- বইয়ের নামঃ কল্যাণ মৈত্রর গল্প
- লেখকের নামঃ কল্যাণ মৈত্র
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
বাতাসের রং নেই – কল্যাণ মৈত্র
সুজয়া বাথরুম থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় শোবার ঘরে। উত্তর-দক্ষিণ দু দিকেই বড় বড় জানলা এই ঘরটাতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেই ডাইনে বাঁয়ে দুটি ঘর, মাঝে ছোট এক ফালি বারান্দা। সুজয়া এ ঘরটাকেই বেছে নিয়েছে। দক্ষিণের জানলা দিয়ে চোখে আসে পুজ মাঠ, ঝাউ অশ্বথের সারি দিয়ে ঘেরা। উত্তরের জানলা দিয়ে চোখ মেললে ভেসে আসবে কর্মচঞ্চল কিছু মানুষের মুখ। ধানের গোলা, দু পাশে বোঝাই করা সরষের ডাল। আদুল গায় দুটো মেয়ে ধান সেদ্ধ করছে। শরীর নিয়ে ওদের বিশেষ চিন্তা নেই। খোলা পিঠে রোদ বড়ই বেয়াদপ। মাঝে মাঝে ওরা নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা তামাশা করছে।
অলস দুপুরের এ চিত্র কদিন ধরেই সুজয়া এক মনে দেখে আসছে। জানলার ধারেই খাটটা। তাই সুবিধা, পিঠে বালিশ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে থাকলেই হল—মন ভরে যাবে। আসলে সুজয়া এ সবের মধ্যে হারিয়ে যায়। তাই এত ভালোবাসে এ সব দেখতে। নিচ থেকে ওপরে খাবার দিয়ে যায়। কোনো কোনো সময়ে ছোট কাকিমার মেয়েও আসে খাবার দিতে। অবশ্য যে দিন স্কুলে যেতে বাধ্য হয় সেদিন ও আসে না। কোনো অসুবিধেই নেই এখানে। এ বাড়িতে লোকজনও কম। যারা আছে তারাও চাষবাসের কাজে ব্যস্ত থাকে।
সুজয়ার এখানে ভালো লাগছে। অন্তত কেউ ডিসটার্ব করে না বা পার্সোন্যাল কথাবার্তা জানতে চায় না। নিজের মত থাকা যায়। এ বাড়ির লোকজন সবাই একটু চুপচাপ। কেউ কিছু জানতে চায় না। সুজয়ার কথাও হয়তো এরা জানে বা জানে না। কোনো কৌতূহল নেই।
নতুন মা-ই বলেছিলেন অরিন্দমকে : খোকা বৌমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত। সবাই বিয়ের পর বাইরে যায়। পরে ত সময় হবে না, ব্যস্ত হয়ে যাবি। তার চেয়ে বরং ঘুরে আয়। অরিন্দমের আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ছিল। তাই হবে খন, বলে এড়িয়ে গিয়েছিল সে তখন। নতুন মা কিন্তু কথায় ইতি টানেননি। ধমকের সুরে বলে উঠেছিলেন—তুমি মানুষের মন বোঝে না, বড়ই অবুঝ, দেখছ বলে উঠেছিলেন—তুমি মানুষের মন বোঝে না, বড়ই অবুঝ, দেখছ না সুজয়া কেমন মন মরা, এখনো ও এ বাড়ির সঙ্গে মানাতে পারেনি। তাকে আমাদের বোঝা উচিত। অরিন্দম তার মায়ের ইঙ্গিত বুঝেছিল। তাই মুখ নামিয়ে বইয়ের পাতা ওলটাতে ওলটাতে বলে : আমি ত’ বলেছিলাম যেতে। পুরীর টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছিল। সুজয়াই ত’ যেতে চায়নি। এখন আমার সময় নেই, কলেজে টেস্ট পরীক্ষা চলছে, খাতা দেখা, এ সময়ে কি করে যাই? নতুন মা ঈষৎ কর্কশ স্বরে বলে ওঠেন : মিথ্যা অপবাদ দিও না; তোমাদের বিয়ের পর ওর যাবার মত মনের অবস্থা ছিল না; তাই যায় নি।
তুমি গভীরে যাওনি, তাই বুঝতে পারনি। নতুন মা কিছুটা চিন্তা করে বলেন : তার চেয়ে তুমি এক কাজ কর, ওকে দেশের বাড়িতে ছোটকাকুর ওখানে দিয়ে এসো। তোমায় থাকতে হবে না, তুমি দিয়েই চলে এসো। ওখানে তোমার কাকিমা, কৃষ্ণা, সবাই আছে; ওর অসুবিধা হবে না। আমি সময় বুঝে নিয়ে আসবো। মাসখানেক থাকুক ওখানে।
অরিন্দম ফস্ করে বলে ফ্যালেও কি গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারবে? তাছাড়া ওখানে লাইট নেই, ডাক্তার নেই।
–কে বললো নেই, তুমি নিজের দেশের বাড়ির কোনো খবর রাখ? আমরা যদি পারি তবে ও তা পারবে না কেন? আমিও খোদ কলেজ স্ট্রিটের মেয়ে, আমি যাইনি? থাকিনি দিনের পর দিন। যা বলছি শোন, ওখানে এখন স্ব কিছুই আছে, তুমি দিয়ে এসো। অরিন্দম এই পর্যন্ত শুনে নিঃশব্দে চলে যায়। ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাবার সময় দেখতে পায় সুজয়া জানলার সামনে দাঁড়িয়ে ওপারের রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখছে—অরিন্দম বুঝতে পারে সুজয়া সব কিছুই শুনেছে। ধীরে ধীরে তার কাছে যায়, তারপর আলতো করে দুটো শব্দ ছুঁড়ে দেয়যাবে রামমাটি? সুজয়া ঘাড় নাড়ে কেবল। সুজয়া বই শুনেছিল। নতুন মা খুবই ভালো। আজকালকার দিনে এমন মানুষ আর দেখা যায় না। এই দুমাস নতুন মাকে দেখেছে সুজয়া। কতো খবর রাখেন নতুন মা। কতো বোঝেন। শ্রদ্ধায় হৃদয় ভরে যায়।
বৌভাতের পর দিন নতুন মা তাকে তার ঘরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আলমারি খুলে বলেছিলেন-দেখ মা এ ধ্ব তোর। থোকা আমার খুব খামখেয়ালি। সব কিছু তোকেই দেখতে হবে। তোর হাতে দিয়ে তবে আমি শান্তি পাব। এইটুকু বলে চাবিগোছা তার হাতে দিয়েছিলেন। সুজয়া কেঁদে ফেলেছিল হাউমাউ করে। চোখের জলে দুটো গাল ভাসছিল। ওর মনে পড়ে যায় ঠিক ঠিক এমন ভাবে বৌভাতের দিন রাতদুপুরে অভিও টানতে টানতে সুজয়াকে নিয়ে গিয়েছিল বড় ঘরটাতে। সেখানে কেউ, কেউ ছিলনা, কেবল দুটো ফটো ছাড়া। একটা অভির মায়ের আর একটা অভির বাবার। দুজনেই নেই। তবু সুজয়ার মনে হয়েছিল ওরা দেখছে। আনন্দে অধীর হয়ে সুজয়াকে কোলে তুলে সারা ঘর দাপাদাপি করেছিল অভি। তারপর আলমারির চাবিটা দিয়ে অভি সামনের চেয়ারে বসে বলেছিল—আলমারিটা খোলো।
সুজয়া খুলেছিল। এবারে লকারটা খোলো-সুজয়া খুলেছিল। একটা বাক্স আছে বার করো। সুজয়া তাও করেছিল। তারপর বাক্সটা খুলে সুজয়া অবাক হয়ে গিয়েছিল। একটা সীতা হার রয়েছে কেবল—মায়ের; তাই রেখে দিয়েছি তোমায় দেব বলে। বাকি সব ব্যাংকে।