সুজয়া তখন আলমারির সব কিছুই স্পর্শ করতে শুরু করেছে। এ যেন সেই ছোট বেলার দিদিমার সিন্দুক হাতড়ানো।
অভি হারটা পরিয়ে দিয়েছিল খানিক পরেই। পিছন ফিরে অভির দিকে তাকিয়ে সুজয়া দেখতে পায় অভির দুটো চোখ ঘুমে ভেসে যাচ্ছে। সুজয়ার তখন ওই ঘরেই থাকতে বেশি ইচ্ছে করছিল। আলমারিটা বন্ধ করে দিয়ে অভিকে উদ্দেশ্য করে। বলে—আজ যদি এ ঘর থেকে না যাই তাহলে কিছু হবে? সুজয়ার কথা শেষ হয় না। অভি দু হাত দিয়ে ওকে ততক্ষণে বেঁধে ফেলেছে। সে রাতটা ওঘরেই দু জনে অনেকক্ষণ কাটিয়েছিল।
অভিদের বনেদি বংশ। চৌধুরি পরিবার। এককালে এই বংশের নামডাক ছিল। অভির দাদামশায়ও বড় মানুষ ছিলেন। চৌধুরিদের যেমন বিত্ত ছিল তেমনই ছিল বংশ মর্যাদাবোধ। অভির ঠাকুরদাদা কলকাতা হাইকোর্টের জজ হয়েছিলেন। কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে চৌধুরিদের সেই সময় অগ্রণী ভূমিকা ছিল। অভির বাবা বড় ডাক্তার হলেও কি কালীদাস পাঠকের কাছে বৈঠকি বাংলা গান শিখতেন, ঠুমরি চর্চা করনে। সুজয়া এই ঘরের মধ্যে পুরোনো আমলের বাদ্যযন্ত্র—এসরাজ, বীণা, ছবি ইত্যাদির ওপর চোখ রাখলেই এসব কথা ভাবে। ঘরের এক কোণে একটা পিয়ানোজার্মান রিডের। সম্ভবত অভিজ্ঞ মার ছিল সেটা।
আজ সে সবই সুজয়ার মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়। নতুন মা কিছু বুঝতে না পেরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর আলতো করে সুজয়ার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিলেন—এত কষ্ট তোর কোথায় রাখিস মা? আমায় বল্ মা। দেখ আমি ত’ আছি। সুজয়া তখন মুখে কিছুই বলতে পারে নি কেবল নতুন মার বুকে মাথা রেখে খানিকটা কেঁদে নেয়।
অরিন্দমও বুঝতে পারে এ ভাবে ঝোকের মাথায় তার বিয়ে করা ঠিক হয় নি। নিজের তরফে কোনো অসুবিধা ছিল না। তার মা অনেক বেশি উদার।
ঘটনাচক্রে সুজয়াদের বাড়িতে অরিন্দমের মা গিয়ে পড়েছিলেন। সেখানে সুজয়ার সাথে আলাপ। নতুন মা প্রস্তাবটা সৃজয়াদের বাবা মাকে দিয়েছিলেন। সুজয়ার বাবা মারও বিশেষ আপত্তি ছিল না। তারাও চাইছিলেন যাতে সুজয়ার একটা গতি হয়। কিন্তু ছ মাসের বিধ্বা মেয়ের বিয়ে সহজ কথা নয়। এখন এইকালেও। কার বুকের পাটা এত বড়? তাই তারা নতুন করে কিছু ভাবেন নি।
অরিন্দমের মা প্রভাব দেওয়াতে সুজয়ার বাবার বিশ্বাসে জোর আসে। সুজয়ার আত্মীয়স্বজন সবাই একপ্রকার মত দিয়েছিলেন। নম্র, ভদ্র, সুন্দরী সুজয়ার প্রতি সবাই এক প্রকার গুণমুগ্ধ ছিলেন। সুজয়ার ছোট কাকিমা ত’ বলেই ফেললেন কাঁচা বয়স, বিয়ে দিয়ে দাও বড়দি। এ কথায় কি ছিল সুজয়ার জানা নেই। সুজয়ার ইচ্ছা ছিল চাকরি করার। লেখাপড়া তবে কিসের জন্য?
বাবা-মার মুখের দিকে তাকিয়ে সুজয়ার কষ্ট হত। সবার অনুকম্পা, প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে সুজয়ার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।
তাছাড়া নতুন মাকে সুজয়ার কত ভীষণ ভালো লাগতো। স্বার থেকে নতুন মা একটু আলাদা। অনুকম্পা ও দরদ দেখাতেন না। তবে হৃদয় নির্মল। স্নেহ ভরপুর। এজন্যও অনেকটা সুজয়া রাজি হয়।
অভি চলে গেলে কিছুটা সামলে ছিল সুজয়া কেবল পরিবেশকে মনে রেখে। অরিন্দমের সাথে বিয়ের পর তার কাটা ঘায়ে যে নুনের ছিটে লাগতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি। এ এক নতুন যন্ত্রণা সুজয়ার।
সুজয়ার কাছে অরিন্দমের নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আর সুজয়ার মনে হয়। অভির কাছে। বুক ফেটে যায় সুজয়ার। অভির দেওয়া শেষ টাইটেলটাও নেই। কেবল সেই হারটা আছে। তাকে সুজয়াকাছ ছাড়া করে না। কিন্তু এখন মাঝে মাঝে। হারটাকে ফাঁসি বলে মনে হয়। হারটাই অভির কথা মনে করিয়ে দেয়। সুজয়ার পুরোনো যন্ত্রণাটা আবার বাড়ে।
একদিন রাতে অরিন্দম দেরি করে ফিরেছিল। সেদিন সারাক্ষণ সুজয়া অভির জন্য কেঁদেছিল। রাতে কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎই ঘুম ভাঙতে দেখতে পায় অরিন্দম তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখছে। আর বাঁ হাতটা দিয়ে তার সারা মুখে স্পর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। রাগে দুঃখে ফেটে পড়েছিল সুজয়া। ঝট করে উঠেই অরিন্দমের পাঞ্জাবির ধারটা ধরে চিৎকার করে বলেছিল—তুমি? আমায় ধরেছো কেন? কেন? তোমায় কে এই অধিকার দিল? তারপর কিল ঘুসি মেরে পাঞ্জাবীটা ছিঁড়ে দিয়ে হঠাৎই বোবা হয়ে যায়। অরিন্দম সুজয়াকে ধরে শুইয়ে দেয়। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সুজয়ার প্রতি গভীর স্নেহে অরিন্দম সব ব্যাপারেই চুপ থাকতো। ডাক্তার বন্ধু, সমীর তাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, এই সময়টা একটু ধৈর্য ধরতে হবে। ও মেন্টালি ডিপ্রেসানে ভুগছে। ওকে বুঝতে হবে নইলে বিপদ। ইনস্যানিটি দেখা দিতে পারে। অরিন্দম আরও দু’একবার চেষ্টা যে করেনি তা নয়। সবারই সে ব্যর্থ হয়েছে। সুজয়া তাকে বোঝেনি। অভির স্মৃতি তাকে এখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
এ ঘটনার পর দিনই জানলায় দাঁড়িয়ে সুজয়া নতুন মা আর অরিন্দমের কথাবার্তা শুনতে পায়। সে সময় নতুন মার কথাগুলোই ঠিক মনে হয়েছিল। এ সময় তার একটু একা থাকা উচিত। তাই সহজেই রামমাটি যাবার কথায় সায় দিয়েছিল সুজয়া।
কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। খেয়াল ছিল না। কৃষ্ণা চা দিতে এলে বুঝতে পারে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আবার হারিয়ে যায় সুজয়া। কেন জানে না এই মুহূর্তে নতুন মা অরিন্দম—ওদের কথা মনে পড়ছে।