়ে দিয়ে উঠে পড়ল অমলা।

অর্ণব জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে বল তো?

অমলা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, আর মিষ্টি কথায় দরকার নেই। গোড়া কেটে উনি এলেন আগায় জল দিতে। এসব মেয়ে মানুষের ঝেটিয়ে বিষ ঝেড়ে দিতে হয়। এসে বলে কিনা বাপের বাড়ি যাব, দাদাকে একটু এগিয়ে দিতে বলবেন। বাপের চাকর যেন। আজ তোমার দুর্বলতার জন্যে ভাড়াটে বউয়ের এত আস্পর্ধা। ঘরে স্বামীর পায়ে শিকলি বেঁধে, পরের স্বামী নিয়ে টানাটানি। আমি বরদাস্ত করব না বুঝলে।

ব্যাপারটা বুঝে অর্ণব হেসে বলল, শোন মানুষকে ভালবাসা কোন পাপ কাজ নয় গো। আস্তে কথা বল। লোকে শুনলে কি ধারণা হবে। আমি একটু টি ভি দেখতে যাই, তাও কালার টি.ভি. বলে। তাতে এত চেঁচামেচি করছ কেন?

অমলা হাসতে হাসতে বলল, দেখ রাগ কোর না। পাঁচজনে কি বলে বলতো, তুমি কি একবার ভাব না।

অর্ণব বলল, তুমিও কিছু মনে কোরনা একটা কথা বলি। আমি যে নীচের ঘরে টি.ভি. দেখতে যাই তা তো তোমার পঁয়ষট্টি ডেসিব এর বেশী চিল চিৎকারে সারা পাড়া জেনে গেছে।

অমলা অর্ণবের হাতটা ধরে বলে, আমি ওসব জানিনা, তুমি ও ঘরে আর যাবে। এই নাও গলার হার। বন্ধক দিয়ে একটা কালার টি.ভি. নিয়ে এসো। তবে তো হবে। নাকি টি.ভির সাথে চাঁদ মুখও চাই-ই?

অর্ণব উত্তেজিত হয়ে বলল, দেখ রমলা সহ্যের একটা সীমা আছে। তুমি অনেক কথাই বললে আমি আপত্তি করিনি। তুমি আমাকে বিয়ের রজতজয়ন্তী বর্ষ উদযাপনের পরেও সন্দেহ কর আমি ভাবতেই পারছি না। এই জন্যই বলে স্ত্রী চরিত্র দেবা ন জনন্তি। বুঝলে। খেয়ে দেয়ে রেডি হয়ে নেবে তাড়াতাড়ি। বেরোবো।

অমলার গলায় কপোট অভিমান ঝরে পড়ল, না আমি যাব না। সব মাটি হয়ে গেল। না আছে একটা ছেলেপুলে। না আছে শখ আলাদ। নিজেরা পুরুষ মানুষ বাইরে বাইরে থাক বুঝবে কি! আমিই এখন সংসারের দায় হয়ে উঠেছি। আমাকে সরাতে পারলেই তোমার পোয়াবারো। ‘প্রৌঢ়ের তরুণী আসক্তি’ পালাটা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে আর কি! একটা দিন নিজে থেকে বলেছ, যে ভাড়াটা সময়মত দিন। তাতে কি মান যাবে? তিন মাসের ভাড়া বাকি কিন্তু ফস্টি নস্টির তো কিছু বাকি নেই। কাল, কাল যখন তুমি খবর দেখে বেরোচ্ছ তখন হাসতে হাসতে অনিতা এসে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়নি? আমি সব দেখেছি; বুঝলে। নিজের কপাল পুড়ছে নিজের চোখে দেখে কি আর চেঁচানো যায়!

অর্ণব মুখ ফসকে বলে ফেলল, দেখ অমলা! আজ দু বছর ওরা এসেছে ওর কোনদিন চিৎকার শুনেছ? বড় শান্ত স্বভাব। মেয়েদের স্বভাবে কোমলতা হচ্ছে সবচেয়ে বড় অলংকার। যেটা ওর আছে।

অমলা চোখ মুছে আগুন ঝরিয়ে তাকায়। চেঁচিয়ে ওঠে, ও তাহলে তলে তলে এত! আজ আমার সব খারাপ। আমার কিছুই নেই? পঁচিশটা বছর তো এই রূপের দাঁড়ে আটকে দোল খেয়েছ। ভীমরতিতে এসে ধরল শেষ বয়সে! তা যাও আবার

তলায় যাও চাঁদ মুখ না দেখলে যে মূৰ্ছা যাবে।

অর্ণব রাগতস্বরে বলল, এর থেকে অফিস গেলেই ভাল ছিল।

হঠাৎ নীচে কড়া নাড়ার শব্দ কানে ভেসে এলো। অমলা বলল, যাওনা দেখ কে এল আবার।

অর্ণব বলল, না আমি আর নীচে নামব না। এই তো বললে ভাড়াটে আছে নীচে যাবে না। যাব না। নিজে যাও।

অমলা গজ গজ করতে করতে নামতে থাকে। মুখেই অনিতার সঙ্গে দেখা হতেই মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল দরজা খুলতে। যেন শত জন্মের রাগ।

দরজা খুলে থ্‌!

কাঁধে এক পেল্লায় বাক্স নিয়ে এক মুসলিম ভদ্রলোক বললেন, মা অর্ণব দত্তর বাড়ি এটা?

অমলা বিস্মিত চোখে খানিক চেয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু এটা কি ভাই? ছেলেটি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, টি.ভি.।

অমলা বলল, উপরমে চলিয়ে।

ছেলেটি টি.ভি. কাঁধে ঘরে ঢুকে নামিয়ে কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে বলল, বকশিস দিন বাবু। এটা কি কম ভারী বলুন!

অর্ণবও অবাক!

এমন সময় অনিতা পিছন থেকে ঢুকে অর্ণবের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাতে ছোট পিতলের থালায় মিষ্টি। আর একটা রাখী। বলল, আজ রাখী পূর্ণিমা তাই দিদিকে মিষ্টি মুখ করাতে এলাম। আর দাদা হাতটা বাড়ান রাখীটা পড়িয়ে দিই।

অমলা অবাক হয়ে অনিতার আব্দারের দিকে তাকিয়ে থাকে।

অনিতা বলে, ছাপোসা ঘরে কালার টি.ভি. চট করে কি কেনা যায়! তিনমাসের যে ভাড়ার টাকা সেটা অ্যাডভান্স দিয়ে দাদার জন্য এই কালার টি.ভি.টা এনে দিলাম।

অমলা লজ্জায় কুঁকড়ে লাল। হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি কিছু মনে কোর না অনি! আমি হয়তো মাথা গরম করে ফেলি। কিন্তু এ আমার মনের কথা নয়।

অনিতা অর্ণবের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর ধীর অথচ শান্ত গলায় বলে, দাদা ও ট্রান্সফার হয়ে গেছে নর্থ বেঙ্গল। আমরা এ মাসটা আর থাকব। যাক এবার অন্ততঃ আপনাদের দাম্পত্য কলহর অবসান হবে। দাদাকেও আর কালার টি.ভি. দেখতে পাঁচবাড়ি যেতে হবে না।

অর্ণবের চোখের কোল ভিজে উঠতে দেখে অনিতাও চোখের জল সামলাতে পারল না। অমলাও কেমন যেন ভিতরে ভিতরে ভিজে উঠতে লাগল।

অনিতা অস্ফুটে বলল, দাদা! দিদি! প্রিয়জনের বিদায়বেলায় চোখের জল ফেলতে নেই। দিদি চা করুন। দাদা! টি.ভি.টা লাগান। তারপর চালিয়ে দিন। আজ আপনার টি.ভি. দেখতে দেখতে জমিয়ে গল্প করি।

অমলা চা করতে উঠতে উঠতে বলল, তোমরা বসে গল্প কর। আমি এক্ষুনি চা আর পাঁপড় নিয়ে আসছি কেমন।

অর্ণব কালার টি.ভি.টা সেট করতে করতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে কলহপ্রিয় গুটিপোকার ভিতর থেকে বেরিয়ে অমলা যেন আজ আনন্দ প্রজাপতি।

কীট – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

একদিন নীলা চলে গেল।

একদিন না একদিন চলে যাওয়ার কথাই ছিল নীলার। তাই না যাওয়া এবং যাওয়ার মধ্যে খুব একটা তফাৎ হল না। সুবোধ নিজেই গিয়েছিল হাওড়া স্টেশনে নীলাকে গাড়িতে তুলে দিতে। বিদায়-মুহূর্তে স্বামী-স্ত্রীর যেমন কথা হয় তেমন কিছুই হল না। রুমাল উড়ল না, চোখের জল পড়ল না, এমন কি গাড়ি যখন ছেড়ে যাচ্ছে তখন জানালায় নীলার উৎসুক মুখও দেখা গেল না।

নীলা গেল তার বাপের বাড়ি মধুপুরে। সেখানেই থাকবে, না আর কোথাও যাবে তার কিছুই জানল না সুবোধ শুধু জানল নীলার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই; অনেকদিন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল এরকমটাই হবে। খুব শান্তিপূর্ণ ভাবেই শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল ব্যাপারটা।

খুব যে খারাপ লাগল সুবোধের—তা নয়। ভালও লাগল না অবশ্য। তার সম্মানের পক্ষে, পৌরুষের পক্ষে ব্যাপারটা মোটেই ভাল নয়। কত লোকের কত জিজ্ঞাসাই যে এখন তার ঘরে উঁকি মারবে তা ভাবতেও ভয় লাগা উচিত। লু ধ্ব ভেবেও সুবোধের মন শান্তই রইল। খুবই শান্ত। বাসে জানালার ধারের বদ্বার জায়গায় গঙ্গার সুন্দর হাওয়া এসে লাগছিল। এখন বসন্তকাল। কলকাতায় চোরা-গরম শুরু হয়ে গেছে। বাতাসটুকু বড় ভাল লাগল সুবোধের। লোহার প্রকাণ্ড জালের মধ্যে দিয়ে সে উৎসুক চোখে গঙ্গার ঘোলা রূপ, নৌকো, জাহাজের মাস্তুল আর কলকাতার প্রকৃতিশূন্য আকাশরেখায় প্রকাণ্ড বাড়িগুলোর জ্যামিতিক শীর্ষগুলি দেখল। মনোযোগ দিয়ে দেখল, দেখায় কোনো অন্যমনস্কতা এল না। ভালই লাগল তার। এমন অলস ভাবে আয়েসের সঙ্গে অনেককাল কিছু দেখেনি সে। বিয়ের পর থেকেই তার মন ব্যস্ত ছিল, গত দশ বছর ধরে সেই ব্যস্ততা, সেই উৎকণ্ঠা আর বিষণ্ণতা নিয়েই সে সবকিছু দেখেছে। আজ দশ বছর পর সেই ব্যস্ততা হঠাৎ কেটে গেছে। বড় স্বাভাবিক। লাগে সবকিছু। বঙ্কালের চেনা পুরোনো কলকাতার হারানো চেহারাটি হঠাৎ তার চোখে আবার ফিরে এসেছে আজ।

অনেকক্ষণ ধরে চলল বাস। ট্রাফিকের লাল বাতি, মন্থরগতি ট্রাম, রাস্তা পেরোনো মানুষের বাধা। সময় লাগল, কিন্তু অস্থির হল না সুবোধ। কোনোখানে পৌঁছোনোর কোনো তাড়া নেই বলে জানলার বাইরে তাকিয়ে ঘিঞ্জি ফুটপাথ, দোকানের সাইনবোর্ড, দোতলা বাড়ির জানালায় কোনো দৃশ্যকত কি দেখতে দেখতে মগ্ন হয়ে রইল।

সন্ধ্যের মুখে ঘরে এসে তালা খুলল সে। বাতি জ্বালল, জামাকাপড় ছাড়ল, হাতমুখ ধুল, চুল আঁচড়াল, তারপর একখানা চেয়ার টেনে জানালার পাশে বসে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। বাইরে দেবার কিছু নেই। ঢাকুরিয়া বড় ম্যাড়ম্যাড়ে জায়গা, প্রায় আট বছরের টানা বসবাসে এ জায়গায় সব রহস্য নষ্ট হয়ে গেছে। চেনাশুনোও বেড়েছে অনেক। এবার জায়গাটা ছাড়া দরকার। দু এক মাসের মধ্যেই। যতদিন নীলার বাপের বাড়ির থাকাটা লোকের চোখে স্বাভাবিক দেখায় ততদিনই নিরুদ্বেগে থাকতে পারে সুবোধ। তারপর অচেনা একটা পাড়ায় তাকে উঠে যেতে হবে।

ঘরের দিকে চেয়ে দেখল সুবোধ। জিনিসপত্র বেশি কিছু নিয়ে যায়নি নীলা, কেবল তার নিজস্ব জিনিসগুলি ছাড়া। তাই ঘরটা যেমন ছিল প্রায় তেমনই আছে। কেবল আলনায় নীলার শাড়িগুলোর রঙের বাহার দেখা যাচ্ছে না, আয়নার টেবিলে কাপটানের শিশি-কৌটোগুলিও নেই। তাই তফাৎটা খুব চোখে পড়ে না। যেমন নীলার থাকা এবং না থাকার মধ্যে নিজের মনের তফাৎটাও সে ধরতে পারছে না।

না, ব্যাপারটা মোটেই ভাল হল না। গভীরভাবে ভাবলে এর মধ্যে লজ্জার ঘোর অনেক কিছু খুঁটিনাটি তার লক্ষ্যে পড়বে। মন-খারাপ হওয়ার মতো অনেক স্মৃতি। তবু কি এক রহস্যময় কারণে মনটা হাল্কাই লাগছিল সুবোধের। জানালার কাছে বসে রইল, সিগারেট খেল। নীলা থাকলে এখানে বসেই এক কাপ চা পাওয়া যেত। সেটাই কেবল হচ্ছে না। মাত্র এক কাপ চায়ের তফাৎ। তবে চা করার একটা লোক রাখলেই তো তফাৎটুকু বুজে যায়। ভেবে একটু হাসল সুবোধ। হাতঘড়িতে প্রায় আটটা বাজল। তাদের রান্নার লোক নেই, নীলাই রাঁধত। সুবোধ ভেবেছিল হোটেলে খেয়ে আসবে। তারপর ভাবল হোটেলে খেতে গেলে তফাটুকু আরো বেশি মনে পড়বে। তাই সে ঠিক করল রান্নার চেষ্টা করলেই হয়।

রান্নাঘরে একটা প্রেসার কুকার ছিল। কেরোসিনের স্টোভে সেইটেতে ভাতে ভাত রান্না করে খেল সুবোধ। দেখল এই সামান্য রান্নাটুকুতেই সমস্ত রান্নাঘরটা সে ওলট পালট করে দিয়েছে। আবার সেই তফাৎ! সুবোধ আপনমনে হাসল। তারপর বিছানা ঝাড়ল, মশারি টাঙাল, বাতি নেভাল—এই সব কাজই ছিল নীলার। শুয়ে শুয়ে সে অনেকক্ষণ মশারির মধ্যে সিগারেট খেল সাবধানে। ঘুম এল না। নীলা মাঝরাতে পৌঁছোবে আসানসোলে। সেখানে ওর জামাইবাবুকে খবর দেওয়া আছে, ওকে নামিয়ে নেবে। কয়েকদিন পরে যাবে মধুপুরে। নীলার এখন বোধ হয় সুখের সময়। ঘুরে ঘুরে বেড়াবে খুব। এখন এই রাত এগারোটায় নীলা কোথায়! কী করছে নীলা! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। কাল থেকে তার ঝরঝরে একার জীবন শুরু হবে। মাত্র ছত্রিশ বছর তার বয়স, এখনো নতুন করে সব কিছুই শুরু করা যায়। সময় আছে।

সকালে ঘুম ভাঙলে তার মনে পড়ল সারারাত সে অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন দেখেছে। অধিকাংশ স্বপ্নেই নীলা ছিল। একটা স্বপ্নে সে দেখল—সে অফিস থেকে ফিরে এসেছে। এসে দেখছে ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজার কড়া না নেড়ে দরজার গায়ে কান পাতল। ভিতরে নীলা আর একটা পুরুষ কথা বলছে। মৃদু স্বরে কথা, সে ভাল বুঝতে পারছে না, প্রাণপণে শোনার চেষ্টা করল সে। বুঝল কথাবার্তার ধরণ খুবই অন্তরঙ্গ। ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিল সুবোধ, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার হাত এত দুর্বল লাগছিল যে মোটেই শব্দ হল না। ভিতরে কথাবার্তা তেমনিই চলতে লাগল, সে চীৎকার করে নীলাকে ডাকল—দরজা খোলো। বলতে গিয়ে সে টের পেল, সে মোটেই চীৎকার করতে পারছে না। দরজা খোলো বলতে গিয়ে সে ফিস ফিস করে বলছে ‘জোরে কথা বলো।’ এরকম বারবার হতে লাগল। এত হতাশ লাগল তার যে ইচ্ছে করছিল দরজার সামনেই সে আত্মহত্যা করে। ভাবতে ভাবতে সে একই সঙ্গে চীৎকার করে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। অবশেষে দরজায় মৃদু শব্দ হল, থেমে গেল ভিতরের অন্তরঙ্গ কথা, তারপর হঠাৎ দরজা খুলে গেল। বিশাল শরীরওলা একজন পুরুষ দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে লাগল। চমকে উঠল সুবোধ। চেনা লোক—মনোমোহন। তার অনেকদিন আগেরকার বন্ধু। হায় ঈশ্বর! মনোমোহন কোথা থেকে, কি করে যে এল। রাগে দুঃখে ঘেন্নায় লাফিয়ে ওঠে মনোমোহনের পিছু নেওয়ার চেষ্টা করল সুবোধ। কিন্তু পারল না। পা আটকে যাচ্ছিল, যেন এক হাঁটু জল ভেঙে সে দৌড়োবার চেষ্টা করছে। মনোমোহন দুতিন লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে পিছু ফিরে দেখল, নীলা অসভৃত শাড়ি পরে দরজায় দাঁড়িয়ে নিস্পৃহ মুখে তার ভোলা চুলের ভিতরে আঙুল দিয়ে জট ছাড়াচ্ছে। কাকে যে আক্রমণ করবে সুবোধ, তা সে নিজে বুঝতে পারছিল না। রাগ দুঃখ ঘেন্নার সঙ্গে সঙ্গে হিংস্র একটা আনন্দকেও সে টের পাচ্ছিল। পাওয়া গেছে, নীলাকে এতদিনের সুবিধে মতো পাওয়া গেছে। এইরকম স্বপ্ন আরো দেখেছে সে রাতে। কখনো নীলাকে অন্য পুরুষের সাথে দেখা গেল, কখনো বা দেখা গেল নীলা এরোপ্লেনে বা নৌকোয় দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।

সকালের উজ্জ্বল আলোয় জেগে উঠে সুবোধ স্বপ্নগুলোর কথা ভেবে সামান্য জ্বালা অনুভব করল বুকে। বস্তুতঃ নীলার সঙ্গে কারো প্রেম ছিল এটা এখনো পর্যন্ত প্রমাণসাপেক্ষ। মনোমোহনের স্বপ্নটা একেবারেই বাজে। কারণ নীলার সঙ্গে তার বিয়ের অনেক আগে থেকেই মনোমোহনের সঙ্গে পরিচয়। মনোমোহনের সঙ্গে আর দেখা হয় না সুবোধের। মনোমাহন বোধহয় এখন পুলিশে চাকরি করে তার ঘর সংসার আছে, সে নিরীহ মানুষ। স্বপ্নে যে কত অঘটন ঘটে!

তবু বুকে মনে কোথাও একটু জ্বালার ভাব ছিলই সুবোধের। স্টোভ জ্বেলে সে চা করল। চা-টা তেমন জমল না, লিকার পাতলা হয়েছে, চিনি বেশি। সেই চা খেয়ে। সকাল বেলাটা কাটাল সে। ঝি এসে বাসন-কোসন মেজে দিয়ে গেছে, তবু নিজে আজ আর রান্না করবে না সুবোধ। আজ ছুটির দিন রবিবার। দুপুরে গিয়ে কোনো হোটেলে খেয়ে আসবে। সকাল বেলাটায় সে ঘরের কোথায় কি আছে তা ঘুরে ঘুরে দেখল। এখন সবকিছু তাকেই দেখতে হবে। নিজেকে নিজেই চালাতে হবে তার। ব্যাপারটা যে খুব সুবিধেজনক হবে না—তা বোঝা যাচ্ছিল। বিয়ের আগে সেছিল মা বোন বৌদিদের ওপর নির্ভরশীল। বিয়ের বছর দুয়েকের মধ্যেই গড়পাড়ের সেই যৌথ সংসার ছেড়ে চলে এল ঢাকুরিয়ায় নীলাকে নিয়ে। কখনো সে একা থাকেনি বিশেষ। যে কয়েকবার নীলা একটু বেশিদিনের জন্য বাপের বাড়ি গেছে সে কয়েকবারই মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে সুবোধ। কাজেই এখন একা একা সংসারের মতো কিছু চালাননা তার পক্ষে মুশকিল। মাকেও আর আনা যায় না— বাতে অম্বলে এই বুড়োবয়সে মা বড় জবুথবু হয়ে গেছে। তা ছাড়া মাকে আনলেও স্থায়ীভাবে আনা যায়না, গড়পাড়ের সংসার ছেড়ে মা এখানে থাকতেও চাইবে না বেশিদিন। এর ওপর আছে মায়ের অনুসন্ধানী চোখ—এক লহমায় বুঝ নেবে যে। নীলা আর আসবে না।

নীলা আর আসবে না ভাবতেই সকাল বেলায় একটু কষ্ট হল সুবোধের। কষ্টটা নিতান্তই অভ্যাসজনিত। দশ বছদ্ম একসঙ্গে বসবাস করার অভ্যাসের ফল। নীলা না থাকলে হরেকরকমের অসুবিধে। সেই অসুবিধেটুকু বাদ দিলে মনটা বেশ তাজা লাগল তার। বেলা বাড়লে রাতের স্বপ্নগুলোর মধ্যে একমাত্র মনোমোহনের স্বপ্ন ছাড়া আর কোনো স্বপ্নই তার মনে থাকল না। মনোমোহনের সঙ্গে নীলার কিছুই ছিল না—সুবোধ জানে। তবু স্বপ্নটার মধ্যে বিশ্বাসযোগ্য একটা কিছু আছে বলেই তার মনে হচ্ছিল। হয়তো এই ঘরে, তার এই সংসারের মধ্যে থেকেও নীলা কখনো ঠিক পুরোপুরি সুবোধের ছিল না। বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই সুবোধের এইরকম ধারণা শুরু হয়। গড়পাড়ের বাড়িতে বাচ্চা ছেলেমেয়ের অভাব ছিল না। দুই দাদার গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে যাদের বুদ্ধি তেমন পাকেনি তাদের কাছে সে প্রায়ই গোপনে জিজ্ঞেস করত, সে অফিসে চলে গেলে নীলা কি কি করে, বিকেলে ছাদে যায় কিনা, নীলার নামে কোনো চিঠি এসেছিল কিনা। বস্তুতঃ কেন যে সেসব জিজ্ঞাসা করত সুবোধ তা স্পষ্টভাবে নিজে আজও জানে না। বাপের বাড়ির কোনো লোক এসে নীলার খোঁজ করলে সে বিরক্ত হত। কখনো কখনো ঠাট্টার ছলে সে নীলাকে জিজ্ঞেসও করেছে বিয়ের আগে নীলার জীবনে কে কে পুরুষ এসেছে। সুবোধের মনের গতি তখনো ধরতে পারেনি নীলা, তাই ঠাট্টা করেই উত্তর দিত ছিল তো, সে তোমার চেয়ে অনেক ভাল। ঠাট্টা জেনেও মনে মনে ম্লান হয়ে যেত সুবোধ। বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই বাড়িতে একটা গণ্ডগোল শুরু হল মেজদাকে নিয়ে। মেজদার কারখানায় গণ্ডগোল হয়ে লক-আউট হয়ে গেল। ছ মাস পরে কারখানাটা হাত বদল হয়ে গেল। মেজদা পুরোপুরি বেকার তখন। লোকটা ছিল বরাবরই একটু বন্য ধরনের, হৈ-চৈ করা মাথা-মোটা গোঁয়ার মানুষ। চাকরি গেলে এসব লোকের। সচরাচর হয় তাই হল। বাংলা মদ খেয়ে রাত করে বাসায় ফিরত। গোলমাল বা চেঁচামেচি করত না, কিন্তু মাঝে মাঝেই কান্নাকাটি করত অনেক রাত পর্যন্ত। তিন ঘরের ছোট্ট বাসাটায় ঠাসাঠাসি লোজনের মধ্যে ব্যাপারটা বিশ্রী হয়ে দাঁড়াল। মেজদার মদ খাওয়ার স্বভাব ছিলই, কিন্তু আগে মাত্রা রেখে খেতে, পুজো পার্বণ বা অন্য উপলক্ষে বেশি খাওয়া হয়ে গেল বাসায় ফিরত না। কিন্তু চাকরি যাওয়ার পর লোকটাকে রোজই মাত্রার বেশিই খেতে হত, আর বাসা ছাড়া অন্য জায়গায়ও ছিল না তার। প্রতি রাত্রে মেজদাকে গালাগাল করত সবাই, মা বলত—ওকে রাতে ঘরে ঢুকতে দিস না। বৌদি সামলাতো বটে, কিন্তু কিছুদিন পর বৌদিরও ধৈর্য থাকল না। কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়ি চলে গেল বৌদি। সে সময়ে সত্যিই মুশকিল হল মেজদাকে নিয়ে। তাকে সামলানোর নোক কেউ রইল না। মাঝে মাঝে সদরের বাইরেই সারা রাত শুয়ে থাকত মেজদা। দরজা খুলত না কেউই। সে সময়ে এক বৃষ্টির রাতে নীলা উঠে গিয়ে মেজদাকে দরজা খুলে দিয়েছিল। সুবোধ জেগে থাকলে নীলাকে এ কাজ করতে দিত না। যখন জাগল তখন নীলা উঠে গিয়ে দরজা খুলছে। রাগে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে উঠে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে নীলাকে ধরল। সুবোধ কোথায় গিয়েছিলে? নীলা দুর্বল গলায় উত্তর দিল–মেজদাকে দরজা খুলে। দিতে। ভীষণ রেগে গিয়ে সুবোধ চেঁচিয়ে বলল— কি দরকার তোমার? মাতাল, লোফার, লুম্পেন ঐ ছোটোলোকটার কাছাকাছি তুমি কেন গিয়েছিলে? সে কেন তোমার গায়ে হাত দিল? নীলা এবার অবাক হয়ে বলল— গায়ে হাত দিল! কই, না তো! সুবোধ তবু চেঁচিয়ে বলল—আমি নিজে দেখেছি সে তোমার হাত ধরে আছে। অন্ধকারে নীলার মুখের রঙ দেখা গেল না, নীলা একটু চুপ করে থেকে বলল—চেঁচিও না। বিছানায় চল। বলে দরজায় খিল দিল নীলা। সুবোধের সমস্ত শরীর জ্বলে গেল। সে বলল—কেন গিয়েছিলে? তোমাকে আমি বারণ করিনি ওই লোফারটার কাছাকাছি কখনো যাবে না? নীলা সামান্য হাঁফ ধরা গলায় বলল— দরজা খুলে না দিলে উনি সারারাত বৃষ্টিতে ভিজতেন। সুবোধ ছিটকে উঠল—তাতে কী হত। মাতালের সর্দি লাগে না। কিন্তু তাকে তুমি প্রশ্রয় দাও কেন? এ বাসায় তার আপনজন কেউ নেই? লোফারটা তোমার হাত…। সামান্য কঠিন হল এবার নীলার গলা—তুমি নিজে দেখেছো? বাস্তবিক সুবোধ কিছুই দেখেনি, সে উঠে দেখেছে নীলা ঘরে ফিরে আসছে, তবু কেন যেন তার মনে হয়েছিল ওরকম কিছু একটা হয়েছে। তাই সে গলার তেজ বজায় রেখে বলল—হা, দেখেছি। নীলা আস্তে আস্তে বলল—উনি মাতাল অবস্থাতেও চিনতে পেরে আমায় বললেন–তোমাকে কষ্ট দিলাম বৌমা। আমার হাতে ওঁর হাত লাগেনি। সত্যিই কি তুমি নিজে দেখেছো। সুবোধের আর তেমন কিছু বলার ছিল না, তবু সে খাকিক্ষণ গোঁ গোঁ করল। সারারাত ঘুমের মধ্যেও ছটফট করল। জ্বালা যন্ত্রণা হিংস্রতার এক অদ্ভুত মিশ্র অনুভূতি। হাতের কাছেই নীলা, তু কেন নীলাকে দূরের বলে মনে হচ্ছে কে জানে! পরদিন থেকে ব্যাপারটা অন্য চেহারা নিল। রাতে সুবোধের চীৎকার সবাই শুনেছিল। সম্ভবত হাত ধরার ব্যাপারটা বিশ্বাস করে নিয়েই মা আর বড়দা কিছু বলেছিল মেজদাকে। মেজদার সম্বন্ধে তখন ওরকম কোন ব্যাপারই অবিশ্বাস্য ছিল না। সুস্থ অবস্থায় সম্ভবতঃ মেজদাও বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা সত্যিই ঘটেছিল কিনা। তাই পরদিন থেকেই মেজদা কেমন মিইয়ে গেল। দিনের বেলাতে আর বাসায় থাকতই না। নীলা সুবোধকে এ ব্যাপারে সরাসরি দায়ী করেনি, কিন্তু তখন থেকেই আলাদা বাসা করার জন্য সুবোধকে বলতে শুরুকরে নীলা। তাই বিয়ের দু বছরের মাথায় সুবোধ আলাদা হয়ে এল।

তবু শান্তি ছিল না সুবোধের। যাতায়াতের পথে দেখত রকে বসে পাড়ার ছেলেরা মেয়েদের টিটিকিরি দিচ্ছে, পথে ঘাটে দেখত সুন্দর পোশাক পরে সুপুরুষ মানুষেরা যাচ্ছে, কখনো বা বন্ধুদের কাছে শুনত চরিত্রহীনতার নানা রঙদার গল্প। সঙ্গে সঙ্গেই নীলার কথা মনে পড়ত সুবোধের। পৃথিবীতে এত পুরুষ মানুষের ভীড় তার পছন্দ হত না। তার ইচ্ছে হত নীলাকে সে সম্পূর্ণ পুরুষশুন্য কোনো এলাকায় নিয়ে গিয়ে বসবাস করে। অফিসে বেরিয়ে বোধহয় সে অনেকবার মাঝপথে বাস থেকে নেমে পড়েছে। মনে বিষের যন্ত্রণা। একটু এদিক ওদিক ঘুরে চুপি চুপি ফিরে এসেছে বাসায়। নিঃসাড়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছে দোতলায়, দরজায় কান পেতে ভিতরে কোনো কথাবার্তা হচ্ছে কিনা শুনতে চেষ্টা করেছে। তারপর আস্তে আস্তে দরজায় কড়া নেড়েছে। প্রায়ই দরজা খুলে নীলা অবাক হত—এ কী, তুমি! খুব চালাকের মতো হাসত সুবোধ, বলত—দূর রোজ অফিস করতে ভাল লাগে? চলো আজ একটা ম্যাটিনি দেখে আসি। শেষের দিকে নীলা হয়তো কিছু টের পেয়েছিল। আর তাকে দেখে অবাক হত না। শক্ত মুখ আর ঠাণ্ডা চোখে চেয়ে একদিন বলেছিল-চৌকির তলাটলাগুলো ভাল করে দেখে নাও।

ধরা পড়ে মনে মনে রেগে যেত সুবোধ। নিজের সঙ্গে নিজেই বিজনে ঝগড়া করত— কিছু একটা না হলে আমার মনে এরকম সন্দেহ আসছে কেন! আমার মন বলছে কিছু একটা আছেই। বাইরে থেকে আর কতটুকু বোঝা যায়।

তবু নীলা চোখের জল ফেলেনি কোনোদিন। ঝগড়া করেনি। কেবল দিনে দিনে আরো গভীর, শীতল, কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। সুবোধের ধরাছোঁয়ার বাইরেই চলে যাচ্ছিল নীলা। বছর চারেক আগে পেটে বাচ্চা এল তার। তখন আরো রুক্ষ আরো কঠিন দেখাল নীলাকে। হাসপাতালে যাওয়ার কয়েকদিন আগে সে খুব শান্ত গলায় একদিন সুবোধকে বলেছিল— শুনেছি মেয়ের মুখে বাপের ছাপ থাকে। আমার যেন মেয়ে হয়। সুবোধ অবাক হয়ে বলল—কেন? নীলা মৃদু হেসে বলল—তাহলে প্রমাণ থাকবে যে সে ঠিক বাপের মেয়ে। মুখের আদল তো চুরি করা যায় না। মেয়েটা বাঁচেনি। বড় রোগা দুর্বল শরীর নিয়ে জন্মেছিল। আটদিন পর মারা গেল। মুখের আদল তখনো স্পষ্ট হয়নি। কোথায় যেন একটা কাঁটা এখনো খচ করে বেঁধে সুবোধের। নীলা কথাটা যে কেন বলেছিল।

তারপর থেকেই সুবোধ জানত যে নীলা চলে যাবে। আজ কিংবা কাল। আজ কাল করে করেও বছর তিনেক কেটে গেল। খুব অশান্তি কিংবা ঝগড়াঝাটি কিছুই হয়নি তাদের মধ্যে। বাইরে শান্তই ছিল তারা। ভিতরে ভিতরে বাঁধ তুলে দিল কেবল। অবশেষে নীলা চলে গেল কাল।

সারা সকাল কাটল নির্জনতায়, ঘরের মধ্যে! একরকম ভালই লাগছিল সুবোধের। দশ বছরের উৎকণ্ঠা, বিষণ্ণতা, অস্থিরতা, রাগ—এখন আর তেমন অনুভব করা যায় না। কোনো দুঃখও বোধ করে না সে! সন্দেহ হয় নীলাকে সে কোনদিন ভালবেসেছিল কিনা। সে বুঝতে পারে না ভাল না বেসে থাকলে নীলার প্রতি ওরকম অত আগ্রহই বা তার কেন ছিল! গত দশবছরে নীলার কথা সে যত ভেবেছে তত আর কারো কথা নয়।

দুপুরের দিকে ঘরে তালা দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ল। বিয়ের আগে যেমন হঠকারি দায়িত্বহীন সুন্দর সময় সে কাটিয়েছে সেরকমই সুন্দর সময় আবার ফিরে এসেছে আজ বাধাবন্ধনহীন। মনটা ফুরফুরে রঙীন একটি রুমালের মতো উড়ছে। মাত্র ছত্রিশ বছর বয়স তার, সামনে এখনো দীর্ঘ জীবনদায়দায়িত্বহীন। তার চাকরিটা মাঝারি গোছের। উঁচু থাকের কেরানী। তাদের দুজনের মোটামুটি চলে যেত। এবার একা তার ভালই চলবে। নীলা টাকা চাইবে না বলেই মনে হয়। চাইলেও দিয়ে দেওয়া যাবে। মোটামুটি নীলার ভাবনা থেকে মুক্তিই পেয়েছে সে। এবার পুরোনো আড্ডাগুলোয় ফিরে যাওয়া যেতে পারে। এবার গ্রীষ্মে প্রতিটি ফুটবল খেলাই দেখবে সে। রাত্রে লোয়ে দেখবে সিনেমা। ছুটি পেলেই পাড়ি দেবে কাশ্মীর কিংবা হরিদ্বারে, দক্ষিণ ভারত দেখে আসবে। এবার থেকে সে মাঝেমধ্যে একটু মদ খাবে। খারাপ মেয়েমানুষদের কাছে যায়নি কোনোদিন, এবার একবার যাবে। আর দেখে আসবে ঘোড়দৌড়ের মাঠ। মুক্তি–মুক্তি—তার মন নেচে উঠল।

হোটেলে খেয়ে আর ঘরে ফিরল না সুবোধ। সিনেমায় গেল। দামী টিকিটে বাজে বই দেখে বেরিয়ে গেল কলেজ স্ট্রীটে। ঘিঞ্জি পুরোনো একটা চায়ের দোকানে আট নয় বছর আগেও তাদের জমজমাট আড্ডা ছিল। সেখানে পরপর কয়েক কাপ চা খেয়ে সন্ধ্যে কাটিয়ে দিল সুবোধ। পুরোনো বন্ধুদের কারোই দেখা পেল না। বেরিয়ে পড়ল আবার।

সন্ধ্যে সাতটা। কোথায় যাওয়া যায়!

অনেকদিন আগে সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে শখ করে মদ খেয়েছে সুবোধ। সঙ্গীছাড়া কোনোদিন খায়নি। মদের দোকানগুলোকে সে ভয় পায়। তবু আজ একটু খেতে ইচ্ছে করছিল তার। উত্তেজনার বড় অভাব বোধ করছিল সে।

বাসে ট্রামে ভিড় ছিল বলে সে হেঁটে হেঁটে এসপ্ল্যানেডে এল। অনেক মদের দোকানের আশেপাশে ঘুরে দেখল। বেশি বাতি, বেশি লোকজন, হৈ-চৈ তার পছন্দ নয়। অনেকগুলো দেখে সে গলি-খুঁজির মধ্যে একটা ছোট্ট দোকান পছন্দ করে ঢুকল। ভিতরে আলো কম, দু-চারজন লোক বসে আছে এদিক ওদিক। কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ে—আবছা আলোয় তাদের মুখ বোঝা যাচ্ছে না। মেয়েগুলোর দিকে বেশি তাকাল না সুবোধ। ফাঁকা একটা টেবিলে দেয়াল ঘেঁষে বসল। বেয়ারা এলে একসঙ্গে তিন পেগ হুইস্কির হুকুম করল সে।

বেশিক্ষণ লাগল না। অনভ্যাসের মদ তার মাথায় ঠেলা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে গুলিয়ে যায় চিন্তা ভাবনা, শরীরের মধ্যে একটা অবোধ কষ্ট হতে থাকে, পা দুটো ভারী হয়ে ঝিন ঝিন করে। এই তো বেশ নেশা হচ্ছে—ভেবে সুবোধ কাউন্টারের কাছে দাঁড়ানো একটি মেয়ের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি পরিচিতার মতো হাসে। সুবোধ হেসে তার উত্তর দেয়। পরমুহূর্তেই গ্লাসে চুমুক দিয়ে চোখ তুলে সে দেখে মেয়েটি তার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে আছে। মেয়েটি কালো, মোটা থলথলে বয়স ত্রিশের এদিক ওদিক। মেয়েটি বলে–বাব্বাঃ তেষ্টায় বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। একটু খাওয়াও তো।

কোনো কোনো বন্ধুর কাছে এদের কথা শুনেছে সুবোধ। তাই অবাক হয় না। মেয়েটির জন্যও এক পেগের হুকুম দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে—তোমার ঘর কোথায়?

–কাছেই। যাবে?

—মন্দ কী?

–তবে আরো দু পেগের কথা বলে দাও। তাড়াতাড়ি বলো। এরপর বন্ধ হয়ে যাবে।

সুবোধ আরো দু পেগের কথা বলে দিয়ে হাসল—মদ খাও কেন?–তুমি খাও কেন?

আমার বউ চলে গেছে।

-আমারও স্বামী চলে গেছে। বলেই মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে বলে–শোনো ঘরে যেতে কিন্তু ট্যাক্সি করতে হবে। হেঁটে যেতে নেশা থাকে না।

—ট্যাক্সি! হাঃ হাঃ। বলে হাসল সুবোধ। তার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। বলল—আমার বৌয়ের গল্প তোমাকে শোনাবো আজ

-খুব ছেনাল ছিল?

–না না। ছোল নয় তবে অন্যরকম—

–চলে গেল কেন?

—সেটাই তো গল্প। —ওরকম আকছার হচ্ছে। তোমার বৌয়ের দুঃখ আমি ভুলিয়ে দেবো।

—দুঃখ! বড় অবাক হল সুবোধ। দুঃখের কোনো ব্যাপারই তো নয় নীলার চলে-যাওয়াটা! তবু নেশার ঘোরে এখন তার মনটা হু-হু করে উঠল। দুঃখিত মনে সে মাথা নেড়ে বলল—হ্যাঁ খুব দুঃখের গল্প—

—কেটে যাবে। বিলটা মিটিয়ে দাও।

বিল মেটাল সুবোধ। তারপরও গোটা ত্রিশেক টাকা রইল ব্যাগে। মেয়েটা আড়চোখে দেখে বলল—তুমি কি আমার ঘরে সারারাত থাকবে?

—মন্দ কী? সুবোধ হাসল।

—ত্রিশ টাকায় হবে না কিন্তু।

—হবে না?

—হয়! বলো না, এই বাজারে…ত্রিশ টাকায় ঘণ্টা দুই, তার বেশি না।

–না। ত্রিশ টাকায় সারারাত।

—পাগল!

—তবে কেটে পড়ো। আমি কেরানীর বেশি কিছু না।

দাঁত বের করে হাসল মেয়েটি। গ্লাস নিঃশেষ করে আঁচলে মুখ মুছল। বলল—মদ খাওয়ালে, ভালবাসলে, ছাড়তে ইচ্ছে করে না।

—কেটে পড়ো।

—ঠিক আছে। চলো। ত্রিশটাকাতেই হবে। আহা, তোমার বৌ চলে গেছেনা? ঠিক আছে। চলো তো দেখি তোমার বৌ ভাল না আমি ভাল। বলতে বলতে সুবোধকে হাত ধরে টেনে তুলল মেয়েটা।

ট্যাক্সিতে সুবোধ মেয়েটির কাঁধে মাথা রেখেছিল। সস্তা প্রসাধন আর তেলের বিশ্রী গন্ধ। তবু মুখ সরিয়ে নিতে তার ইচ্ছে করছিল না। মেয়েটি ট্যাক্সিওলাকে নানা জটিল পথে নিয়ে যেতে বলছে। কথা আর কথায় বুক ভরে আসছিল সুবোধের। সে অনর্গল কথা বলছিলনীলার কথা, কাল রাতের স্বপ্নের কথা, মেজদার কথা, মরা মেয়েটার কথা। কখনো সে বলছিল সে এবার বেড়াতে যাবে হরিদ্বারে, যাবে ঘোড়দৌড়ের মাঠে, ফুটবল ম্যাচ দেখবে। একা একাই থাকবে সে। মেয়েটি কোনো কথাতেই কান দিল না। শুধু মাঝেমাঝে বলল—শুয়ে পোড় না বাপু গায়ের ওপর। পুরুষমানুষগুলো যা ন্যাতানো হয়, একটু দুঃখটুঃখ হলেই গড়িয়ে পড়ে। কথাগুলো ঠিকঠাক বুঝতে পারছিল না সুবোধ! দুঃখ! দুঃখ কিসের! মেয়েটি জানেই না তার মন রঙীন একখানা রুমালের মতো উড়ছে।

ট্যাক্সি যেখানে থামল সে জায়গাটা সুবোধ চিনল না। শুধু টের পেল গোলকধাঁধার মতো খুব জটিল প্রকাণ্ড একটা বাড়ির মধ্যে সে ঢুকে যাচ্ছে। অনেক সিঁড়ি, সরু বারান্দা, আবার সিঁড়ি বিচিত্র অচেনা লোকজন, মাতাল, বেশ্যা, ফড়ের গা ঘেঁষে মেয়েটি তাকে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে নীলার দুঃখ ভুলিয়ে দিতে। অথচ জানে না দুঃখই নেই আসলে। ভেবে সে হাসল—ভাল জায়গায় থাকো তুমি কি যেন নাম তোমার!

মেয়েটি বলল–অনিলা।

হাসল সুবোধ—চালাকী হচ্ছে?

-কেন?

—আমার বৌয়ের নাম তো নীলা।

—ওমা! তাই নাকি! বলোনি ত!

–বলিনি?

–না। মাইরী…

চালাকী হচ্ছে? অ্যাঁ।

মেয়েটি হাসে—সত্যিই আমি অনিলা। তোমার বৌয়ের উল্টো। দেখো প্রমাণ পাবে। খুব সুন্দরী ছিল তোমার বৌ? ফর্সা?

–না। কালোই। মন্দ না।

—খুব কালো?

–না। শ্যামবর্ণ। এই আমার গায়ের রঙ।

—ওমা। তুমি তো ফর্সাই!

–যাঃ–হাসল সুবোধ। লজ্জায়।

ঘরখানা ভালোই। ছিমছাম। বসতে ঘেন্না হয় না। পরিষ্কার বিছানাটাই আগে চোখে পড়ল সুবোধের। ভারী মাথা নিয়ে গড়িয়ে পড়ল। বলল–মদ খেয়ে কিছু হয় না। উত্তেজনা লাগছে না।

—আর খাবে।

–না। পয়সা নেই।

—পয়সা না থাক, ঘড়ি আংটি আছে। জমা রেখে খেতে পারো, পরে পয়সা দিয়ে ছাড়িয়ে নেবে।

-না। আর খেলে ঘুম পাবে, বমিও হবে।

—তবে থাক।

সুবোধ মেয়েটিকে অনাবৃত হতে দেখেছিল। হঠাৎ কি খেয়াল হল, জিজ্ঞেস করল—আজ কি তোমার আর খদ্দের আছে? তাড়াতাড়ি করছ কেন?

মেয়েটি হাসল—আছে। কিন্তু তাতে তোমার কি! তোমাকে আলাদা বিছানা করে ঘুম পাড়িয়ে রাখবো। তুমি টেরও পাবে না।

—পাবো না?

–না।

মেয়েটি কাছে আসে। আস্তে আস্তে উঠে বসে সুবোধ—তুমি তো অনিলা!

—হুঁ।

—দূর। তাহলে হবে না। বলে হাই তোলে সুবোধ।

–কেন?

সুবোধ উত্তর দেয় না! অন্যমনস্ক চোখে চেয়ে থাকে। নীলা! নীলা এখন কোথায়। তার মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। পৃথিবীময় লক্ষ লক্ষ পুরুষ। তার। মধ্যে নীলা একা কোথায় চলে গেল? কী করছে এখন নীলা?

মেয়েটি বলে—আমার দিকে তাকাও। দেখ না আমাকে।

সুবোধ গরুর মতো নিরীহ চোখে তাকায়। হাসে। বলে—দূর। তোমার দ্বারা হবে না।

-কেন?

-তুমি তো পরিষ্কার মেয়ে। কিছু লুকোনো নেই তোমার। তোমাকে একটুও সন্দেহ হয় না।

বাঃ। তা তুমি চাও কি? সন্দেহ করতে। বলতে বলতে সে সুবোধ। হেসে চোখ ফিরিয়ে নেয়।

কুমারী মাটি – পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

সতীর ডাঙার বৃত্তান্ত :

এক বিস্তীর্ণ অনাবাদী প্রান্তর। রুক্ষ পাথুরে ভূমি। কোনও অতীত সভ্যতার ধ্বংসস্তূপ। গোছে। সেখানে সূর্যের আলো ঝলকায়। বর্ষার জলে উদোম বুক ঠায় ভেজে। দুরে পলাশের জঙ্গল ঋতুকালে অগ্নিবর্ণ হয়। সতীর ডাঙায় তথাপি ছিটেফোঁটা সবুজের বিস্তার ঘটে না।

জ্ঞান হওয়া ইস্তক সতীর ডাঙার এই চিত্রটা দেখে আসছে মন্মথ। সময় এসে তো কবারই ভাঙচুর করে দিয়ে গেছে জীবনের জ্যামিতি, সতীর ডাঙা তবু বদলায়নি। দুরে দুরে বসতি গড়ে উঠেছে। তাদের গ্রাম বাজেনীলপুর। কয়েকশো দেহাতি মানুষের ভিড়ে গ্রাম জমজমাট। প্রতি বছরই অঘ্রাণের বাতাসে যখন করাতের। ধার ফোটে, তখন এক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ রাত্তিরে একদল মানুষ জমায়েত হয় সতীর ডাঙায়। মেলা বসে। সতীমায়ের পুজো হয়। হোম-যজ্ঞবলিদান কত কী হয়! ও এক মহাধন্দের ব্যাপার। সতী মা না মেয়ে? কেউ বলে, অঘোর চাটুজ্জের সধবা মেয়ে সতী একটা ছেলের কামনায় আজীবন অপেক্ষা করে শেষ-মেশ পাথরে মাথা ঠুকে মরেছিল। আর কেউ বলে, সতীর আসলে বিয়েই হয়নি। বিয়ে না করেই গর্ভধারণের লোভ হয়েছিল মেয়েটার। কী সাংঘাতিক আদিখ্যেতা! কুকর্মের বোমা ধরিত্রী বহন করেননি। এই ডাঙাতেই মা মনসার বিষে মরণ হয়েছিল তার। আসলে, মনে পাপ ঢুকেছিল যে! সেই পাপে আজও সতীর ডাঙায় শস্য ফলে না। ইত্যাকার নানা কিংবদন্তী এলাকার বাতাসে ঘুরছে। তাই অঘ্রাণের শেষ অমাবস্যায় সতীর নামে উৎসব। পুজো, মেলা, জনসমাগম সবই হয়। বাজেনীলপুরের মানুষজন বচ্ছরকার দিনে সেখানে ভিড় করে।

সতীর ডাঙায় এখন অপর এক জনসমাবেশের প্রস্তুতি চলছে। কদিন পরেই মন্ত্রী আসবেন, সঙ্গে বি.ডিও সায়েব। সামিয়ানার নিচে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করবেন ওঁরা। এর আগেও অনেকবার সরকারি গাড়ি এসেছিল। মাটি পরীক্ষা হয়েছে। মেশিন বসিয়ে তেল খোঁজাখুঁজি হয়েছে। লোকজন ছুটে গিয়ে ভিড় করেছিল। সেসব দৃশ্য দেখতে। ইদানীং মন্ত্রী আসার খবরটা এলাকায় মুখে-মুখে ফিরছে। বাজেনীলপুরের ধস খাওয়া। স্কুলের উন্নতির বিষয়টিও এই প্রসঙ্গে জড়িত। এখন মন্মথর ওপরে একটা বড় কাজের। দায়িত্ব চেপেছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে পাড়ায়-পাড়ায় গিয়ে চাঁদা আদায় করছে সে। তাই ওর ব্যস্ততা তুঙ্গে। আপ্যায়নের খরচও তো বড় কম নয়। স্কুলের ব্যাপারে সরকারি সাহায্য আর সেই সঙ্গে সতীর ডাঙায় হাসপাতাল তৈরির সুপারিশ নিয়ে স্থানীয় মানুষের জমায়েত হওয়ার সমস্ত পরিকল্পনা তৈরি। মন্ত্রী আসার দিনক্ষণও ঠিক। বাজেনীলপুরের মানুষরা তাই এখন প্রহর গুনছে। কেউ কেউ মন্মথকে সামনে পেয়ে ধাঁ করে জিজ্ঞেসও করে বসছে—হ্যাঁ গো, মন্ত্রী ঠিক আসবে তো?

মন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত ভাষণ

আজ আমরা আপনাদের এলাকায় এসে এখানকার প্রত্যেকটি মানুষের অপরিসীম আন্তরিকতায় সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। ভাবতে ভালো লাগছে যে, আদর্শ গ্রাম গড়ার শপথ নিয়ে আপনারা এগিয়ে এসেছেন। স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সমৃদ্ধিই আমাদের স্বপ্ন, সার্বিক উন্নতিই আমাদের লক্ষ্য। দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো মজবুত করার জন্যে প্রয়োজন যথার্থ গ্রামীণ বিকাশ। সেটাই উন্নত্রি সূচনা। আপনাদের স্কুলটির অবস্থা আমি দেখেছি। নিদারুণ দৈন্যদশায় জর্জরিত। এই স্কুলটির উন্নতির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সরকারি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আমি আপনাদের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া, আর একটি উৎসাহব্যঞ্জক খবর হল, সতীর ডাঙা নামের এই অনাবাদী জমি নিয়ে সরকারি চিন্তাভাবনা ফলপ্রসূ হতে চলেছে। উন্নতমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে এখানে একটি সরকারি কৃষিখামার গড়ে তোলা হবে। বিভিন্ন দপ্তরের সিদ্ধান্তসাপেক্ষেই এই অনুমোদন। খুব অল্পদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে এর কাজে। অনাবাদী, অচ্ছুৎ হিসেবে পরিত্যক্ত এই জমিতে একদিন বুজের বিপ্লব আসবেই। এটা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক যে, সরকারি কৃষিখামার তৈরি হলে এই এলাকার অধিকাংশ কৃষিমজুরই সারাবছরের কর্মসংস্থানের সুযোগ করতে পারবেন। আপনারা এগিয়ে আসুন এই কর্মযজ্ঞে। শ্রম দিয়ে, সহযোগিতা দিয়ে, নিষ্ঠা দিয়ে এই মহৎ উদ্দেশ্যকে সার্থক করুন।

মন্মথ-সুভদ্রার দাম্পত্য জীবন

মন্মথর বিয়ে হয়েছে সাত বছর। যে পুরুষালি চেহারার একটা আলাদা দম্ভ থাকে, মন্মথ সেদিক থেকে ত্রুটিযুক্ত। গলার স্বরে কেমন যেন নরমভাব। অনেকসময় ইনিয়ে-বিনিয়ে ন্যাকা-ন্যাকা সুরে কথা বলে। তবু বেশ করিকর্মা। সতীর ডাঙার প্রসঙ্গ নিয়ে মন্ত্রী এবং বিডিও সায়েবের ভাষণ সে একেবারে গিলে খেয়েছে। এরপর হয়তো সরকারি মহলের আরও লোকজন আসবে। কত যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম আসবে। কৃষিখামার তৈরি হলে পাথুরে অজন্মা জমিতে জেগে উঠবে প্রাণের জোয়ার। সে-মাটি সোনা হবে।

মন্মথ বি.এ. পাশ। একটা চাকরিও করে। স্বামী হিসেবে সুভদ্রার কাছে আস্থাবানও। সুভদ্রার বাবা পৃথিবীর দরিদ্রতম মানুষগুলির একজন। স্কুলে পড়ার সময়েই সুভদ্রার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুরবাড়ি আসার দিন থেকেই দু’মানুষের এই সংসারে সে সর্বেসর্বা।

ঝাঁ-ঝাঁ রোদ্দুর মাথায় নিয়ে মন্মথ বাড়িতে ঢুকল। এখন শুখার মরশুম, বাতাসে আগুনের হলকা। তেষ্টায় গলা ফাটছে মন্মথর। জল দেওয়ার একান্ত মানুষটি ঘরে নেই। সুভদ্রা ফিরল একটু পরে, মন্মথকে বসে থাকতে দেখে বিড়ম্বিত গলায় জিজ্ঞেস করল কখন এলে?

–এসেছি তো অনেকক্ষণ। এক গেলাস জল—তাও হাতের কাছে পাই না।

—ঘরে কি জলের আকাল? নিয়ে খেলেই তো পারতে!

—তার চেয়ে বলো, রান্নাটাও না হয় নিজেই করে খাই। আর তুমি পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াও। এমন সংসারের মাথায় কাটা মারি।

—চেঁচিও না তো! আমি কখন পাড়ায়-পাড়ায় ঘুরে বেড়ালাম? দিনান্তে একবারও বুঝি বাইরে যাওয়ার জো নেই! এই সবে একবার কুন্তলাদির বাড়িতে পা দিয়েছি কী দিইনি, এদিকে মহাপুরুষের রাগ মাথায় উঠেছে।

সুভদ্রার দেওয়া জল শেষ করে মন্মথ আগুন-চোখে তাকাল—ফের তুমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলে? ওই প্রফুল্লদের বাড়িতে ঢুকতে নিষেধ করিনি আমি?

–কুন্তলাদি ভালবাসে, যেতে বলে, তাই যাই।

–সবসময় কুন্তলাদি, কুন্তলাদি করে হাঁফিও না তো! সেদিন তোমার ওই কুন্তলাদিকে বিধবা করে ছাড়তাম। তাতে জেল, পুলিশ যা হওয়ার হত। আমার প্রতিবেশী হয়ে আবার আমারই নামে মামলা করবে বলেছে! প্রফুর স্বভাব-চরিত্র জানো?

জানে সুভদ্রা। কুন্তলাদির স্বামী মদ খায়। খারাপ জায়গায় যায়। কোনও কোনওদিন রাত্তিরে বাড়িও ঢোকে না। বদ লোকের সঙ্গে মেশে। তার জন্যে। কুলাদির অবশ্য কোনওরকম অভিযোগ নেই। প্রফুল্প রেশনের ডিলারশিপ নিয়ে দিনদিন পয়সায় একেবারে কেঁপে ফুলে উঠছে। চারিদিকে যখন চালের আকাল তখন সে জানিয়ে দিল দিনের দিন রেশন না তুললে পরের দিন আর পাওয়া যাবে না। গরিব-গুর্বো মানুষগুলো ঠিকসময়ে পয়সা যোগাড় করতে পারে না। তাতে প্রচুর লাভ যোলো আনা। রেশনের চাল বেশি দামে বিক্রি করে ফয়দা তুলেছে সেসময়টায়। সেই নিয়ে মন্মথর সঙ্গে একদিন হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। লক্ষ্মীর ফসল খুঁটে খুঁটে যে দুখবর্ণ চাল বেরোয় তা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা! কিন্তু কুন্তলা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পুরুষের বিবাদ পুরুষদের মধ্যেই থাকুক। তাই কুশুলাদির কাছে যায় সুভদ্রা। অথচ মন্মথ বারণ করে, প্রফুর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে সাবধান করে দেয়। সুভদ্রা শাদা-মাটা। গলায় বলে জানি। সেইজন্যেই বুঝি ওদের বাড়িতে গেলে তোমার ভয় হয় গাছে কুন্তলাদির স্বামীর কুনজর পড়ে আমার ওপরে! তা, হওয়াটাই স্বাভাবিক। তোমার মতো একজন বিচক্ষণ পুরুষের মাথায় এরকম চিন্তা তো সবার আগে আসবে। আহা, ভাবনাচিন্তাটুকু যদি সাতবছর আগে করতে! কেন যে তখন বিয়ে করার শখ হয়েছিল!

–সুভদ্রা, তুমি খুব অসুখী, তাই না! মন্মথর গলা হঠাই খাদে নেমে গেল। হাসল সুভদ্রা, অথচ হাসিটুকু একেবারেই নিষ্প্রভ, বলল—অসুখী কেন? দুঃখের বোঝায় চাপাপড়া এক কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণকে তুমি উদ্ধার করেছিলে, এবড় মনুষ্যত্ব কজনের আছে! …..কুন্তলাদির বাড়িতে যাওয়া নিয়ে অনেকবার অশান্তি করেছ, নানসন্দেহ করেছ, আজও করছ। বু আমি কথা শুনি না। কেন জানো? কুন্তলাদির ওই ফুটফুটে ছেলেটা আমাকে বড় চিনেছে, তাই না গিয়ে থাকতে পারি না।

এরকম পারিবারিক অশান্তি গত সাবছরে অনেকবার হয়েছে। তা সত্ত্বেও মিলজুল করে দিব্যি কেটে যাচ্ছে ওদের দাম্পত্যজীবন। মন্মথর রক্তে এক ধরনের সন্দেহপ্রবণতা আজন্ম প্রতিপালিত। অথচ, সুভদ্রা সাময়িক রাগারাগি, অশান্তি করলেও পরক্ষণেই জুড়িয়ে যায়।

একই সংসারের মধ্যে পরস্পরের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ থাকলে অস্বস্তি বাড়ে। সেই পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্যে একসময় সুভদ্রাই বলল-যাদের পিছুটান থাকে না তারা মাঝে মাঝে বাইরে বেড়াতে যায়, তাহলে মনটাও হাকা হয়।

–যাবে? চলল, দিনকয়েক না হয় কোথাও চলে যাই। মন্মথ ঠাণ্ডগলায় বলল।

-–থাক, ওকথা অনেকবার শুনিয়েছ, কান পচে গেছে আমার।

–সত্যি বলছি। আমারও খুব একঘেয়ে লাগে। চলো, সামনের মাসে দেওঘর থেকে ঘুরে আসি। জায়গাটা ভালো। স্বাস্থ্যকরও।

সারাদিন ওদের সংসারে যে গুমোট আবহাওয়া চলছিল, একসময় সেখানে ঠাণ্ডা বাতাস বইতে শুরু করে। সুভদ্রার চুলে বিলি কাটছে মন্মথ। তার সোহাগ চুল থেকে মুখে। গালে। ঠোঁটে। সুভদ্রার মাংসল শরীরের উত্তাপে তৃপ্তি পাচ্ছে মন্মথ। তার যুবতী বউ এই আদরটুকু পেয়েই পরম শান্তিতে চোখ বুজে আছে।

.

একটি নিঃসংকোচ স্বীকারোক্তি

প্রফুল্ল জরুরি কাজে বাইরে গেছে। রাত্তিরে ফিরবে না। কুন্তলা বাড়িতে একা। ছেলেটা সন্ধে থেকেই কাদছে। কী হয়েছে কে জানে, কিছুক্ষণ থামে তো আবার কাঁদে।

কুন্তলা একসময় ভীষণ ভয় পেয়ে সুভদ্রাকে ডাকল—একবার এসো ভাই, : কেন যে ছেলেটা কাঁদছে জানি না, তোমাকে দেখলে যদি থামে।

মন্মথ বাড়িতে নেই। সতীর ডাঙায় গেছে। সেখানে এখন সারি সারি তাবু পড়েছে। লোকজনের ভিড়ে এলাকা জমজমাট। পাথুরে জমির ওপরকার কঠিন আস্তরণ সরিয়ে ফেলে সুপ্ত প্রাণের সন্ধানে শুরু হয়ে গেছে বিরাট কর্মজ্ঞ। সারারাত্তির আলো জ্বলে। বাজেনীলপুরের প্রচ্ছন্ন বেকার মানুষগুলো সেখানে ঠিকে কাজ পেয়েছে। কুমারী মাটির গর্ভে নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি।

সুভদ্রা এল। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দূরের আলো দেখাল, আকাশের চাঁদ দেখাল। গুনগুন করে গান শুনিয়ে ভোলাতে চাইল শিশুকে। কুন্তলা অসহায়ভাবে বলল-পেটে লাগছেনা তো?

—আমিও সেটাই ভাবছি। অম্বল হতে পারে। কী দুধ খাইয়েছিলেন দিদি?

—কৌটোর। ওর বাবা বাড়িতে নেই, আমি তো ভয়ে আধমরা হয়ে আছি। বাড়িতে একা থাকলে কার না ভয় করে!

অনেকক্ষণ পরে ছেলেটা ঘুমোল। সুভদ্রা বলল—আপনি বিছানা করে দিন, আমি শুইয়ে দিচ্ছি। বাচ্চাদের কিছু হলেই জ্বালা, মুখে বলতে পারে না।

কুন্তলা আপ্লুতস্বরে বলল—ছেলেটা আগের জন্মে তোমার কে ছিল কে জান! কেবল তোমাকেই চিনেছে, আমি শুধু গর্ভেই ধরেছি।

সুভদ্রা চুপ করে আছে।

–এবার তোমার কোলে একটা আসুক সুভদ্রা। অনেকদিন তো হল, এমন কোলশূন্য মানায় না।

বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুভদ্রা-ভগবান তো সে ভাগ্য দেননি দিদি।

—ছিঃ, অমন কথা বলতে নেই। মা ষষ্ঠীকে ডাকো, ঠিকই হবে। ডাক্তার টাক্তার দেখাচ্ছে না কেন?

—দেখিয়েও কোনও লাভ নেই। আনমনে বলল সুভদ্রা।

—তাই কি হয়! এখন কতরকম চিকিৎসা বেরিয়েছে, কাগজে পড়ো না!

–বললাম তো দিদি, কোনও চিকিৎসাই আমার কিছু করতে পারবে না। সাধ্য মানুষেরও নেই, ভগবানেরও নেই।

এবার কুন্তলার অবাক হওয়ার পালা–তার মানে?

সুভদ্রা যেন হঠাৎ দমে গেল, তারপর স্বীকারোক্তি করার মতো বলে ফেলে লোকটা আসলে

একমুহূর্তের জন্যে ঘরের মধ্যে থমকানো পরিবেশ। কুন্তলার মাথা ঘুরছে, নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু কোনওরকমে বলল—এতদিন ধরে…

—সেই ফুলশয্যার রাত্তিরেই আমি জেনেছি, তবু আমরা সুখী, বিশ্বাস করুন। সুভদ্রার গলার স্বর ভীষণ স্পষ্ট আর ধারালো, কোনওরকম আড়ষ্টতা নেই সেখানে। কুন্তলার লু ভাবতে অবাক লাগছিল। তার মনে হচ্ছিল, সুভদ্রা যেন ভাসছে। তীব্র কামনার প্লাবনে সেই ভরা যুবতী এখন নিঃশব্দে ভেসে বেড়াচ্ছে।

কুয়োতলার কাব্য – অশোককুমার কুণ্ডু

বর্ষা এসেছে তিলুর উঠোনে। চোইত বোশেখের পোড়ামাটিতে আজই প্রথম বর্ষার এক ঝট। গন্ধ উঠেছিলো মাটির! আকাশটা তেমন জমেনি। প্রথম বর্ষা তো, কিছুটা কুমারী মেয়ের মন, দাঁড়ালো না। এসেছিলো, চলে গেল, উঁকি দিলো, সবটা দেখা গেল না।

বুও দুকুঠরী ঘরের পশ্চিম মটকার কোণের আকাশ যেন ধান সিজোনো হাঁড়ির কালো মুখ, মিশকালো। যেন মরা বিকেলে আবার নামবে। এই এলো, আবার গোটাও পাততাড়ি, গোয়ালের গরু সামলাও, খামার থেকে তুলে আনো বন্দিনী তিলের শুটি, মাকাই ও সরষের বীজ, রোদ খেতে দেওয়া ঋতুমতী গমের বীজদের। হাওয়া বইলো দমকা মেরে। গাছের ডালে ডালে পাতায় পাতায় গা ঘষাঘষি, ঠেকাঠেকি, অনেকদিন প্র যেন প্রাণখোলা প্রতিবেশী।

এই কদিন দেখতে দেখতে শেষ আষাঢ়ের আরও পাঁচটা দিন গেল। তিলুর ক্যালেণ্ডার বলতে একটি তালপাতা। সে তালপাতায় আছে গোয়ালার গুণ-ছুঁচের হিসাবে দাগ। পাচদিন হলো মনে মনে হিসেব করলো তিলু, কেননা এই পাঁচদিন হয়েছে, কালো গাই-গরুটা ডাকছে। মাঠ দেখানোর সময়। এ সময় এই প্রথম ডাক পার হলে বড় মুশকিল, অথচ এই গরুটা তিলুর বাপের বাড়ির সামগ্রী। বিয়ের পরই দেওয়া, তিলুর বাচ্চা দুধ খাবে।

এই পাঁচদিন তিলুর ভিতরে কোথাও মেঘ জমেছে? কোথাও কি বর্ষার পায়চারি কিংবা কোথাও বেড়ার পাশে অযত্নে বেড়ে ওঠা আগাম মেহদী ফুলের গন্ধ? তিলু সামান্য নাড়া খেয়েছে, ঐ যে কথায় বলে, আগুনের কাছে ঘি থাকলে গলবেই গলবে।

দুপুরে প্রথম জলের আগেই হুটোপাটি করে সংসারের জিনিসপত্র ভোলাতুলির সময় পেজালি বসেছিলো উঠোনে, ভাতঘুম থেকে ওঠার পর তিলু দেখলো সেইসব পেঁজালিগুলি মুছে গেছে প্রায়। গাই গরুটাকে দেখতে ভূষণ আসবে, আজকে চারদিনের ওষুধ শেষ হয়েছে। গরুটাও দস্যি, বলিহারি যাও! খোঁটার দড়ি ছিঁড়ে লড়াই করে ডাইরে শিং ভেঙে, ও একবারে রক্তের কন্যা। তারপর এই ডাক। বিপদের উপর আরও এক গেরো। এই সব ঘরগেরোস্তো, শ্বশুরবাড়ি, কাঠ কয়লার গনগনে আগুনের মত জা মায়া, আর তার বড় ছেলে, তিলুর বড় ন্যাওটা। এই সব পাঁচমিশেলি ভাবনায় তিলুর মন আজ আনচান। ভূষণ আসবে বিকেলে। ভূষণ এসেছিলো ফিরে লক্ষ্মীবার। সেই মানুষটার কোনো খবর নাই বহুদিন।

খিড়কির পশ্চিমপাড়ে তালগাছ একপায়ে সব কথায় সাক্ষী। পাশের যে পাতাটা ঝুলে পড়েছে সেটায় বাবুই পাখিদের দিনের শেষবেলাকার আলোয় কিছু মজলিশি নালিশ। সেদিকে তাকাল তিলু। ভূষণ কবরেজ আসছে না কেন? শাশুড়ী গেছে পাড়া বেড়াতে। এখুনি এই নাগাদ সন্ধ্যের ফিরবে। ঐ মানুষটার কথার ভাষ্যি নেই। গাছপালার শিকড়কড় খুঁজতে খুঁজতে মাথার মধ্যে কথা শিকড় হয়ে গেছে না হলে আজ এত দেরি? জানে ধ্ব, অথচ কী করছে কে জানে, হয়তো ভুলে মেরে দিয়েছে। নয়তো অন্য গায়ে কোনো খেত আকন্দের ফুলের সন্ধান পেয়েছে। লাছদুয়ারে এসে মুখ বাড়াল তিলু।

ভাঁড়ার ঘরের পাশে ঝিটচালের পাঁচিল অনেকটা পড়ে গেছে। ওখানে এই বর্ষার গন্ধে গজাবে কিছু লতাগুল্ম, বর্ষার স্পর্শে শিহরিত হবে। আর ওদিকে পুকুরের পাড়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা বৈচি গাছে সবুজ ফল ধরেছে। এ কদিনে তিলুর মধ্যে বেড়ে উঠেছে একটি গাছ নিতান্তই অবহেলায়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো শাশুড়ীর ঘোড় দৌড়। বেড়ার পাশে ঝিঙে ফুলের হলুদ রঙ। শাশুড়ী বেড়ার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বললো, ঝিঙে ফুলে বেলা মরলো, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না দেখছো, জল আনতে আমি এই বুড়ো বয়সে যাই, ঠ্যাঙ হাত ছড়িয়ে ভোগ করো তোমরা, আমি মরে গেলে। তিলু নীরব। সরব হয় অন্তরের অন্তরীক্ষে। মাটির দেওয়ালে লাগানো ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখে তিলু।

জা বাপের ঘর গেছে সংসারের ভার ছেড়ে দিয়ে, ভাঁড়ারের চাবি নিয়ে। তিলু এ সংসারে বড় অবৈধ। ভাঁড়ারের চাবি নিয়ে যাওয়াটা এই প্রথম। মানুষকে অবিশ্বাস করলে মানুষ বড় কাঁদে। তিলুর বোধহয় কান্নাও শুকিয়ে গেছে। বস্তুত আজকাল সে আর কাঁদে না। মুখে একটা মৃত হাসি জিইয়ে রেখে আজ দিন পাঁচেক সে কিছুটা আলাদা। গাঁয়ের বৌদের যেখানটায় খুটি সেখানটায় তিলু আশ্রয়হীন। অথচ দোষ তার কোথায়? এতদিন এই তিন বছরে বিয়ের পর, সে হিসেব করে দেখল প্রথম কমাসের জন্যে আলোকিত অধ্যায়। তারপর সামান্য কথা কাটাকাটি এবং হারাধনের গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া। চলে যাবার পর তিল ভেবেছিলো ওটা সাবেকী ঢঙ, সব পুরুষ মানুষেরই যেমন। তার শাশুড়ীর তিলুকে বাপের বাড়ি পাঠানো। তারপর ঐ রকম সময়টুকুর জন্যে হঠাৎ আবির্ভাব। কোথাও ছিলো না এমন লেখা। তিল যখন বাপের বাড়িতে পাঁচদিন কাটালো, ভেবেছিলো হারাধন নোক পাঠাবে কিংবা নিজে আসবে। তখন সে হারাধনের হাত ধরে আবার ফিরে আসবে এখানে। হয়নি। সেই মিথ্যে অভিমান প্রসব করেছে এক বঞ্চনা। লোকে বলে হারাধন নাকি ফিরবে এ ভিটেয়, তিলু মরার। অন্তত শাশুড়ীর তাই রটানো খবর। এক একবার শাশুড়ীর মুখের দিকে তাকিয়ে সে কেঁদেছে। তারপরে শাশুড়ীর মুখঝামটায় সমস্ত দুঃখের খবরগুলো বাসি হয়ে গেছে।

না না বেলা যাচ্ছে। আষাঢ়ের অহর প্রহর দীর্ঘ বেলারও মৃত্যু হয়। গাছের মল সহনশীলা তিলু চঞ্চল! সমস্ত ঘটনার কারণ হিসেবে প্রথম প্রথম সে নিজেকে দোষী করত, তারপর কপালকে মন্দ বলত। আজকাল তিলু অন্য কিছু ভাবছে।

কলসী আর দড়ি নিলো তিলু, জলকে যাবে। তার আগে মোড়ল পুকুরে গা ধোবে, সেখান থেকেই চলে যাবে কুয়োতলায়। নিখেপ জল আনা চাই। এখন ঘরের আর তেমন কোনো কাজ নাই। সন্ধ্যে দেখাশোনাটা শাশুড়ী করে নেবে। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখল জায়ের ছেলে খেলে ফিরছে। এই বাচ্চাটাই তিলুর বুকে শিকড় গেড়েছে মামার বাড়ি যায়নি মার সঙ্গে। জ্যাঠাইমার ন্যাওটা। হারে রঙীন কাঁচের গুলি দেখিয়ে বলল, চারটে পেয়েছি আজকে। তাড়াতাড়ি ঘরে আয় জ্যাঠাই।

তিলু হাসল। এই বালক তাকে বন্দী করেছে। তিলু বলে, ঠাকমা রেগে গেছে, চুপচাপ খেয়ে নিয়ে পড়তে বসে যাবি, আমার আজ লিখেপ। যাবো কি আসবো।

ঘাটে মানুষ আসার সময় পার হয়ে গেছে। তিলুর দেরি হয়েছে আজ অকারণে। কোন কারণ ছিল না দেরির। ঘাটের ঝামার উপর কলসী নামিয়ে কাপড় আজাড়ে গামছা পরার আগে কলসী মাজল। জলে নামল ধীর পায়ে। জলে আয়নায় তিলুর মুখ টলছে। সেই টলা মুখ দেখে সামান্য মজা পেল। এই মরা বেলায় জিয়ল মাছ ফুট কাটছে। জলে দাঁড়ানো বাঁশের উপর এক শাদা বক শান্ত পূজারীর মতো নিথর। চুনো মাছ ভাসলেই ধারালো ঠোঁটে আক্রমণ।

দীর্ঘকায় পাকুড় গাছ ছায়া ফেলেছে। আজ কেমন থমথমে লাগছে। তবে কি সবাই গন্ধ পেয়েছে তিলুর মহোৎসবের? তিলু স্বপক্ষে কিছু যুক্তি খাড়া করল। এতদিনে নিজেকে দোষ দেওয়া তারপর কপাল ধিয়ানো। আজ তিলু এক বলিষ্ঠ যুক্তি খাড়া করেছে। মানুষ শুধু মরতে বলে, সব ত্যাগ করতে বলে, ভালো হতে বলে। বদলে কেউ দেবার জন্যে হাত বাড়ায় না। এই দু’বছর সে হারাধনের অপেক্ষায়। সাত গাঁয়ে রটে গেল তিলু সতীলক্ষ্মী। কেউতো কই একদিনও সময় করে গেল না হারাধনের খোঁজ আনতে। তিলুর এই সুনাম আজ পচা কাসুন্দীর মতো লাগছে। ও যেন ছিড়তে চাইছে, ভাঙতে চাইছে ভিতরে ভিতরে কিছু। জলে ঢেউ দিল। গারে ছায়া ভাঙল, তিলুর মুখ হারাল, তিলু ডুব দিল। জল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভূত দেখল। জলে নামার সময় পুর্ব কোণায় কিছু গাছ নড়ছিল, ভেবেছিল ছাগল টাগল হবে। দেখল যা, তাতে অবাক হবার থেকেও বেশি কিছু। ভূষণ কবরেজ এই তিন সন্ধ্যেবেলায় কোন গাছের শিকড় তুলছে। হাতে ছোট কুড়ুল আর কোমরে বাঁধা তালপাতার থলি। মুখ তুলে ঘাটের দিকে তাকিয়ে ভূষণের মাথা ঝিমঝিম করছিল। ভূষণ ভুলে গেছে, ভুলে গেছে তিলুদের গরুর কথা। ভুলে গেছে আজ যাবার কথা। এই গাছ-পাগলা ভূষণ কবরেজ কিছুটা দোষীর মতন কুড়ুল আর গোটা গাছটা সমেত এগিয়ে আসছে ঘাটের দিকে। তিলু সাত তাড়াতাড়ি করে ভিজে গামছার ওপর কাপড় জড়াল।

তিন সন্ধ্যেবেলায় মোড়লপাড়া থেকে শাঁখ বাজল। পাকুড় গাস্ত্রে কোটর থেকে লক্ষ্মীপেঁচা বার হয়ে প্রথম সাঁঝে ডাক দিয়ে উড়ে গেল।

.

—ভাত কি দেয় ভাতারে, ভাত দেয় গতরে।

ঠক করে পিতলের কলসী কুয়োতলার চটা-ওঠা সিমেন্টের মেঝেতে নামিয়ে পারুল বললে। কে জানে কী কারণে ও আজ মুড়ি-ভাজা খোলার মতন তেতে আছে। কুয়োতলায় যারা ছিল তারা বেশি গা করল না পারুলের কথায়, জানে ওকে নষ্ট মেয়ে বলেই।

পারুল ও গাঁয়ের ঠোঁটকাটা। বিয়ের দু’বছর ঘোরার পর চার মাসের ছেলে কোলে গাঁয়ে ফিরে এসেছিল। স্বামীর মারধর, আইবুড়ো দেওরের হাত ধরে টানা, পারুলের একদম পোষায়নি। ভাইরা খুশী হয়নি। বড়দার বৌ তো উঠতে বসতে খোঁটা দিত। পারুল দাদাদের কাছে সামান্য ভিটে চেয়ে নেয়। তারপর ওর সঙ্গে জুটে যায় সহদেব। এধারের মাটি ওধার করে পারুল কপাল ফিরিয়েছে। ওর পিতলের কলসীতে বিকেলের আলো ঠিকরে পড়ছে। এখন পারুলের অবস্থা ফিরছে তরতর করে। ওসব কথা পারুলের সাজে, পারুলের মানায়। এখন ওর দাদারাই অভাবে পারুলের কাছে হাত পাতে।

বিকেলবেলায় গাঁয়ের কোনো কুয়োতলায় দাঁড়ালে এইরকম দৃশ্য। এ সময়টাই বৌঝিদের সংসার জীবন থেকে কিছুটা মুক্তি, খবরের আদান-প্রদান। রটনা-ঘটনা।

এ গাঁয়ে কুয়ো বলতে একটাই। অন্য দুটোর জল তেমন ভালো নয়। একটার পাড় চুইয়ে পুকুরের জল ঢোকে। অন্যটায় লক্ষ্মী ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, তাই সে জল আর কেউ নেয় না। এ কুয়োর বয়েস কেউ জানে না। যারা জানতো তারা মরে গেছে। যারা জানে তারা ঠিক-বেঠিক মিশিয়ে জানে।

সেই কবে লালমুখো সাহেবের বন্দুক নিয়ে কাছার পাড়ে পাখি-মারা, তারপর কী একটা কাগজে লিখে টিপসই। তারপর কুয়ো। কুয়োর কপিকল বার কয়েক বদলেছে। মাথার উপর পাতানো কাঠ দেখলে মালুম হবে কাঠটা কত পুরনো দিনের সাক্ষী। গায়ে তার, অসংখ্য দড়ির দাগ। সবাই বলে, এ কুয়ো পীরের থানের বলেই এর জল এত ভালো। কুয়োর থামের পাশে লেখা ‘এলাহি, ভরসা, মিস্ত্রী সেখ কাবাতুল্লা, সাকিন রসুলপুর।’ ‘সন’ কথাটার পর থেকে চটা উঠে গেছে। কুয়োয় গোল মেঝের উপর সিমেন্টের চিহ্ন নেই। বৌ-ঝিদের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে সেও অনেকটা দুঃখী মানুষের মতো সহনশীল ও নিথর।

সারি সারি কলসী বসেছে কুয়োতলায়, হরেক রকমের কলসী। কোনোটা ঝকঝকে, কোননোটার গায়ে পড়েছে সময়ের ময়লা, কোনোটার কানা বাঁকা। কোথাও কোনোটার গা বেড়ানো, অতীত দিনের অসাবধানতায় পড়ে টাল খেয়ে যাওয়া, নয়তো কোনো অত্যাচারের কাহিনী। এরই মধ্যে বেমানান মাটির কলসী। কলসী দেখ আর কলসীর মালিককে দেখ! ঠিক আটকাল করতে পারবে কলসীর সঙ্গে মানুষের কত যোগ। কে কেমন, তার কলসী কেমন? যে কেমন কলসী তার তেমনি। কুয়োতলায় কলসীই মানুষদের মুখের কথা বলে।

মনসারামের বৌ কলসীবালতি-দড়ি নিয়ে হাজির হয়। সুখী-সুখী মুখ। এখনও একবছর পুরো হয়নি বিয়ের। মনসা এই একটু আগে বেরিয়ে গেল কুয়োতর রাস্তার পাশ দিয়ে। যাচ্ছে কালীপুর মোকামে। সাইকেলের ফ্রেমে বাঁধা কাপড়ের পাড়। বিয়ের যৌতুক। মনসারামের সাইকেলের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে পথের বাঁকে।

হারুর পিসি ফুট কাটল বালতিতে গিট মারতে মারতে মনসার বৌ-এর দিকে তাকিয়ে। ‘হ্যাঁ লো লাতবৌ আজকাল কি সাইকেল চেপে জল আনতে এসিস? লাতি গেল এই দেখানু’ মনসার বৌ হাসি লুকোয়।

–দিদিমা, আমার একটু তাড়া আছে। আমায় একটু আগে জল তুলতে দাও।

—তাতো বটেই। লাতি কি এখুনি ফিরে পড়বে? সাঁঝ পহরেই শুয়ে পড়বি নাকি?

ফুলীমামী রশিতে টান দিতে দিতে যোগ করল কথার পিঠে কথা, ছেলে, ছেলো, আমাদেরও রঙের গা ছেলো বয়েসকালে।

তিলু মার খেয়েছে বেদম, গেল-মঙ্গলবারে শাশুড়ীর হাতে। এ আর নতুন খবর কী? কিন্তু মারের কারণ শুনে হাঁ হয়ে গেল দু এক জনা। তিলু নাকি ভূষণের সঙ্গে আছে। কুয়োতলার অনেকেই তিলুর হয়ে গাইল। কেউ দজ্জাল শাশুড়ীর কথা। উড়িয়ে দিল, কেননা তিলুর শাশুড়ী মিথ্যে খবর রটানোতে একবারে জাঁহাবাজ।

মনসার বৌ কথাটা শুনে গেল। গাঁয়ের মধ্যে আপাতত ওরা সুখী-জোড়। রতির মার কথায়, যেমন হাঁড়ি তেমনি সরা। ভগমানের মিলিয়ে রাখা।

কথাটা কানে গলে মনসার বৌ-এর। পীরের থানের দিকে এক হাত তুলে গড় করল। ঘরের পথটুকুতে তিলুর কথা ভাবতে ভাবতে ও ঘরে ফিরল। ও বিশ্বাস করতে পারছিল না। তিলু এ গাঁয়ের মেয়েদের কাছে একটা বিশ্বাসের সিন্দুক।

বেলা চলে যাচ্ছে দ্রুত।

কপিকলের একদিকে রতির মার বালতি নামছে। অন্যদিকে কাঠ বেয়ে সন্ধ্যার বালতি। দুটো বালতি দুদিক থেকে। কির কির করে কপিকলে শব্দ উঠছে।

ঝনাক, একটা শব্দ হলো।

ছর ছর করে জল পড়ল। কুয়োর জল কুয়োতেই। কুয়োর পাট চুইয়ে জল পড়ছে। ব্যাস অমনি শুরু হয়ে গেল।

—তোর মাগী উদোম বাই। দেখতে পাসনু আমার বালতি উঠছে? অত যদি তাড়া তবে সন্দের পোঁদে বাতি দিয়ে ক্যানে? বেলাবেলি আসতে পারুসনি?

কথার পিঠে কথা পড়ছে। শুরু হচ্ছে বচসা।

সাবিত্রী থামায় ওদের দুজনকে।

ছবি এল। ফ্রকের পিছনে সেফটিপিন আঁটা। সামনের দিকে বুকের উপর তেলচিটে ময়লা দাগ, সন্ধের করুণ আলো। পিতলের কলসী বড় বিবর্ণ। মাজা হয়নি অনেকদিন। কলসী বাঁধা দিয়ে অভাবের দিন পার করেছে। এই কদিন হলো কলসী মহাজনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে।

কলসীর দিকে তাকিয়ে সারি বলল সই, কলসী মাজুনি ক্যানে?

পরশু ছাড়িয়ে এনেছে পালেদের ঘর থেকে। একদম অপসোর নাই। ধান সিজোনো হচ্ছে।

কুয়োতলায় লম্বা লাইন। মেয়েরা ভাগ ভাগ হয়ে গল্প করছে।

দ্রুত পায়ে সেজোপিসি আসছে। যেন প্রেসমার্কা গাড়ি।

সবাই তাকায়। সবাই জানে সেজোপিসি এসে এমন একটা খবর দেবে যে সবাই সে খবরে বেবাক বোকা বনে যাবে। এই খবর রবারের গড়ির মতো টানতে টানতে বাড়াবে সেজোপিসি। আর সেই ফাঁকে জল তুলে নিয়ে যাবে। আসবে সবার শেষে, আর যাবে সবার আগে। যাবার সময় গল্প শেষে বলবে, এই যা। উনুনে দুধ আছে।

আজকে কোনো গুরুতর সংবাদ হবে। সেজোপিসির শাস দ্রুত।

একটা জটলা হয় সেজোপিসিকে ঘিরে। সারি বলে, কী, দিদিমা ছুটে ছুটে এসচো, দাদু লাছে দাঁড়িয়ে আছে নাকি?

—তোর মাগী রঙের গা। বর দেখা হচ্ছে তো!

সেজোপিসিকে কালোর মা একদম দেখতে পারে না। বলে, সেজোপিসি গোটা গাঁয়ের লেগে খপোর বিয়োয়।

সুও যে বিয়োতে জানে সে মজা বোঝে। না হলে ঘর গেরস্থালীর কাজ ছেড়ে জল তোলা ভুলে সবাই ঘিরে ধরে কেন সেজোপিসিকে!

খবরটা আর বাড়াতে হলো না আজ। খবরের পূর্বাভাস এসে গেছে কুয়োতলায়। আর এই সাঁঝের আগমনে খবরটা যেন ভঁসালো পেয়ারা। আইবুড়ো মেয়েরা পিসির কাছে এগিয়ে এল। চৌকিদার গিন্নীর মুখঝামটা, তোরা আইবুড়ো মেয়ে, তোদের এত কী? জল নিয়ে সেজোপিসি খবরের শেষ চমক দিয়ে গেল। গোটা কুয়োতলায় চরকীর আলোর মত পরিষ্কার হয়ে গেল। সেজোপিসি আজ দেখেছে তিলু মোড়লপুকুরে ভূষণের সঙ্গে ‘বাক্যি’ করছে।

তবুও সামান্য সন্দেহ রয়ে গেল দু একজনের মনে। অন্তত মাটির কানাভাঙা কলসীর মালিক, থামের গায়ে ঐ যে চুপচুপ ধন-যৌবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে পার্বতী।

সবার অলক্ষে পার্বতী চোখের ‘নোয়া’ মুছল, না না তিলু কখনও এমন হবে না।

জল তুলতে তুলতে মলিনা তাকাল কালোর মার দিকে। কালোর মা গালে হাত দিয়ে, ‘ও ভাগ্যি মা, এত শত ব্যাপার।’

মনিষ্যির মন তো লয়, লদী। এই দেখছো কাঠফাটা শুকনো বালি। কাল দেখবে ভরা বন্যেয় উথাল পাতাল। সেই ঘোলা জল, সেই স্রোত, সব কেমন ঝিমিয়ে পড়ে। বোশেখে শান্ত নদী শিশুর মতো কাছে ডাকে। পরিষ্কার আয়নার মতো জল ‘তিয়াসে’র জল।

নদীর সনে মানুষের কত মিল। এইসব দার্শনিক ভাবনা নিয়ে আর কলসীভর্তি জল নিয়ে ফিরে গেল পুব পাড়ার নমিতা। ও বাঁজা। লোকে বলে, ওর স্বামীর অসুখ আছে। নমিতা দেখছে জীবন তো চলছে এই ভাবেই। ও তিলুকে খুব ভালোবাসে। গাজনে ওর সঙ্গে ঝাঁপজল পাতিয়েছে। বুড়োশিবের চড়কের সিন্দুর তুলে বলেছে, ঝাঁপজল তোমার অপিক্ষে মিথ্যে হবে নে, দেখো। তোমার ভিতরে তো ময়লা নাই, তুমি তোমার মানুষ পাবে। দেখবে না এ বছরেই ফিরে আসবে। প্রথম রাতে কী কথা হবে আমায় কিন্তু শোনাতে হবে। তিলু সেদিন এই বন্ধ্যা রমণীর এক রমণীয় আশীর্বাদ মাথায় রেখে চোখ ঝলছল করে বলেছিল, আশায় আশায় আর কতকাল ঝাঁপজল?

নমিতার ইচ্ছে আজই সাঁঝ প্রহরেই জিজ্ঞেস করে নেবে তিলুকে ঝাঁপজল এ কী শুনছি–ঝাঁপজলের বিশ্বাস তিলু ওকে লুকোবে না।

কিন্তু নমিতার ভয় হয় ঐ পরান ডোবার বাঁকটায়, ওখানে অন্ধকার বড় ঘুরঘুটি। সেদিন পালেদের বড় ছেলে ওখানে দাঁড়িয়ে হাত ধরেছিল নমিতার। মানুষের বেঁচে থাকার কী জ্বালা! বাঁশ গাছের থেকে কেন লাউডগা সাপ নামে না? কেন ওকে সেই সাপ কাটে না?

***

শেষ কথাটাই ভূষণ কবরেজের কানে বাজছে। তিলু বলে গেল, মানুষ হয়তো বোঝে, চাল হয়তো সেজে।

ভূষণ উত্তর দিয়েছিল, আমারও হাল নাই, তোমারও বলদ নাই। এসো তবে। কিন্তু গলার ভিতর থেকে উত্তর আসেনি। ভূষণ শাদা আঁকোডের গাছটা ফেলে দিল জলে। এই শিকড়বাকড় দিয়ে আজন্ম কাটছে। গুরুর কথা মনে পড়ছে ভূষণের! গোঘাটের পঞ্চবটী থানের গুরু। কতবার বলেছে ভূষণকে, বাপ এবার বে কর। কাজে অনেক বল পাবি। অত দুঃখ রাখিবি কোথায়? না হলে পাগল হবি।

ভূষণ বালা কুড়ুলের মুখ থেকে মাটি মোছে। গাই গরুটার ডাক শোনা যাচ্ছে এখনও। ভূষণ জানে ও ডাক কীসের। গরুটার একটা কঠিন অসুখ। মাঠ দেখানোর পর ওর পেটে বাচ্চা আসবে। দুধের মোড় ফুলে উঠবে। দুধ জমবে। কিন্তু ও বিয়োতে পারবে না। সেবার অনেক কষ্টে মরা বাচ্চা ভূষণের হাতেই নেমেছিল। এবার মারা যাবে গাইটা নিজেই। তাই ভূষণ এড়িয়ে চলছে।

কিন্তু—সব কথার পিঠে কিন্তু।

বনবাদাড়ের আনাচে কানাচে ব্যাঙ ডাকছে। মিটিমিটি করে জোনাকি জ্বলছে। অহেতুক কিছু শব্দ ভূষণকে নাড়ায়—পূর্বসূরীদের ডাকের মতন।

ভূষণ ঘরে আসে। দড়মা থেকে শালপাতা বের করে চটা পাকায়। আরও একটু রাত বাড়বে। তারপর সে আজ জীবনের শেষ গাছ তুলবে। এ গা ছেড়ে দেবে। চলে যাবে গুরুর কাছে দুরে দুরে গোঘাট গাঁয়ে। গিয়ে বলবে, এই দ্যাখো ওস্তাদ শ্বেত করঞ্জার ফুল। এই লাও বনবৈচির শিকড়। এই দেখ পূর্ণিমায় লক্ষ্মীবারে ভোলা প্রতিষ্ঠা করা আশুদ গাছের ছাল।

ঘরের সমস্ত সঞ্চয় যা ছিল একটা কুপীর আলো, মাটির হাঁড়ি, ঠ্যাং-ভাঙা কুকুর, সব ঠিক তেমনি আছে। ভূষণ মনে মনে ঠিক করল কিছুই নেবে না। এক কাপড়ে চলে যাবে। শুধু নেবে ওর বয়সকালের আড় বাঁশি। অনেকদিন ছোঁয়নি এটা।

বুকে বেশ বাতাস দিচ্ছে। এমনি বাতাস ভূষণের দিয়েছিল সেবার, যেবার ও তিলুকে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। শাশুড়ীর বঁটির আঘাতে তিলুর কোমর কেটে ঘা। তিলু মরতে চেয়েছিল। ভিতরে ভিতরে ঘা বেড়ে যাই-যাই। মাঝরাতে তিলুর দেওর নিমাই এসে ডেকেছিল ভূষণকে।

তিলু ওষুধ খেতে চায়নি। ভূষণকে উত্তর দিয়েছিল, শিকড়কড়ে আর বাঁচতে আমি চাই না। শুধু চাই এই ঘা সোরোশ করে যেন ঢুকতে পারে কলজেতে। ভূষণ মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, মনিষি মরলেই তো মাটি হয়ে গেল। তালে কেন আর এই জীবন?

সে তো গেল বছর। ভূষণ অনুভব করল এই যে সব গাস্ত্রে শিকড়বাকড়, এই যে সব প্রতিদিন মাটি খুঁড়ে তুলে আনা, এতে তো সব অসুখ সারে না। ভূষণের নিজের ভিতরেও তো ব্যথা আছে। বাড়লেই গুরুর কাছে চলে যায়। হাউ হাউ করে কাঁদে আর তখনই ভূষণকে গুরু বলে, এবার একটা বে কর ভূষণ। মাটির কলসী থেকে ভূষণ কিছুটা জল খেল। খুব ভাসা ভাসা লাগছে। মনে হচ্ছে এতদিনে মানুষের। যে সমস্ত উপকার করেছে তা কত কম, কত সামান্য।

কিছু আর খেতে ইচ্ছে করল না। খুঁটিতে হেলান দিয়ে আকাশ দেখল। সাঁঝতারা বেশ কিছুক্ষণ আগে উঠেছে। এখন সারা আকাশে যেন একথালা সুপুরি—অগুনতি অসংখ্য তারা। সাতভাই উঠেছে। চাদের একটা বেশ বের হচ্ছে। আষাঢ়ের কালো মেঘ সাঝে সাঝে ছুটে এসে চাপা দিচ্ছে আলো। আবার অন্ধকার, আবার আলো। এই সমস্ত খেলাটাই চলছে ভূষণের ভিতর। ভূষণ মনে মনে তৈরি হয়ে নেয়। ওকে চলে যেতে হবে এই ঘর, এই গ্রাম, এই মনীষ্যিদের ছেড়ে।

তবে এটা বুঝেছে সে, যে মেয়েদের স্বামী নাই সে মেয়েরা দশ হাত কাপড়েও ন্যাঙটো, কত অসহায়!

.

তিলুর আজ যা কিছু চরম ঘটার জন্যে ইচ্ছে করছে রুখে দাঁড়াতে। কুয়োতলায় পার্বতী এখনও দাঁড়িয়ে। তিলুকে দেখে দখনো বাতাসের মতো তার বুক জুড়ে যায়। তিলু ওকে রশি বালতি দেয়।

পার্বতী শুধায়, তুমি আগে নিয়ে যাবে? তোমায় তো আরও দুখেপ এসতে হবে। তিলু অন্যদিনের থেকে একটা আলাদা। না, তুমিই আগে নাও পিসি, আমি পরে নোব। আজ আমার এই এক খেপ জল।

তিলু হাঁপাচ্ছে, কলসীর মুখে ছোট্ট একটা চাদ। কলসীর মুখের কানায় জলের শব্দ উঠছে। বালতির জল আজ একটা বেশি চলকাচ্ছে। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল। কোন নাঙ কুয়োতলায় ছিল যে এত দেরি, কুয়ো কেটে কি জল আনচু তেয়োধাতালীর ঝি? কলসী বালতি নামিয়ে রেখে তিলু জানত, এরপর কী। চুলের গুছি ধরে দুটো চড়। খুঁটিতে হাতটা লেগে শাখাটা ভাঙ্গল তিলুর। রবারের তিনটে চুড়ি ছিটকে বেরিয়ে গেল। উঠোনে গাছের ছায়ায় বোঝা গেল না। ঘর থেকে দেওর বেরিয়ে এসে মাকে সরিয়ে নিয়ে গেল। দেওরের ছেলে পরান টুকরোগুলো কুড়িয়ে নিল। এ সমস্ত দৃশ্যে পরান অভ্যস্ত, এমন কি এই উঠোনে পোঁতা তুলসীগাছও।

তিলুর চোখের ভাষ্য আজ সামান্য আলাদা। কলসী নিয়ে দ্বিতীয়বার বের হল। খেয়াল করল না পরান ওর পিছে পিছে এসেছে কুয়োতলা অব্দি।

শেষ খেপ জল নিয়ে যখন ঘরে ফিরল, তখন শুনতে পেল প্রথম প্রহর শেষের চৌকিদারের ডাক, হো—হো–হো-ও।

প্রতিদিনের মতো ঘরে ধুনো দিল তিলু। মশারী টাঙিয়ে পরানকে ঘুম পাড়াল। শেষ খেপ জল আনার সময় পরান বলেছিল, জ্যাঠাই, বড় হয়ে আমি তোকে লিয়ে যাব মামাদের গাঁয়ে। পরান, ছেলেটা বড় বেঁধে রেখেছে তিলুকে। বোধ হয় বেঁচে থাকা এর জন্যেই। আরও একটা ক্ষীণ স্রোত অন্তরীক্ষে, যদি সে মানুষটা ফেরে। কেউ বলে, সে সন্ন্যাস নিয়েছে। পালেদের জামাই তারকেশ্বরে পুজো দিতে গিয়ে দেখেছিল তাকে। কেউ রটায় সে চাপাডাঙায় মেয়েছেলে রেখেছে।

রাত বাড়ছে। সবার খাওয়া শেষে তিলু ঘাটে গেল। হাঁড়িতোলা রাত ভারী হবে এবার। তিলুর খাবার ইচ্ছে নেই। না খেলে শাশুড়ীর গালমন্দ, চোটপাট মারধর। লুকিয়ে জামবাটির তলার সমস্ত ভাত ফেলে দিল জলে। হাঁসে খাবে, মাছে খাবে। সবাই তো বেঁচে থাকবে। ঘরে ফিরে থালা রাখল। রান্না ঘর মুছল তিলু। চুপিসাড়ে দরজার পাশে গিয়ে শুনতে চাইল দেওরের ঘুমের গভীরতা কতখানি।

শাশুড়ীর পানের ডিবের শব্দ আসছে। চৌকিদারের হাঁক, ‘হো-হো-হো-হো-ও’ রাতের গভীরতায় ডুবে যাচ্ছে সবকিছু। উঠোনে জাম গাছের ছায়া কখনও পড়ছে, কখনও হারাচ্ছে, আগাম বর্ষার আলো-ছায়ার খেলা। শোবার ঘরে ধুনোর আগুন সামান্য উসকে দিয়ে মশারীর মধ্যে গেল। পরান ঘুমিয়ে কাদা।

কাল সকালে পরান কাদবে, কত কাদবে। শাশুড়ী এতদিন যা চাইত, যা খুলে মেলে বলত তাই ঘটেছে দেখে খুশী হবে। দেওর আর জায়ে কাল সকালে বা পরশু হাত-পা ছড়িয়ে সম্পত্তির হিসেব করবে। তারপর আবার সবাই ভুলে যাবে।

ধুনো-চুরে আরও কিছুটা ধুনো দিল তিলু। চুপি সাড়ে বাইরে বেরিয়ে এল। যেন গোয়াল দেখাতে যাচ্ছে। গরুটার শিঙের ব্যথাটা কমবে একদিন। ওকে মাঠ দেখানো হবে। ওর বাচ্চা হবে। সব ঠিক থাকবে, থাকবে না শুধু যার ধন সে।

লাছ দুয়ারে হুড়কো খুলল তিলু। বাইরে এল। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করল। ঘুর পথে হাঁটতে শুরু করল। এত রাতে কেউ বের হবে না। যারা এত রাতে বের হয় তারা কেউ জানবে না। হাঁটবেও না এই ঘুর পথে।

এই পথ সোজা কুয়োতলা। সেখান থেকে মাঠ ভেঙে, তারপর…। তিলু জানে না। সব পথ ভূষণের শিকড়ের থলিতে। ভয় লাগছে। আকাশে উড়ো মেঘেরা অন্ধকার সাজিয়েছে। এই অন্ধকার এখন বড় জরুরি, বড় দরকার।

তিলু হাঁটছে। কুয়োতলায় যখন এল শুনতে পেল পুকুর পাড় থেকে ভূষণ গলার শব্দ করল। আচ্ছা যদি কেউ ভূষণকে দেখে? পুরুষ মানুষের সাতখুন মাফ। আর মেয়েমানুষের বদনামটাই সম্বল। তাই নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়। মেয়েমানুষ বড় কাঙাল। এইবার তিলুর মধ্যে সংশয়ের ঢেউ। তবুও গেল পুকুর পাড় ধরে। আকাশ থেকে মেঘ সরে যাচ্ছ। ভূষণের বুকের মধ্যে যা ভয় জমছে তিলুর তার একশো গুণ।

ভূষণ বলল ফিস ফিস করে, খুব কাছেই তিলু। চলো এই মাঠ-পথ অনেক সহজ।

তিলু মুখ তুলল। ভূষণ গাছের শিকড়ের গন্ধ চেনে। মেয়েদের শরীরের এই গন্ধ সে কোনোদিন পায়নি। এখানে কোন শিকড় আছে? শ্বেতকরবী না তেসিরে মনসার আঠা! নাকি, রাঙা জবার ডাল। ভূষণ পাগলপারা। তিলুর মাথা ঘুরছে। ঘরের ধুনোর গন্ধ, পরানের হাত পা ছড়ানো শরীর। উঠোনের উপর জামের গাছের ছায়া। আর গাঁয়ের সব মেয়েদের হাতে যে বিশ্বাস তুলে দিয়েছিল তিলু!

তিলু হাত ছাড়িয়ে নেয়। তুমি যাও।

চৌকিদারের হাঁক কাছে আসছে। দ্রুত পায়ে তিলু কুয়োতলার কাছে ফিরে আসে। ভূষণকে দেখার চেষ্টা করল। একি ভূষণ মাঠ পার হয়ে সোজা পথ ধরেছে। ধরুক। সামনে চৌকিদারকে দেখে তিলু ভূত দেখলে। কে গো? উত্তর নেই। কাছে এল চৌকিদার। মুখের দিকে তাকিয়ে বলল কী গো মা, এত রাতে? তিলু পীরের থান দেখিয়ে বলল, মাটি আনতে।

সোজা পথেই তিলু ফিরল। শুধু ভাবল, এক আঁধার কাটানোর জন্যে আর এক আঁধারে কেন ডোবা, ডুব দেওয়া। হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, এই জ্যোৎস্নায় আলোকিত পথে ওর ঝাঁপজল বলছে, সয়ে থাকলে রয়ে পাবি ঝাঁপজল। আর ওর বুকের মধ্যে পরানের হাত। মাথার মধ্যে ধুনোর গন্ধ। ও ঘরে ফিরে এল।

ক্ষত ও নিরাময় – তৃণাঞ্জন গঙ্গোপাধ্যায়

এভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছে কেন প্রবীরকে! তার মুখে মাসে দু-একবার মদের গন্ধ পেলে লিপিকা দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোয়। কলকাতার যাবতীয় আবর্জনা নিয়ে বয়ে যাওয়া বাগজোলা ক্যানেল তাদের এই ভাড়াবাড়ি থেকে ইটছেঁড়া দূরত্বে। তাই সভনে মশায় এবাড়ি সারাক্ষণ ভরে থাকে। স্কুল থেকে ফিরেই লিপিকা জানালাগুলো দিয়ে দেয় পটাপট। তাই প্রথম বিকেল থেকেই ঘরে হাওয়া বাতাস ঢোকা বন্ধ। কিরকম যেন এক ভ্যাপসা গরমে এই ঘরে দুই বাসিন্দা লিপিকা আর রুদ্র ঘামতে থাকে। তার ওপরে দেয়ালের দিকে মুখ করে বিছানায় মশারির কোণে সরে গেলে তো আরও গরম লাগবে। লিপিকার আবার সামান্য গরমও সহ্য হয় না। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে বিছানা থেকে নেমে ফ্রিজের কনকনে জল কচক করে গলায় ঢালে। সেই লিপিকাও মাসে দু-একদিন যেদিন রুদ্র মদ খেয়ে ফেরে, সেদিন দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে মশারির কোণে চলে যাবে। আর সেই লিপিকাই প্রবীরের এই মুহূর্তে এ বাড়িতে বসে মদ খাওয়াটাকে মেনে নিচ্ছে।

শুধু মেনে নিচ্ছে নয়, রুদ্র স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে, দু-চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছে, রীতিমত প্রশ্রয় দিচ্ছে প্রবীরকে লিপিকা। লিপিকা রান্নাঘরে গিয়েছিল। ছোট কাঁচের প্লেট হাতে ফিরে এসে লজ্জিত চাহনিতে বলল, টোম্যাটো সস আর পেঁয়াজ ছাড়া কিছু নেই এমুহূর্তে..

কাফি, কাফি, বলে দাড়ি চুলকে গোঁফের নিচে হাসি ভাসিয়ে তুলল প্রবীর। হাত বাড়িয়ে প্লেটটা নিয়ে নিল। সামনের ছোট বেতের টেবিলের ওপরে নামিয়ে রেখে বলল, একটু জল লাগবে….

হ্যাঁ, হ্যাঁ, দিচ্ছি…..। লিপিকা অত্যন্ত সহজভাবে ঘাড় নাড়ে এবং চলে যায়।

ঐ সহজতা রুদ্রর মাথার ভিতরে ঠোকর মারে। প্রবীরের মদ্যপানের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিবাদ তো নেই-ই উল্টে পূর্ণ সহযোগিতা। এর রহস্য? চোয়াল মৃদু শক্ত হয়ে ওঠে রুদ্রর। জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়। অলস রোদের ভিতর দিয়ে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছেলেমেয়েরা ভ্যানরিক্সায় বাড়ি ফিরছে। তার মানে বারোটা। তার মানে একতলায় গিয়ে রিজার্ভারের চাবিটা বন্ধ করে দিতে হবে। না হলে ওপরে জল আসবে না। লিপিকা স্কুলে চাকরি করে। রুদ্রকে তাই সামলাতে হয় ঘর সংসার। এতে অবশ্য কোন সমস্যা নেই রুদ্রর। উল্টে কিছুটা সুবিধা।

ঘরের কাজ করেও সময় পাওয়া যায় অনেকটা। দশটা পাঁচটার অফিস করলে কি এতটা সময় পাওয়া যেত। তখন কোথায় থাকত তার স্বপ্ন, তার স্বপ্নের কন, এই পৃথিবীতে তার অবস্থান হলেও, আসলে সেই যোজন যোজন দূরে, সেই ছবি আঁকা তখন কোথায় থাকত! এই বেশ ভালো আছে।

রুদ্র খদ্দরের পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেতের চেয়ার ছেড়ে একটু তাড়ার ভাব এনে উঠে দাঁড়াল। বলল, তুই বোস, আমি নিচে গিয়ে রিজার্ভারের চাবিটা বন্ধ করে দিয়ে আসি, না হলে সারাদিন আবার জল পাওয়া হবে না……।

বীর বলে উঠল, বোস কি রে! তুই খাবি না! ও চাবিটাবি পরে বন্ধ করলেও চলবে তুই বোস তো…..লিপিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ঐ তো, ও বন্ধ করে দিয়ে আসবে। তুই বোস…..

