এই প্রথম অরিন্দমের মুখটা সুজয়ার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। সুজয়া বোঝে, নতুন মা ছাড়া তাকে আর কেউ ঠিক বোঝে না। লু অরিন্দমের কথা মনে হতেই কেমন করুণা হয়। ওর জন্যই অরিন্দমের এত কষ্ট। তাছাড়া অরিন্দমের প্রতি আর একটা কারণে সুজয়ার শ্রদ্ধা জাগে। তা হল, সেদিন রাতটা ছাড়া এই তিন মাসে অরিন্দম তাকে একটু ডিসটার্ব করে নি। জোর খাটায়নিও। ও ইচ্ছা করলেই পারতো। জোর করে ওর পাওনা সুদে আসলে মিটিয়ে নিতে। তা কিন্তু অরিন্দম করে নি। সিঁড়ির নিচ থেকেই কৃষ্ণা ডাকতে থাকে—ও বৌদিদি মা ডাকচে। নিচে এসো। একা একা যে তুমি কি কর? নিচের ঘরে কত লোক এসেছে, তোমাকে মা তাই ডাকছে। সুজয়া তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে। হাতের বইটা রেখে দিয়ে কৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বলে আমি এখুনি আসছি মাকে বলগে। কৃষ্ণা চলে যায়। সুজয়া হাত মুখ ধুয়ে নেয়। কাপড়টাও বদলে নেয়। নীল রঙের একটা হালকা তাঁতের শাড়ি পরে। সাদা রঙের ব্লাউজ। হাল্কা নীল টিপ। আজ তার অনেক কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ব্লাউজের হুকটা লাগাতে গিয়ে মনে পড়ে গেল, ঠিক এরকমই একদিন শাড়ি পরার সময় অভি ঘরে ঢুকে পড়েছিল। সুজয়া বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় নি। অভি প্রতিবর্ত ক্রিয়ায়, চোখে হাত দিয়ে বলে ‘সরি’—তাড়াতাড়ি সেরে নাও। আমি কিন্তু এখন। কানামাছি। সুজয়ার হাসি পায় অভিকে বিব্রত হতে দেখে। অভি শান্ত ভদ্র অথচ দুষ্টু। একটু যা মিচকে মিচকে হাসে। অভিকে আরো লজ্জায় ফেলেছিল সুজয়া একইভাবে। রয়ে গিয়ে বলেছিল : হয়ে গেছে। চোখ খোলো। সেদিন অবশ্য অভি এ জন্য সুজয়াকে শাস্তি দিয়েছিল, একটু অন্যভাবে।
অরিন্দম কিন্তু তেমন নয়। ঘরে ঢোকার আগে জানায়। যেন অফিসারের খাস কামরায় ঢুকছে। সুজয়া বোঝে অরিন্দমের ঠিক দোষ নেই। ও যথেষ্ট সহ্য করেছে, করছেও। ও সুজয়া মন দিতে পারেনি। অরিন্দমও দূরে সরে থেকেছে। ওর পড়া আছে। বাইরে যাওয়া আছে। নিজের লাইব্রেরিতেই বেশিক্ষণ থাকে অরিন্দম। কিংবা পড়ায়। অরিন্দম এ সব নিয়ে থাকতে পারে। সুজয়া পারে না। তার সময় অনেক বড়। কাজ সে তুলনায় অনেক কম। এ ভাবে একা থাকতে সুজয়ার কষ্ট হয়। বাড়ে বুকের ব্যথা। মনে হয়, কে যেন তার হৃদপিণ্ডের ওপর একটা পাথর বসিয়ে দিয়েছে।
নিচে যেতেই সুজয়া দেখতে পায় জন কয়েক ভদ্রমহিলাকে, সম্ভবত আশেপাশেই থাকেন। কাকিমা পরিচয় করালেন।
কৃষ্ণা বৌদির পাশে তখন আটকে গেছে। সে সময়ে পাশের বাড়ির মহিলারা অরিন্দমের ছোটবেলায় টুকরো স্মৃতি নিয়ে আলোচনা করছে। সুজয়ার কাছে এ সব কথা কোনো গুরুত্ব পাচ্ছিল না। ও শুধু নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকে। একজন সুজয়াকে প্রশ্ন করেন অরি এলো না কেন। কাকিমা বললেন : অরির কলেজে এখন পরীক্ষা চলছে তাই বৌদি ওকে এখানে দিয়ে গিয়েছে। অরি এসে নিয়ে যাবে। পাশের বাড়ির রুমকির মা বললেন সুজয়াকে উদ্দেশ্য করে—দেখো বৌমা আমাদের অরিকে নিয়ে তুমি সুখে থাকবে। ওর মত ছেলে হয় না। সুখি হবার কথায় সুজয়ার চমক