রুদ্র এক মুহূর্ত হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইল। লিপিকা তার না প্রবীরের বৌ, বুঝতে পারল না। আরও অবাক হল এমন একটা কথার পরে লিপিকা নীরব! সে কথাগুলো বললে তো এ-মুহূর্তে বাতাসে আগুন ধরে যেত।

একদিন সবে রঙে তুলি ডুবিয়েছে রুদ্র। লিপিকা সেদিন বাড়িতে। মাধ্যমিকের মেয়েদের টেস্টের খাতা দেখছে। বিছানা থেকে দেয়ালঘড়ির ওপরে চোখ পড়ে যাওয়ায় লিপিকা বলেছিল, কি গো, নিচে গিয়ে রিজার্ভারের চাবিটা বন্ধ করে দিয়ে এসো না……

রুদ্র বিরক্ত হয়েছিল। রেগে গিয়েছিল। উঁচু স্বরে বারান্দা থেকে বলেছিল, আমি ক্যানভাসে রঙ চাপিয়েছি…..

আমি খাতা দেখছি….। উঁচু স্বরেই ফিরেছিল উত্তর।

তোমার খাতা দেখা আর আমার ছবি আঁকা এক হল!

সব মানুষের কাজই কাজ, এই যে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভাবনাটা তোমার কথা থেকে মাঝে মধ্যেই বেরিয়ে আসে সেটা আসলে মুখোশ বলো…..

এই এক সমস্যা লিপিকার। সব সময় একটা উত্তর যেন ঠোঁট খুলে বেরিয়ে আসার জন্যে অপেক্ষা করছে জিবের ডগায়।

রুদ্র রীতিমত ক্ষেপে উঠেছিল। প্রায় চেঁচিয়ে বলেছিল, ছাত্রী পড়াতে পড়াতে তুমি সকলকেই তোমার ছাত্রী মনে করতে শুরু করেছ, ঘ সময় অমন দিদিমণিমার্কা কথা বলো না তো….

দিনিমণিমার্কা কথা! তার একটা মার্কা দিয়ে ফেলেছে এই কটা দিনে রুদ্র। ভাবতে ভাবতে অবাক হচ্ছিল লিপিকা। ও ক্ষেপে গেল। বলল, কেন এই দিনিমণির কথাই তো মাত্র কয়েকটা বছর আগেই তোমার ভালায় সূরণ ঘটাত, তখনও তো আমি দিদিমণি-ই ছিলাম….

তারপরে আর কোন শব্দ ছিল না। অসহ্য নীরবতা। লিপিকা বিরক্ত হচ্ছিল কালক্ষেরে জন্যে। তারপরে ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গিয়েছিল রিজার্ভারের চাবিটাকে বন্ধ করে দেবে বলে।

ঐ ঘটনার পরে রুদ্র অবশ্য নিজের সঙ্গে নিজেই একটা সমঝোতা করে নিয়েছিল। এ বাড়িতে, এ-সংসারে থেকে ছবি আঁকতে গেলে কিছু কিছু কাজ তাকে করতে হবে। যদি কাজের লোকও রাখে লিপিকা, সুও তাকে কিছু কাজ করতে হবে। তাই ও নিয়ে রাগ করলে চলবে না। মানে সে রাগ করবে না। ছবিকেই ভালোবেসেছে ধ্ব থেকে। তাই আর কিছুই ভাবেনি। স্কুলের গণ্ডিও পেরনো হয়নি। একটা নির্ভরতার তো প্রয়োজন। লিপিকা তো সেটা তাকে দিচ্ছে। তারও কিছু ক্য আছে। ব্যাপারটা রুদ্রর কাছে কর্তব্যে এসে ঠেকেছে। যেনবা এক সাংসারিক বিনিময় প্রথা। ছবি আঁকাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে রক্ত-মাংসের যেটুকুকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তার রসদ লিপিকার কাছ থেকে গ্রহণ, আর তার প্রত্যর্পণ হল সাংসারিক কাজকর্ম, দায়-দায়িত্ব। ব্যস এই, আর কি, এর বাইরে তো আর কিছু নেই। এমনই জানে রুদ্র। তাই একটা মাপজোক গুণভাগ করে একটা সম্পর্ক আজকাল সে বজায় রেখে চলে লিপিকার সঙ্গে।

আর আজ হঠাৎ অনেকদিন পরে এবাড়িতে হঠাৎ করে ঢুকে পড়ে এই সাংসারিক আবহাওয়া, একটা নিয়মের পরিবেশ। লিপিকার পছন্দ-অপছন্দের যে সীমারেখা তা যেন অতি সহজেই ভেঙে দিচ্ছে প্রবীর। কি করে হচ্ছে এটা। প্রবীর পেরে উঠছে? নাকি লিপিকাই ওকে পেরে উঠতে সাহায্য করছে।

প্রবীরের কোকড়ান দাক্সি ওপরে চোখ রাখতে রুদ্র কফিহাউসের দিনগুলোকে দেখতে পেল মুহূর্তের জন্যে। যোল-সতেরোজনের জমায়েত, মানে অতটুকু টেবিলে অতজন ধরে না, প্রথমে জনা-পাঁচেকের একটা বৃত্ত, তাকে ঘিরে আরেকটা বৃত্ত, তাকে ঘিরে ফের একটা, যেন গ্রহ-উপগ্রহের কক্ষপথ, সে পথে কফি জল নিয়ে চলাফেরা করা বেয়ারারা আটকে যায়, ধমক দেয়, কিন্তু সে শোনে ধমক, গ্রহ-উপগ্রহেরা তো তখন তুমুল আলোচনায় ব্যস্ত, ছবি আঁকিয়ে রুদ্র, কবিতা ও লিটিল ম্যাগাজিন নিয়ে থাকা প্রবীর, এম টেকের শ্যামল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়তে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়তে আসা সায়নী আর নম্রতা, দুপুরে অফিসেঅফিসে স্টেশনারি সাপ্লাই দেওয়া আর সন্ধ্যেবেলায় গ্রুপ থিয়েটারের রিহার্সাল করা অৰ্বিাণ—কে না থাকত আড্ডায়! লিপিকা বি.এড পড়তে এসে জুটে গেল।

পুরোদস্তুর ঝালমুড়ি-আড্ডা। আচ্ছা চলাকালীন কে যেন একবার হো-হো করে হেসে উঠে কথাটা বলেছিল। তারপরে সকলে। প্রবীর শুধু হাসেনি। সিরিয়াস স্বরে বলেছিল, ব্যাপারটাকে এরকম চিপ করে দাম না, ঝালমুড়ি-আড্ডা না বলে বল এই সময়ের আড্ডা। প্রবীর কবিতা লিখত। কথা বলত কবিতার মত। সমস্ত জীবনটাকে কবিতা করে নিতে চেয়েছিল। এমন এমন কথা বলে উঠত, আর গতি থেমে যেত। সকলেই চিন্তাশীল হয়ে উঠত। রুদ্র লক্ষ করেছে কয়েক মুহূর্তের জন্যে আড্ডা থামিয়ে সকলেই প্রবীরের কথাগুলো নিয়ে ভাবলেও শেষ পর্যন্ত প্রবীরের কথা বা প্রবীরের ব্যাপারে কেউই উৎসাহী হতো না। কাউকেই প্রবীর উৎসাহী করতে পারেনি কখনও তার প্রতি। মেয়েদের মধ্যে কোন আবেদনই তৈরি করতে সক্ষম হয়নি প্রবীর।

কিন্তু আজ রুদ্রের মনে হচ্ছে প্রবীর সম্পর্কে যা ভেবেছে, যা জেনেছে তা হয়ত সবই ভুল। লিপিকার হৃদয়ের গভীর আড়ালে প্রবীরের প্রতি ক্ষীণ একটা দুর্বলতা হয়ত আছে। রয়ে গেছে এখনও। হয়ত ভেবেছিল কবিতা-লিটিল ম্যাগাজিন গায় বাড়ি—কিছুই না করার ইচ্ছে-এমনকি একটা ছোট সম্পর্ক, একটু প্রেম প্রেম খেলা—সেই সরে ইচ্ছে নেই—ছন্দ মাত্রা শব্দ শরীর আর অপার ভাবাবেগের কথা শুধু মাঝেমাঝে কথা থামিয়ে ড্যান্ড্যা করে তাকাত লিপিকার দিকে। প্রবীরের। অনুপস্থিতিতে ওর কথা উঠলেই লিপিকা হাসতে হাসতে বলত, কিরকম ছাগলের মত চোখ দুটো না! কথাটা শেষ হলেও লিপিকার হাসি যেন শেষ হতে চাইত না।

কিন্তু আজ রুদ্রর মনে হচ্ছে ঐ হাসিটা নিখুঁত অভিনয় ছিল লিপিকার। মনের নিভৃত কোণে প্রবীরের ব্যাপারে রয়ে গিয়েছিল অন্য কোন ছোঁয়া। না হলে এমনভাবে। প্রশ্রয়টাকে বাড়িয়ে তুলছে কেন লিপিকা। প্রবীর দীর্ঘদিন পরে ওদের সঙ্গে দেখা করবে বলে হঠাৎ করে এবাড়িতে ঢুকে পড়ার পর থেকেই লিপিকার মধ্যে রুদ্রর প্রতি একটা প্রবল রাগ একটু একটু করে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। এটা জানে রুদ্র। বুঝেছে রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেটাক না, যত খুশি রাগ মেটাক লিপিকা। কিন্তু অত তাড়ার কি আছে। আগে প্রবীর বাড়ি থেকে চলে যাক। একটা ছোট মিথ্যে গল্প, একটা কিছু সাজিয়ে আগে প্রবীরকে বাসে তুলে দিয়ে আসুক, তারপরে নয় হবে। অথচ তা না করে এ-মুহূর্তে প্রবীরকেই যেন একটা অস্ত্র করে নিয়ে তুলে ধরেছে তার বিরুদ্ধে সেই রাগটাকে মিটিয়ে নেওয়ার জন্যে। এটা কি শুধু রাগ মেটানো, নাকি

একভাবে পুরনো বন্ধুর প্রতি ঘুমিয়ে থাকা পুরনো রোমাঞ্চকে জাগিয়ে তোলা?

নিচে রিজার্ভারের চাবি বন্ধ করার জন্যে এ-ঘর থেকে যাওয়ার সময় দেখেছিল দুটি গ্লাসে দুটি পেগ বানিয়ে ফেলেছে প্রবীর। নিচে চাবিটা বন্ধ করে ওপরে ফিরে আসতে একটা বেশিই সময় নিয়েছিল রুদ্র। ওপরে ফিরে মদ ঢালা গ্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তো খাবো না…..

প্রবীর অবাক হয়ে বলল, খাবি না মানে।

খাবো না মানে এ-সময় আমি খাই না—

এ সময় তুই খাস্ না। কথাটা বলে প্রবীর হো হো করে হেসে উঠেছিল। লিপিকার চোখে তাকিয়ে নিয়ে বলল, বিয়ের পরে খুব উন্নতি হয়েছে রে, তোর….

রুদ্র চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, উন্নতির কি হল এতে, সাতসকালে তুই ছাড়া দেশে মদ্যপান করেটা কে!

রুদ্র লক্ষ করল একথায় প্রবীরের মধ্যে সামান্য ভাবান্তও ভেসে উঠল না। নিজের গ্লাসে জল ঢেলে বলল, দেখ তোর গ্লাসে কতোটা জল ঢালব….

আমি খাবো না প্রবীর…। রুদ্রর স্বর এখন বেশ গম্ভীর। আড়চোখে তাকাল লিপিকার দিকে। আশা করেছিল লিপিকার দিক থেকেই সকালবেলাতেই মদ্যপানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আসবে। অথচ রুদ্র দেখল লিপিকার দু-চোখে নীরতার ভিতরে শুধু প্রশ্রয়। খুব কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে প্রবীরের গ্লাসের মদে জল মেশানো দেখছে।

একটা গ্লাস উঁচু করে রুদ্রর দিকে তুলে ধরল প্রবীর। বলল, কফিহাউসের দিনগুলো মনে পড়ে, তখন তো কোন কোনদিন তুই আর আমি মদ দিয়ে মুখ ধুয়েছি…..

রুদ্র বলল, তাই বলে আজীবন সেগুলোকে রক্ষা করতে হবে নাকি, আর রক্ষা করতে না পারলেই কি সেটার নাম দিবি পালিয়ে আসা। বোগাস…যতসব….

প্রবীর গ্লাসটাকে রুদ্রর আরও কাছে এগিয়ে দেয়। বলে, ঝগড়া করছিস কেন! আমি কি তোর কাছে ঝগড়া করতে এসেছি!

ঝগড়া নয়, ঝগড়া নয়। কথা দুটো বলে প্রবীরের হাত থেকে ঝপ করে গ্লাসটা নিয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ঠক্ শব্দে নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপরে। প্রবীরের মনে হল আজ রুদ্র তার সঙ্গে বসে মদ্যপানই করছে না, ডাক্তারের নির্দেশে কোন তেতো ওষুধ যেন গিলছে।

লিপিকা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা বোসো তাহলে, দেখি পাশের পাড়া থেকে কিছু আনা যায় কিনা….

প্ৰবীর বলল, পাশের পাড়া কেন।

এ-পাড়ায় তো আজ সব দোকান বন্ধ। আজ সোমবার না, এ-পাড়ায় সব দোকান বন্ধ থাকে….

লিপিকা পায়ে স্লিপার দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর রাগে গা রি-রি করে উঠল রুদ্রর। প্রবীরের প্রতি লিপিকার এতোটা আতিথ্যের হেতু! মাসের মধ্যে একদিন-দুদিন তার মুখ থেকে মদের গন্ধ যার কাছে অসহ্য, সে-ই এখন মদের চাটের জন্যে পাশের পাড়ার দোকানে ছুটছে!

সকালে হঠাৎ করে প্রবীর যখন ঢুকে পড়েছিল এ বাড়িতে, চমকে ওঠে রুদ্র। শেষ পর্যন্ত চলে আসবে কল্পনাতেও আনতে পারেনি। আজকাল তেলরঙের কাজ আর করে না রুদ্র। করে না বললে ভুল। আসলে ক্যানভাসের ওপরে তেলরঙের কাজে যে ছবি, স্রষ্টার এক একটি অনিন্দ্য সুন্দর ভাবনা ফুটে ওঠে, তা আর আজকাল রুদ্রর কল্পনার জগতে স্থান করে নিতে পারে না। আজকাল আর ভাবনার জন্ম হয় না তার মস্তিষ্কে। আর হয়েই বা কি লাভ! ছবিগুলো তৈরি হওয়ার পরে একজিবিসান করো। এখানে পাঠাও, ওখানে পাঠাও। সে অনেক পরিশ্রমের ব্যাপার। তার থেকে কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় বড়ো প্রকাশকের ঘরে বই-এর প্রচ্ছদ, লে-আউট করলে পয়সা খারাপ পাওয়া যায় না, পরিশ্রমও কম।

কিন্তু লিপিকা বলে, তোমাকে অত পয়সার চিন্তা কে করতে বলেছে! সে তো আমার দায়িত্ব, তুমি শুধু মন দিয়ে ছবি এঁকে যাও।

উত্তরে রুদ্র ঠোঁট ফাঁক করে সিগারেটের ধোঁয়া সরু করে ছেড়ে দিয়েছিল ঘরের সিলিঙের দিকে। বলেছিল, ধুস, যা বোঝে না তা নিয়ে অতো কথা বললো কেন—

এক বাকরুদ্ধ ব্যথায় কঁকিয়ে উটেছিল লিপিকার ভিতরটা। সে বলতে পারেনি তুমি ঠিকই বলেছো, আমি ছবির কিছু বুঝি না। কিন্তু আমি তো কোনদিন ছবি বুঝতে চাইনি, বুঝতে চেয়েছি শুধু আঁকিয়ে মানুষটাকে, সেই যে কফিহাউসের দিনগুলোতে তোমার ক্ষয়াটে গাল, সামান কোটর গর্ত চোখ, চোখের নিচে কালি, দীর্ঘ নাকের নিচে শুয়োপোকার রোমের মত গুঁড়োগুড়ো গোঁফ, অধজ্বলন্ত বিড়ি আর অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ভাবনা কথা, আমি যে সেই রুদ্রকেই ভালোবেসেছি। সেই রুদ্রকেই চেয়ে এসেছি বরাবর। এই যে এখন তুমি পরিণত, দাবানলের মত আবেগ আর কণ্ঠ বেয়ে ঝরে পড়ে না, কখন কাকে কি কথা বললে সন্তুষ্ট করা যাবে জেনে গেছ, এখন তোমার গাল আর ক্ষয়টে নয়, হাসলে মেদ ঢেউ তোলে থুতনির নিচে, বিড়ি নয়, কিংসাইজ এখন তোমার ঠোঁটে, এই উজ্জ্বল রুদ্রকে যে আমি কোনদিনও চাইনি, এই উজ্জ্বল রুদ্র তো আসলে রুদ্রর মৃতদেহ….। লিপিকা বুঝেছিল এইকথাগুলো তার পক্ষে রুদ্রকে বলা সম্ভব হয়নি। কারণ ঐ শেষের ভয়ঙ্কর শব্দটা তার পক্ষে উচ্চারণ করা কঠিন ছিল।

কলেজ স্ট্রিট পাড়ার প্রকাশকের ঘর থেকে ফেরার পথে কফিহাউসের দরজায় দেখা হয়ে গিয়েছিল প্রবীরের সঙ্গে। চমকে উঠেছিল রুদ্র, এ কি চেহারা করেছিস। রুদ্র দেখেছিল চুল উঠে মাথার ওপরে জায়গায় জায়গায় টাক পড়ে গেছে প্রবীরের। গাল আরও ঢুকে গেছে। দুচোখে অদ্ভুত এক হলুদ ছোঁয়া। যেন অনন্ত জন্ডিস ওর সঙ্গী। কি করছিস? রুদ্রের প্রশ্নের উত্তরে প্রবীর ওর সম্পাদনায় সাত বছর ধরে চরম নিয়মিত ভাবে প্রকাশপাওয়া লিটিল ম্যাগাজিনের নবতম সংখ্যাটি ধরিয়ে দিয়েছিল প্রশ্নকর্তার হাতে। আর ফিসফিস করে বসেছিল, কোন জায়গা থেকে ধরে কিছু টাকার। ব্যবস্থা করে দে না, আগামী ইস্যুটা না হলে বেরবে না, দরকার হলে সুদ দেবো…।

রুদ্র প্রায় হেসে ফেলেছিল। শীর্ণ প্রবীর আরও শীর্ণ হয়েছে। লাঠির মত সরলরেখা হয়ে গেছে। মানুষটাই নেই। আসলই নেই, সেখানে সুদ আসবে কোথা থেকে। তাই বলেছিল, এভাবে নিজেকে ক্ষয় করে কি লাভ—

প্রবীর যেন চমকে উঠেছিল ওর কথায়, এটাকে তুই ক্ষয় বলছিস। এটা যে কি…..

তারপর নিজের থেকেই কথার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল প্রবীর। বলেছিল, ঠিকানাটা দে, একদিন যাবো….।

ঠিকানা দিয়েছিল রুদ্র। তারপর লিপিকার কথা জিজ্ঞেস করায় রুদ্র বুঝেছিল তাদের বিয়ের কথাটা প্রবীর জানে না। মজা করার একটা ইচ্ছে ভিতরে প্রবল হয়ে উঠেছিল রুদ্রর। বলেছিল, আমার সঙ্গে আর দেখা হয় না রে, তোর সঙ্গে হয়?

লিপিকার সঙ্গে রুদ্রর আর দেখা হয় না শুনে প্রবীর অবাক হয়েছিল। কফিহাউসের সেই আড্ডার সকলেই তো জানতো মাটির বুক থেকে হিমালয়কে সরিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু লিপিকার জীবন থেকে রুদ্রকে বা রুদ্রর জীবন থেকে লিপিকাকে আলাদা করা যাবে না কোনদিন। সেই লিপিকার সঙ্গে রুদ্রর এখন আর দেখা হয় না। আবেগে প্রবীর মনের রুদ্ধ গোপন দ্বার খুলে ধরেছিল রুদ্রর সামনে। বলেছিল, আমি জানতাম ও কোথাও নোঙর করবে না, শুধু এ-ঘাট থেকে ও-ঘাট, ও-ঘাট থেকে সে-ঘাটে ঘুরে বেড়াবে…..। এক কপট সিরিয়াস ভাব মুখে চোখে আটকে সেই মুহূর্তে প্রবীরের কথাগুলো শুনছিল রুদ্র। আর সেটাই যেন প্রবীরের কথা বলার উৎসাহকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। আর রুদ্র তখন ভিতরে ভিতরে হোহো করে হাসছিল।

আজ সকালে এবাড়িতে ঢুকে সিঁথিতে সিঁদুর টানা, হাতে শাঁখা-পলা পরা লিপিকাকে দেখে চমকে ওঠে প্রবীর। সেই মুহূর্তে যে কি চরম অস্বস্তিতে কেটেছে তা একমাত্র রুদ্রই জানে। আসলে সে তো কল্পনাও করতে পারেনি, প্রবীর শেষ পর্যন্ত চলে আসবে। আর সকালের সেই পর্বের রুদ্র আর প্রবীরের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে লিপিকাও জেনছে রুদ্র তাদের বিয়ের কথাটা প্রবীরকে জানায়নি। প্রবীরের দুটি বিহ্বল চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝেছে জানায় তো নি, উল্টে প্রবীরকে নিয়ে এক নিষ্ঠুর কৌতুক করেছে রুদ্র। কেন? কেন? কেন এরকম হয়ে উঠেছে রুদ্র। এখন তো রুদ্রর জীবনে ব্যথা অনিশ্চয়তা ব্যাপারগুলো কতো কমে গেছে। তাহলে রুদ্র এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে কেন। আচ্ছা, ব্যথা মরে গেলেই কি মানুষ এমন নিষ্ঠুর কৌতুকপ্রিয় হয়ে ওঠে! না, না, ব্যথা নয়, অন্য কোন কিছু মরে গেলেই বোধহয় মানুষ এমনই কৌতুকে মেতে ওঠে। কিন্তু সেটা কি? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না লিপিকা।

দু পেগ মদ সাত-সকালে শরীরে যাওয়ায় স্নায়ুগুলো সব ধনুকের মত টানটান ছিলা হয়ে উঠেছে রুদ্রর। রান্নাঘরে আসতে দেখল ডিমের ঝুরি ভাজছে লিপিকা। ওর ঠিক মনে আছে, প্রবীরের প্রিয় চাট কি। এ-পাড়ায় দোকান বন্ধু বলে পাশের পাড়ার দোকান থেকে ডিম-পেঁয়াজ নিয়ে এসে ঝুরি ভাজছে লিপিকা। রান্নাঘরের চৌকাঠের কাছে এসে রুদ্র দাতের সঙ্গে দাঁত ঘষে বলে, এটা কি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না!

কিসের বাড়াবাড়ি?

ওকে তুমি মদ খেতে অ্যালাও করলে কেন?

অ্যালাও করার কি আছে। তোমার পুরনো বন্ধু, একসঙ্গে অনেক মদ খেয়েছ, তাছাড়া আড্ডার মাঝখানে ও যেভাবে বোতলটা বের করে ফেলল, তাতে না বলার সুযোগটা পেলাম কই……

সুযোগ পেলাম কই, রাগে রুদ্র ভেংচে উঠল। কেন, আমার মুখ থেকে তো মাঝেমধ্যে গন্ধ পেলে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শোও, তাও তো আগের মত রেগুলার খাই না….

তুমি তো নিজের জন্যে খাও না, তুমি তো এখন মদ খাও তোমার প্রয়োজনের লোকদের খুশি করার জন্যে, আর আজ যা বুঝলাম তা হল প্রবীর খায় শুধু নিজের জন্যে….

তাতে হয়েছেটা কি! এবার শুধু দাঁত্রে সঙ্গে দাঁত নয়, রুদ্রর শরীরে হাড়ের সঙ্গে হাড় ঢুকে যায়।

লিপিকার ভিতরে এসব কিছু তেমন কোন রেখাপাত ঘটাতে পারে না। নির্লিপ্ত স্বরে বলে, হবে আবার কি, বলছিলাম শুধু তফাতটার কথা। ও আর তোমার তফাৎ, তুমি অনেক দূর এগিয়েছ, অনেক সুন্দর হয়েছ, কিন্তু তুমি আর তুমি থাকতে পারোনি, ও ক্ষয়েছে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে আর শীর্ণ হয়েছে, কিন্তু ও প্রবীরই রয়ে গেছে। এখনও সেই আগের মতই ব্যথা পেতে জানে। সকালে ও যখন সবে এবাড়িতে ঢুকেছে, দেখলে না আমার সিঁথিতে সিঁদুর দেখে কিরকম বিহ্বল হয়ে পড়ল। কেন তুমি জানাওনি ওকে আমাদের বিয়ের কথাটা…

রুদ্র মেঝের ওপরে দৃষ্টি নামিয়ে আনে। বলে, বিশ্বাস করো, অতো ভেবেচিন্তে ব্যাপারটা আমি করিনি। সেদিন ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে হঠাৎ করে ওকে নিয়ে একটু মজা করতে ইচ্ছে হয়েছিল…

মজা! হাঁ করে রুদ্র দিকে তাকাল লিপিকা। বলল, তুমি না শিল্পী, ছবি আঁকো!

আঁকি তো। এবার রুদ্রও অবাক।

প্রবীর, তো কবিতা লেখে, লিটিল ম্যাগাজিন করে, ও তো তোমারই মতো শিল্পী, একজন শিল্পী আরেকজন শিল্পীকে নিয়ে এভাবে মজা করতে পারে। কৌতুকপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। তুমি না আমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে। লিপিকা কিরকম যেন কঁকিয়ে ওঠে। বলে, তোমার ভিতরে শিল্পী-মানুষটা মরে গেলে আমি কাকে ভালোবাসবো বলল তো….

এখন রাত্রি-সমুদ্রের নীরবতা এই জনবসতিপূর্ণ লোকালয়ের ঘরটিতে।

রুদ্র ধীর পায়ে রান্নাঘরের সামনে থেকে সদরের দিকে চলে আসে। প্রবীর বলেছিল সিগারেট ফুরিয়ে গেছে। সিগারেট আনতে হবে এখন। সিগারেট আনা নয়, রুদ্র আসলে পালাল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বুঝতে পারছিল, কেন সকাল থেকে লিপিকা প্রবীরের মদ খাওয়াটাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। প্রবীর তো আসলে মদ্যপান করছে না। প্রবীর তো আসলে তার শরীরে সৃষ্ট ক্ষতের নিরাময় করছে। যে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। রুদ্রের কৌতুক।

খাঁচার ভিতর সুচিন পাখি কমনে বাঁইচে রয় – শওকত আলী

খিলগাঁও-এর বাসায় ঘরগুলো বেশ বড় ছিল, বারান্দাটাও ছিল চওড়া। ওদিকে আবার বাচ্চার স্কুল, বাজার, বাসস্ট্যান্ড—সবই ছিল কাছাকাছি। অসুবিধা ছিল শুধু একটাই, আর তা হল, সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই ইলেকট্রিসিটি থাকতো না। একদিন-দু’দিন পরপর সন্ধ্যাটি হতো আর অমনি ঝপ করে নেমে আসতো অন্ধকার। তখন মোমবাতি ধরাও, নইলে কুপি জ্বালাও, কেরোসিন আছে না ফুরিয়ে গেছে তা দেখে লণ্ঠনের চিমনি। মোছে—এইসব হাঙ্গামায় পড়তে হতো। হাঙ্গামা-টাঙ্গামা শেষ করে মেয়েকে পড়াতে বসতে বসতে রাত সাড়ে সাতটা/আটটা বেজে যেতো তখন আবার একসঙ্গে দুই কাজ-মেয়েকে পড়ানো একদিকে আর অন্যদিকে রান্না করা। দুই কাজই একসঙ্গে করতে হতো। শুধু একটা করতে গেলে অন্যটা বাদ পড়ে যেতো। মেয়েকেই যদি শুধু পড়াতো, তাহলে রাতের খাওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়ে যেতো। কারণ কর্তার শুধু ভাত নয়, তরকারিও সদ্য রান্না হওয়া চাই। তবু ঝামেলা-টামেলা থাকা সত্ত্বেও সে মোটামুটি মানিয়ে নিয়েছিল। নীলফামারী থেকে বাস উঠিয়ে ঢাকার এই খিলগাঁওয়ের বাসায় ঠাই গাড়া, সোজা ব্যাপার নয়। তবু সে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে সংসার পেতেছিল। শুধু সংসার পাতাই নয়, নিজে কিছু করতে পারে কি না, সেই চিন্তাও তার মগজের ভেতরে ঢুকে পড়েছিল।

সকাল ন’টার দিকে আতিক বেরিয়ে যেতো, সেই জন্যে রান্নাবান্নার কাজ শেষ করতে হতো আটটার মধ্যেই। স্বামী বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই মেয়েকে নিয়ে স্কুলের পথে বেরুতে হতো। মেয়েকে ক্লাসে ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে আর তার কোনো কাজ নেই। সে স্কুলেই থেকে যেতো তারপর। মেয়ের ছুটি না হওয়া পর্যন্ত। বাসায় ফিরে সে করবেটাই বা কী? একাকি শুধু এঘর-ওঘর করা, নইলে জানালা দিয়ে রাস্তায় মানুষ দেখা তাছাড়া তিন ঘন্টা পর তো আবার মেয়েকে নেওয়ার জন্য আসতেই হবে। সুতরাং সে বাসায় ফিরতো না। অন্য বাচ্চাদের মায়েদের সঙ্গে সে স্কুলের। বারান্দায় নয়তো মাঠের গাছতলায় ঘাসের ওপর বসে আড্ডা দিতো।

স্কুলের নতুন টিচার তাজিন বেগমের সঙ্গে ঐ সময় তার আলাপ হয়। মহিলা একদিন বলে বসেন, আচ্ছা, আপনারা ওভাবে গল্প করে সময় নষ্ট করেন কেন, বলুন তো? অতক্ষণ ধরে কথা বললে মুখ ব্যথা করে না আপনাদের?

তাহলে কী করব?

বইটই সঙ্গে করে আনলেই তো পারেন। বই পড়ে দিব্যি সময়টা কাটিয়ে দেবেন।

বান্টির মা মোটাসোটা ভারিক্কি ধরনের মহিলা। তিনি বলে ওঠেন, বইয়ের কথা বলবেন না ভাই, স্কুল-কলেজে থাকার সময় ওসব অনেক পড়েছি, আর না এখন আমরা সংসারের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, অন্য পরীক্ষা দিতে পারব না।

আহা, পরীক্ষার কথা আপনাদের কে বলেছে! পরীক্ষার কথাতো আমি বলি নি। তাজিন বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু বান্টির মা কোনো কিছু বলার সুযোগ দেয় না। বলে, হয়েছে ভাই, ঐ পড়াপড়ির মধ্যে আমরা নেই।

তাজিন সমবয়সী হবে বলে মনে হয় শাহিনার; তাই সামান্য ঘনিষ্ঠতাও হয়। একদিন সে জিজ্ঞেস করে বসে, আপনি আগে কোথায় ছিলেন মানে কোন্ স্কুলে?

কোনো স্কুলে ছিলাম না। তাজিন বলতে থাকে। বলে, বাসায় ছিলাম, রান্নাঘরে—এই স্কুলেই আমার প্রথম চাকরি।

নিজের থেকেই তাজিন আরও গল্প শোনায়। তাতে জানা যায়, স্বামীর উৎসাহে সে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হয়ে পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাস করেছে, তারপর চেষ্টাচরিত্র আর ধরাধরি করেই স্কুলে চাকরিটা পাওয়া।

ওই গল্প শুনে শাহিনা কৌতূহলী হয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, আপনার স্বামী নিশ্চয়ই কলেজে-টলেজে আছে?

নাহ্, কীসের কলেজে থাকবেন? এম. এ. পাস করলে তবে না কলেজে চাকরি হবে, ওতো বেকারই থাকে বেশির ভাগ সময়।

তার মানে?

নতুন নতুন সব খবরের কাগজে ঢুকে পড়ে, তার কিছুদিন পর কাগজ বন্ধ হয়ে গেলে বেকার হয়ে যায়।

তাহলে পুরনো ভালো কাগজে ঢুকলেই পারেন।

আরে নাহ্, তাজিনের গলায় কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছিল। বলেছিল, ভালো কাগজে ঢুকলে ওঁর রাজনীতিটা কে করবে?

তাজিন আরও দুঃখের কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু সেসব সে মনে রাখে নি। ওর ঐ প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হয়ে বি.এ. পাস করার খবরটা তার মগজের ভেতরে ঠাই নিয়ে নেয় এবং তাকে খোঁচাতে শুরু করে। তার ফলে সে মনে মনে সুযোগ খোঁজে। স্বামী রত্নটিকে কিছু জানায় না। কেননা তিনি আবার মেয়েদের স্কুল কলেজে লেখাপড়া শেখানোর ঘোর বিরোধী। এমনকি নিজের বাচ্চা মেয়ে সামিনাকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি করানোর সময়ও তার আপত্তি ছিল—তার ইচ্ছে ছিল মেয়েকে মসজিদের মক্তবে পাঠানোর। শেষে অনেক বলে কয়ে যখন বোঝানো হলো যে কেজি স্কুলেও আজকাল ইসলাম ধর্ম বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, তখন সাহেবের সম্মতি পাওয়া গেল। সবই ভাল চলছিল। সে দিব্যি তাজিনের কাছ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসটাও চেয়ে নিয়েছিল, তার দেখাও হয়ে গিয়েছিল যে শুধু বাংলা আর ইংরেজিতেই এখন যা আলাদা। অন্যসব বিষয়ের সিলেবাস একই রকম, আট বছর আগে যা ছিল। সে মনে মনে আশা করতে শুরু করে তখন যে, প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে সে আল্লাহর ইচ্ছায় অনায়াসে বি. এ. পাস করতে পারবে। আর যদি সে পাস করতে পারে, তাহলে একটা কাজটাজ জোটানো কি অসম্ভব কিছু? সামিনাদের এই এ্যাপোলো কিন্ডারগার্টেনেই কি তার কাজ জুটতে পারে না?

তার আরও মনে হয়, সে যদি কাজটাজ জুটিয়ে নিতে পারে তাহলে আতিককে এখনকার মতো উদয়াস্ত খেটে বেড়ানোর দরকার হবে না। এইরকম চিন্তাভাবনা আর। আশা-আকাঙ্খ নিয়ে সে বলা যায় একরকম গুছিয়েই বসেছিল। বাড়িওয়ালার শালা সাবিদ আলীও বি.এ. পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল। খবরটা জেনে সে তাকেই ধরল বইপত্র যোগাড়ের ব্যাপারে। আতিককে কিছু বলে নি, কেননা বললে সে হাসাহাসি করবে। ভেবেছিল নিজে তৈরি হয়ে উঠতে পারলে তখন সে সবাইকেই জানাবে।

কিন্তু পারা যায় নি। মাস্টার মানুষ ঘরে বই থাকলে তার নজরে না পড়ে পারে?

প্রথম দিন ইয়োরোপের ইতিহাস বইখানা টেবিল থেকে তুলে হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, এ বইখানা কোত্থেকে এল?

শাহিনা তখন পাশের ঘরে ছিল। মেয়ে সামিনা জানিয়ে দিল, ও বই তো সাবিদ চাচার। আম্মুকে পড়তে দিয়েছে। বলেছে, আরও বই দেবে।

কবে দিয়েছে?

কেন, কাল দিয়ে গেল। আমরা স্কুল থেকে আসবার পর আমার হাতে দিয়ে গেছে।

আতিক বইখানা উল্টেপাল্টে দেখে আবার টেবিলের ওপর রেখে দেয়। দিন দুয়েক পরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান-এর বই চোখে পড়লে আতিক ফের মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, সাবিদ চাচা আবার কবে এসেছিল?

বাহ্ এই তো, সকাল বেলা, যখন স্কুলে যাচ্ছিলাম, সামিনা হাসতে হাসতে জবাব দেয়।

তখন কিছু বলে না আতিক। কিন্তু রাতের বিছানায় বউকে এক প্রস্থ ভোগ করার পর জিজ্ঞেস করে, ঐ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বইখানা কি তুমি পড়ছে?

হ্যাঁ, শাহিনা ব্লাউজের বোতাম লাগাতে লাগাতে জবাব দেয়। বলে, দুপুরে কোনো কাজ থাকে না, তাই…..।

হুঁ, কাজ না থাকলে বই পড়া ভাল কিন্তু ও তো পাঠ্যবই, ছাত্ররা পড়ে—তুমি কী বুঝবে ওসব বই পড়ে?

দেখি পড়ে, শাহিনা বলে। বলে, একসময় তো পড়তাম, আমিও তো ছাত্রী ছিলাম।

সে তো এক যুগ আগের কথা।

একটু থেমে ফের বলে আতিক, পরীক্ষা-টরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে-টিচ্ছে হচ্ছে নাকি?

ইচ্ছে তো হয়ই।

তা ইচ্ছেটা কি সাবিদ আলী জাগিয়ে দিয়েছে?

শাহিনা লু হাসে। বলে, বাহু তা কেন হবে, ও এবার পরীক্ষা দিচ্ছে, তাই ওর কাছ থেকে বই চেয়ে নিলাম।

আতিক আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে।

শাহিনার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটার ওখানেই শেষ কিন্তু পরে দেখে ব্যাপারটা নতুন সমস্যা তৈরি করে বসে আছে। দিন দুই পর থেকেই দেখে কর্তার মেজাজ একটুতেই খিচড়ে উঠছে। একই বাড়ি নিচতলায় বাড়িওয়ালা থাকে। সিঁড়ির মুখে কেন পানি জমে থাকে তাই নিয়ে গজর গজর করে। কলে যদি পানি না থাকে, তাহলে চাচামেচি জুড়ে দেয় আর নিচতলা সিঁড়ির পাশে, ড্রেনের ওপর বাড়িওয়ালার দু’বছরের নাতিটিকে যদি হাগতে বা মুততে দেখে তাহলে গালাগাল করে বাড়িওয়ালার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দেয়।

ঐ একই সময়ে শাহিনা স্বামীর মুখে এক নতুন আফসোস শুনতে পায়—কেন সে ছেলের বাপ হতে পারল না! বাপ সে হল, কিন্তু ছেলের নয়, মেয়ের। বিয়ে সে করল, তাতেও তার দান-যৌতুকহীন খটখটে কপাল। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে যে সংসার পাতল, সেখানেও আয় বরকত বলে কিছু ছিল না। আর বউটাও এমন যে বেটাছেলে পেটে ধরতে পারে না। আর যদি ছেলেপুলে না হয় বউয়ের, তখন?

শাহিনা বুঝতো, মানুষটার বড় আশা ছিল যে প্রথম সন্তানটি ছেলে হবে, কিন্তু তা না হওয়াতে মনের ভেতরে ক্ষোভ জমে আছে।

কিন্তু ঐ ক্ষোভ দূর যে করবে, সেই সাহস তার তখন কোথায় মফস্বলের প্রাইভেট স্কুলের অস্থায়ী চাকরি, কোনো মাসে বেতন হয়, কোনো মাসে হয় না–সরকারি অনুদানের টাকা আসে তিন মাস পর পর। অমন অবস্থায় সে কেমন করে ছেলে হওয়ার ঝুঁকি নেয়! লুকিয়ে লুকিয়ে পিল খাওয়া ধরেছিল, সেটাই সে চালিয়ে যেতে থাকে।

আতিক টের পেয়েছিল কি না সে জানে না। তবে ওব্যাপারে নজর দেওয়ার মতো অবস্থা তার তখন একেবারেই ছিল না। চাকরি খুঁজবে না বউয়ের পেট কেন বানাতে পারছে না তার খোঁজ করবে? সৈয়দপুর জংশন-এর রেলওয়ে স্কুলে লিভ ভ্যাকান্সিতে বছরখানেক কাজ করা পরও যখন চাকরি হল না তখন গেল বদরগঞ্জ। সেখানে সুবিধা না হলে বলীগ জামাতের এক লোক ধরে লম্বা পাড়ি দিয়ে একেবারে টঙ্গীর এক স্কুলে, তারপর সবার শেষে এই ঢাকার মাতুয়াইলে। তবু তো। প্রথম প্রথম মনস্থির করতে পারে নি চাকরিতে থাকতে পারবে কি পারবে না করতে করতে একটা বছর পুরো পার হলে তারপর বউ বাচ্চাকে নিয়ে ঢাকায় আসা। আর সেই তবলীগ জামাতের মানুষটির সুপারিশেই তার খিলগাঁওয়ের বাসা ভাড়া নেওয়া। এখন সকালে স্কুল, বিকেলে কোচিং সেন্টার আর রাতে একটা টিউশনি। রোজগার যা হচ্ছে তাতে সংসার মন্দ চলছে না। কিন্তু মানুষটার পরিশ্রম যে চোখে দেখা যায় না, তার কী হবে! তার খুব খারাপ লাগে। সংসারের জন্য মানুষটা একা একা খেটে মরবে? সংসারটাতো তারও। কিছুই কি সে করতে পারে না?

কিন্তু তার চিন্তাভাবনা যা-ই হোক, তাকে পাত্তাটা দিচ্ছে কে? কর্তাটির মুখে তখন উঠতে বসতে বউকে খোঁটা আর সর্বক্ষণ বাসাবদলের হুমকি। একেকদিন মেয়েকে কোলে বসিয়ে আদর করতে করতে জিজ্ঞেস করে, সাবিদ বই দিতে এসেছিল? আসে নি? বই দিতে এলে কি ঘরে ঢোকে? ঢোকে, তাই না? তখন কি দরজাটা খোলা থাকে?

শাহিনা একটু আড়ালে নিজেদের রাখলে কী হবে, কানে আসে সব কথাই, তখন সে কাদবে না হাসবে বুঝে উঠতে পারে না। সাবিদের মতো একটা অল্পবয়সী ছেলেকে জড়িয়ে বউকে যে মানুষ সন্দেহ করে, সে মানুষকে কী বলা যায়? প্রতিবাদ করারও তো রুচি হয় না তার। সে এও বোঝে—কোনোরকম প্রতিবাদ করে লাভ হবে না। সে বোঝাতে চেষ্টা করে আর সেজন্যে সে আরও ঘনিষ্ঠ হয়। অবশ্য অমন স্বামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারটা যে আসলেই শারীরিক সেটা তার অজানা ছিল না। যে মানুষ সকাল নয়টায় বেরিয়ে দুটোয় বাসায় ফেরে তারপর আবার তিনটায় বেরিয়ে ন’টায় দশটায় ফেরে, তার সঙ্গে কী ধরনের ঘনিষ্ঠতা হতে পারে সে ভেবে পায় না। শোয়ার পর একটু এটাওটা সংসারের কথা হয়। তারপর ধামসাধামসি চলে কিছুক্ষণ। শেষে বাবুসাহেব একেবারে কাত এবং শুরু হয় তার নাসিকা গর্জন।

এমন অবস্থায় শাহিনার আর কী উপায়? সে পিল খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তারপর একদিন রাতে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, সামিনা তো ছ’বছরের হল, এখন আমাদের আর একজন দরকার, তাই না?

তার অমন দৃঢ় স্বরের কথার প্রতিক্রিয়ায় বীর পুরুষটির মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোয় না—যা হয় তার সবই শারীরিক এবং ধামসাধামসিটা সে রাতে এতো বেশি জোরে হয় যে দশ মাস আগে রাস্তার ধার থেকে কেনা পুরনো খাটখানি ভেঙে পড়ে।

শাহিনার ধারণা হয়েছিল তার পিল খাওয়া বন্ধের খবর এবং সন্তান ধারণের ইচ্ছা জানার পর আতিকের বাসাবদলের বাতিকটা কেটে যাবে। দেখা গেল আতিক সত্যিসত্যিই বাসা বদল সম্পর্কে কিছু বলছে না। উপরন্তু বাসায় ফেরার সময় কলাটা, কমলাটা, আপেলটা, প্রায় প্রতিদিনই আনছে। আর বাসায় ফিরতে বেশি রাতও করছে না।

দেখতে দেখতে এক মাস কেটে যায়। আতিক বউয়ের মুখের দিকে তাকায়, শরীরের দিকে তাকায়। কিন্তু উঁহু! কোনো লক্ষণই আবিষ্কার করতে পারে না। শাহিনারও চিন্তা হয়, ব্যাপারটা কী? সে বাঁজাটাজা হয়ে গেল নাকি? ছবর বার্থ কন্ট্রোল করলে মেয়েরা কি বাঁজা হয়ে যায়? সে ভেবে পায় না কার কাছে জিজ্ঞেস করবে কথাটা।

তার চিন্তা হয়, কিন্তু তবু বেশি পাত্তা পায় না চিন্তাটা। কারণ পড়াশেনার দিকে ততোদিনে তার মন বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ইতিহাসের ফার্স্ট সেকেন্ড দুটো পেপারই মোটামুটি তার আয়ত্তে এসে গেছে। এখন বাকি শুধু থার্ড পেপারটা—সে ওটা নিয়েই তখন ব্যস্ত। তাকে বই জোগানো, প্রশ্ন তার সঙ্গে আলোচনা সাবিদ আলীই করছে।

একদিন দুপুরের আগে, বেলা তখন বোধহয় এগারোটা, হঠাৎ আতিককে আসতে দেখা যায়। তখন সাবিদের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে আলাপ করছিল। অবশ্যি সাবিদ আতিককে দেখামাত্র নিচে নেমে যায়। আর সেও চলে আসে নিজের ঘরে। তাই প্রথমে মনে হয়েছিল আতিক তাদের দেখে নি। কারণ দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়া করল। রান্না খুব ভাল হয়েছে বলে প্রশংসা করল, কটার সময় মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাবে, তাও জিজ্ঞেস করল। তার অমন কথাবার্তা শুনে কে আন্দাজ করবে যে মানুষটা মনের ভেতরে অন্যরকম শয়তানি প্যাঁচ কষছে।

বিছানায় গড়িয়ে পড়ার সময় আতিক ডেকে বলে, একটা কথা শোনো, আমি কিন্তু রোজ দুপুরের আগেই বাসায় এসে যাবো, বুঝলে?

শাহিনার অবাক লাগে, কী এমন ঘটল যে সাহেবের এমন সুমতি! কথাটা তার মনে হয় কিন্তু মুখে সে কিছুই বলে না।

কী বললাম, বুঝলে? আতিক পরে জিজ্ঞেস করে। তারপরে জিজ্ঞেস করে, ঐ সময় আমি যদি বাসায় আসি তাহলে কি তোমার অসুবিধা হবে?

বাহ্, আমার কেন অসুবিধা হবে? শাহিনার রীতিমতো রাগ হয়। সে সোজাসুজি জবাব দেয়। বলে, তুমি যখন খুশি আসবে-যাবে, তাতে কার কী? তুমি সংসারের কর্তা ওভাবে ন্যাকার মতো কথা কেন বলেছে?

ও, আমি তাহলে ন্যাকামি করছি তাই না?

চোখে চোখ রেখে আতিক কুটিল হাসি হাসে। বলে, দুপুরের আলাপটা তোমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করো, নাকি ঘরের ভেতরেও তোমাদের আলাপ চলে?

শাহিনার শরীর-মন থমকে স্থির হয়ে যায়–ছি!! এসব কী বলছে মানুষটা? যার মন এতো নিচু আর প্রশ্নটা এতো নোংরা! সে কী জবাব দেবে? সে জবাব না দিয়ে বলে, তুমি তোমার নোংরা মন নিয়ে যতো ইচ্ছে নোংরা ঘাঁটো, আমি মেয়েকে আনতে স্কুলে গেলাম।

সে ঘর থেকে ঐ মুহূর্তেই বেরিয়ে পড়ে।

ফিরতে সে দেরি করে না। বলা যায় আধঘন্টার মধ্যেই সে ফিরে আসে এবং দেখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাবিদের সঙ্গে গল্পে আতিক মশগুল। তার ভাবসাব দেখে মনে হয়, যেন কতোকালের আপনজনের সঙ্গে কথা বলছে।

শাহিনার দৃশ্যটা দেখতে ভাল লাগে। আশা হয়, হয়তো সাবিদ আলীর সঙ্গে যে ভুল ধারণাটা আতিকের রয়েছে, সেটা কেটে যাবে। কিন্তু খানিক পরই তার মনের ঐ আশা উবে যায়।

মেয়েকে নিয়ে তখন সে খেতে বসেছে। ঐ সময় বারান্দা থেকে ঘরে এসে আতিক জানায়, আমি এবার যাই। অনেক দেরি হয়ে গেছে, সাবিদ ছেলেটা তো মহা ধুরন্ধর। সহজে কিছুই বলতে চায় না।

শাহিনা মুখের দিকে তাকালে সে ঠাট্টার ভঙ্গিতে ফের বলে, অন্য কিছু না, শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম, দুপুরবেলা যে অততক্ষণ ধরে আলাপ করো, তাতে কী বুঝছো, তোমার ভাবী কি পরীক্ষা দিতে পারবে? তো ছোঁড়া স্বীকার করল যে হ্যাঁ, পরীক্ষা দিলেই পাস করে যাবে। কিন্তু এটা কিছুতেই স্বীকার করল না যে রোজ দুপুরবেলা

সে তোমার সঙ্গে আলাপ করে। যখন বললাম, যদি আলাপই না করো, তাহলে কীভাবে বুঝলে যে ও পরীক্ষা দিলেই পাস করবে? তখন আমার ঐ প্রশ্ন শুনে বাছাধন বেকায়দায় পড়ে গেল, মুখ দিয়ে আর কথা বের হয় না, বুঝলে? সব আমি বের করে ফেলতে পারি।

খাওয়া তখন লাটে উঠেছে শাহিনার। বুকের ভেতরটা ভয়ে তখন হিম। মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হয় না রাগ-ঘেন্না-বিরক্তি-এসবের শেষ সীমায় পৌঁছা’লে মানুষ কী করতে পারে? আসলে এমন অবস্থায় মানুষ কিছুই করতে পারে না। সে বোবার মতো স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে আর আতিক এমন ভাব নিয়ে বেরিয়ে যায় যে মনে হয়, সে দুনিয়া জয় করে ফেলেছে।

শাহিনা ঐ দিন থেকে চুপ হয়ে যায়। আতিকের মুখের ওপর কোনো কথা বলে। দুপুরে রোজ বাসায় ফেরে। গোসল, খাওয়া-দাওয়া করে বিছানায় গড়ায়, ততক্ষণে শাহিনা মেয়েকে নিয়ে বাসায় ফেরে। তিনটের দিকে আতিক ফের বেরিয়ে যায়। ফেরে রাত নটার পর। টিভিতে দশটার খবর আরম্ভ হলে খেতে বসে। খাওয়া দাওয়া শেষ হরে বাসন-কোশন ধোয়া-পাকলা সেরে যতোক্ষণ পর্যন্ত বউ বিছানায় না। আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত জেগে থাকে। বিছানায় বউ এলে কাছে টেনে নিয়ে ঘাড়ে-পিঠে। হাত বোলায়। তারপর নিত্যকার গরম শরীর থেকে খালাস করে দিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়। শাহিনার কিন্তু ঘুম আসে না। এ কেমন জীবন হয়েছে তার? অতীত বর্তমান মনের ভেতরে ওলটপালট করে। মফস্বল শহরের কালো বরন মেয়ে। বাপ স্কুলের মাস্টার, ছাত্রী ভাল হলেই বা কী, মেয়ের শেষ গতি তো বিয়েতে। যতোদিন বিয়ে না হচ্ছে, ততোদিন পড়ুক। আর বিয়ে হবেই বা কীভাবে? মেয়ের বিয়ে দিতে যৌতুক লাগে না? ছেলে গ্র্যাজুয়েট হলেই তার দাম এক লাখ। আর যদি মোটর সাইকেল দিতে পারে শ্বশুর তাহলে তো আরও ভাল। মেয়ের বিয়ে সহজেই হয়ে যায়। যে পারে না, তার মেয়ের বয়স শুধু বেড়েই চলে, আই.এ. পাস করুক কি বি.এ. কিছুতেই কিছু হয় না। শাহিনার যখন ঐ রকম বয়স বাড়ছিল, বি. এ. ক্লাসের ফোর্থ ইয়ারে উঠেছে, ঐ সময় সম্বন্ধটা আসে। ছেলের আসল বাড়ি বর্ডারের ওপারে। জলপাইগুঁড়ি। এপারে বাড়িঘর, আত্মীয়-স্বজন কিছুই নেই, বি.এসসি. পাস. দিতে থুতে হবে না। ছেলের শুধু বসবাস করার জন্য বাড়ি চাই। তবে হ্যাঁ, ঘরজামাই কিন্তু সে থাকবে না।

আতিকুল ইসলাম প্রধান, বি.এসসি. কে পেয়ে বেলাল মাস্টার যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। পছন্দ না করার কোনো যুক্তি নেই। আলাদা জায়গা তো তার নেই। একই উঠোনের একদিকে একখানা শুধু ঘর তুলে দেবেন, কেন পারবেননা—খুব পারবেন। মেয়ের মা খুঁতখুঁতে করে উঠেছিল ছেলের নাকি বয়স বেশি। তা হোক বয়স বেশি, বউকে ধমকে উঠেছিল বেলাল মাস্টার। বলেছিল, তোমার মেয়ের বয়স কি কম, এ্যাঁ? বলো, কম তোমার মেয়ের বয়স?

ধমকে উঠলে কী হবে, বেলাল মাস্টার নিজেও জানজ্ঞে ছেলের বয়স মেয়ের। তুলনায় বেজায় বেশি, ১৯৭২ সালে স্কুলের পড়া শেষ করলে ১৯৯৪ তে কত বয়স হয় ছেলের! কম করে হলেও ৩৭/৩৮। তাহলে? ২৩/২৪ বছরের মেয়ের বয়স হলে ফারাকটা কতো হয়?

হোক ফারাক, বেলাল মাস্টার কথার নড়চড় করেন না। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেনমোহরের পঁচিশ হাজার টাকা উসুল দেখিয়ে কাবিননামায় সই হয় শাহিনা আখতার বেগমের। বাপের বাড়ি থেকে বিদায় দেওয়া হয় না তাকে। বাপের বাড়িরই একখানা ঘরে সে একজন পুরুষ মানুষকে নিজের বিছানায় পেয়ে যায়। তারপর আটটা বছর পার হয়ে গেল। এখন কি তার অন্য কিছু ভাব্বার উপায় আছে? বাপের বাড়িতেই বা সে কয়দিন থাকতে পারবে? এখন স্বামীর ইচ্ছাতেই তার ইচ্ছা, স্বামীর খুশিতেই তার খুশি, স্বামীর পছন্দেই তার পছন্দ। এখন স্বামীর যদি সন্দেহ হয় তার ওপর, তাহলে যাতে সন্দেহ না হয়, তাকে সেইভাবে চলতে হবে। সে আর বই হাতে। তোলে না। পরীক্ষা দিয়ে বি.এ. পাস করার চিন্তাটাকে সে মন থেকে হটিয়ে দেয়। দুপুরবেলা স্বামী বাসায় ফিরলে তার সামনে দাঁড়ায়, স্নানের আগে লুঙ্গি গেঞ্জি গামছা তেল সাবান এগিয়ে দেয়, স্বামী তার দিকে তাকিয়ে হাসলে সেও পাল্টা হাসে। ঘাড়ে হাত চাপলে সে আরও গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। কোনো কোনোদিন আতিকুল ইসলাম আট বছরের পুরনো বউয়ের বুকে হাত দেয়। গাল টিপে ধরে। চুমু খাবার সময় ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিন্তু শাহিনা আখতার উঃ আঃ কিছুই করে না—শুধুই হাসে। কখনো দুষ্টু হাসি হাসে। কখনো ধন্য হওয়ার হাসি হাসে। কখনো কৌতুকের হাসি হাসে। একইভাবে খুশি হওয়ার, কী কৃতজ্ঞ হওয়ার, কিংবা চমক লাগার হাসিও সে হাসতে পারে।

এরই মধ্যে একদিন সাবিদ আলী খবর নিয়ে আসে যে, প্রাইভেট পরীক্ষার্থীদের জন্য টেস্ট পরীক্ষার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এখন ভাবীর দরখাস্ত করা দরকার।

শাহিনা শোনে, কিন্তু দরখাস্ত দেওয়া কিংবা না-দেওয়া সম্পর্কে কিছুই বলে না। শুধু জানায় সামিনার আব্বা আসুক। উনিই যা করার করবেন।

সেদিন দুপুরে ফের আসে সাবিদ আলী। আতিককে খবরটা জানানো হলে সে একটু যেন থমকায়। তারপর গলা খুলে হাসে একদফা। হাসতে হাসতেই শাহিনাকে ডেকে বলে, দেখো কী খবর এনেছে সাবিদ আলী। তুমি কি পরীক্ষা দেবে? প্রিপারেশন হয়েছে তোমার?

শাহিনা সামনে আসে কিন্তু মুখ তোলে না। মুখ নিচু করেই জানায়না, আমি পরীক্ষা দেবো না।

সে কী! সাবিদ আলীর বিশ্বাস হতে চায় না। বলে, এ আপনি কী বলছেন? আপনি যা জানেন, রেগুলার স্টুডেন্টদের অনেকেই তা জানে না। ভাবী, প্লিজ দিন পরীক্ষাটা, দেখবেন, আপনি ভালোভাবে পাস করে যাবেন।

সাবিদ এমনভাবে বলে, যেন শাহিনার পরীক্ষা দেওয়াটা তারই কোনোরকম দায়ের ব্যাপার। সে রীতিমত অনুরোধ করে। কিন্তু শাহিনা মুখ তোলে না, তার নিচু মুখ নিচুই থেকে যায়। ওদিকে আতিকও কিছু বলে না। ব্যাপারটা তার কাছে নাটকের মতো লাগে। সে একবার বউয়ের দিকে তাকায়। একবার বাড়িওয়ালার শালার দিকে। দু’জনের ভাবসাব দেখে সাবিদ আলীর ও সম্ভবত ভাল লাগে না। সে দরজার দিকে পা বাড়িয়ে বলে, আমি এবার যাই।

আর তখনই শাহিনা মুখ তুলে পেছনে থেকে ডাকে। বলে, তোমার বইগুলো নিয়ে যাও। ওগুলো এখানে থাকলে খামোকা নষ্ট হবে। অন্য কাউকে দিলে তার কাজে লাগবে।

সাবিদের যে কী হয় বোঝা যায় না। সে এমন ভাব দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় যে মনে হয়, শাহিনার কথা শুনতেই পায়নি।

ওদিকে আতিকুল ইসলাম কী বোঝে সেই জানে। সে বলে ওঠে, আহা ছোঁড়া বোধ হয় দিলে বড় দাগা পেয়েছে গো! তুমি ওভাবে কথাটা বললে কেন?

শাহিনা জবাবে কিছু বলে না, চুপচাপ স্বামীর সামনে থেকে সরে যায়।

আর পরের দিনই আতিকুল ইসলাম বাড়িওয়ালা সোহারাব মিয়াকে জানিয়ে দেয় যে মাসের শেষে সে বাসা ছেড়ে দিচ্ছে।

খবরটা শুনে শাহিনা থ হয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, এসময় বাসা বদলালে সামিনার লেখাপড়ার ক্ষতি হবে না! বছরের আর তিনটে তো মাস। ওর স্কুলের কাছে কি বাসা পাওয়া যাবে?

ধরে নাও, পাওয়া যাবে না। আতিক শান্ত গলায় বলে।

তাহলে?

তাহলে কী?

একটা বছর নষ্ট হবে না ওর?

হ্যাঁ, হবে। আতিক হাসতে হাসতে বলে, মেয়েদের দু-একটা বছজ্ঞ নষ্ট হলে খুব কি যায়-আসে?

অমন কথার পর শাহিনা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পায় না।

দিন দুই পরে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাবার তাড়া দেখে আতিক বউকে ডেকে বলে, স্কুলে যাওয়ার জন্যে অতো তাড়া কীসের? ঐ স্কুলে তো মেয়ে আর পড়বে না। ওকে বরং তুমি বাড়িতেই পড়াও। ওতে মেয়ের ভাল হবে। একটু হেসে ফের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকায় আতিক। তারপর চোরা হাসি হাসতে হাসতে বলে, আমার কিন্তু তোমার জন্যই বেশি চিন্তা হচ্ছে। আসলেই তোমার খুব কষ্ট হবে এই বাসাটা ছাড়লে, মেয়ের স্কুলে তোমরা বান্ধবী জুটেছিল অনেক তার ওপর সাবিদ আলীর মতো অমন একজন হ্যান্ডসাম ইয়ংম্যান নির্জন দুপুরের সঙ্গী, এমন তো সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।

শাহিনা শোনে আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে আল্লাহকে বলে, খোদা, সহ্য করার শক্তি দাও, আর যে সহ্য হয় না।

বলা হয়েছিল মাসের শেষে যাবে। কিন্তু কেমন করে যেন দু’পক্ষের কী যোগাযোগ হয়ে গেল। আর তাতেই দিন দশেক পরেই একদিন সকালে আতিক এসে বলল, এবার গাঁটরি-বোচকা বাঁধো; আমরা অন্য বাসায় যাবো।

দেখতে দেখতে সব কিছু বাঁধাছাদা হয়ে গেল। কিন্তু সাবিদ আলীর বইগুলো নিয়ে সমস্যা দাঁড়াল। শাহিনা বুঝতে পারে না কী করবে। বইগুলো ঐ বাসাতেই রেখে যাবে, না বাড়িওয়ালার বাসায় দিয়ে আসবে। সাবিদ আলী ওদিকে পরীক্ষার পর দেশের বাড়ি বেড়াতে গেছে। সে বউগুলো নিয়ে ওর বড়বোনকে দিতে গেল, মহিলা বলে ওঠেন, ওর বইয়ের ঝামেলা আমার ওপর কেন চাপাচ্ছেন? ওগুলো আপনিই নিয়ে যান। একটু থেমে ফের বলেন, যদি না নেন, তাহলে ঐ বাসাতেই কোথাও রেখে যান।

শাহিনা শেষে কী করে, বইগুলো বসার ঘরে তাকে সাজিয়ে রেখে বাসা ছেড়ে চলে যায়।

যাত্রাবাড়ির নতুন বাসায় কয়েদিন খুব মনমরা ভাব থাকে শাহিনার। কিন্তু সেও অল্প দু-চার দিন। তারপর সেটা আর থাকে নি। কারণ হতে পারে এই যে, নতুন বাসায় আতিক বেশিক্ষণ বাসায় থাকছে। তাছাড়া সাজানো-গোছানো এসব কাজ তো ছিলোই।

নতুন বাসাও দোতলাতেই। কিন্তু ঘরগুলো ছোট। একেবারেই খুপড়ি খুপড়ি। ডাইনিং স্পেস এমন একটুখানি যে তাতে খাবার টেবিলের পর মাত্র দু’খানা চেয়ার বসানো যায়। শোয়ার ঘরে একখানা খাট পাতলে আর দ্বিতীয় খানার জায়গা হয় না। সুরাং দুই ঘরে দুই খাট পাততে হয়। বারান্দা এমনই চিকন যে ওখানে শুধু দাঁড়ানো যায়। চেয়ার পেতে বসা যায় না। আতিক হাসে খাট পাবার সময়। বলে, মেয়েকে নিয়ে এ ঘরে শোবে তুমি। আমি ও ঘরে। অসুবিধাটা অবশ্যি তোমাকেই পোহাতে হবে, এক রাতে দুই ঘরে শোয়া সোজা কথা নয়। বলতে বলতে মানুষটা এমন অশ্লীল হাসে যে শাহিনার কানে আঙুল দিতে ইচ্ছে করে।

যত অসুবিধার কথা ওঠে সব আতিক একের পর এক হেসে উড়িয়ে দেয়। রান্নাঘর এতো ছোট যে নড়াচড়া করা যায় না–আতিকের সে ব্যাপারে জবাব, তুমিতো রান্নাঘরে লাফঝাপ করতে যাচ্ছে না। বসে বসে শুধু রান্না করবে। তাতে আর অসুবিধা কী?

শাহিনীর গোছগাছে ঝামেলা পোহা