ভাঙে কে সুখি হবে?—অরিন্দম? সুজয়া? বুকের ভেতরটা আবার কেমন ভারি হয়ে যায়। মাথাটা ঘুরতে থাকে। কেমন অসুস্থ লাগে। দিন কতক রাতে ঘুম হয় নি। সুজয়া কোনো রকমে সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে ওপরে চলে যায়। ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে, দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পড়ে।
নিচে অনেকক্ষণ থেকে কৃষ্ণা চেঁচামেচি করছে। সুজয়া আধোঘুমের ভেত্র দু একটা কথা শুনতে পাচ্ছিল। খুব সম্ভবত কেউ এসেছে। একটু পরেই অরিন্দমের গলা পায়। এত রাতে?—সুজয়া ভাবে।
কেমন জানি সুজয়ার লজ্জা। এ ধরনের অনুভূতি এই প্রথম। বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে।
নিচে ছোট কাকিমা অরিন্দমকে বলছিলেন বাবা দু দিন বউ ছেড়ে থাকতে পারলি না। যাক্ সুজয়া এসেছে তাই এলি। নয়তো তোর টিকিও দেখা যেত না। সাত বছর ত বাবু এমুখো হয় নি। সেই কৃষ্ণার মুখেভাতে এসেছিলি। অরিন্দম হাত পা ধুয়ে দাওয়ার ওপর বসেছিল। কাকিমা চা দিয়ে যাবার সময় কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে—যা ওপরে আছে। বোধহয় শরীরটা খারাপ। মনখারাপও হতে পারে। বেশি দেরি করিস না। খাবার সময় এসে পড়বি তাড়াতাড়ি।
অরিন্দম একটু মুচকে হাসে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। আজ অরিন্দম প্রস্তুত হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে ওপরে ওঠে। দরজার গোড়ায় গিয়ে দ্যাখে সুজয়া শুয়ে আছে। জানলার দিকে মুখ। অরিন্দম ওর পাশে গিয়ে বসে। একটু ভেবে নিল কি একটা তারপর হাতটা আস্তে আস্তে সুজয়ার মাথার ওপর রাখে, তারপর সঞ্চালন করে। এবারে সুজয়া তাকাল অরিন্দমের দিকে।
–কখন এলে?
–একটু আগে।
–নতুন মা কেমন আছে, ভাল?
–হ্যাঁ, ভালোই।
—তুমি?
—ভালো না।
–কেন?
–মনখারাপ।
—কেন?
–তোমার জন্য। তাই চলে এলাম।
—তুমি আমায় ভালবাস তাই না? আমি তোমায় কষ্ট দি।
—ও কিছু নয়। এখানে কেমন ছিলে?
—ভালোই। তবে….
—তবে কি?
—তোমার কথা মনে হচ্ছিল।
—অরিন্দম মৃদু হাসে। সুজয়া বুঝতে পারে অরিন্দম এই ক’দিনে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। বাইরে বাতাস একটু জোরে বইছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মাঝে মাঝে। বোধহয় বৃষ্টি হবে।
সুজয়া আবার বলে–কাল বাড়ি যাবো?
—কোথায়, পাণ্ডুয়া?
–না নতুন মার কাছে, তোমার বাড়িতে। আমার কেমন ভয় করছে। খালি মনে। হচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছি।